বিজ্ঞান পত্রিকা

বিস্মৃতপ্রায় বাঙালি বিজ্ঞানী হরিনাথ দে

১৯৭১ সালের ২৭শে মার্চ । থমথমে ঢাকা তখনও ২৫ শে মার্চে ঘটে যাওয়া পৃথিবীর ইতিহাসের জঘন্যতম জেনোসাইডের ধাক্কায় টালমাটাল। কার্ফ্যুর জন্যে যদিও মানুষজন খুব একটা ঘরের বাইরে যেতে পারছে না। কিন্তু ২৭শে মার্চ অল্প কিছুক্ষণ কার্ফ্যু তুলে নেওয়ার বিরতিতে লোকজন অতি সন্তর্পণে ঢাকা শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছে দূরের গ্রামে। কেউবা হেঁটেই পাড়ি দিচ্ছে সীমান্ত- চলে যাচ্ছে ভারতে। ঢাকা তখন তাদের কাছে মৃতের নগরী,এই শহরে ঘনিয়ে আসা রাত্রি তাদের কাছে এক বিভীষিকার নাম। তাই চায়ের কাপের টুংটাং শব্দ, রেডিওতে বাজতে থাকা গানের কলি আর মানুষের আড্ডায় সবসময় সজাগ থাকা পুরান ঢাকার অলিগলি হঠাত যেন ঝিমিয়ে গেছে।

এইদিন রাত ১০টার দিকে পুরান ঢাকার মালাকার টোলা লেনে আচমকা জলপাই রঙের জিপ এসে থামে। জিপ থেকে আচমকা পাকিস্তানি সেনা নেমে এসে গলিতে মর্টার শেল নিক্ষেপ করে আশে পাশের বাড়ি ঘর থেকে মোট ১২ জন কে ধরে আনে। তাদের এনে জড়ো করা হয় মালাকারটোলা মন্দিরের সামনে। এরপর তাদের নিয়ে যাওয়া হয় লোহারপুল ব্রিজের ঢালে। তখন রাত প্রায় বারটা।

পাকিস্তানি আর্মি ক্যাপ্টেন সেনাদের ফায়ারের নির্দেশ দিলেন। তারপর মুহুর্মুহু গুলিতে প্রকম্পিত হল চারপাশ।আর তারপরেই কতকগুলি মানুষের জীবনের গল্প কেমন যেন হঠাত করেই থেমে গেল। গুলি করবার আগে তাদের জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল ” তুম সব হিন্দু হ্যাঁয় ? ” একজন মানুষ সামনে এগিয়ে এসে দৃঢ় কণ্ঠে জবাব দিলেন ” হ্যাঁ, আমরা সবাই হিন্দু” । ওইদিন যে বারজন মানুষকে ধরে আনা হয়েছিল তাদের মধ্যে দশজন মানুষ ব্রাশফায়ারে মৃত্যুবরণ করেছিলেন যাদের মধ্যে এই মানুষটিও ছিলেন। মানুষটির নাম ডক্টর হরিনাথ দে। যিনি ছিলেন সেই সময়ের একজন প্রসিদ্ধ পুষ্টিরসায়নবিদ। মৃত্যুর আগে সায়েন্স ল্যাবরেটরির প্রিন্সিপ্যাল সায়েন্টিফিক অফিসার হিসেবে তিনি নিযুক্ত ছিলেন ।

হরিনাথ দে’র জন্ম তার পুরান ঢাকার পৈতৃক নিবাস ৪৩ মালাকার টোলা লেনে। হরিনাথ দে’র পিতা যদুনাথ দে ছিলেন সেই সময়ের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। ১৯১৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর প্রথম মহাযুদ্ধের উন্মাতাল সময়ে হরিনাথ দের জন্ম। সেই সময় অসংখ্য অর্বাচীন ব্যবসায়ী ফুলে ফেঁপে উঠলেও যদুনাথ দের উপর বাণিজ্যলক্ষ্মী খুব একটা প্রসন্ন ছিলেন না। ফলে পরিবারের আর্থিক অনটনের সময়ে বেড়ে ওঠাটা বালক হরিনাথের পক্ষে বেশ দুঃসহই ছিল। পড়ালেখার প্রতি তার ছিল প্রবল আগ্রহ। কিন্তু ঘরে রাতের অন্ধকারে আলো জ্বালবার মত অবস্থাও ছিল না তার পরিবারের। তাই আক্ষরিক অর্থেই ল্যাম্পপোস্টের আলোয় তার পড়ালেখা করতে হয়েছে। ১৯৩১ সালে ঢাকার পগোজ স্কুল থেকে মাধ্যমিক , ১৯৩৩ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক -দুইবার ই প্রথম বিভাগ পেয়ে তিনি উত্তীর্ণ হন। এরপরে তিনি ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে। সেখান থেকে ১৯৩৬ সালে রসায়নে স্নাতক ও ১৯৩৭ স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। রসায়নে পড়বার সময় তিনি পুষ্টিবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণার প্রতি তাঁর আগ্রহ সৃষ্টি হয় এবং পিএইচডিতে পুষ্টি রসায়নকেই গবেষণা অভিসন্দর্ভের বিষয় হিসেবে বেছে নেন।

সেই সময় বাঙলাদেশে সয়াবিন তেলের প্রচলন আজকের মত ছিল না। সয়াবিনের পুষ্টি মান সম্পর্কেও খুব বেশি গবেষণা হয় নি। ডক্টর হরিনাথ দে এই সম্পর্কে গবেষণা শুরু করলেন। সয়াবিনের পুষ্টিমান সম্পর্কে তাঁর বিশদ গবেষণা বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশিত হয়। পাশাপাশি সামুদ্রিক মাছ থেকে আহরিত প্রোটিন সহজলভ্য উপায়ে জনগণের

কাছে পৌঁছোবার জন্য তিনি ফিশ পাউডার থেকে কেক ও বিস্কুট তৈরি করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন। একজন গবেষক হিসেবে তিনি যথেষ্ট সফল ছিলেন। পুরো গবেষণা জীবনে মৌলিক গবেষণার স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি বেশ কিছু পেটেন্ট করতে সক্ষম হন। কিন্তু ঢাকায় সায়েন্স ল্যাবেরটরি (তদানীন্তন ইস্ট রিজিওনাল ল্যাবরেটরিজ অফ পাকিস্তান) তে প্রতিষ্ঠানে থাকার সময় তাঁর গবেষণাগুলির অধিকাংশ স্বত্বগুলি দেশ স্বাধীন হবার পর পাকিস্তান আইনের ফাঁকফোকর দেখিয়ে চুরি করে নেয়।

১৯৩৭ সাল থেকে ১৯৫০ সাল অব্দি তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়নবিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষকতা করেন এবং রিডার পদ পর্যন্ত উন্নীত হন। এরপর ভারতের ইন্দোরে মহাত্মা গান্ধী মেমোরিয়াল মেডিক্যাল ইন্সটিটিউটে পুষ্টি কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৬০ সালে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদে যোগ দিয়ে ১৯৭১ এ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এই প্রতিষ্ঠানেই যুক্ত ছিলেন। প্রাণরসায়ন ও পুষ্টিবিজ্ঞানের  ড. কুদরাত-ই-খুদা, ড. জে সি দেবনাথ প্রমুখ বিজ্ঞানীর সাথে যৌথভাবে এবং যুগপৎ তাঁর একক গবেষণাকর্ম প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন খ্যাতনামা জার্নালে।

১৯৩৭ সালে রঞ্জাবতি দে-র সঙ্গে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ২৭ মার্চ প্রাণরসায়ন স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি তাদেরর সন্তানদেরকে আগলে রেখেছিলেন ভীষণ নিষ্ঠার সঙ্গে। তারা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে প্রত্যেকেই নিজ নিজ জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত। ব্যক্তিগত জীবনে ড. দে ছিলেন একজন সত্যিকারের পরোপকারী মানুষ। স্বজন ও বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে তাঁর অবসর সময় কাটত। ভালবাসতেন তন্ময় হয়ে গান শুনতে। অসাম্প্রদায়িক এই মানুষটি হৃদয়ে পরম মমতা আর ভালবাসা ধারণ করে কাছে টেনে নিয়েছেন ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষকে। তিনি বই পড়তে ভীষণ পছন্দ করতেন। বিশেষত ধর্ম দর্শন সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান ছিল ভীষণ সমৃদ্ধ। স্মৃতি ১৯৭১ বইতে তাঁর সন্তান সঙ্কর্ষণ দে তাঁর পিতার চরিত্রের এই দিক সম্বন্ধে বলতে গিয়ে লিখেছেন,

” খুব প্রিয় ছিল তাঁর ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারটি । পৈতৃক সূত্রে তিনি পেয়েছিলেন এটি। এতে বহু বিষয়ে বই ছিল। তবে ধর্মীয় গ্রন্থের সংগ্রহ ছিল রীতিমতো ঈর্ষণীয়। এসব বই তিনি বিশেষ আগ্রহের সঙ্গে পড়তেন। আসলে ধর্মচর্চা ও জ্ঞানচর্চাকে তিনি মিলয়ে নিয়েছিলেন। তাই তাঁর গ্রন্থাগার একইসঙ্গে হয়ে উঠেছিল তাঁর উপাসনালয়। ”

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অন্যান্য শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মতই ড. দে’র স্মৃতির স্মরণে বাংলাদেশ সরকার ডাকটিকিট প্রকাশ করে।

                                   ( উপরের সারিতে বাম থেকে প্রথমে ড.হরিনাথ দে)

২৫শে মার্চের কালরাত্রির পর হরিনাথ দে’কে সবাই অনুরোধ করেছিলেন দেশত্যাগ করে ভারতে চলে যেতে। ভারতে না যান নিদেনপক্ষে ঢাকা ছেড়ে যেন চলে যান।  ড. দে এসব কথা শোনেন আর মৃদু হেসে বলেন কোনদিন জ্ঞানত কারো ক্ষতি করি নি । আমার আবার কিসের ভয় ? আর তোমরা চলে যেতে যে বলছ ? যাবটা কোথায় ? এই যে আমার আজন্ম পরিচিত স্মৃতির শহর ঢাকা, আমার মমতায় ঘেরা দেশের মাটি আর পূর্বপুরুষদের ভিটেমাটি এ সব ছেড়ে কোথাও গিয়ে আমি শান্তি পাব কি ? ওই যে গলির মোড়ে বসা আমাদের মুদি ইন্দ্রমোহন কিংবা শৈশবের বন্ধু কলমিস্ত্রী অথবা ছবি বাঁধাই করে যে বন্ধু। তাদের ছেড়ে যাব কোথায় ? ড. হরিনাথ দে’র সত্যিই কোথাও চলে যেতে হয় নি। এই দেশকে তিনি ভালবেসেছিলেন। এই দেশেরই আলো বাতাস আর মাটির গন্ধে তিনি মিশে আছেন।

অতনু চক্রবর্ত্তী
-বুসান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, দক্ষিন কোরিয়া

লেখকের কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ স্মৃতি ১৯৭১ গ্রন্থ এবং ড. হরিনাথ দে’র পুত্র সঙ্কর্ষণ দে

Exit mobile version