বিজ্ঞান পত্রিকা

বাঙালি জ্যোতিপদার্থবিজ্ঞানী মৃণাল কুমার দাশগুপ্ত

১৯২৩ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর মৃণাল কুমার দাশগুপ্ত জন্মগ্রহণ করেন। বাবা সুকুমার দাশগুপ্ত এবং মা তরুবালা দাশগুপ্তের তৃতীয় পুত্র ছিলেন মৃণাল কুমার দাশগুপ্ত । সুকুমার দাশগুপ্ত ছিলেন একজন নামী স্কুলশিক্ষক। শিক্ষক হিসেবে প্রতিটি শিক্ষার্থীর হৃদয়ে তিনি গভীর ছাপ ফেলতে সক্ষম ছিলেন। তার প্রাক্তন ছাত্র আরেকজন বিখ্যাত ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক অমলেন্দু বসুর স্মৃতিচারণে একজন শিক্ষক হিসেবে সুকুমার দাশগুপ্তের অসাধারণ মেধা, ধৈর্য ও নীতিগত আদর্শের কথা শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করেন। সুতরাং এমন পিতার সন্তান হয়ে ছেলেবেলা থেকেই নিয়ম-নীতি আর আদর্শিক শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে মৃণাল ও যে জ্ঞান পিপাসু, অধ্যবসায়ী, স্থিতধী এবং মেধাবী হবেন এটাই স্বাভাবিক।

বরিশালেই একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথমে মৃণাল ভর্তি হন। পরে সেখানে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে তিনি ভর্তি হন ঢাকার সেন্ট গ্রেগরি উচ্চ বিদ্যালয়ে। গ্রেগরিতে নবম শ্রেণিতে (১৯৩৮ সাল) থাকার সময় জগন্নাথ কলেজের কনফারেন্স হলে বক্তৃতা দিতে আসেন সেই সময়ের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রখ্যাত অধ্যাপক শিশির কুমার মিত্র। এই শিশির কুমার মিত্রের বক্তৃতা তাকে ভীষণ ভাবে অনুপ্রাণিত করে। বিজ্ঞানের প্রতি তার সীমাহীন ভালোলাগাটা আরও বেড়ে যায়। কিন্তু তখনও কি তিনি জানতেন এই শিশির কুমার মিত্র ই তার পরবর্তী জীবনের স্বপ্নদ্রষ্টা হবেন! শিশির কুমার মিত্রকে নিয়ে তার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেছেন-

“ ১৯৩৮ সালে আমি সেন্ট গ্রেগরি স্কুলে ক্লাস এইট থেকে নাইনে উঠলাম। আমাদের প্রধান শিক্ষক রেভারেন্ড ব্রাদার ওয়াল্টার একদিন ঘোষণা দিলেন যে একজন বিখ্যাত বিজ্ঞানী অধ্যাপক শিশির কুমার মিত্র জগন্নাথ হলের কনফারেন্স রুমে জনসাধারণের জন্যে একটি বক্তৃতা দিতে আসছেন। আমরা অনেকে সেই বক্তৃতা শুনতে গেলাম। প্রথম দেখাতেই অধ্যাপক মিত্রের অপূর্ব বাচনভঙ্গি আর আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়েছিলাম। খুব সহজ কথায় রেডিও, আয়ন-স্তর এবং এই সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়গুলি তিনি আমাদের সামনে তুলে ধরেছিলেন। তার এই বক্তৃতা আমাকে বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করতে ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। আমি তখন থেকেই স্বপ্ন দেখতাম আমি ওনার মত যদি কখনও এত সুন্দর বক্তৃতা দিতে পারতাম ! ওনার মত বড় বিজ্ঞানী হতে পারতাম। কিন্তু তখনো ভাবি নি যে আমার ভবিষ্যৎ জীবনের একটা বড় অংশ জুড়ে উনিই থাকবেন। আমার ভবিষ্যৎ জীবনে বিজ্ঞানের পথে চলাটা ওনার হাত ধরেই আরও সুগম হবে।”

তিনি ঢাকা থেকেই মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। সেই সময়ে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে রীডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু। সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সান্নিধ্য ও মৃণালকে সামনের দিকে চলার অনুপ্রেরণা দেয়।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকের পর ১৯৪৬ সালে তিনি স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় বসলেও ১৯৪৭ সালের মাঝামাঝি এসে পরীক্ষার ফল বের হয়। কিন্তু ১৯৪২ থেকে ১৯৪৭ এর এই সময়টা ছিল ভীষণ উত্তাল। দেশভাগ, জিন্নাহ এর দ্বিজাতি তত্ত্ব নীতি এ সব মিলিয়ে যে গোষ্ঠীগত সংঘাত ও ধর্মীয় দ্বন্দ্ব তৈরি হয় তাতে পূর্ববঙ্গের অনেক হিন্দু পরিবার দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। দাশগুপ্ত পরিবার ও এর ব্যতিক্রম ছিল না।স্নাতকের মতই স্নাতকোত্তরে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই গবেষণা বৃত্তি নিয়ে সেখানে থাকতে চাইলেন। কিন্তু পরিবেশের চাপে ও সেই সময়ের ধর্ম ও দেশভাগ নিয়ে সৃষ্টি অরাজকতায় পরিবার ও তাকে কলকাতায় চলে যেতে বললেন।

১৯৪৭ সালে দুর্গাপুজোর অষ্টমীর দিনে পরিবারের সাথে তিনিও দেশত্যাগ করলেন। কলকাতায় পৌঁছানোর পড় বেশ কয়েকমাস কেটে গেল তার চাকরির খোঁজে। অবশেষে একদিন তিনি সকালের অমৃতবাজার পত্রিকায় অধ্যাপক শিশির কুমার মিত্রের সাথে কাজ করার জন্যে একজন গবেষণা সহকারীর পদের জন্য নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখে সেখানে আবেদন করলেন।অধ্যাপক শিশির কুমার মিত্র ছিলেন সেই সময়ের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের “ ঘোষ অধ্যাপক”। তিনি সেই সময়ে প্রধানত দুইটি বড় প্রকল্পে যুক্ত ছিলেন। একটি হচ্ছে তার বিখ্যাত বই “দ্য আপার এটমোস্ফিয়ার” – এইটির পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত দ্বিতীয় সংস্করণের কাজ। অন্যটি ছিল আরেক বিখ্যাত অধ্যাপক মেঘনাদ সাহার সাথে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে “রেডিও ফিজিক্স এন্ড ইলেক্ট্রনিক্স” নামে সম্পূর্ণ একটি নতুন বিভাগ তৈরির কর্মযজ্ঞ।
মৃণাল এখানে এসে প্রথমে এস কে মিত্রের (শিশির কুমার মিত্র) অধীনে সক্রিয় নাইট্রোজেন নিয়ে গবেষণা করেন। অবশ্য অল্প কিছুদিন পরেই ভারত সরকারের ওভারসিজ স্কলারশিপ নিয়ে তিনি বিলেতে পাড়ি জমান রেডিও এস্ট্রোনমি-র উপর গবেষণা করতে। প্রথমে তিনি বিলেতে যাওয়া নিয়ে খুব একটা উৎসাহী ছিলেন না। কিন্তু এস কে মিত্র ই তাকে এই বিষয়ে উচ্চতর গবেষণা করতে উৎসাহ প্রদান করেন। তিনি বলেন,

” আমি চাই যে তুমি বিলেত থেকে নতুন কোন বিষয় শিখে আসো। রেডিও এস্ট্রোনমি একটি নতুন বিষয় আর তাই এখানে গবেষণা ও নতুন কিছু আবিষ্কারের সম্ভাবনা ও প্রবল।”

বেতারীয় জ্যোতির্বিদ্যা বা রেডিও এস্ট্রোনমি হচ্ছে জ্যোতির্বিদ্যার একটি উপশাখা যেখানে বেতার তরঙ্গের সাপেক্ষে মহাজাগতিক বস্তুকণা সম্পর্কে অধ্যয়ন করা হয়। বস্তুতঃ এর মাত্র বছর বিশেক আগে থেকে রেডিও এস্ট্রোনমি নিয়ে টুকটাক গবেষণা শুরু হয়। কার্ল জানস্কি বেল ল্যাবে বসে ট্রান্স আটলান্টিক টেলিফোন সংক্রান্ত গবেষণায় এই মহাজগতীয় রেডিও কলহের কথা বুঝতে পারেন। এরপরে ১৯৪০ সালে আমেরিকান বিজ্ঞানী গ্রোটে রেবার ও এই সম্বন্ধে জোরদার প্রশ্ন তুললেন। আস্তে আস্তে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হতে না হতে বিভিন্ন বিজ্ঞানীর গবেষণার বিষয় হিসেবে এই রেডিও এস্ট্রোনমি ঠাই করে নিল। সেই সময়ে অধ্যাপক পি এম এস ব্ল্যাকেট ছিলেন ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান। অধ্যাপক ব্ল্যাকেটের প্রচেষ্টায় সেই সময়ের সবচে আধুনিক রেডিও এস্ট্রোনমি গবেষণাগার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ম্যানচেস্টারে। অধ্যাপক এস কে মিত্রের সাথে ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক ছিল অধ্যাপক ব্ল্যাকেটের। তাই বিলেতে আসার পর তার সহযোগিতায়ই ম্যানচেস্টারে “জডরেল ব্যাংক এক্সপেরমিনেটাল স্টেশন” নামের সেই বিখ্যাত গবেষণাগারের অধিকর্তা অধ্যাপক লোভেলের অধীনে মৃণাল তার গবেষণা শুরু করেন। এখানে আসার পর তার সহকর্মী ছিলেন আরেকজন দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার রোজার জেনিসন। দাশগুপ্ত ও জেনিসন এই দুজনের প্রচেষ্টাতে আবিষ্কৃত হল অজানা এক ডাবল রেডিও গ্যালাক্সি। তাদের গবেষণার মধ্য দিয়েই প্রথম কৃষ্ণগহ্বরের পরোক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায় যে সময়ে কৃষ্ণগহ্বরের ধারণাই অনেকের কাছে অধরা ছিল।

১৯৫৪ সালে পি এইচ ডি ডিগ্রি লাভের পর তিনি কলকাতায় ফিরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেডিও ফিজিক্স এন্ড ইলেক্ট্রনিক্স বিভাগে অধ্যাপনায় নিযুক্ত হলেন। এই বিভাগের উন্নতিতে তার অবদান অপরিসীম। এই বিভাগেই তিনি নানা সময় বিভিন্ন উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত থেকেছেন। ১৯৯১ সালে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে অবসর নিলেও নানা সময় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন বক্তৃতা দেয়ার মাধ্যমে তিনি নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন। পাশাপাশি কলকাতা বিড়লা প্ল্যানেটেরিয়ামের ” এস্ট্রোনমি এন্ড প্ল্যানেটোরিয়াম সায়েন্স” কোর্সের অধিকর্তা হিসেবে তিনি কাজ করেছেন। তার অধীনে অভিসন্দর্ভ সম্পন্ন করা বিভিন্ন ছাত্র ছাত্রী নানা সময় বিভিন্ন বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানে বিজ্ঞানী এবং গবেষক হিসেবে কাজ করেছেন। পদার্থবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তার বিশেষ করে তরঙ্গ সম্পর্কীয় গবেষণায় তার খ্যাতি ছিল প্রবাদপ্রতিম। নেচার বা ফিল ম্যাগের মত জার্নালগুলিতে তার বেশ কয়েকটি গবেষণা পত্র প্রকাশিত হয়। তার উল্লেখযোগ্য অবদানগুলি হলঃ

● The sudden enhancement of the integrated field intensity of atmospherics subsequent to nuclear bomb explosions of megaton range.
● The gradual enhancement of the integrated field intensity of atmospherics prior to the incidence of Nor’westers.
● The solar cycle dependence of the incidence of sporadic E (ES) – a global picture
● The variability of solar microwave radiations.
● The effect of a total solar eclipse on microwave line-of-sight propagation and also on ionosphere electron content.
● The effect of earth’s orbital eccentricity on incident solar flux at 10.7 cm.

-অতনু চক্রবর্তী,
শিক্ষার্থী, অনুজীব বিজ্ঞান বিভাগ,
পুসান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, সাউথ কোরিয়া।

Exit mobile version