১৬৬৫ সাল। ব্রিটেনে তখন প্লেগের মহামারী। কাতারে কাতারে লোক মরছে। ভয়ার্ত মানুষগুলো আতঙ্কে দিশেহারা। প্রাণভয়ে পালাচ্ছে শহর ছেড়ে। ব্রিটেনের ক্যামব্রিজেও লেগেছে মহামারীর বাতাস। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক তরুণ বিজ্ঞানীও ভীত। ক্যামব্রিজ ছেড়ে চলে গেলেন লিঙ্কনশায়ারের খামারবাড়িতে। সেখানে তাঁর মা আর সৎ বাবা বসবাস করেন। সেই গ্রীষ্মটাই মোড় ঘুরিয়ে দেয় পদার্থবিজ্ঞান ইতিহাসের। এটা নিয়ে প্রায় রূপকথার মতো একটা গল্পও চালু হয়েছে মানুষের মুখে মুখে। আপেল পড়ার গল্প। নিউটন একদিন আত্মমগ্ন হয়ে বসে ছিলেন একটা আপলে গাছের নিচে। হঠাৎ একটা আপেল গাছ থেকে পড়ে মাটিতে। নিউটনের মাথায় তখন একটা প্রশ্ন উঁকি দেয়। আপেলটা মাটিতে পড়ল কেন? কেন ওপরে উঠে গেল না? তাহলে কি পৃথিবীকে আকর্ষণ করছে?
নিউটন
রোমান্টিকদের বিশ্বাস সেদিনের সেই আপেল পড়ার ঘটনাই মহাকর্ষ বলের হদিস পাইয়ে দেয় নিউটনকে। এ গল্প সত্যি কি মিথ্যা, নিশ্চিত করে বলার জো নেই। সত্যি হতেও পারে। তবে স্রেফ একটা আপেল পড়ার ঘটনা থেকে মহাকর্ষ বলের জন্ম, একথা বিশ্বাস করা কঠিন। নিউটন অনেক দিন থেকেই মহাকর্ষ বল নিয়ে ভাবছিলেন। হাতড়াচ্ছিলেন কীভাবে এই রহস্য সমাধান করা যায়। লিঙ্কনশায়ারের সেই আপেল পড়ার ঘটনা হয়তো নিউটনের ভাবনার জগতে গতি এনে দিয়েছিল। কিন্তু শুধু সেই ঘটনার কারণেই মহাকর্ষ সূত্র আবিষ্কার হয়নি এটা সত্যি। কারণ মহাকর্ষ বল নিয়ে নিউটনের আগে অনেক বিজ্ঞানীই ভেবেছেন। যদিও তাঁরা সমাধান বের করতে পারেননি।
মহাকর্ষ বলটা কী? আমরা যে পৃথিবীর ওপর হাঁটছি, ঘুরছি-ফিরছি পৃথিবীর বুক থেকে অনন্ত মহাশূন্যে পড়ে যাচ্ছি না, সেটা মহাকর্ষ বলের কারণেই। আবার ওই যে পড়ে যাবার কথা বললাম, সেটাই বা কেমন? গাছের আপেল মাটিতে কেন পড়ে? কেন কোনো কিছু ওপরে ছুড়ে মারলে তা আবার নিচে ফিরে আসে, মাটিতে আছাড় খায়? এর পেছনে একটাই বল কাজ করছে। মহাকর্ষ বল। অনন্ত মহাবিশ্বে আমরা পড়ছি না, কারণ পৃথিবী তার আকর্ষণ শক্তি দিয়ে আমাদের ধরে রেখেছে। আবা মহাশূন্যে বিশাল বিশাল অঞ্চল ফাঁকা। একদম কিছুই নেই। কী পরিমাণ ফাঁকা সেটা কল্পনাও করতে পারবেন না। ফাঁকা বলে সেখানে মহকর্ষ বলের কারসাজিও কম। তাই সেখানে পড়াপড়ির বিষয়টা কল্পনাও করা যায় না। তাহলে আমরা পৃথিবীর বুক থেক মহাশূন্যে পড়ছি না একই সাথে দুটো কারণে। পৃথিবী তার মহাকর্ষ টানের সাহায্যে আমাদের ধরে রেখেছে। আর মহাশূন্যের ফাঁকা অঞ্চলে আকর্ষণ করার মতো কিছু নেই যে আমারা মহশূন্যে কোনো এক দিকে ঝাঁপ দিলেই সেদিকে ভীমবেগে পড়ে যাব।
নিউটন মহাশূন্য বলটা একেবারে খাতা-কলমে প্রমাণ করেছেন। তাই বলে কি প্রাচীনকালের মানুষ মহাকর্ষ বলের কোনো হদিস জানত না। জানত এক প্রকার। সেটাকে আসলে মহাকর্ষ বললে মশকরা করা হবে। প্রাচীন গ্রিসেই আধুনিক সভ্যতা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশ শুরু হয়। গ্রিক পণ্ডিত মনে করতেন বস্তুর মাটিতে পড়ার পেছনে স্বর্গীয় ব্যাপার-স্যাপার জড়িয়ে আছে। যেসব বস্তু স্বর্গীয় নয়, সেসব বস্তু ওপরে নিক্ষেপ করলে আবার মাটিতে ফিরে আসবে। যেসব বিষয়গুলো মানুষ ব্যাখ্যা করতে পারত না, সেখানেই হাজির হতো দেবতা, শয়তান, স্বর্গ-নরক ইত্যাদি অলৌকিক বিষয়। গ্রিক দার্শনিকদের কাছে বস্তু কেন মাটিতে পড়ে তার ব্যখ্যা ছিল না। তেমনি যেসব বস্তু ওপরে উঠে যায়, তার কারণও তাঁদের জানা ছিল না। আদিম যুগে মানুষ আগুন দেখে ভয় পেত। দিশেহারা হয়ে পড়ত বনের দাবানলে। আগুনের কাছে একদম অসহায় ছিল সেই মানুষগুলো। তাই আগুনকে পুজো করত আদিম যুগের মানুষেরা। অনেক পরে মানুষ আগুনের ব্যবহার শেখে। তখন দেবতার আসন হারায় আগুন। অবশ্য এই আধুনিক যুগেও কোনো কোনো সমাজে আগ্নিপুজো করা হয়ে। তবে তাদের সংখ্যা নগন্য, তারা ব্যতিক্রম।
গ্রিক যুগেও এমন বহু বহু বিষয়কে অলৌকিক মনে করা হত। যেমন আগুন ওপরে উঠে যায় কেন? ওপরে উঠে যায় জলীয় বাষ্প, ধোঁয়া, বিভিন্ন প্রকার গ্যাস ইত্যাদি। এর ব্যাখ্যা গ্রিক দার্শনিকদের কাছে ছিল না। তাই এগুলোর সাথে স্বর্গের যোগ আছে বলে মনে করতেন। তাই এরা স্বর্গের টানে ওপরে উঠে যায়।
আকাশের জ্যোতিষ্কমণ্ডলি দেখা যায় খোলা চোখেই। কত কত তারা আকাশে। একই তারা নিয়ে একেক দেশে একেক গল্প চালু আছে। তারাদেরও নামও আলাদা। একই তারা কোনো দেশে দয়াময় দেবতা, কোনো দেশে আবার ভয়ঙ্কর দানব। কেন এমন হলো? এর পেছনরে কারণ দেশটির ভৌগলিক অবস্থান। কালপুরুষ যখন আকাশের গায়ে ঝলমল করে তখন হয়তো কোনো দেশে সবুজ ফসলে ভরে ওঠে। আবার একই সময়ে কোনো দেশ হয়তো তলিয়ে যায় বানের জলে, কোনো দেশ হয়তো ভয়ঙ্কর খরায় পুড়ে ছারখার। যে দেশ সবুজ ফসলে ভরে ওঠে, সেই দেশ হয়তো কালপুরুষ দয়াময় দেবতা হিসেবে গণ্য হয়। বন্যা কিংবা খরা কবলিত দেশগুলোতে কালপুরুষকে দেখা হয় ভয়ঙ্কর দানবরূপে। এভাবেই হাজার হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠে পৌরণিক কাহিনিগুলো। সেসব কাহিনির নায়ক-নায়িকা, ভিলেন, দানব, রাক্ষস, দেব-দেবী সব চরিত্রগুলোই গড়ে উঠেছে কোনো না কোনো তারাকে ঘিরে। সমাজের সুখ-দুঃথ, হাসি-কান্না, বন্যা, মহামারি জড়িয়ে আছে সেসব কাহিনির আড়ালে। মানুষ নিজে যা করতে পারে না, সেই অসম্ভব কাজগুলো করিয়ে নেই কল্পকাহিনির চরিত্রগুলো দিয়ে। এভাবেই সেসব চরিত্র মিশে যায় মানুষের দৈননন্দিন জীবনে। আর সেই কল্প কাহিনির চরিত্রগুলো খুঁজে নেয় রাতের আকাশে, কোটি কোটি গ্রহ নক্ষত্রের ভিড় থেকে।
প্রাচীন যুগেই জন্ম পুরাণ কাহিনিগুলো। তখনই সুত্রপাত জ্যোতির্বিদ্যার। মানুষ আকাশের তারা দেখে পথ চিনতে, চাষ-বাসের সঠিক সময় নির্ধারণ করতে শেখে। সেকালে তাঁরা দেখে কিছু মানুষ ভবিষ্যৎ বলতে পারত। তাদের বলা হত গণক ঠাকুর কিংবা জ্যোতিষ। এর বেশিরভাগ বুজরুকি। তবে কিছু কিছু বিষয় হয়তো ফলে যেত। তবে সেটা মোটেও ভাগ্য গণনা করে নয়। গ্রহ-নক্ষত্রের গতিপথ বিশ্লেষণ করে কিছু মানুষ পেয়ে যেত আবহাওয়ার আগাম সংবাদ। কৃষিনির্ভর সেই সমাজে আগাম আবহাওয়ার সংবাদ জানাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
চলবে…
আগের পর্ব : কৃষ্ণগহ্বর-১ : ফিরে দেখা ইতিহাস
-আব্দুল গাফফার রনি
বিজ্ঞান লেখক
[লেখকের ফেসবুক প্রোফাইল]
[এই লেখাটি কৃষ্ণগহ্বর ঃ এক মহাজাগতি রহস্যের ঊপাখ্যান বইয়ের অংশবিশেষ। বইটি ২০১৮ সালের অমর একুশে বইমেলায় প্রকাশ করবে অন্বেষা প্রকাশন]