গত শতাব্দীর বাঙালির চিন্তা ভাবনা, ভ্রমণ অভিজ্ঞতা কিংবা দেশে বিদেশে উল্লেখযোগ্য অর্জনের মুখপত্র ছিল “প্রবাসী” পত্রিকা। এই প্রবাসী পত্রিকার ই এক শ্রাবণ(১৩৪৫ বঙ্গাব্দ) মাসের সংখ্যায় বিবিধ প্রসঙ্গ কলামে অন্যান্য খবরের পাশে “লণ্ডনের ডক্টর উপাধি” শিরোনামে ছোট্ট আর একটি খবর জায়গা করে নিল-
” …… বড়োদা ট্রেনিং কলেজের প্রিন্সিপ্যাল গঙ্গাচরণ দাশগুপ্তের পুত্র নীরজনাথ দাশগুপ্ত পদার্থ-বিজ্ঞানে লণ্ডনের পিএইচ-ডি উপাধি পাইয়াছেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম-এসসিতে প্রথম-স্থানীয় হইয়াছিলেন।”
এই নীরজনাথ দাশগুপ্ত ছিলেন বিজ্ঞানের ইতিহাসে অন্যতম উল্লেখযোগ্য বাঙালি বিজ্ঞানী যার হাত ধরে এই ভারতীয় উপমহাদেশে জীবপদার্থবিজ্ঞান শাখাটি বিকশিত হয়েছিল। যার একান্ত প্রচেষ্টাতেই তৈরি হয়েছিল সমগ্র এশিয়ার প্রথম ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ।
১৯০৯ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারি পিতা গঙ্গাচরণ দাশগুপ্তের ঘরে জন্ম নিয়েছিলেন নীরজনাথ। গঙ্গাচরণের বাড়ি ছিল চট্টগ্রামের পরইপাড়া গ্রামে। কিন্তু কাজের সুবাদে ডেভিড হেয়ার ট্রেনিং স্কুলের অধ্যক্ষ গঙ্গাচরণের কলকাতাতেই থাকতে হত। সেজন্যে নীরজনাথ ও শিশুকাল থেকেই বড় হয়েছেন কলকাতায়। নীরজনাথ পড়াশুনা করেছিলেন হিন্দুস্কুলে। ১৯২৫ সালে কৃতিত্বের সাথে ম্যাট্রিক পাশ করে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। ১৯২৯ ও ১৯৩১ সালে যথাক্রমে স্নাতক ও প্রথম স্থান অধিকার করে স্নাতকোত্তর পাশ করেন এবং যথারীতি গোল্ড মেডেল পেয়ে তিনি সম্মানিত হন।
স্নাতকোত্তর পড়াশুনার পর তিনি বিলেতে পাড়ি জমান। সেখানে বিখ্যাত বিজ্ঞানী স্যার এডওয়ার্ড ভিক্টর এপলটনের কাছে তিনি গবেষণার সুযোগ পান। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো যে এই স্যার এপলটন ই বায়ুমণ্ডলের আয়নস্তরে বেতার তরঙ্গের প্রভাব নিয়ে যুগান্তকারী গবেষণা করেন। তাঁর এই গবেষণা ১৯৪৭ সালে তাকে নোবেল পুরস্কার এনে দেয়। এপলটনের অধীনেই গবেষণা সম্পন্ন করে নীরজনাথ ১৯৩৮ সালে তাঁর ডক্টরেট সম্পন্ন করেন এবং ১৯৩৯ সালে দেশে ফিরে আসেন। পরবর্তীতে স্বল্প সময়ের জন্য নীরজনাথ কাজ করেছিলেন বোম্বাই টাটা মেমোরিয়াল ইন্সটিটিউটে। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি অধ্যাপক হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। এরপরে প্রায় পুরো সময়টাই নীরজনাথ গবেষণা আর অধ্যাপনাতেই ব্যয় করেছিলেন।
ছাত্রজীবন থেকেই নীরজনাথ ছিলেন পদার্থবিজ্ঞানের কৃতী ছাত্র। তাঁর গবেষণাজীবনের প্রথম দিকে তিনি মূলত আগ্রহী ছিলেন জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের উপর। মূলত সেই জায়গা থেকেই প্রফেসর এপলটনের অধীনে গবেষণা করতে তিনি লণ্ডনে গিয়েছিলেন যেখানে পিএইচডি তে তার মূল গবেষণা ছিল কসমিক রশ্মি নিয়ে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করবার পর তাঁরই শিক্ষক, সেই সময়ের আরেক বিখ্যাত বাঙালি পদার্থবিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা নীরজনাথকে পদার্থবিজ্ঞানে সেই সময়ের প্রচলিত কিছু ক্ষেত্র থেকে বেরিয়ে এসে নতুন কিছু বিষয়ে গবেষণা করবার পরামর্শ দেন। পিএইচডির পরে তাই তিনি কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিশেষত জীবচিকিৎসাবিদ্যা আর জীবপদার্থবিদ্যার উপর গবেষণার মাধ্যমে তাঁর ডিএসসি ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। কিন্তু জীবপদার্থবিদ্যা নিয়ে এর পরবর্তীতে বিশদ গবেষণা করবার উপায় সেই সময় ছিল না । যার একটি প্রধান কারণ তা ছিল প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা।
বিশ্বের প্রেক্ষাপটে সেই সময়টা ছিল আণবিক জীববিজ্ঞানের শৈশবকাল। বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন জৈব রাসায়নিক অণুর গঠন বোঝবার চেষ্টা চালাচ্ছেন। অনেকে চেষ্টা করছেন এমন কোন একটা উপায় বার করবার যার মাধ্যমে তারা সেইসব জৈব রাসায়নিক কণার রূপ উন্মোচন করতে পারবেন যা সাধারণ মাইক্রোস্কোপেরও সাধ্যের বাইরে। এই প্রচেষ্টাকে প্রথম বাস্তব রূপদান করেন আর্নস্ট রাস্কা। মূলত কোন বস্তুকণাকে দেখবার জন্য অতি সূক্ষ্ম তরঙ্গদৈর্ঘ্যের ইলেকট্রন রশ্মির শক্তি কাজে লাগিয়ে বস্তুকণাকে বহুগুণ বাড়িয়ে তাকে দেখবার নীতিকে কাজে লাগিয়ে ১৯৩১ সালে ম্যাক্স নল নামের এক ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারের সাথে মিলে প্রথম ইলেকট্রন মাইক্রস্কোপের একটি প্রোটোটাইপ তৈরি করেন তিনি। এর বছর দুয়েক পর, ১৯৩৩ সালে, রাস্কা তৈরি করেন প্রথম পূর্ণাঙ্গ ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ। বিজ্ঞান, বিশেষ করে আণবিক জীববিজ্ঞানের জগতে একটি বিপ্লব আনে রাস্কার এই আবিষ্কার যার জন্যে ১৯৮৬ সালে রাস্কা ভূষিত হন নোবেল পুরস্কারে। রাস্কার সমসাময়িক অন্যান্য অনেক বিজ্ঞানীও কিন্তু তাদের নিজস্ব প্রক্রিয়ায় ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ তৈরি ও এর ক্ষমতা প্রবর্ধনের কাজ করে যাচ্ছিলেন। তাদের মতই একজন ছিলেন স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রন পদার্থবিদ্যার গবেষক প্রফেসর মার্টন (Ladislaus Laszlo Marton)। প্রফেসর মার্টন নিজেই স্ট্যানফোর্ডে নিজের গবেষণাগারে একটি ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ তৈরি করেছিলেন।বাণিজ্যিকভাবে ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ উৎপাদন করবার লক্ষ্যে রাস্কা , মার্টন কিংবা অন্যান্য অনেক গবেষকের ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ তৈরি সংক্রান্ত উল্লেখযোগ্য গবেষণাস্বত্বগুলো অবশ্য পরে সিমেন্সসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান কিনে নেয় । কিন্তু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে নীরজনাথ দাশগুপ্তের জীবনের যে সময়ের কথা বলছি সেই সময় এরকম একটি ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ কিনতে গেলে যে অর্থের প্রয়োজন ছিল তা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ছিল না। অথচ যুগের সাথে তাল মিলিয়ে জীবপদার্থবিজ্ঞান ,আণবিক জীববিজ্ঞান কিংবা এসম্পর্কিত যেকোন গবেষণা করবার জন্য একটি ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ দরকার। এগিয়ে আসলেন মেঘনাদ সাহা আর ব্যবস্থা করলেন নীরজনাথকে বাইরের কোন একটি দেশে পাঠানোর যাতে উনি সেখান থেকে ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ তৈরি করবার প্রক্রিয়া শিখে এসে দেশে ফিরে একটি যন্ত্র নিজেই তৈরি করতে পারেন।
একটু আগে বলা স্ট্যানফোর্ডের প্রফেসর মার্টনের কাছে গেলেন নীরজনাথ। তাঁর অধীনে শিখলেন যন্ত্র তৈরির কৌশল। দেশে ফিরে নীরজনাথের নেতৃত্বে তৈরি হল তরুণ গবেষক দল। তাদের দীর্ঘ ও একাগ্র পরিশ্রমে তৈরি হল ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ। যা শুধু ভারতবর্ষের ই নয়, বরং ছিল পুরো এশিয়া মহাদেশে তৈরি হওয়া প্রথম ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ। নীরজনাথ দাশগুপ্তের নেতৃত্বে তৈরি হওয়া এই ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপের মাধ্যমে বায়োফিজিক্স বা জীবপদার্থবিদ্যা নামে এই উপমহাদেশে সম্পূর্ণ নতুন শাখাটির বিকাশ হওয়ার পথ সুগম হল। এদিক থেকে দেখতে গেলে অধ্যাপক দাশগুপ্ত ছিলেন এই উপমহাদেশে বায়োফিজিক্স গবেষণার অন্যতম পথিকৃৎ। এই পুরো ঘটনার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে অধ্যাপক দাশগুপ্ত ” Research and Teaching in Biophysics” বইয়ে বলেছিলেন,
“The great importance of the science of Biophysics was foreseen as early as 1940 by the late Prof. Meghnad Saha. Under his inspiration a small nucleus for biophysical work was created in the Palit Laboratory of Physics,C.U. in 1944…..An electron Microscope, an essential equipment for researchers in Biophysics,was developed and used later for investigations on cell ultrastructures.
…… The project for the construction of an Electron Microscope was started in 1946 in the Palit Laboratory of Physics, Calcutta University. This was completed in 1948 and was the first electron microscope in India. …. ”
ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপটি তৈরি হলে বিভিন্ন অজৈব পদার্থের কণাকে প্রথমে বৃহৎ আকারে পর্যবেক্ষণ করা হয়। ক্রমে কোষ, জীবাণু , কোষঅঙ্গাণু ইত্যাদি জৈবরাসায়নিক অণু সম্পর্কিত গবেষণাও শুরু হয়। নীরজনাথের এইসকল গবেষণাকর্ম বিভিন্ন বিখ্যাত জার্নালে প্রকাশিত হয়। ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপি ব্যবহারের মাধ্যমে জীবপদার্থবিজ্ঞান ও চিকিৎসাবিজ্ঞানে তাঁর উল্লেখযোগ্য কিছু অবদানের মধ্যে রয়েছে-
- কালা জ্বরের পরজীবী (Parasites of the Leishmania) ও কুষ্ঠ রোগের পরজীবী (Mycobacterium leprae) এর গাঠনিক বৈশিষ্ট্য ও ক্রোমোজোম পর্যবেক্ষণ (Electron microscopic research on bacterial chromosomes and on the morphology of the kala-azar parasite and Mycobacterium leprae)
- রক্তকণিকার হিমোগ্লোবিন অণুর গাঠনিক বৈশিষ্ট্য পর্যবেক্ষণ (Investigation of the physical characteristics of haemoglobin molecules)
- ভাইরাসের ডিএনএ পৃথকীকরণ, পর্যবেক্ষণ ও অন্যান্য ওষুধ-রাসায়নিকের সাথে এই ডিএনএ এর আচরণ পর্যবেক্ষণ (Investigation of viral DNA molecules as well as their interactions with proteins and drug molecules.)
ইলেকট্রন মাইক্রস্কোপের দিকপাল রাস্কা ১৯৬৫ সালে ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপি বিষয়ক সম্মেলনে অধ্যাপক দাশগুপ্তের তৈরি মাইক্রোস্কোপ দেখতে আসেন । এছাড়াও আসেন আরেক নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী আইরিন ক্যুরিসহ অন্যান্য বিশিষ্ট বিজ্ঞানীদের দল।
আজীবন শিক্ষকতা ও গবেষণায় নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া অধ্যাপক দাশগুপ্ত তাঁর ছাত্রছাত্রীদের কাছে ছিলেন অন্যতম অনুপ্রেরণার নাম। দীর্ঘদিন শিক্ষকতা ও গবেষণার স্বীকৃতি হিসেবে তিনি পেয়েছিলেন এফ এন এ সম্মাননা (১৯৮৫) , মেঘনাদ সাহা স্বর্ণপদক (১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দ), ডক্টর জেসি রায় ওরেশন মেডেল (১৯৯০), জি এন রামচন্দ্রন পুরস্কার (১৯৯১)।
১৯৯৯ সালের ১৫ ই আগস্ট অধ্যাপক নীরজনাথ দাশগুপ্ত শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ আর বিশ্বের কাছে খুব একটা নতুন কোন বস্তু নয়,নয় ভারতীয় উপমহাদেশেও। কিন্তু আজ থেকে থেকে অনেক বছর আগে প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা আর অর্থের টানাটানির সময়েও এই মানুষটি প্রথম ইলেকট্রন মাইক্রস্কোপ তৈরি করে এই উপমহাদেশে জৈবপদার্থবিজ্ঞান সম্পর্কিত গবেষণার বিকাশে যে বিস্ময়কর অবদান রেখেছিলেন তা কি আমরা মনে রেখেছি ?
-অতনু চক্রবর্তী,
শিক্ষার্থী, বুসান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, দক্ষিন কোরিয়া
(এই লেখাটি নেওয়া হয়েছে অতনু চক্রবর্ত্তীর সদ্য প্রকাশিত বই “মেঘে ঢাকা তারা”র দ্বিতীয় খণ্ড থেকে। বইমেলায় বইটি পাবেন ঐতিহ্য প্রকাশনীতে, প্যাভিলিয়ন ১৪ তে )