বিজ্ঞানীদের একটি দল স্ফীতি তত্ত্বের নতুন একটি শক্তিশালী পরীক্ষার প্রস্তাব রেখেছেন। স্ফীতি তত্ত্ব বা ইনফ্লেশন থিওরি অনুযায়ী ধারনা করা হয় মহাবিশ্ব নাটকীয়ভাবে বিগব্যাং পরবর্তী সেকেন্ডের অতিক্ষুদ্রাংশের মধ্যে বিপুলভাবে সম্প্রসারিত হয়। নতুন এই পরীক্ষাটির লক্ষ্য দীর্ঘদিন ধরে আবর্তিত একটি প্রশ্নের উত্তর খোঁজা: “বিগ ব্যাংএর পূর্বে মহাবিশ্ব দেখতে কেমন ছিল?”
মহাবিশ্বের স্ফীতির মাধ্যমে মাহাজাগতিক অনেক রহস্যের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। তবে এসব রহস্য অন্যান্য সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের তত্ত্বের মাধ্যমেও ব্যাখ্যা করা যায়। এসব তত্ত্বের মধ্যে কোনো কোনোটি ধারনা দেয় বিগ ব্যাংএর পূর্বে মহাবিশ্ব সংকোচনশীল ছিলো এবং সংকুচিত হয়ে একটি বিন্দুতে পরিণত হয়ে পুনরায় প্রসারিত হতে থাকে। অর্থাৎ বিগ ব্যাং মূলত বিগ বাউন্সের একটি অংশ।
স্ফীতি এবং অন্যান্য ধারনাকৃত তত্ত্বগুলোর মধ্যে একটিকে বেছে নেওয়ার জন্য যেটা জরুরী তা হলো মিথ্যাপ্রতিপাদনযোগ্যতা। অর্থাৎ একটি তত্ত্ব মিথ্যা প্রমাণযোগ্য কিনা তা নির্ধারণ করা যেকোনো বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের জন্য জরুরি। এই ক্ষেত্রে বাট্রান্ড রাসেলের একটি উপমা উল্লেখ করা যেতে পারে। রাসেল বলেছিলেন, কেউ দাবী করতে পারেন মঙ্গল এবং বৃহস্পতি গ্রহের মাঝখানে একটি টি-পট আছে (এটি রাসেলের টি-পট নামে পরিচিত)। এই টিপটের তত্ত্বটি বৈজ্ঞানিক ভাবে গ্রহণযোগ্য হবে না কেননা এটি মিথ্যা প্রতিপাদনযোগ্য নয়। অর্থাৎ টিপটটি যে সেখানে নেই সেটি প্রমাণযোগ্য নয়। কেননা, অতিশক্তিশালী টেলিস্কোপও মঙ্গল ও বৃহস্পতির মাঝখানে আবর্তনরত একটি টি-পট খুঁজে পাওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়।
স্ফীতি তত্ত্বের বিষয়ে অনেক জ্যোতির্বিদেরই আপত্তি রয়েছে মিথ্যা প্রতিপাদনযোগ্যতা নিয়ে। অনেকেই মনে করছেন স্ফীতি তত্ত্ব মিথ্যা প্রতিপাদনযোগ্য নয় তাই বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব হিসেবে এর গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ। এদের মধ্যে রয়েছেন হার্ভাড এন্ড স্মিথসোনিয়ান ক্যামব্রিজের সেন্টার ফর এ্যাস্ট্রোফিজিক্সের (CfA) গবেষক এভি লোয়েব। তিনি দাবী করেন স্ফীতি তত্ত্বকে যেভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে তাতে এটি যেকোনো পর্যবেক্ষণের সাথে খাপ খেয়ে যেতে পারে এবং তাই এটিকে পরীক্ষা করে দেখা দুঃসাধ্য। তিনি বলেন, “যেকোনো বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের গ্রহণযোগ্যতা নির্ভর করে এর মিথ্যাপ্রতিপাদনযোগ্যতার উপর। স্ফীতি তত্ত্বের বর্তমান পরিস্থিতি অনুযায়ী এটি এতোই নমনীয় যে এটি পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ করা মুষ্কিল। পর্যবেক্ষনযোগ্য যা-ই মানুষ পরিমাপ করুক এটিকে কোনো না কোনো ভাবে স্ফীতিতত্ত্বের মধ্যে ফেলে দেওয়া যাবে।”
CfA-র গবেষক জিংগাং চেন, এভি লোয়েব এবং ঝং-ঝি জিয়ানিউ এর নেতৃত্বে বৈজ্ঞানিকদের একটি দল আদিম আদর্শ ঘড়ি (Primordial standard clock) নামের একটি ধারনা স্ফীতি তত্ত্বের বাইরের অন্যান্য তত্ত্বগুলোর উপর প্রয়োগ করছেন এবং একটি উপায় বের করেছেন যার মাধ্যমে স্ফীতি তত্ত্বকে মিথ্যা প্রতিপাদন যোগ্য করা সম্ভব এবং পরীক্ষাযোগ্যভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। স্ফীতি তত্ত্বকে অন্যান্য তত্ত্ব হতে পৃথক করার জন্য বিজ্ঞানীগণ বিভিন্ন তত্ত্বের আদিম মহাবিশ্বের আকারের মধ্যে তুলনা করতে শুরু করেছেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, স্ফীতি তত্ত্ব অনুযায়ী স্ফীতিকালীন সময়ে মহাবিশ্বের আকার সূচকীয় হারে বৃদ্ধি পায়। কোনো কোনো তত্ত্বে মহাবিশ্ব সংকুচিত হয়। আর কিছু তত্ত্ব অনুযায়ী মহাবিশ্ব খুব ধীরে বৃদ্ধি পায়, আর কিছু ক্ষেত্রে খুবই দ্রুত। মহাবিশ্বের প্রসারণের যেসব বিভিন্ন কারণ বিভিন্ন তত্ত্বে আরোপ করা হয়েছে সেগুলোকে পরস্পর হতে পৃথক করা কঠিন কেননা এগুলো পরীক্ষাযোগ্যভাবে বর্ণনা করা হয়নি। তাই গবেষকগণ এখন চাইছেন এই সম্প্রসারণের বিষয়টিকে এমন সব রাশির মাধ্যমে ব্যাখ্যা করতে যেগুলো পর্যবেক্ষণযোগ্য এবং বিভিন্ন তত্ত্বের সংজ্ঞা নির্ধারক।
আদিম মহাবিশ্বের আদর্শ ঘড়ি হতে প্রাপ্ত সংকেত এই কাজে সাহায্য করতে পারে। এই ঘড়িটি হতে পারি আদিম মহাবিশ্বের যে কোনো একটি ভারী মৌলিক কণিকা। এ ধরনের কণিকা সব ধরনের তত্ত্বেই থাকবে এবং এদের নিদিষ্ট নিয়মিত কম্পাঙ্ক থাকবে যেটিকে একটি পেন্ডুলামযুক্ত ঘড়ির কম্পাঙ্কের সাথে তুলনা করা যায়।
আদিম মহাবিশ্ব পুরোপুরি সুষম ছিল না। এতে সূক্ষ অনিয়মিত ঘনত্বের পার্থক্য ছিল যা বর্তমান মহাবিশ্বের বিশালাকায় সব কাঠামোগুলোর বীজ হিসেবে কাজ করেছে। এই বিষয়টিই বিগব্যাংয়ের পূর্ববর্তী বিষয়ের ধারনা পাওয়ার জন্য পদার্থবিদদের হাতিয়ার। আদর্শ ঘড়ির টিক টিক হতে যে সংকেত পাওয়া যাবে তা মহাবিশ্বের এই অনিয়মিত অংশের মধ্যে খোদিত রয়েছে। মহাবিশ্বের উদ্ভবের বিভিন্ন তত্ত্বের ক্ষেত্রে এই সংকেতের অনুমান ভিন্ন ভিন্ন হবে কেননা এই তত্ত্বগুলোতে মহাবিশ্বের বিবর্তনের ইতিহাস ভিন্ন ভিন্ন।
জিনগ্যাং চেন বলেন, “বিগ ব্যাং এর পূর্বে কী ঘটেছে সেই সম্বন্ধ আমরা অদ্যাবধি যা জেনেছি সেটাকে ফিল্মের বিভিন্ন ফ্রেমে কল্পনা করা যাক। এই অবস্থায় আদর্শ ঘড়িটি আমাদের দেখাবে কোন ফ্রেমের পর কোন ফ্রেমটি পর্দায় ফেলতে হবে। তথ্যের ঘড়ি ব্যাতীত আমরা জানতে পারব না ফিল্মটিকে সামনের দিক বরাবর নাকি উল্টোদিক বরারবর চালাতে হবে। কিংবা দ্রুত চালাতে হবে নাকি ধীরে। এটি মহাবিশ্বের তত্ত্বের সাথে তুলনীয়। আমরা জানি না, আদি মহাবিশ্ব সংকুচিত নাকি প্রসারিত হয়েছে কিংবা কতটা দ্রুত ঘটেছে এই সংকোচন অথবা প্রসারণ। সময়ের আদর্শ ঘড়িটি ফিল্মের উপর সময়ের নির্দেশনা বসিয়ে দেবে, যে ফিল্ম ধারন করা হয়েছে বিগ ব্যাং এর পূর্বে”।
গবেষক দলটি ইতিমধ্যে গণনা করে বের করেছে, বিভিন্ন তত্ত্ব অনুযায়ী আদর্শ ঘড়িটি হতে কী ধরনের সংকেত পাওয়ার কথা এবং জ্যোতিপর্যবেক্ষণ হতে বাস্তবিক ক্ষেত্রে কীভাবে এই সংকেত পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব। যদি স্ফীত তত্ত্বের বাইরের অন্যকোনো তত্ত্বের গণনার সাথে পরীক্ষালব্ধ তথ্য মিলে যায় তাহলে সম্পূর্ন স্ফীতি তত্ত্বটি মিথ্যা প্রতিপন্ন হয়ে যাবে।
এই ধারনাটির সাফল্য নির্ভর করছে যথাযথ পরীক্ষার উপর। আদিম মহাবিশ্বের ভারী মৌলিক কণিকার সংকেতগুলো হবে অত্যন্ত দূর্বল ফলে ব্যাপক পরিসরে এগুলোকে খুঁজে দেখতে হবে। মহাজাগতিক পটভৌমিক বিকিরণ হবে এগুলো খুঁজে পাওয়ার সম্ভব্য স্থান। অপর স্থান হতে পারে স্থানে গ্যালাক্সিগুলোর বিন্যাস। চেন জানিয়েছেন তাঁরা ইতিমধ্যে এই সংকেত খুঁজতে শুরু করেছেন এবং সাফল্যও ধরা দিচ্ছে। তবে তাঁদের আরো তথ্য দরকার। তাঁদের এই গবেষণায় নাসাসহ আরো অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠান যুক্ত হয়েছে যারা উন্নত মানের তথ্য দিয়ে কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে সহায়তা করছে। [phys.org অবলম্বনে ইষৎ রূপান্তরের মাধ্যমে রচিত।]
-ইমতিয়াজ আহমেদ
সম্পাদক, বিজ্ঞান পত্রিকা
[লেখকের ফেসবুক প্রোফাইল]
বিজ্ঞান পত্রিকা প্রকাশিত ভিডিওগুলো দেখতে পাবেন ইউটিউবে। লিংক:
১. টেলিভিশনঃ তখন ও এখন
২. স্পেস এক্সের মঙ্গলে মানব বসতি স্থাপনের পরিকল্পনা
3. মাইক্রোস্কোপের নিচের দুনিয়া