তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা পৃথিবীতে প্রথমবারের ত্রিমাত্রিকভাবে মানুষের হৃৎপিণ্ড মুদ্রণে সক্ষম হয়েছেন। এ কাজে তারা ব্যবহার করেছেন রোগীর নিজের কোষ ও অন্যান্য শারীরিক উপাদান। মুদ্রিত হৃৎপিণ্ডটি “ঐ রোগীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, কোষ, প্রাণরসায়নিক, এবং অন্যান্য শারীরিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সম্পূর্নরূপে সামঞ্জস্যপূর্ন”।
এর আগে পর্যন্ত গবেষকেরা ত্রিমাত্রিক মুদ্রণের মাধ্যমে শুধুমাত্র রক্তনালীবিহীন সাধারন কোষ উৎপাদন করতে সক্ষম ছিলেন। প্রধান গবেষক, তাল দাবির এক বিবৃতিতে বলেন, “এই হৃৎপিণ্ডটি মানুষের কোষ ও রোগীর নির্দিষ্ট শারীরিক উপাদান দিয়ে তৈরি। আমাদের এই প্রক্রিয়ায় শারীরিক উপাদানগুলো বায়োইংকের (জৈব কালি) মত কাজ করে যা চিনি এবং আমিষ দ্বারা তৈরি। এই চিনি এবং আমিষ ব্যবহার করে কোষের জটিল নকশার ত্রিমাত্রিক মুদ্রণ করা হয়। এর আগে ত্রিমাত্রিক মুদ্রণের মাধ্যমে হৃৎপিণ্ডের কাঠামো তৈরি করা সম্ভব হয়েছিল, কিন্তু তাতে কোন কোষ বা রক্তনালী ছিল না। আমাদের গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফল ভবিষ্যতে রোগীদের স্বতন্ত্রভাবে কলা ও প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপনের সুযোগের সম্ভাবনা দেখায়”।
গবেষক দলটি বিবৃতিতে জানান যে, মানুষ এবং শুকরের তলপেটের কাঠামোর ওমেন্টাম নামক চর্বিযুক্ত কলার বায়োপসি সংগ্রহ করে তারা মূল কাজ শুরু করেন। এই কলার কোষীয় উপাদানগুলো পৃথক করে ফেলা হয় এবং এমন নির্দেশনা দেয়া হয় যাতে করে তারা প্রাপ্তবয়স্ক কোষে পরিনত হতে পারে। এই প্রাপ্তবয়স্ক কোষগুলো শরীরের তিন স্তর থেকেই অন্য যেকোন কোষ ও কলা উৎপাদন করতে সক্ষম। এরপর গবেষক দলটি হাইড্রোজেলে মুদ্রণ “কালি” হিসাবে ব্য্যবহার করে কোলাজেন এবং গ্লাইকোপ্রোটিনের তৈরি কোষীয় ম্যাট্রিক্স। কোষগুলি হাইড্রোজেলের সাথে মেশানো হয় এবং তারপরে হৃৎ-কোষ ও এন্ডোথেলিয়াল কোষে (যা রক্ত এবং লিম্ফ্যাটিক পাত্রের অভ্যন্তরীণ পৃষ্টের সমান্তরাল) আলাদা করা হয়। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তৈরি করা হয় নির্দিষ্ট রোগীর জন্যে রক্তনালী যুক্ত, রোগ প্রতিরোধক্ষম হৃদ-কোষের অংশ এবং এর থেকেই ধীরে ধীরে তৈরি হয় নির্দিষ্ট রোগীর শারীরিক বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন একটি সম্পূর্ণ হৃদপিন্ড।
যদিও দলটি ব্যাপক আশাবাদী, তারা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন যে, তাদের উৎপাদিত হৃৎপিণ্ডটি এখনও মানবদেহে প্রতিস্থাপনের জন্য প্রস্তুত নয়।
দাবির বলেন, “এই পর্যায়ে, আমাদের মুদ্রিত ত্রিমাত্রিক হৃৎপিণ্ডটি আকারে ছোট, খরগোশের হৃৎপিণ্ডের আকারের মত। কিন্তু মানুষের বৃহদাকার হৃৎপিণ্ড মুদ্রনের জন্যে ও এই একই প্রযুক্তি প্রয়োজন”।
প্রাথমিক পর্যায়ে মানুষের হৃৎপিণ্ড তৈরি করতে অনেক বেশি সময়ের প্রয়োজন এবং এতে লক্ষ লক্ষ নয় বরং কোটি কোটি কোষের প্রয়োজন। উপরন্তু, চেরি আকারের হৃৎপিণ্ড অবশ্যই একটি প্রকৃত হৃৎপিণ্ডের মত আচরণ করে না। তাই, এই গবেষনার আরও বিকাশের প্রয়োজন আছে এবং কৃত্রিমভাবে উৎপাদিত এই হৃৎপিণ্ডগুলোকে মানবদেহের হৃৎপিণ্ডের মত আচরণ করতে এবং রক্ত পাম্প করার ক্ষমতা অর্জনের যোগ্য করে গড়ে তুলতে হবে। বর্তমানে, কোষগুলো সঙ্কোচন করতে পারে, কিন্তু একসঙ্গে কাজ করতে পারে না।
তবে যাই হোক, এই আবিষ্কার অঙ্গ প্রতিস্থাপনে একটি বিশাল অগ্রগতি। হৃদরোগ হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পুরুষ এবং মহিলাদের মধ্যে মৃত্যুর প্রধান কারণ। এবং শেষ পর্যায়ের হৃদ-রোগের একমাত্র চিকিৎসা হল — হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপন। শুধুমাত্র দাতাদের ঘাটতিই যে নতুন কৌশল অনুসন্ধানের কারণ তা নয়, বরং রোগীর অনন্য জৈবিক বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপিত অঙ্গ প্রত্যাখ্যানের ঝুঁকি রোধ করতে পারে।
দাবির বলেন, “অঙ্গ প্রতিস্থাপন প্রত্যাখ্যানের ঝুঁকি নির্মূল করার জন্য সঠিক শারীরিক বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন উপকরণ দ্বারা উৎপাদিত অঙ্গের প্রয়োজন। বেশিরভাগ সময় এই ধরনের চিকিৎসা বিফলে যায় শুধুমাত্র সঠিক শারীরিক বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন অঙ্গের অভাবে। আদর্শিকভাবে, প্রতিস্থাপিত অঙ্গটি রোগীর নিজের কোষ ও কলার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ন ও একই বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হওয়া উচিত। এখানে আমরা ত্রিমাত্রিকভাবে মুদ্রিত পুরু, রক্ত সংবহনে সক্ষম হৃৎকোষগুলোর একটি সহজ পদ্ধতির প্রতিবেদন করতে পারি, যা সম্পূর্ণভাবে রোগীর অনন্য জৈবিক বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন”। আশা করা হচ্ছে, ত্রিমাত্রিকভাবে মুদ্রিত হৃৎপিণ্ডকে দক্ষতার সঙ্গে রক্ত পাম্প করার “প্রশিক্ষণ” দেয়ার পরে প্রাণীদেহে এগুলো প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হবে। [iflscience অবলম্বনে]
-পুলক বড়ুয়া