বিজ্ঞান পত্রিকা

ডায়নোসরের ক্লোন করা কি আদৌ সম্ভব?

আজকের মানুষেরা যেমন বিভিন্ন জাতি গোত্রে ভাগ হয়ে সমস্ত পৃথিবী জুড়ে রাজত্ব করে বেড়াচ্ছে, মানুষের আবির্ভাবের আগে ঠিক এমন একটা রাজত্ব ছিল ডায়নোসরদের। ডাঙায়, জলে, স্থলে সবখানেই ডায়নোসরেরা বিরাজমান ছিল। কোনো এক দুর্ঘটনায় বৈচিত্র্যময় ডায়নোসরেরা বিলুপ্ত হয়ে যায়। বিলুপ্ত হয়ে গেলেও তাদের কোনো কোনোটির দেহাবশেষ এখনো খুঁজে পাওয়া যায়। এই দেহাবশেষের সূত্র ধরে কারো কারো মনে প্রশ্ন জাগে, বিজ্ঞান এখন অনেক উন্নত হয়েছে, উন্নত বিজ্ঞানকে ব্যবহার করে কি সেই ডায়নোসরদের আবার পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা যায় না?

এই চাহিদা বা আকাঙ্ক্ষারই প্রতিফলন ঘটেছিল হলিউড চলচ্চিত্র ‘জুরাসিক পার্ক’ এর মাঝে। জুরাসিক পার্ক চলচ্চিত্রে দেখা যায় বিজ্ঞানীরা এম্বারে আটকানো অবস্থায় ডায়নোসরের সচল DNA উদ্ধার করতে পারে, এবং সফলভাবে একে কাজে লাগিয়ে ডায়নোসর উৎপাদন করতে পারে।

উল্লেখ্য এম্বার হচ্ছে এক ধরনের আঠা জাতীয় পদার্থ। প্রাগৈতিহাসিক যুগে কোনো মশা যদি কোনো ডায়নোসরকে কামড়ে এম্বারে গিয়ে বসে এবং ঘটনাক্রমে ঐ মশা এম্বারের ভেতর আটকা পড়ে যায় তাহলে আঠা শুকিয়ে গেলে বছরের পর বছর মশার ভেতরে থাকা রক্ত সংরক্ষিত অবস্থায় থাকে। এমনকি কোটি কোটি বছর পর্যন্ত সংরক্ষিত থাকে। এই অনুকল্পকে ব্যবহার করেই গড়ে উঠেছিল স্টিভেন স্পিলবার্গের জুরাসিক পার্ক চলচ্চিত্রটি।

এম্বারে আটকে যাওয়া প্রাগৈতিহাসিক পোকা। ছবিঃ American Museum of Natural History

 

কিন্তু বাস্তবতা সিনেমার মতো নয়। এম্বারে আটকে থাকা দেহাবশেষ হতে ঐ প্রাণী পুনরুৎপাদন সম্ভব নয়। ২০১৩ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্র এই কথাই বলে। এম্বারে হয়তো প্রাগৈতিহাসিক সময়ের DNA-র অনেক তথ্য থাকে কিন্তু তা একটি প্রাণীকে পুনরুৎপাদনের জন্য যথেষ্ট নয়।

DNA কতদিন পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে?

প্রাণী ক্লোন করার প্রথম শর্তটি হচ্ছে ঐ প্রাণীর অবিকৃত ও নিখুঁত DNA-র উপস্থিতি। সাম্প্রতিক সময়ে অস্তিত্ব আছে এমন প্রাণীর বেলায় অবিকৃত DNA পাওয়া খুবই সহজ। কিন্তু সেই প্রাণীটি যদি হয় লক্ষ কোটি বছরের আগের তাহলে সেখানে অবিকৃত DNA প্রাপ্তি নিয়ে কিছু সমস্যা আছে।

কোনো একটা প্রাণী (জৈবিক সিস্টেম) মারা যাবার পর থেকেই তার DNA ক্ষয়প্রাপ্ত হতে থাকে। এই ক্ষয়ের পেছনে কাজ করে বিভিন্ন এনজাইম যা মাটির বিভিন্ন অণুজীব বা দেহের বিভিন্ন কোষে উপস্থিত থাকে। পাশাপাশি সূর্যের অতি-বেগুনী রশ্মিও এই ক্ষয়ের পেছনে কাজ করে। উপরি পাওনা হিসেবে পানির কণা কিংবা বাতাসের অক্সিজেনও DNA-র ক্ষয়িষ্ণুতার জন্য দায়ী হতে পারে। যে যে উপাদানগুলোর কথা বলা হয়েছে তারা ততদিন পর্যন্ত DNA-র ক্ষয় করেই যাবে যত দিন না পুরো DNA টা শেষ হয়ে যায়। যখন আর কোনো কিছুই বাকি থাকবে না তখন তাদের কার্যকরীতা শেষ হবে। পরিবেশ যেহেতু এদের কোনো অভাব নেই, তাই কোনো অবিকৃত DNA-র আশা না করাই বেশি যুক্তিযুক্ত।

এমন পরিস্থিতিতে একটি DNA কতদিন পর্যন্ত টিকে থাকতে পারবে তা কিছুটা ঘোলাটে। বিজ্ঞানীদের ধারণা একটি DNA অনায়াসেই ১ মিলিয়ন বছর টিকে থাকতে পারে। কিন্তু কখনোই ৫/৬ মিলিয়নের বেশি সময় টিকে থাকা সম্ভব নয়। যা ডায়নোসরের DNA-র বেলায় খুবই অপ্রতুল। কম করে হলেও ৬৫ মিলিয়ন বছর টিকে থাকা লাগবে। ৬৫ থেকে ২৩০ মিলিয়ন বছর আগে ডায়নোসরেরা পৃথিবীতে বিরাজ করেছিল।

সত্যি কথা বলতে কি অনেক গবেষকই ডায়নোসরের ক্লোন করতে আগ্রহী, কিন্তু ক্লোন করার জন্য যতটুকু অপরিবর্তিত DNA দরকার তারা তা কখনোই সংগ্রহ করতে পারেননি।

একবার একদল গবেষক ডায়নোসরের হাড়ের ভেতর এমন এক উপাদান পেয়েছিল যা গবেষকদের আশা যোগায়। গবেষকদের ধারণা এখানে প্রাপ্ত DNA দিয়ে বিশেষভাবে হলেও ডায়নোসর ক্লোন করা যাবে। কিন্তু এখানেও সমস্যা দেখা দেয়। ঐ উপাদান ছিল এক কপি-ই। তার উপর এটি যে ডায়নোসরের তা শতভাগ নিশ্চিত নয়। হতে পারে এটি ডায়নোসরের ভেতরে বাসা বাধা কোনো জীবাণুর, কিংবা হতে পারে ঐ সময়ে বাস করা অন্য কোনো প্রজাতির। শতভাগ নিশ্চিত হতে হলে এর সিকোয়েন্স করতে হবে, সিকোয়েন্স করলে DNA টি টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। যা আগের অবস্থা আর ফিরে পাবে না। সবদিক বিবেচনা করে সবেধন নীলমণি উপাদানটিকে অক্ষত রাখতেই সম্মত হয়েছেন বিজ্ঞানী দল।

কোনোভাবে মেসোজয়িক পিরিয়ডের DNA আজকের যুগে টিকে থাকলেও তা এতটাই ক্ষয়প্রাপ্ত হবে যে এটি দিয়ে উল্লেখ করার মতো কিছু করা যাবে না।

তাহলে ডায়নোসরদের হাড়গুলো? হাড়গুলো আসলে ‘হাড়’ নয়। এগুলো ফসিল। ফসিলগুলো ডায়নোসরের দেহের ছাচে তৈরি হয়েছে। ডায়নোসরের হাড়ের প্রতিটি অণু-পরমাণু প্রতিস্থাপিত হয়ে তৈরি হয়েছে এই ফসিল। মৃতদেহ যখন কাদার মাঝে নিমজ্জিত হয় তখন দেহের প্রতিটি অণু-পরমাণু একটি একটি করে খনিজ পদার্থের অণু-পরমাণু দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়। খনিজ পদার্থের অণু-পরমাণুগুলো পানিতে/কাদায় নিমজ্জিত থাকে। প্রতিস্থাপিত হওয়া অণু-পরমাণুগুলো পরবর্তীতে পাথরে রূপান্তরিত হয়। এগুলোকেই আমরা ফসিল হিসেবে জানি।

যুক্তির খাতিরে

তারপরেও যদি যুক্তির খাতিরে ধরে নেই ডায়নোসরের DNA ঠিকঠাক মতোই সংরক্ষিত আছে এবং তা থেকে ডায়নোসর ক্লোন করা সম্ভবও, তাহলেও এখানে অনেক সমস্যার সৃষ্টি হবে। প্রথমত ক্লোন করতে হলে একটি পেটে ধারণকারী ‘মা’ লাগবে, যা পৃথিবীতে নেই। ডায়নোসরেরা অনেক আগেই বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। এদের বংশধর বিবর্তনের মাধ্যমে পাখি হয়ে আজকের যুগে উড়ছে, কিন্তু প্রজাতিগতভাবে তারা অনেক দূরে চলে গিয়েছে, তাদের মাঝে আজ অনেক পার্থক্যের দেয়াল তৈরি হয়ে আছে।

অন্য কোনো বিকল্প না থাকাতে যদি মানুষেরা গর্ভ হিসেবে পাখিকে বেঁছে নেয় তাহলেও সমস্যা দেখা দিবে। ওখান থেকে জন্ম নেয়া প্রাণীতে পাখির বৈশিষ্ট্যও সঞ্চারিত হবে। অর্থাৎ উৎপাদিত প্রাণীটি ঠিক ঠিক কাঙ্ক্ষিত থাকবে না। কিছুটা সংকর হয়ে যাবে।

ডায়নোসরদের উপযোগী পরিবেশ তৈরি করতে হলে কম করে হলেও ৫ হাজার ডায়নোসর (যে কোনো প্রজাতির) তৈরি করতে হবে। ছবিঃ Todd Marshall

তার উপর বর্তমানের পরিবেশ সমস্যা করবে। যে DNA থেকে মানুষ ডায়নোসর ক্লোন করবে ঐ DNA-র প্রাণী এমন একটা পরিবেশে বেঁচে ছিল যা আজকের পরিবেশ থেকে একদমই আলাদা। কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ, অক্সিজেনের পরিমাণ, তাদের তুলনামূলক অনুপাত এখনকার পরিস্থিতির চেয়ে অনেক ভিন্ন ছিল। তাপমাত্রাও ভিন্ন ছিল। দূষিত, বিপর্যয়গ্রস্ত ও অপরিচিত একটা পরিবেশে তার টিকে থাকাই কষ্টকর হবে। একটি ডায়নোসরকে এই পরিবেশে স্বাভাবিকভাবে বাঁচিয়ে রাখা বেশ চেলেঞ্জিং হবে। জীবাশ্মবিদ সুইটজার মনে করেন, নবসৃষ্ট প্রাণীর জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে হলে কম করে হলেও ৫ হাজার পরিমাণ ডায়নোসর তৈরি করতে হবে। যা সমস্যার পিঠে সমস্যাই তৈরি করে চলবে।

⚫ সিরাজাম মুনির শ্রাবণ

বিজ্ঞান পত্রিকা প্রকাশিত ভিডিওগুলো দেখতে পাবেন ইউটিউবে। লিংক:
১. টেলিভিশনঃ তখন ও এখন
২. স্পেস এক্সের মঙ্গলে মানব বসতি স্থাপনের পরিকল্পনা
3. মাইক্রোস্কোপের নিচের দুনিয়া

Exit mobile version