বিজ্ঞান পত্রিকা

একাকীত্ব এবং অন্ধকার মানুষকে দীর্ঘ সময় ঘুম পাড়িয়ে রাখতে পারে

মানুষ দিনে কতটুকু ঘুমায়, একবার ঘুমানোর পর আবার কখন ঘুম পায় এ নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে। কিছু গবেষক ঘুমের চক্রের উপর সূর্যের আলোর এবং সঙ্গীর প্রভাব নিয়ে গবেষণা করেছেন। দেখা গেছে, সূর্যালোক না থাকলে অর্থাৎ দীর্ঘসময় অন্ধকারে নিঃসঙ্গ অবস্থায় থাকলে মানুষ একটানা দীর্ঘ সময় ঘুমাতে পারে এবং ব্যক্তিভেদে তা ত্রিশ থেকে আটচল্লিশ ঘন্টার মত হতে পারে।

১৯৬০ এর দশকে জোসি লরেস এবং এন্টনি স্যান্নি ঘুমের উপর সূর্যালোক এবং সঙ্গীর প্রভাব পরীক্ষা করতে দীর্ঘ সময় অন্ধকার গুহার মধ্যে কাটান। লরেস কাটান ৮৮ দিন এবং এন্টনি ১২৬ দিন। অন্ধকার গুহায় একা একা কাটানো সময়ের এই রেকর্ড এখন পর্যন্ত কেউ ভাঙতে পারেনি।

লরেস এবং এন্টনির এই পরীক্ষার উদ্দেশ্য ছিলো একাকীত্ব এবং অন্ধকার মানুষের মনে কি প্রভাব ফেলে এবং তাতে ঘুমের কি ব্যঘাত ঘটে তা খতিয়ে দেখা।

মজার বিষয় হলো, গুহায় অবস্থান কালে তাদের দুজনেরই সময়জ্ঞান নষ্ট হয়ে যায়। দুজনের কাছেই সময় হয়ে যায় ধীর। গোটা সময় কাটানোর পর তাদের কাছে মনে হয়েছিল মাত্র সপ্তাহ কয়েক তারা গুহায় ছিলেন, অথচ সেটা ছিল প্রায় তিন এবং চার মাসের চেয়েও বেশি। আর এক ঘুমে ত্রিশ ঘন্টা কাটানোর পর লরেসের কাছে মনে হতো, ছোট্ট একটা ঘুম দিয়েছেন মাত্র। আর এন্টনি কখনো কখনো ঘুমাতেন একটানা আটচল্লিশ ঘন্টার মত, বোধটা সেই ছোট্ট ঘুমের মত।

এই যুগলকে গবেষকরা রেখেছিলেন কাছাকাছি দুটি ভিন্ন গুহায়। সেখানে তাদের জন্য ছিল পর্যাপ্ত খাবার ও অন্যান্য সামগ্রী। আর তাদেরকে রাখা হতো সার্বক্ষনিক পর্যবেক্ষণে, নজরে রাখা হতো তাদের স্বাস্থ্যগত প্রতিটি খুটিনাটি বিষয়ে। তবে, তাদেরকে সূর্যাস্ত, সূর্যোদয় কিংবা সময় সম্পর্কে কোন ধারণা দেয়া হতো না। এতে করে, প্রকৃত কাটানো সময় আর যুগলের সময়বোধ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণাটি পাওয়া গিয়েছে।

গবেষণা শেষ করার আনন্দে উত্তেজিত লরেস সাংবাদিকদেরকে বলেন, “আমি খুব খুশি যে আমি সময়কে, সব কিছুকে ভুলতে পেরেছি, জয় করতে পেরেছি একাকীত্বকে”। তার ভাষায়, “শেষ দিকে সময় কাটানোটা একদম অনেক কঠিন এবং যাচ্ছেতাই হয়ে আসছিলো। যদিও খুব দ্রুতই আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি, তবু প্রথম দিনগুলোতে আমি পড়াশোনা করেছি। এমন নয় যে ঠান্ডার কারণে মনোযোগ হারিয়েছিলাম কারণ তাবুর মত রুমটির তাপমাত্রা খুব ভাল ছিলো। টেপ রেকর্ডার নষ্ট থাকায় এটিকে ঠিক করতে আমার বেশ সময় লেগেছিলো, এ কারণে গান শোনাটা প্রথম দিকে হয়ে উঠেনি। আর প্রতিটা মুহুর্তেই আমি প্রতীক্ষায় থাকতাম, কখন শেষ হবে আর সূর্যের দেখা পাবো”।

ঘুমের উপর সূর্যের আলো এবং সঙ্গীর প্রভাব নিয়ে করা গবেষণাটি নভোচারীদের শারিরীক এবং মানসিক স্বাস্থ্যগত ব্যপারগুলোকে ব্যাখ্যা এবং সমস্যা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করবে বলে মনে করেন মহাকাশ বিজ্ঞানীরা। তাদের মতে নভোচারীদের লম্বা সময়ের মহাকাশ যাত্রায়, তাদের একাকীত্ব এবং সূর্যালোকবিহীন পরিবেশে খাপ খাওয়াতে এই গবেষণাটি একটি নতুন বাতায়ন খুলে দিয়েছে, বিশেষ করে নাসার মঙ্গলে নভোচারী পাঠাতে এটি অনেক ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

যদিও, গুহায় অবস্থান আর নভোযানে অবস্থান এক বিষয় নয়, তথাপি পরিবেশগত দিক অর্থাৎ সঙ্গী এবং সূর্যের আবর্তনের দিকে এরা প্রায় একই। এই গবেষণার পর থেকে নভোচারীরা আশাবাদী কারণ, নভোযানে যখন তাদের কিছু করার থাকবে না, তখন ছোট্ট একটা ঘুমের মধ্য দিয়ে কাটিয়ে দিতে পারবেন অনেক লম্বা সময়, হয়ত একটানা কয়েক দিন।

দূর দুরান্তের গ্রহে নভোচারী পাঠাতে যদি গভীর ঘুম এবং ক্রায়োজেনিক পদ্ধতি উন্নত করা যায়, তাহলে এই গবেষণা থেকে প্রাপ্ত ফলাফল মানুষকে পুনরায় প্রাকৃতিকভাবে জাগিয়ে দিতে অনেক ভূমিকা রাখবে বলেও বিজ্ঞানীরা আশাবাদী।

যদিও দীর্ঘ সময় একাকীত্ব এবং মানসিক ক্লান্তি মানুষের জন্য অনেক কঠিন একটা বিষয়, তবুও বিজ্ঞানীরা এবং সাথে আমরাও আশাবাদী এই গবেষণার মধ্য দিয়ে যে বাতায়ন খুলেছে তা খুলে দিক নতুন এক দিগন্ত, চলতে থাকুক বিশ্বজয়ে বিজ্ঞানের জয়যাত্রা।

-পৃথু স্যন্যাল

Exit mobile version