আমাদের হাত-পা কিংবা শরীরের কোন জায়গায় কেটে গেলে সেটা সেরে ওঠে কেমন করে?
আমাদের শরীরের ত্বক দুটো স্তর দিয়ে গঠিত। বাইরের স্তরটাকে বলা হয় এপিডার্মিস এবং ভেতরের স্তরটাকে বলা হয় ডার্মিস। এদের কাজ হলো দেহের ভেতরে যেন কোন ধরণের ক্ষতি না হয় সেটা নিশ্চিত করা এবং বাইরের ক্ষতিকারক সবকিছু থেকে শরীরকে যথাসম্ভব রক্ষা করা। কিন্তু এরা নিজেরাই যখন ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে পড়ে, কেটে গিয়ে ভেতরের রক্তনালী থেকে বেরিয়ে আসে রক্ত, কী হয় তখন?
সাথে সাথে শরীরের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা প্রচন্ড ব্যস্ত হয়ে পড়ে এবং ক্ষতিগ্রস্থ রক্তনালী, ডার্মিস এবং এপিডার্মিসকে পুরোপুরি সারিয়ে তোলার জন্য একটি প্রক্রিয়া শুরু করে দেয়। পুরো ব্যাপারটাকে নিখুঁত করার জন্য এটি সম্পন্ন হয় কয়েক ধাপে। এর ফলে একটা সময় রক্ত পড়া থেমে যায় এবং আস্তে আস্তে ক্ষতস্থান পুরোপুরি সেরে ওঠে। কেমন করে হয় এটা?
ক্ষত সেরে ওঠার এই প্রক্রিয়াটা সম্পন্ন হয় মূলত চারটি ধাপে।
প্রথম ধাপ, হিমোস্ট্যাসিস।
গ্রিক ভাষায় হিমোস্ট্যাসিস শব্দের অর্থ হলো রক্তক্ষরণ বন্ধ করা।
কেটে যাওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই কাটা জায়গার চারপাশে অনুচক্রিকার দল ভীড় জমাতে শুরু করে। এই সময়ে এরা দুটো কাজ করে। প্রথমত, এরা নিজেদের আকৃতি বদলে নিয়ে রক্তক্ষরণ বন্ধের জন্য প্রয়োজনীয় আকৃতি ধারণ করে(এই আকৃতি নির্দিষ্ট না। ক্ষতের প্রকৃতির উপর নির্ভর করে রক্তক্ষরণ বন্ধের জন্যে যে সময় যে আকৃতি সবচেয়ে সুবিধাজনক মনে হয়) এবং একধরণের রাসায়নিক ক্ষরণ করে। ক্ষরিত রাসায়নিক রক্তের নিষ্ক্রিয় ফাইব্রিনকে সক্রিয় করে তোলে। এই ফাইব্রিন এক ধরণের জালের মতোন সৃষ্টি করে। এর কাজ হলো, ভীড় করে থাকা বিচ্ছিন্ন অনুচক্রিকাগুলোকে এক করে নিয়ে কাজে লাগানো। সরল কথায়, সক্রিয় সুপারগ্লু! এর ফলে সব অনুচক্রিকা একসাথে জালে বাঁধা পড়ে। এরা কেটে যাওয়া রক্তনালীর প্রাচীরের ক্ষতিগ্রস্থ অংশটুকু ভরাট করার চেষ্টা করতে থাকে এবং রক্তক্ষরণ বন্ধ করার জন্যে কাজ শুরু করে।
দ্বিতীয় পর্ব, ইনফ্ল্যামেশন।
এই পর্যায়ে এসে শ্বেতকণিকারা কাজে হাত দেয়। এরা ফ্যাগোসাইটোসিস প্রক্রিয়ায় মৃতকোষগুলোকে পরিষ্কার করে ফেলে, ক্ষতিগ্রস্থ টিস্যুগুলোকে সরিয়ে নেয় এবং কেটে যাওয়ার সুযোগে যেসব ব্যাকটেরিয়া এবং প্যাথোজেন(দেহের জন্য ক্ষতিকারক যে কোন কিছু) শরীরে ঢুকে গেছে, এদেরকে তাড়া করে ধরে আনে। এই ফ্যাগোসাইটোসিস হয় লাইসোজোম নামে এক ধরণের কোষের ভেতরে। দেহের জন্য ক্ষতিকারক কোন কিছুকে লাইসোজোম নিজের ভেতরে ঢুকিয়ে বন্দি করে রেখে এক ধরনের রাসায়নিক ক্ষরণ করে পুরো কোষটাকেই ধ্বংস করে ফেলে। এজন্যে ফ্যাগোসাইটোসিসকে আত্মধ্বংসী প্রক্রিয়া বলা হয়।
এই সময়ে ক্ষতস্থানের জায়গাটুকুতে ক্ষতিগ্রস্থ রক্তনালী যেন দ্রুত বেড়ে ওঠে, এজন্য এক ধরণের রাসায়নিক নির্গত হয়। এর নাম PDGF গ্রোথ ফ্যাক্টর। পরবর্তী ধাপে যেন রক্তনালীর কোষ মাইটোসিস প্রক্রিয়ায় দ্রুত বিভাজিত হতে পারে এবং ক্ষতস্থানের পুরো অংশটুকুতে ছড়িয়ে পড়তে পারে, এটি নিশ্চিত করে এই PDGF।
তৃতীয় ধাপ, প্রোলিফারেশন।
এই ধাপে মূলত নতুন টিস্যু বেড়ে ওঠে এবং ক্ষতস্থান মেরামত করে। PDGF গ্রোথ ফ্যাক্টরের সহায়তায় কোষ বিভাজনের হার বৃদ্ধি পায় এবং রক্তনালীর নতুন কোষ তৈরি হতে থাকে। একই সময়ে ফাইব্রোব্লাস্ট নামের লম্বা মাকু আকৃতির কিছু কোষ তাদের দায়িত্ব বুঝে নেয়। কোলাজেনের যে জাল আমাদের শরীরের সুস্থ টিস্যুগুলোকে একসাথে বেঁধে রাখে, এই জালটাকে মেরামতের কাজ করে এই ফাইব্রোব্লাস্ট। রক্তনালীর মেরামতের সাথে সাথে এপিথেলিয়াল কোষেরাও ক্ষতের উপরে এসে জমা হতে থাকে এবং মাইটোসিস প্রক্রিয়ায় বিভাজিত হতে থাকে। এরা আস্তে আস্তে পুরো কাটা জায়গাটুকু জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত অংশটুকু ভরাট করে দিতে থাকে। ক্ষতিগ্রস্থ রক্তনালী এবং ত্বক মেরামতের এই প্রক্রিয়ার একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে মাইক্রোফাইব্রোব্লাস্ট ক্ষতের দুই মাথা ধরে টেনে এনে ক্ষতটাকে মিলিয়ে দেয়।
চতুর্থ ধাপ, ম্যাচুরেশন।
মোটামুটি সব কাজ শেষ, এবার রিমডেলিং।
কোলাজেনের নতুন যে জালটা ফাইব্রোব্লাস্ট তৈরি করে দিয়েছিল, সেটা জায়গামতো বসে যায় এবং অ্যাপোপটোসিস শুরু হয়। বহুকোষী প্রাণির দেহে অপ্রয়োজনীয় যেসব কোষ মাইটোসিস প্রক্রিয়ায় তৈরি হয়ে যায়, এরা যেন দেহে জমে গিয়ে কোন সমস্যা করতে না পারে, এজন্য খুবই নিয়ন্ত্রিত একটি পদ্ধতিতে এদেরকে মেরে ফেলা হয়, এর নাম অ্যাপোপটোসিস। পুরো প্রক্রিয়ার সময় যেসব অপ্রয়োজনীয় কোষ তৈরি হয়েছে এদেরকে মেরে ফেলার মাধ্যমে শেষ হয় ম্যাচুরেশন।
এভাবেই আমাদের দেহের যে কোন ক্ষত বা কাটাছেঁড়া সেরে ওঠে।
তথ্যসূত্র:
১. How It Works, Issue 99
২. উইকিপিডিয়া
-উচ্ছ্বাস তৌসিফ
শিক্ষার্থী, কম্পিউটার সাইয়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।
[ফেইসবুক প্রোফাইল]