বিজ্ঞান পত্রিকা

আমরা কি মহাবিশ্বে একা?

আমাদের এই মহাবিশ্বের বয়স ১৩৮০ কোটি বছর [১]। এই মহাবিশ্বের পর্যবেক্ষণযোগ্য অংশে মোট গ্যালাক্সি রয়েছে ২ ট্রিলিয়ন (২ লাখ কোটি) বা তার চেয়ে বেশী [২]। গড়ে প্রতিটি গ্যালাক্সিতে নক্ষত্র বা তারা রয়েছে ১০ কোটি [৩]। অধিকাংশ তারাকে কেন্দ্র করে রয়েছে গ্রহ এবং সেই গ্রহগুলোকে কেন্দ্র করে রয়েছে উপগ্রহ। সৌরজগতের বাইরে, আমাদের মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সির গ্রহগুলোকেও আমরা সনাক্ত করতে শুরু করেছি। সব মিলিয়ে হিসেব করলে দেখা যাবে এই মহাবিশ্বের দৃশ্যমান অংশে মোট বাসযোগ্য গ্রহের সংখ্যা লক্ষ লক্ষ কোটি। তথাপি মহাবিশ্বের কেবলমাত্র একটি গ্রহে অদ্যাবধি প্রাণের অস্তিত্ব প্রমানীত হয়েছে। সেই গ্রহটি সূর্য নামের একটি তারাকে কেন্দ্র করে ঘুরছে এবং সূর্য নামক তারাটি মিল্কি ওয়ে নামের একটি গ্যালাক্সিকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। এই মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সির নিজেরই রয়েছে ১০ হাজার কোটি হতে ৪০ হাজার কোটি তারা [৪]। এর মধ্যে আমাদের সূর্যের মতো নক্ষত্র আছে অন্ততঃ দুই হাজার কোটি। এদের এক পঞ্চমাংসের রয়েছে পৃথিবীর আকারের বসবাসযোগ্য অঞ্চলে (পৃথিবীর মতোই খুব উষ্ণ বা শীতল নয় তাই প্রাণ ধারনের উপযোগী) পরিভ্রমণরত গ্রহ। এই গ্রহগুলোর মধ্যে যদি কেবল প্রতি হাজারে একটির মধ্যেও প্রাণ তৈরি হয়ে থাকে তাহলে শুধু মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সিতেই প্রাণধারী গ্রহের সংখ্যা দাঁড়ায় ১০ লক্ষ। কিন্তু অদ্যাবধি আমাদের গ্যালাক্সির কোথাও কোনো ধরনের প্রাণের আলামত দেখা যায়নি। আমরা কী তাহলে এই মহাবিশ্বে, বা অন্তত আমাদের গ্যালাক্সিতেই একা?

এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া খুব সহজ নয় তবে নানা ভাবে এর উত্তর খোঁজার চেষ্টা চলছে। যদি পৃথিবীই এই মহাবিশ্বের একমাত্র প্রাণধারনকারী গ্রহ হয়ে থাকে তাহলে বলতে হয় মহাবিশ্বে প্রাণের উদ্ভব ও বিকাশের সুযোগ বা সম্ভাব্যতা অতি অতি অতি নগন্য এবং পৃথিবী ও সৌরজগতের এই অংশ অতি অতি অতি বিরল একটি অঞ্চল। আর যদি তা না হয় তাহলে সম্ভাবনা থাকবে এই মহাবিশ্বে আরো কোটি কোটি অঞ্চলে প্রাণের সৃষ্টি ও বিকাশ ঘটেছে এবং তার মধ্যে একটা উল্লেখযোগ্যসংখ্যক অঞ্চলে সভ্যতার সূচনা হয়েছে। এই যে এত বড় সম্ভাবনা এবং তথাপি কোথাও খুঁজে না পাওয়া এর একটি নাম রয়েছে। এর নাম ফার্মি প্যারাডক্স [৫]।

ফার্মি প্যারাডক্স

পদার্থবিদ এনরিকো ফার্মি সর্বপ্রথম এই সমস্যাটি আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরেন। তিনি উপলব্ধি করেন আমাদের সৌরজগৎ এই মহাবিশ্বের অন্যান্য স্থানের তুলনায় অপেক্ষাকৃত নবীন। মহাবিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে সভ্যতা গড়ে উঠলে এবং তারা রকেটের প্রযুক্তি আয়ত্ব করতে পারলে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই (এক কোটি বছরের মধ্যে) সমগ্র গ্যালাক্সিতে ছড়িয়ে পড়ার কথা। আমাদের পৃথিবীর সভ্যতার বিকাশের দিকেই দেখুন। পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভব হয়েছে ৩৫০ কোটি বছর আগে আর মানুষের উদ্ভব প্রায় দেড় লাখ বছর আগে। আমাদের প্রযুক্তির ইতিহাস বড়জোর দেড়শ’ বছরের মতো। এই দেড়শ’ বছরেই মানুষ কত কিছু অর্জন করে ফেলেছে প্রযুক্তির দিক দিয়ে যা আগের ৩৫০ কোটি বছরের তুলনায় রীতিমত অকল্পনীয় গতির। প্রযুক্তির অগ্রগতির দিক থেকে সভ্যতাগুলোকে তিন শ্রেনীতে ভাগ করা হয়, যথাক্রমে টাইপ-১, ২ ও ৩ [৬]। টাইপ-১ সভ্যতা তার সম্পূর্ণ গ্রহের শক্তির উৎসগুলোকে নিজের কাজে লাগাতে পারে। টাইপ-২ সভ্যতা তাদের নক্ষত্রটির সমগ্র শক্তিকে নিজেদের কাজে ব্যবহার করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, শক্তি সংগ্রহের একটি নমুনা হতে পারে, নক্ষত্রের চারদিকে ঘিরে সৌরপ্যানেল বসিয়ে দেওয়া এবং তার শক্তি সরাসরি নিজেদের গ্রহে স্থানান্তর করা (এ ধরনের একটি শক্তি সংগ্রহের গোলককে নাম দেওয়া হয় ডাইসন গোলক [৭])। আর টাইপ-৩ সভ্যতা হলো সেই সভ্যতা যারা সমগ্র গ্যালাক্সিটির শক্তিকে সংগ্রহ করে নিজেদের কাজে লাগাতে পারে, ফার্মি যেমন ধারনা করেছিলেন। কেমন করে একটি টাইপ-৩ সভ্যতা সমগ্র গ্যালাক্সিতে ছড়িয়ে পড়তে পারে? একটা উপায় হতে পারে প্রজন্মান্তর মহাকাশযান তৈরি করা। এই মহাকাশযানগুলোকে মূল গ্রহ হতে তৈরি করে চতুর্দিকে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। তারপর তারা নিজেরাই বিভিন্ন নক্ষত্র ব্যবস্থায় হাজির হবে এবং সেখানকার গ্রহগুলোকে নিষ্কাশন করে সম্পদ আহরণ করবে এবং নিজেদের মতো আরো অনেকগুলো মহাকাশ যান তৈরি করবে। এভাবে হাজার বছরের ব্যবধানে সমগ্র গ্যালাক্সিটি মহাকাশযানে সয়লাব হয়ে যাবে।

একটি কাল্পনিক ডাইসন স্ফিয়ার বা গোলক

পৃথিবীর সভ্যতার দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায় আমরা এখনো আমাদের গ্রহটির সমগ্র শক্তির উৎস কাজে লাগাতে পারিনি, তবে আগামী ২-৩ শ’ বছরের মধ্যে পারব এবং তাই হিসেব অনুযায়ী আমাদের সভ্যতা টাইপ-০.৭৩ এর কাছাকাছি। অর্থাৎ আমরা এখনো সভ্যতার সংজ্ঞার মধ্যে উপনীত হতে পারি নি।

জীবদ্দশায় ফার্মি এই প্যারাডক্স নিয়ে বেশীদূর এগোতে পারেন নি। তাঁর মৃত্যুর পর ১৯৭৫ সালে মাইকেল এইচ. হার্ট এই বিষয়ে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন [৮]। এই গবেষণাপত্রে তিনি বেশকিছু যুক্তি তুলে ধরেন। যেমন:

১. মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সিতে কয়েকশ’ কোটি সূর্যের মতো নক্ষত্র রয়েছে।
২. এই নক্ষত্রগুলোর অনেকগুলোকে কেন্দ্র করেই পৃথিবীর মতো গ্রহের উপস্থিতির বড় সম্ভাবনা আছে। এবং প্রাণের বিকাশ স্বাভাবিক হলে এদের অনেকগুলোতেই ইতিমধ্যে বুদ্ধিমান প্রাণের বিকাশ হয়েছে।
৩. বুদ্ধিমান প্রাণের এই সভ্যতাগুলোর মধ্যে কিছু কিছু আন্তঃনাক্ষত্রিক ভ্রমনের প্রযুক্তি অর্জন করেছে। পৃথিবী এখন এই প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করার পর্যায়ে আছে।
‘৪. খুব ধীর গতিতেও যদি আন্তঃনাক্ষত্রিক ভ্রমনের প্রযুক্তি এগোয় তবুও সমগ্র মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সি দখল করে নিতে কোটি বছরের মতো সময় লাগার কথা।
৫. সর্বোপরি, যেহেতু সূর্যের মতো নক্ষত্রগুলোর একটি বিরাট অংশ শতকোটি বছরের পুরোনো এর ফলে ইতিমধ্যেই গ্যালাক্সির সর্বত্র সভ্যতা ছড়িয়ে যেতে যথেষ্ট পরিমান সময় পেয়ে যাওয়ার কথা।

এই পর্যায়ক্রমিক যুক্তিগুলো অনুসারে মানুষের পৃথিবীতে ইতিমধ্যেই মহাজাগতিক বুদ্ধিমান প্রানীর হানা দেওয়ার কথা।  শুধু যুক্তিই নয়, মহবিশ্বে কতগুলো স্থানে সভ্যতা গড়ে ওঠার সম্ভাবনা আছে তা নিয়ে রয়েছে একটি সমীকরণ। এর নাম ড্রেক ইকুয়েশন [৯]। ১৯৬১ সালে ফ্রাংক ড্রেক এই সমীকরণটি তৈরি করেন। ড্রেক ইকুয়েশনটি হলো,

এখানে, N হলো আমাদের গ্যালাক্সিতে গড়ে ওঠা সভ্যতার সংখ্যা, R* = আমাদের গ্যালাক্সিতে নক্ষত্র তৈরির হার, fp = গ্রহ রয়েছে এমন নক্ষত্র ব্যবস্থাগুলোর ভগ্নাংশ, ne = প্রতিটি নক্ষত্রকে আবর্তনরত প্রাণ ধারনে সক্ষম গ্রহের গড় সংখ্যা, f1 = প্রাণ ধারনে সক্ষম গ্রহগুলোর মধ্যে যেগুলোতে প্রানের আবির্ভাব ঘটেছে তার ভগ্নাংশ, fi =প্রাণের আবির্ভাব ঘটা গ্রহগুলোর মধ্যে বুদ্ধিমান প্রাণ তথা সভ্যতা গড়ে ওঠা গ্রহের ভগ্নাংশ, fc =যেসব সভ্যতায় প্রযুক্তি মহাকাশে তাদের সনাক্তকরার উপযোগী সংকেত প্রেরণে সক্ষম তার ভগ্নাংশ আর সবশেষে, L হলো প্রতিটি সভ্যতার সংকেত প্রেরণের সময়ের দৈর্ঘ্য।

ড্রেক ইকুয়েশনের একটি সমস্যা হলো এই সমীকরণে যে রাশিগুলো আছে তার অনেকগুলোই যথাযথভাবে নির্ণয় করা দুঃসাধ্য এবং অনুমান নির্ভর। ড্রেক ইকুয়েশন ব্যবহার করে অনেকেই সম্ভাব্য সভতার সংখ্যা গণনা করতে চেষ্টা করেছেন এবং বলাই বাহুল্য একেকজনের গণনার মধ্যে রয়েছে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। আশাবাদীরা এই সমীকরণ ব্যবহার করে অনুমান করেছেন মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সিতে সভ্যতা থাকার সম্ভাবনা ১ হাজার হতে ১০ কোটি। আর এদের কয়েকটির মধ্যে যদি পৃথিবীর চেয়ে মাত্র কয়েক কোটি বছর আগেও সভ্যতার উদ্ভব ঘটে থাকে তাহলে এতদিনে তাদের পক্ষে গ্যালাক্সির সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ার কথা। তাহলে তারা কোথায়? এর একটি উত্তর হতে পারে ‘মহা ফিল্টার (The Great Filter)’ [১০]।

মহা ফিল্টার

ধারনা করা হয় একটি সভ্যতা বিকশিত হওয়ার পূর্বে বা পরে তা কোনো একটি ফিল্টারের মধ্য দিয়ে আটকে যায়। এবং এই ফিল্টারটি অতিক্রম করে যাওয়া খুবই দুঃসাধ্য। হতে পারে সভ্যতাগুলোর প্রকৃতি এমনই হতে বাধ্য যে প্রাযুক্তিক সক্ষমতা লাভের একটি পর্যায়ে পৌঁছে নিজেরাই নিজেদের ধ্বংস করে ফেলে। যেমন: হতে পারে, পরমানাবিক শক্তির প্রযুক্তি উদ্ভাবনের পরে তারা নিজেদের মধ্যে পারমাণবিক যুদ্ধে জড়িয়ে গিয়ে সমূলে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এই ধরনের ফিল্টার আবার হতে পারে দুই ধরনের।

প্রথমতঃ ফিল্টার হতে পারে একেবারে আদিম পর্যায়ে। হয়তো প্রাণের প্রাথমিক উদ্ভব খুবই দুঃসাধ্য এবং অতি বিরল। আমাদের পৃথিবীতে কেমন করে প্রাণের উদ্ভব হয়েছে তা এখনো পুরোপুরি উদ্ঘাটন করা যায়নি এবং হয়তো প্রাকৃতিকভাবে জটিল প্রাণের উদ্ভব আমরা যত সহজ মনে করি ততটা নয়। হয়তো প্রাণের উদ্ভবের জন্য যতগুলো ফ্যাক্টর জড়িত থাকা প্রয়োজন সেগুলো একত্রে উপযোগী হওয়া অসম্ভবের কাছাকাছি। যদি তেমনই হয় তাহলে মানব সভ্যতা ইতিমধ্যে এই ফিল্টার অতিক্রম করে ফেলেছে যা আমাদের গ্যালাক্সির আর কেউ পারেনি। হয়তো মহাবিশ্ব ইতিপূর্বে এমনই বিশৃঙ্খল ছিলো যে কোথাও প্রাণের উদ্ভব হতে পারে নি এবং কেবল সাম্প্রতিক সময়ে এসে প্রাণের উপযোগী পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে এবং আমাদের পৃথিবী এমন একেবার প্রথম না হলেও প্রথমদিকের একটি গ্রহ। হয়তো সময়ের সাথে গ্যালাক্সির বিভিন্ন অংশে প্রাণের সূচনা কেবল শুরু হয়েছে বা হচ্ছে। সেই ক্ষেত্রে হতে পারে সভ্যতার সূচনাতেও পৃথিবীবাসী এগিয়ে আছে এবং অন্যত্র এখনো সূচিত হয়নি তবে অদূর ভবিষ্যতে হতে পারে।

দ্বিতীয়ত: ফিল্টারটি বিদ্যমান থাকতে পারে আমাদের ভবিষ্যতে। যদি তেমনই হয় তাহলে তা আমাদের জন্য বিপদ সংকেত। এই ক্ষেত্রে বিষয়টি এমন হতে পারে যে মহাবিশ্বে প্রাণের উদ্ভব খুবই স্বতঃস্ফুর্ত ঘটনা এবং মহাবিশ্বের বিভিন্ন স্থানের প্রানের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে চলেছে। কিন্তু একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে গিয়ে এটি থমকে যায়। আগেই যেমন একটি উদাহরণ দেওয়া হয়েছে, প্রতি সভ্যতাতেই প্রযুক্তি বিকশিত হয়ে এমন একটি বিন্দুতে পৌঁছায় যেখানে তারা প্রযুক্তি প্রয়োগ করে নিজেরা নিজেদের ধ্বংস করে ফেলে। এটাই যদি নিয়তি হয় তাহলে আমরা পৃথিবীবাসী সেই নিয়তির কাছাকাছি চলে এসেছি। আমাদের কাছে এমন প্রযুক্তি চলে এসেছে যার মাধ্যমে আমরা নিজেরা নিজেদের ধ্বংস করে ফেলতে সক্ষম। হয়তো প্রতিনিয়তই মহাবিশ্বের বিভিন্ন স্থানে সভ্যতার সৃষ্টি হচ্ছে এবং পরস্পরের সাথে যোগাযোগ স্থাপনেরআগেই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে এবং এটা সভ্যতার ধর্ম যা উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। কিংবা এমনও হতে পারে অনেক প্রাচীন কোনো একটি সভ্যতা ইতিমধ্যে টাইপ-৩ পর্যায়ে পোঁছে গেছে এবং গ্যালাক্সির সর্বত্র নজর রাখছে। যখনই তারা কোথাও একটি সভ্যতাকে একটি নির্দিষ্ট বিন্দু পর্যন্ত বিকশিত হতে দেখে তখনই সেটিকে চোখের পলকে ধ্বংস করে দেয়। কিংবা বৈজ্ঞানিক সূত্রগুলো আবিষ্কার করতে করতে প্রতিটি সভ্যতাই এমন সুনির্দিষ্ট কিছু আবিষ্কার করে ফেলে যেটি আবিষ্কার না হলেই তাদের জন্য মঙ্গল হতো।

যোগাযোগের সমস্যা?

আরেকটি অতি সম্ভাবনাময় পরিস্থিতি রয়েছে। হয়তো আমাদের গ্যালাক্সিতেই নানা অঞ্চলে নানা সভ্যতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে শুধু আমরা তাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারছি না। হতে পারে আমাদের যোগাযোগ পদ্ধতি আর তাদের যোগাযোগ পদ্ধতি ভিন্ন। এই পৃথিবীতেই প্রজাতি হিসেবে মানুষ অন্য অধিকাংশ প্রজাতির সাথেই যোগাযোগ করতে পারে না। মানুষ একটি চড়ুইয়ের সাথে ভাব বিনিময়ের সক্ষমতা অর্জন করতে পারে নি। একটি চড়ুই এই মূহুর্তে কী ভাবছে বা তার মনের অভিসন্দি কী সেটি সে কিছুতেই বুঝতে পারে না। তাছাড়া মানুষ চেষ্টা করেও চড়ুইয়ের মাথায় তার সমাজ ব্যবস্থা ঢোকাতে পারবে না। মহাজাগতিক সভ্যতাগুলো আমাদের কল্পনাতীত কিছুও হতে পারে। হয়তো আমাদের যোগাযোগ মাধ্যম অত্যন্ত সীমিত ও সেকেলে এবং এই ধরনের সংকেতের প্রতি কেউ নজরও দেয় না। সেই ক্ষেত্রে আমাদের হয়তো দীর্ঘদিন একা থেকে যেতে হতে পারে যতদিন পর্যন্ত না আমরা যথাযথ পন্থায় যোগাযোগ করতে শিখছি। হয়তো অন্যান্য সভ্যতাগুলো এতোই উন্নত যে আমাদের মতো নগন্য গ্রহটিকে তারা স্রেফ উপেক্ষা করে যায়। আপনি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে যদি পিঁপড়ার সারি দেখেন তাহলে নিশ্চয়ই তাদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করবেন না, বরং উপেক্ষা করবেন? বিষয়টি হতে পারে তেমনই। আপনি যখন সম্পদ সংগ্রহের জন্য বনভুমি উজাড় করেন তখন সেই বনভুমির বাসিন্দা নানাবিধ বন্যপ্রানীর যে ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে তাতে আপনি নিশ্চয়ই দৃষ্টি দেন না। এমন নয় যে আপনি একটি কাঠবেড়ালিকে শত্রুতা বসত তার বাস্তু হতে উৎখাত করছেন, বরং আপনি শুধু নিজের প্রয়োজনে গাছ কাটছেন এবং কাঠবেড়ালীটিকে স্রেফ উপেক্ষা করে যাচ্ছেন। হতে পারে একটি টাইপ-৩ সভ্যতা প্রয়োজন হলে আমাদের পৃথিবীর সম্পদ আহরণ করে নিয়ে যাবে এবং আমাদের স্রেফ উপেক্ষা করে যাবে। কিংবা তারা নিজেরাও গ্যালাক্সির বিভিন্ন স্থানে হানা দেয় না বরং মেশিন পাঠিয়ে দেয়। মেশিনগুলো নিজেরাই নিজেদের মত কাজ করে সম্পদ সংগ্রহ করে নিয়ে যায় এবং কোনো যোগাযোগের চিন্তাভাবনাও নেই তাদের মধ্যে।

 উপরের যে ঘটনাটিই ঘটে থাকুক না কেন এই মূহুর্তে সত্য একটিই; পৃথিবীর বাইরে আর কোথাও প্রাণের কোনো আলামত নেই। কিন্তু কোথাও যদি প্রাণের আলামত পাওয়া যায় সেটি কী আমাদের জন্য খুব সুখবর বয়ে আনবে?

মহাজাগতিক প্রাণের অস্তিত্ব আমাদের জন্য দুঃসংবাদ

মহাকাশ সংস্থাগুলো সৌরজগতের বিভিন্ন স্থানে প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়ার জন্য তোড়জোড় শুরু করেছে। সংস্থাগুলো আশা করছে মঙ্গলের মাটিতে, কিংবা বৃহস্পতির উপগ্রহ ইউরোপায় বা শনির উপগ্রহ টাইটানের সমুদ্রে অত্যন্ত প্রাথমিক বা আদিম পর্যায়ের কোনো প্রাণের নিশানা পাওয়া যাবে। কিন্তু যদি সত্যিই মঙ্গলে বা অন্যত্র পৃথিবীর মতোই প্রাণের উপস্থিতি প্রমাণ হয় তাহলে তা আমাদের জন্য বড় ধরনের দুঃসংবাদ। এর অর্থ হলো প্রাণের উৎপত্তি সত্যিই খুবই স্বতঃস্ফুর্ত ব্যপার এবং আমাদের গ্যালাক্সির কোটি কোটি গ্রহে প্রাণের উৎপত্তি হয়েছে। কিন্তু কোথাও যেহেতু সভ্যতার কোনো আলামত নেই তারমানে প্রাণের উদ্ভব ঘটার পর সভ্যতা ভালোভাবে বিকাশিত হওয়ার আগে আবার তা ধ্বংসও হয়ে গেছে। সেই ক্ষেত্রে সুনিশ্চিতভাবেই আমাদের সামনে একটি ফিল্টার অপেক্ষা করছে।

-ইমতিয়াজ আহমেদ
সম্পাদক, বিজ্ঞান পত্রিকা
(লেখকের ফেসবুক প্রোফাইল)

বিজ্ঞান পত্রিকা প্রকাশিত ভিডিওগুলো দেখতে পাবেন ইউটিউবে। লিংক:
1. স্পেস এক্সের মঙ্গলে মানব বসতি স্থাপনের পরিকল্পনা
2. মাইক্রোস্কোপের নিচের দুনিয়া

তথ্যসূত্র:

১. “Cosmic Detectives”. European Space Agency. 2 April 2013. Retrieved 2013-04-15.

২. Christopher J. Conselice; et al. (2016). “The Evolution of Galaxy Number Density at z < 8 and its Implications”. The Astrophysical Journal. 830 (2): 83.

৩. https://www.livescience.com/56634-how-many-stars-are-in-the-universe.html.

৪. Odenwald, S. (March 17, 2014). “Counting the Stars in the Milky Way”. The Huffington Post. Archived from the original on August 1, 2014. Retrieved June 9, 2014.

৫. Woodward, Avlin (September 21, 2019). “The Fermi Paradox asks why we haven’t found any evidence of aliens. Here are 13 potential answers to that question”. Insider Inc. Retrieved September 21, 2019.

৬. Kardashev, Nikolai (1964). “Transmission of Information by Extraterrestrial Civilizations”. Soviet Astronomy. 8: 217–221,

৭. Tate, Karl. “Dyson Spheres: How Advanced Alien Civilizations Would Conquer the Galaxy”. space.com. Retrieved January 14, 2014.

৮. Hart, Michael H. (1975). “Explanation for the Absence of Extraterrestrials on Earth”. Quarterly Journal of the Royal Astronomical Society. 16: 128–135.

৯. Burchell, M.J. (2006). “W(h)ither the Drake equation?”. International Journal of Astrobiology. 5 (3): 243–250. Bibcode:2006IJAsB…5..243B.

১০. Hanson, Robin (1998). “The Great Filter — Are We Almost Past It?”. Archived from the original on 2010-05-07.


Exit mobile version