জাপানি বিজ্ঞানী হেডেকি ইউকাওয়া ১৯৩৫ সালে একটা নতুন কণার কথা বললেন। এই কণা সাধারণ বস্তুকণা ইলেকট্রনের মতো নয়। এর কাজ সবল নিউক্লীয় বল বহন করা। অনেকটা আলোর কণা ফোটনের মতো। আলো হলো বিদ্যুৎচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ। আর এই তরঙ্গ আর বল বহন করে ফোটন কণা।
মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে আমাদের মহাবিশ্বের সৃষ্টির ব্যাপারটা মোটামুটি সব বিজ্ঞানীই মেনে নিয়েছেন। কীভাবে ঘটেছিল এই বিস্ফোরণ?
পদার্থের অত্যন্ত ঘন আর বিরাট উত্তপ্ত অবস্থা থেকে সেই ভয়ংকর বিস্ফোরণ ঘটে। ঠিক কতটা ঘন আর কেমন উত্তপ্ত ছিল সেই হিসাব আজও চলছে।
যাহোক, মহাবিস্ফোরণ এখন আমাদের আলোচনার বিষয় নয়। তবু এসে পড়ল চারপ্রকার প্রাকৃতিক বলের কথা ওঠায়। ধারণা করা হয়, বিগব্যাংয়ের সময় মহাকর্ষ ও অন্য চারটা বল একত্রিত অবস্থায় ছিল। সেই চারটা বল হলো, মাহাকর্ষ বল, তড়িচ্চুম্বকীয় বল, সবল নিউক্লীয় বল ও দুর্বল নিউক্লীয় বল। এখন কিন্তু ওই চার প্রকার বল আর একসাথে নেই। তাদের বৈশিষ্ট্য আর আচরণও এখন অনেকটাই আলাদা।
আমরা যে আলোর সাহায্যে দেখি সেটা একই সাথে কণা এবং তরঙ্গ প্রকৃতির। আলোর সেই কণাকেই ফোটন বলে। ফোটন আবার দু রকমের বাস্তব আর ভার্চুয়াল ফোটন। পরমাণুর ভেতরে ইলেকট্রনরা যখন এক উচ্চ শক্তিস্তর থেকে নি¤œ শক্তিস্তরে নেমে আসে আস তখর আমরা যে ফোটন দেখি সেগুলো বাস্তব কণা। আবার তড়িচ্চুম্বকীয় বলের জন্য দায়ী কণারা হলো ভার্চুয়াল ফোটন।
এই ফোটনই বিদ্যুৎচুম্বকীয় বলকে বহন করে।
কীভাবে?
একটা সময় পর্যন্ত বিদ্যুৎ আর চুম্বককে আলাদা মনে করতেন বিজ্ঞানীরা। আলোকে এদের সাথে মেলানোর কথা ভাবতেই পারেনি কেউ। অষ্টাদশ শতাব্দীতে মাইকেল ফ্যারাডের গবেষণা থেকে বেরিয়ে এল আশ্চর্য তথ্য। বিদুৎ আর চুম্বকশক্তি আলাদা কিছু নই। আসলে একই বলের দুটি ভিন্ন রূপ। তাই গতিশীল বিদ্যুৎক্ষেত্র চুম্বকের মতো আচরণ করে, আর গতিশীল চুম্বকক্ষেত্র আচরণ করে বিদ্যুৎক্ষেত্রের মতো।
ফ্যারাডের এই আবিষ্কারের পর প্রায় ১০০ বছর কেটে যায়। এরপর স্কটিশ বিজ্ঞানী জেমস ক্লার্ক মাইকেল অনুপ্রাণিত হন ফ্যারাডের ক্ষেত্রতত্ত্বে। তিনিও গবেষণা চালিয়ে যান। তাঁর গবেষণা আর পূর্বসূরি বিজ্ঞানীদের বিদ্যুৎ আর চুম্বকের সূত্রগুলো একত্রিত করে একটা চারটি সূত্রে আবদ্ধ করেন এবং সেই চার সূত্রের ভেতরই লুকিয়ে ছিল আরেকটি আশ্চর্য তথ্য।
ফ্যারাডে দেখিয়েছিলেন, বিদ্যুৎ আর চুম্বক যেমন একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ, তেমনি এদের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে আলোকতরঙ্গও। এর জন্য তিনি কাজে লাগিয়েছিলেন আলোর তরঙ্গ তত্ত্বকে। ফ্যারাডে লক্ষ করেন বিদ্যুৎ যে বৈদ্যুতিক বল ছড়িয়ে রাখে তার ক্ষেত্রের ভেতর, সেই একই বল ছড়িয়ে থাকে চুম্বকক্ষেত্রের ভেতর। আর সেই বল ছড়ায় তরঙ্গাকারে। কী সেই তরঙ্গের প্রকৃতি। ম্যাক্সওয়েল দেখালেন সেই তরঙ্গ আসলে আলোকতরঙ্গ ছাড়া আর কিছুই নয়।
তার মানেটা কী দাঁড়াল? বিদ্যুৎ ও চুম্বক বল আসলে অদৃশ্য আলোকতরঙ্গ বৈ কিছু নয়। সপ্তদশ শতাব্দীতে স্যার আইজ্যাক নিউটন দেখিয়েছিলেন সূর্যের সাদা আলো আসলে শুধু সাদা নয়। সাতটি রঙের সমাহার, যে সাতটি রং সাজানো রংধনুতে। অবশ্য নিউটন মনে করতেন আলো এক ধরনের কণা।
নিউটনের সমসাময়িক বিজ্ঞানী ক্রিশ্চিয়ান হাইগেনস বলেন, আলো আসলে তরঙ্গ। কিন্তু সে কথা আমলে নেয়নি সেকালের বিজ্ঞানী সমাজ।
প্রায় ২০০ বছর পর মার্কিন বিজ্ঞানী থমাস ইয়ং তাঁর দুই ছিদ্র পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ করে দেন আলো আসলে তরঙ্গ। সেই সাথে এটাও বেরিয়ে এলো সেকালে, আলো সব আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য সমান নয়। আর আমাদের চোখ বিশেষ একটা তরঙ্গদৈর্ঘ্যর বাইরে কোনো আলোয় সংবেদশীল নয়।
দৃশ্যমান আলোর মধ্যে লাল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য সবেচয়ে বেশি, আর বেগুনি আলোর সবচেয়ে কম। ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ দেখাল এর এই সীমার বাইরে আলো আছে। অর্থাৎ লাল আলোর চেয়ে বেশি এবং বেগুনি আলোর চেয়ে কম তরঙ্গদৈর্ঘ্যরে আলোও আছে। ম্যাক্সওয়েলের সেই তত্ত্বের প্রমাণ দেন হেনরিখ হার্জ আর জগদীশ চন্দ্র বসুর মতো বিজ্ঞানীরা।
একে একে অদৃশ্যের আড়াল থেকে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেয় অবলোহিত আলো, বেতার তরঙ্গ, অতিবেগুনি তরঙ্গ, এক্স রে ইত্যাদি আলোকতরঙ্গ। ম্যাক্সওয়েলের সূত্র ধরেই বেরিয়ে এল, চার্জিত কণা ত্বরিত হলে বিদ্যুৎচুম্বকীয় তরঙ্গ বিকিরণ করে। আবার চুম্বকের প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে এই সব অদৃশ্য আলোর কাঁধে ভর করে। তেমনি দুটি চার্জিত কণা পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ বা বিকর্ষণ বল অনুভব করে, সেই বলটাও আসলে ওই বিদ্যুৎচুম্বকীয় তঙ্গেরই ফল।
একটা চার্জিত কণা যখন ত্বরিত হয় বা বৃত্তের পথে ঘোরে তখন সেই তড়িচ্চুম্বক তরঙ্গ বিকিরণ করে। আবার চার্জিত কণা বিদ্যুৎক্ষেত্র তৈরি করে। মানে তার যে বৈদ্যুতিক প্রভাব সেটা ছড়িয়ে রাখে শূন্যস্থানে। আরেকটি চার্জিত কণা যখন সেই বিদ্যুক্ষেত্রের আসে তখন সে এক ধরনের বল অনুভব করে। সেই বল বিদ্যুৎচুম্বকীয় বল।
একই ধরনের ব্যাপার ঘটে চৌম্বকক্ষেত্রেও। একটা চুম্বক তার চৌম্বকীয় প্রভাব ছড়িয়ে রাখে শূন্যস্থানের ভেতর। আরেকটা চৌম্বকীয় পদার্থ সেই ক্ষেত্রের ভেতর এলে চৌম্বক বল অনুভব। এটাও আসলে বিদ্যুৎচুম্বকীয় বল।
বিজ্ঞারীরা অনেক আগেই দেখিয়েছেন চুম্বক আর বিদ্যুৎ আর চুম্বক একই বলের আলাদা রূপ। আর বৈদ্যুতিক চার্জ আর চুম্বক শূন্যস্থানে যে বল ছড়িয়ে রাখে সেগুলো আসলে বিদ্যুৎচুম্বকীয় তরঙ্গ আকারে।
আবার আলো, যার সাথে আমাদের নিত্য বসবাস, সেটাও কিন্তু বিদ্যুৎচুম্বকীয় তরঙ্গ ছাড়া কিছু নয়। পরমাণুর ভেতর প্রোটন আর ইলেকট্রনের ভেতর যে আকর্ষণ, যার কারণে ইলেকট্রন নিউক্লিয়াসের চারপাশে ঘোরে, সেই আকর্ষণ বল আসলে এক ধরনের বিদ্যুৎচুম্বকীয় বলই।
বিদ্যুৎচুম্বক তরঙ্গাকার ছড়িয়ে পড়ে তার পেছনে ভূমিকা রয়েছে ভার্চুায়াল ফোটনদের।
মহাবিশ্বে আরো তিনটি বল সক্রিয়। সবল নিউক্লীয় বল, দুর্বল নিউক্লীয় বল আর মহাকর্ষ বল। সবল নিউক্লীয় বল ক্রিয়া করে পরমাণুর নিউক্লিয়াসের ভেতর।
নিউক্লিয়াসে ধনাত্মক চার্জযুক্ত প্রোটন আর চার্জনিরপেক্ষ নিউট্রন অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে যুক্ত থাকে। তাদের এই শক্তিশালী বন্ধনের রহস্য কী? বিজ্ঞানীরা এটা নিয়ে একসময় বিরাট ঝামেলায় পড়েছিলেন। কারণ নিউক্লিয়াসের ভর।
পরে প্রমাণ হয় এর পেছনে সম্পূর্ণ অজানা এক বল কাজ করে। বিজ্ঞানীরা এই বলের নাম দিলেন সবল নিউক্লীয় বল। চার বলের মধ্যে এই বল শক্তিশালী। কিন্তু পাল্লাটা খুব কম। পরমাণুর নিউক্লিয়াসের ক্ষুদ্র আয়তনের মধ্যেই এর যত জারিজুরি। তার বাইরে এর বাহাদুরি চলে না।
কিন্তু এই বলের জন্য দায়ী কোনো কণা আছে কি?
বিজ্ঞানীরা একটা সময় করতেন মেসন নামের এক ধরনের কণা এই বলের বাহক হিসেবে কাজ করে। পরে বিজ্ঞানীরা জানতে পারেন মেসন নিজেই মূল কণিকা নয়। এগুলো কোয়ার্ক দিয়ে তৈরি। মূল কণিকা নয় নিউট্রন কিংবা প্রোটনও; এরাও কোয়র্ক দিয়ে তৈরি। নিউট্রন, প্রোটন আর মেসনের ভেতরে কোয়ার্কগুলোকে আটকে রাকে গ্লুয়ন নামের বলবাহী কণা। আর এই গ্লুয়নই সবল নিউক্লীয় বল।
এ ছাড়া আরো এক রকম বল আছে। সেটাকে বলে দুর্বল নিউক্লীয় বল বা তাড়িত দুর্বল বল। হাইড্রোজেন কিংবা লোহাবেশির ভাগ মৌলের নিউক্লিয়াস স্থিতিশীল। কিন্তু কিছু পরমাণুর নিউক্লিয়াস মোটেও সুখে-শান্তিতে থাকতে রাজি নয়। তাদের ভেতরের নিউক্লিয়নগুলোর মধ্যে যেন জšে§র আড়ি। আর সেই আড়ি থেকেই তাদের নিউট্রনগুলোর ভেতর ভাঙন ধরে। তেজস্ক্রিয় রশ্মি বিকিরণ করে ক্রমামাগত কমে যায় ভেতরের নিউক্লিয়ন সংখ্যা। এক পরমাণুর নিউক্লিয়াস ভেঙে পরিণত হয় আরেকটি পরমাণুর নিউক্লিয়াসে। কণা বিজ্ঞানীরা বলেন, এর পেছনে কাজ করে দুর্বল নিউক্লীয় বল। আর এই দুর্বল নিউক্লীয় বলের বাহক হলো ড+, ড- ত০ নামের তিনটি কণা।
পুরো প্রক্রিয়াটার ইতিহাসের দিকে একবার নজর বোলাতে পারলে ভালো হয়। এ জন্য আমাকে একটু পেছনে ফিরে যেতে হচ্ছে। প্রথমেই যেতে হবে বিংশ শতাব্দীর তিরিশের দশকের শুরুর দিকে। তখন বিজ্ঞানের জগৎ মোটামুটি নিশ্চিত নিউট্রন ও প্রোটন কণার সমন্বয়েই পরমাণুর নিউক্লিয়াস গড়ে উঠেছে।
কিন্তু শুধু এটুকু কথায় চিঁড়ে ভেজেনি। পরমাণুর অন্দরমহলের যে মাইক্রোস্কোপিক জগৎ, তার আমাদের চেনা জগতের জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়ে পুরোপুরি উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। তাই এক ঝাঁক সূক্ষ্মচিন্তাবিদেরা গড়ে তুললেন কোয়ান্টাম মেকানিক্স নামের এক আশ্চর্য জগৎ। এর আগ পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল, মহাবিশ্ব দাঁড়িয়ে আছে দুই ধরনের বলের খুঁটিতে ভর দিয়ে। একটা হলো মহাকর্ষ বল আর অন্যটা তড়িচ্চুম্বকীয় বল। দুনিয়ায়, মহাবিশ্বে যা কিছু ঘটছে তা এই দুটি বলের কারণে। এই দুই বলের আকর্ষণ সীমা বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত।
কিন্তু বিজ্ঞান এই দুইয়ে আটকে থাকল না। আবিষ্কার হলো স্বল্পদৈর্ঘ্য-সীমার মধ্যে ক্রিয়াশীল আরো দুই প্রকার বল। সবল ও দুর্বল নিউক্লিয় বল। সবল নিউক্লীয় বল প্রোটন ও নিউট্রনদের নিউক্লিয়াসের মধ্যে শক্তিশালী বন্ধন তৈরি করে আটকে রাখে। আর দুর্বল নিউক্লীয় বল কাজ করে তেজস্ক্রিয় পরমাণুর নিউক্লিয়াসে। এই বল তেজস্ক্রিয় পরমাণুর নিউট্রনকে ভেঙে প্রোটনে পরিণত করে। আর সে কারণে তা থেকে বিটা-রশ্মি নির্গত হয়। বিটা রশ্মি মূলত ইলেকট্রনের স্রোত। বলাই বাহুল্য, তাত্ত্বিকভাবে এসব ঘটনা বুঝতে হলে আমাদের কোয়ান্টাম তত্ত্বে যেতেই হবে।
দুর্বল নিউক্লীয় বলের রহস্য সমাধানের জন্য কোয়ান্টামের জগতে হাত বাড়িয়েছিলেন বিখ্যাত ইতালিয়ান পদার্থবিদ এনরিকো ফার্মি। অনেক খেটেখুটে দাঁড় করিয়েছিনে গাণিতিক খসড়া। খসড়া মোটামুটি গ্রহণযোগ্য এবং সহজবোধ্য ছিল। কিন্তু ত্রুটিও ছিল তাতে। মূল কণিকাগুলো গতিশক্তি কম হলেও ফার্মির তত্ত্বে কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু যেসব মূল কণিকাগুলো অনেক বেশি গতিশক্তি নিয়ে ছোটে, ফার্মি-তত্ত্বে গণ্ডগোল লেগে যায় তখন।
পরের ২০ বছরে কোয়ান্টাম মেকানিক্সে এলো বৈপ্লবিক গতি। তড়িচ্চুম্বকীয় প্রক্রিয়ায় কোয়ান্টাম তত্ত্ব মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে গেল। আবার উচ্চগতিশক্তির কণাদের ক্ষেত্রেও কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সফল প্রয়োগ সম্ভব হলো। আর এর মধ্য দিয়েই জš§ হলো ‘কোয়ান্টাম ইলেকট্রডাইনামিক্সের’। অর্থাৎ সবল নিউক্লীয় বলের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল কোয়ান্টাম মেকানিক্স।
বহু বিজ্ঞানীর নিরলস প্রচেষ্টার ফলে কোয়ান্টাম মেকানিক্স এই পর্যায়ে পৌঁছুতে পেরেছিল। তবে তিনজনের নাম আলাদাভাবে উল্লেখ না করলেই নয়। রিচার্ড ফাইনম্যান, জুলিয়েন সুইংগার ও সিন-ইটিরো তোমোনাগা।
সবল নিউক্লীয় বলের জন্য কোয়ান্টাম তো প্রতিষ্ঠিত হলো, তাহলে দুর্বল নিউক্লীয় বলের জন্য কেন নয়? এই চিন্তা-ভাবনা যখন চলছে তখন আবিষ্কৃত হলো দুর্বল বলের এক আশ্চর্য ধর্ম। তা হলো, দুর্বল প্রক্রিয়ায় মূল কণিকার স্পিনিং ধর্ম ডান-বামের সাম্যবস্থায় থাকে না।
বিষয়টা আরেকটু খোলাসা করে বলা যাক। আগেই বলা হয়েছে, দুর্বল নিউক্লীয় বলের প্রভাবে তেজস্ক্রিয় পদার্থ থেকে বিটা রশ্মির আদলে ইলেকট্রন বেরিয়ে আসে। একটা বিষয় জানা ছিল বিজ্ঞানীদের। ইলেকট্রন সব সময় নিজে নিজে লাটিমের মতো ঘোরে। যদিও কোয়ান্টাম মেকানিক্স ঠিক লাটিমের মতো ঘোরার ব্যাপারটা সমর্থন করে না। তবুও ব্যাপারটা যা দাঁড়ায় তা কিছুটা হলেও লাটিমের মতো ঘূর্ণন বলে ধরে ধরে নেয়া যায়। মোট কথা, ইলেকট্রনের একটা নিজস্ব ‘কৌণিক ভরবেগ’ থাকে, যার কারণ হচ্ছে ঘূর্ণন প্রক্রিয়া।
এই ঘূর্ণন দু’দিকে হতে পারে। ডানহাতি ও বাঁহাতি স্ক্রু নিয়মে। ডানহাতি স্ক্রু নিয়ম হলো, ডান হাত সাহায্যে স্ক্রু ড্রাইভার দিয়ে স্ক্রু আঁটতে গেলে হাতটাকে যে ভাবে ঘোরাতে হবে। আর বাঁহাতি স্ক্রু নিয়ম হলো, বাঁ হাতের সাহায্যে স্ক্রু ড্রাইভার দিয়ে স্ক্রু আঁটতে গেলে হাতটাকে যে ভাবে ঘোরাতে হবে।
আবার ফিরে আসি আগের প্রসঙ্গে। বিটা রশ্মির অন্তর্ভুক্ত ইলেকট্রনগুলো পরীক্ষা করে আশ্চর্যজনক ফল পেলেন বিজ্ঞানীরা। এই ইলেকট্রনগুলোর সবই বাঁহাতি স্ক্রু নিয়মে ঘোরে। সত্যি অদ্ভুত! এই আবিষ্কার ফার্মির তত্ত্বকে এগিয়ে দিল আরো একধাপ। তবে ফার্মির তত্ত্বে নতুন বিষয়টা যোগ করার দরকার হলোতত্ত্বটার মধ্যে একটা ডান-বামের অসাম্য থাকতে হবে।
এ-কাজে এগিয়ে এলেন চার-চারজন মার্কিন বিজ্ঞানী। জর্জ সুদর্শন, রবার্ট মার্শাক, মারে গেলমান ও রিচার্ড ফাইনম্যান। তাদের প্রচেষ্টায় ফার্মির তত্ত্বে আরো সুন্দর কাঠামো পেল। কিন্তু ইলেকট্রডাইনামিক্সের মতো সর্বাঙ্গসুন্দর কোয়ান্টাম তত্ত্ব এখনও পাওয়া যায়নি।
কোনো বিশেষ কারণে বিজ্ঞানীরা হন্যে হয়ে কোয়ান্টাম ইলেকট্রডাইনামিক্সের আদলে দুর্বল প্রক্রিয়ার তত্ত্বকে সাজাতে চাইছিলেন, তা একটু বোঝার চেষ্টা করা যাক। ধরা যাক, দুটো ইলেকট্রন ছুটে পরস্পরের কাছাকাছি এল। কিন্তু তাদের মধ্যে পারস্পরিক বিকর্ষণের ফলে আবার ছিটকে দু’দিকে চলে গেল। এ রকম ঘটনা কী হারে ঘটতে পারে?
ইলেকট্রনগুলির কোনো বিশেষ দিকে ছিটকে যাওয়ার সম্ভাবনা কী রকম? অঙ্ক কষে এগুলোর উত্তর বের করতে গেলে ফল আসবে ‘অসীম’! এক-কে শূন্য দিয়ে ভাগ করলে যেমন কোনোও অর্থবহ ভাগফল পাওয়া যায় না। ইলেকট্রন ছিটকে যাওয়ার হার কষতে গেলে সে রকমই হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
কোয়ান্টাম ইলেকট্রডাইনামিক্স এই আশঙ্কা দূর করে। এর কতগুলো গাণিতিক বৈশিষ্ট্যও আছে, যার ফলে ওই জাতীয় উদ্ভট পরিণাম সব সময়েই এড়ানো যায়। তাই স্বাভাবিকভাবেই বিজ্ঞানীরা দুর্বল নিউক্লীয় বলকেও ক্ষেত্রে একই রকম গাণিতিক ছাঁচে ফেলতে। আমেরিকান পদার্থবিদ শেলডন গ্লাশো প্রথম এ ধরনের একটা গাণিতিক কাঠামো প্রস্তাব করালেন। ৬০-এর দশকে কিন্তু সেই কাঠামোকে সম্পূর্ণ চেহারা দিতে লেগে গেল বেশ কয়েক বছর। শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী পাকিস্তানি বিজ্ঞানী আবদুস সালাম আর স্টিফেন ওয়াইনবার্গের হাত দিয়ে সম্পূর্ণ চেহারাটা বেরিয়ে এল। সত্তর দশকের শুরুর দিকে দুই ডাচ বিজ্ঞানী জি টি হুফ ও এম ভেল্টম্যান নামের দু’জন বিজ্ঞানী প্রমাণ করলেন যে, তত্ত্বটার গাণিতিক গঠন অভ্রান্ত।
গ্লাশোর প্রস্তাব, আর সালাম-ওয়াইনবার্গের দেওয়া পূর্ণাঙ্গ রূপ-এর মাঝে কটা বছর কেন অপেক্ষা করতে হলো? এই প্রশ্নটাই বিজ্ঞানকে হিগস বোসন কণার হদিস পাইয়ে দেয়। গ্লাশোর প্রস্তাবিত কাঠামো নিঃশর্তভাবে মেনে নিলে এবং তা তা দুর্বল প্রক্রিয়ার জন্যে ঠিকমতো কাজ করতে গেলে মহাবিশ্বের সমস্তÍ মূল কণিকাকে সম্পূর্ণ ভরহীন হওয়া লাগত। কিন্তু তা তো সম্ভব নয়। ইলেকট্রনের ভর আছে, ভর আছে অন্য সব মূল কণিকার। সুতরাং বিজ্ঞানীরা পড়ে গেলেন কঠিন এক ধাঁধার ফাঁদে।
শেষ পর্যন্ত সমাধান এল। কারো একার কৃতিত্বে নয়। বেশ কয়েকজন পদার্থবিদের পরিশ্রমের ফলে। তাঁদের মধ্যে সর্বাধিক সবচেয়ে পরিচিত নাম স্কটল্যান্ডের এডিনবরার তৎকালীন অধ্যাপক পিটার হিগস। একই সময়ে আরো কয়েকজন বিজ্ঞানী একই প্রক্রিয়ায় বিষয়টা নিয়ে গবেষণা করেন। টম কিবল, ফিলিপ অ্যান্ডারসন, কার্ল হেগেন, ফ্রাঁসোয়া এংলার্ট, রবার্ট ব্রাউট এবং জেরাল্ড গুরালনিক। এদের সবার কাজের সম্মিলিত সম্মিলিত রূপই হিগস কণার অস্তিত্ব সম্মন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী।
২০১২ সালের ৪ জুলাই জেনেভায় এক বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে এলএইচসির পক্ষ থেকে জানানো হয়, হিগস কণার অস্তিত্ব প্রাথমিক ভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
সালাম, ওয়াইনবার্গ আর গ্লাশোর সাফল্যের পর বিজ্ঞানীরা নড়চড়ে বসলেন। তাঁদের এবারের লক্ষ্য সবল নিউক্লীয় বলের সাথে তড়িত দুর্বল বলের একীভূত করা। নতুন উদ্যমে চলে গবেষণা ও সাধনা। কি ‘তড়িত দুর্বল’ আর ‘সবল নিউক্লীয়’ বলকে একীভূত করার জন্য যে তত্ত্ব-উপাত্ত ব্যবহার করা হচ্ছে তার নাম ‘মহান একীভূত তত্ত্বাবলি’। ইংরেজিতে একে বলে এৎধহফ টহরভরবষফ ঞযবড়ৎরবং।
এই তত্ত্বগুলো বলে, মহাকর্ষ বল বাদে অন্য তিনটি সৃষ্টির শুরুতে একীভূত ছিল। সে সময় মহাবিশ্বের তাপমাত্রা ছিল অবিশ্বাস্য রকমের বেশি। প্রায় ১০২৮ ডিগ্রি প্রায়। এই বিশাল তাপমাত্রা ল্যাবরেটরিতে উৎপন্ন করা সম্ভব নয় বলে এৎধহফ টহরভরবষফ ঞযবড়ৎরবং ব্যবহারিক প্রমাণ দেয়া সম্ভব নয়।
১৯২০ সালের পর থেকেই আইনস্টাইন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন মহাকর্ষ ও তড়িচ্চুম্বকীয় বল একীভূত করার। আইনস্টাইন প্রায়ই ভাবতেন, সাফল্যের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন। কিন্তু তাঁর সেই স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়। শুধু আইনস্টাইন কেন আজ পর্যন্ত সম্ভব সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারেননি তাঁর উত্তরসূরিরাও।
কোনো কোনো বিজ্ঞানী সমস্যাটা সমাধানের জন্য মহাকর্ষ বলকে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের আওতায় আনতে চেয়েছেন। তড়িচ্চুম্বকীয় বিকিরণে যেমন ফোটন কণার অস্তিত্ব আছে, তেমনি মহাকর্ষ ক্ষেত্রেও তাঁরা এমন একটা কণার খোঁজ করছেন। সেই কণাটার নাম গ্রাভিটন কণা। কিন্তু এখানে একটা সমস্যা আছে। সেটা হলো এভাবে গ্রাভিটন কণা খুঁজতে গেলে আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটির যে জ্যামিতি তার থেকে বেরিয়ে এসে ভিন্নভাবে সমাধান করতে হয়। এই সমাধান অত্যন্ত জটিল। অনেক বিজ্ঞানী এটাকে মানতে পারেননি। কারণ আইনস্টাইনের মহাকর্ষের এত চমৎকার একটা চিত্রকে ধূলিস্যাৎ করার কথা তাঁরা ভাবতেই পারেন না। অবশ্য বিকল্প আরেকটা সমাধানও আছে। এই সমাধানটা আইনস্টাইনের জ্যামিতির ভেতর থেকেই করার প্রয়াস। অর্থাৎ স্থানকালের বক্রতার ভেতর থেকে নিংড়ে বের করা চেষ্টা। এ জন্য অতিরিক্ত একটা বক্রমাত্রার কল্পনা করার দরকার পড়ে। সুপারস্ট্রিং বা তন্তুতত্ত্ব গড়ে উঠেছে মূলত এই ধারণা থেকেই।
আগের সব পর্ব :
কৃষ্ণগহ্বর-১১ : প্রতি কণার জগতে
কৃষ্ণগহ্বর-১০: কোয়ার্ক, নিউট্রিনো আর অন্যান্য কণিকা
কৃষ্ণগহ্বর-৯ : মূল কণিকাদের কথা
কৃষ্ণগহ্বর-৮ : পরমাণুর কথা
কৃষ্ণগহ্বর-৭ : মহাকর্ষের কথা শোনে আলোও
কৃষ্ণগহ্বর-৬ : আপেক্ষিকতা ও আধুনিক মহাকর্ষ
কৃষ্ণগহ্বর-৫ : আলোর কচড়া
কৃষ্ণগহ্বর-৪ : নিউটনের কামান আর পৃথিবীর মুক্তিবেগ
কৃষ্ণগহ্বর-৩ : নিউটনের মহাকর্ষে
কৃষ্ণগহ্বর-২ : মহাকর্ষের পটভূমি
কৃষ্ণগহ্বর-১ : ফিরে দেখা ইতিহাস