বিজ্ঞান পত্রিকা

মশক-তাড়ক বাষ্পক

মশা ইদানীং শহুরে এবং গ্রামীণ এলাকায় একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার মত মারাত্মক সব রোগের জীবাণুর বাহক মশা [চিত্র ১] মানুষের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত একটি মারাত্মক হুমকি বললেও কোন অত্যুক্তি হয় না। আমরা সকলেই জানি যে প্রতিরোধ সবসময় প্রতিকারের চেয়ে উত্তম। তাই মশার কামড় থেকে আমরা সবসময় নিজেদের বাঁচানোর চেষ্টা করি।

চিত্র ১। মশা

আমরা আগে কিভাবে মশা তাড়াতাম? সন্ধ্যেবেলায় নারকোলের ছোবড়া জ্বেলে তাতে ধুনো দেওয়া বোধহয় প্রাচীনতম। তারপর শুরু করলাম মশার কয়েল ব্যবহার। এটি সাধারণত pyrethrum[a] পাউডার দিয়ে তৈরি একটি শুকনো পেস্ট থেকে তৈরি সর্পিল আকৃতির একটি ধূপ। বায়ুতে দহনের ফলে pyrethrum-এর ধোঁয়া মশা তাড়াতে সাহায্য করে। একটি বাজার চলতি মশার কয়েলের ব্যাস প্রায় ১৫ সেমি এবং জ্বলে প্রায় ৭-১২ ঘন্টা। এর থেকে হতে পারে অগ্নি বিপত্তিও। কিছু গবেষণাপত্র দাবী করেন, মশার কয়েল মানুষের এবং স্তন্যপায়ী প্রানীদের জন্য নিরাপদ নয়। এর থেকে ক্ষতিকর PM2.5, PM10 এবং ফর্মালডিহাইড নির্গত হয়[b]। মশার কয়েল থেকে শরীরের অন্যান্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও বদ্ধ ঘরে দীর্ঘক্ষণ মশার কয়েল জ্বললে ধোঁয়া থেকে শ্বাসপ্রশ্বাস কিছুটা ব্যহত হয়, এতে কোন দ্বিমত নেই। এজন্যই নতুন কিছু দরকার হয়ে পড়লো আমাদের। বিভিন্ন বিষাক্ত এবং অবিষাক্ত পদার্থের ব্যবহারে যেসব পদ্ধতি মশা দূরে রাখতে আজ পর্যন্ত উদ্ভাবন করা হয়েছে তার মধ্যে মশক-তাড়ক বাষ্পক[c] হল অর্থনৈতিক দিক থেকে সবচেয়ে সস্তা এবং বহুল ব্যবহৃত একটি যন্ত্র। ঘরের আর পাঁচটি সাধারণ গ্যাজেটের মত একটি সহজ বৈদ্যুতিক হিটার, ও একটি রিফিল[d] ব্যবহার করে, মিনিটের মধ্যে এই ছোট প্রাণী থেকে আমরা রেহাই পেতে পারি। কিন্তু এটি কিভাবে কাজ করে তা আমাদের অধিকাংশের কাছেই অজানা। এই লেখায় আমরা মশক-তাড়ক বাষ্পক-এর কারিকুরি কিছুটা বোঝার চেষ্টা করবো।

চিত্র ২। মশক-তাড়ক বাষ্পক-এর বাইরের খোলক

মশক-তাড়ক বাষ্পক-এর বাইরের খোলকটি হালকা ওজনের প্লাস্টিকের তৈরি। যখন যন্ত্রটি উত্তপ্ত হয় তখন সর্বোচ্চ তাপমাত্রা যাতে সইতে পারে এমন প্লাস্টিক দিয়েই খোলকটি তৈরি করা হয়। বাজারে দুটি ভিন্ন ধরনের উপযুক্ত প্লাস্টিক (Polybutylene Terephthalate: PBT) এবং (Liquid Crystalline Polymers: LCP) এই খোলক তৈরিতে ব্যবহার হয়। এটি একটি অত্যন্ত সহজ বৈদ্যুতিক যন্ত্র যাতে রিফিল খুব সহজে ব্যবহার করা যায় [চিত্র ২]। আধুনিক ডিভাইসে একটি স্লাইডার থাকে, যার মাধ্যমে আমরা কি পরিমাণ তরল বাস্পীভূত করতে হবে তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। উৎপন্ন বাস্প পাত্রের উপরের একটি ছোট আয়তক্ষেত্রাকার বা গোলাকার খোলা অংশের মাধ্যমে মুক্ত হয়। অন্য পাশে বৈদ্যুতিক প্লাগ এবং একটি LED ইনডিকেটর থাকে যা চালু অবস্থায় জ্বলে। যেখানে রিফিল ঢোকানো হয় ও যান্ত্রিকভাবে মেশিন দ্বারা তাকে আটকে রাখা হয় সেই অংশটি চিত্র ৩-এ দেখানো হল। যন্ত্রের গরম করার উপাদান দ্বারা রিফিলের পলতের যে অংশ আচ্ছাদিত করা হয় তার ক্ষেত্রফলের সাথে বাষ্পীভূত তরলের পরিমাণ সমানুপাতিক হয়। গরম করার উপাদানের যত কাছে পলতের অংশ থাকবে, বাষ্পীভবনের হারও তত বেশি হবে। স্লাইডার গরম করার উপাদানের অধীনে পলতের ক্ষেত্রফল বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। যান্ত্রিক পদ্ধতিতেই এটি করা হয়, কোন ইলেকট্রনিক্স পদ্ধতিতে নয়।

 

চিত্র ৩। মশক-তাড়ক বাষ্পক-এর নিচের অংশ

তা এই গরম করার কায়দাটি কি? অভ্যন্তরীণ গঠন থেকে জানা যাবে হিটিং-এর কৌশল। ইলেকট্রিক প্লাগ থেকে দুটি তার নিয়ে এসে তাকে চারটি ভাগে ভাগ করা হয় [চিত্র ৪]। এর মধ্যে দুটি তারকে LED-এর সঙ্গে সংযুক্ত করা হয় ও অপর দুটিকে হিটারের সঙ্গে লাগানো হয় যা গরম হয়ে তরলকে বাষ্পীভূত করে। রিফিল থেকে তরল কৈশিকতার ধর্ম অনুযায়ী পলতে দিয়ে উঠে আসে, আর তারপর হিটিং মডিউল দ্বারা তরলকে বাষ্পীভূত করা হয়। এই অঞ্চলটিকে একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় রাখা হয়, যাতে একটি নির্দিষ্ট প্রয়োজনীয় পরিমাণ তরলই বাষ্পীভূত হয়। এমন মানে এটিকে রাখা হয় যাতে একটি থাম্ব রুল হিসেবে বলা যেতে পারে যে ২৫ থেকে ৩০ দিন যেন রিফিলটি অন্তত চলে। যেহেতু পলতের সঙ্গে হিটিং মডিউলের কোন সংস্পর্শ থাকে না, তাই প্রয়োজনীয় তাপমাত্রায় পৌঁছানো গেল কিনা তা চূড়ান্তভাবে পরীক্ষা করা বেশ কষ্টসাধ্য। প্রচলিত হিটিং মডিউলে তাপ উৎপাদন করা হয় কার্বন রোধকে তাপীয় জুল ক্রিয়াকে কাজে লাগিয়ে [চিত্র ৫ (a)]। আর একটি পদ্ধতিতে ধনাত্মক উষ্ণতা গুনাঙ্ক [Positive Temperature Coefficient (PTC)]  বিশিষ্ট চোঙাকৃতি থারমিস্টর ব্যবহার করা হয় [চিত্র ৫ (b)]। উত্তপ্ত করার সাথে সাথে PTC থারমিস্টরের রোধ বৃদ্ধি পায়। এটি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে কাজ করে ও সর্বোপরি এটি খুবই সস্তা। এই ক্ষেত্রে PTC থারমিস্টরের স্বাভাবিক মানে কাজ করতে প্রয়োজনীয় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা হল প্রায় ১৩৫° C। অতি অল্প সময়ের মধ্যে এই তাপমাত্রায় PTC থারমিস্টর পৌঁছে যায়, ফলে এই যন্ত্রটি খুব দ্রুত সাড়া দিতে পারে। আর থারমিস্টর চোঙাকৃতি হওয়ার জন্য রিফিলের পলতে অংশকে অরীয় দিকে সমভাবে ও তাৎক্ষনিক ভাবে উত্তপ্ত করতে পারে। প্রচলিত গরম করার মডিউলের তুলনায় প্রায় ৫০ শতাংশ শক্তি কম খরচ হয় এই PTC থারমিস্টর মডিউলে। অত্যন্ত কার্যকর পদার্থ শুধুমাত্র অল্প পরিমাণে মুক্ত যাতে করে হতে পারে, তাই গরম করার মডিউলে তাপমাত্রা একটি সংকীর্ণ সীমার মধ্যে রাখতে হয়। খুব সামান্য পরিমাণও নয় আবার অত্যধিক পরিমাণ তরলও যাতে বাষ্পীভূত না হয় সেটা নিশ্চিত করা হয়। প্রতিটি তরলের স্ফুটনাঙ্ক আলাদা। তাই বাষ্পীভবনের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তিও স্বাভাবিকভাবেই এক পদার্থ থেকে অন্য পদার্থে আলাদা হবে। তাই তরল অনুযায়ী সঠিক তাপমাত্রা তৈরিতে গরম করার মডিউলে ঠিক মশা তাড়ানোর তরলের বাষ্পীভবনের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তির সমমানের তাপশক্তিই উৎপন্ন করা হয়। ব্যাপারটি শুনতে যতটা সহজ, এই ধরনের ডিভাইসে বাস্তবে এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ।

 

চিত্র ৪। মশক-তাড়ক বাষ্পক-এর অভ্যন্তরীণ অংশ-বৈদ্যুতিক সংযোগ
চিত্র ৫। (a) সাধারন কার্বন রোধক ব্যবহারকারী হিটিং মডিউল (b) PTC থারমিস্টর ব্যবহারকারী হিটিং মডিউল

চিত্র ৬-এ হিটিং মডিউলে উৎপন্ন তাপমাত্রা এবং প্রয়োজনীয় অন্তঃপ্রবাহ সময়ের সঙ্গে কিভাবে পরিবর্তিত হয় তা রেখাচিত্রের মাধ্যমে দেখানো হল। এটা স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে যে PTC হিটিং মডিউলের চূড়ান্ত তাপমাত্রায় পৌঁছে যাওয়ার থেকে সাধারন রোধক ব্যবহারকারী হিটিং মডিউলের একই তাপমাত্রায় পৌঁছাতে সময় লাগে বেশী। একইসঙ্গে দেখা যাচ্ছে যে অন্তঃপ্রবাহের পরিমান একাধারে যেমন কম তেমনই স্থিতাবস্থায় পৌঁছাতেও সময় লাগছে তুলনামূলক ভাবে কম। তাই আধুনিক মশক-তাড়ক বাস্পক ডিভাইসে PTC হিটিং মডিউল ব্যবহার করা হয়।

চিত্র ৬। নিরবিচ্ছিন্ন রেখা PTC থারমিস্টর ব্যবহারকারী হিটিং মডিউল এবং খন্ডিত রেখা সাধারন কার্বন রোধক ব্যবহারকারী হিটিং মডিউলকে নির্দেশ করছে। PTC হিটিং মডিউলের তাপমাত্রা কয়েক সেকেন্ড পরেই চূড়ান্ত তাপমাত্রায় পৌঁছেছে। রোধক হিটিং মডিউলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি উল্লেখযোগ্যভাবে বিলম্বিত। স্থিতাবস্থায় অন্তঃপ্রবাহের পরিমান এবং তাই শক্তি শোষণের পরিমানও PTC হিটিং মডিউলের জন্য উল্লেখযোগ্যভাবে কম।
চিত্র ৭। রিফিল

এবার আসা যাক রিফিলের কথায়। এটি একটি প্লাস্টিকের বোতল [চিত্র ৭]। এর মধ্যে রাখা থাকে মূলত Transfluthurin[e], একটি স্থিতিকারক (প্রধানত Butlyated hydroxytoluene) এবং একটি সুগন্ধি তরলের রাসায়নিক মিশ্রন। এই সব রাসায়নিক deodorized কেরোসিনের মধ্যে দ্রবীভূত করে রাখা থাকে যাতে তারা সহজে প্রয়োজনীয় উত্তাপে বাষ্পীভূত হতে পারে। মিশ্রণটি বিষাক্ত। মিশ্রণ-এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল Transfluthurin। এটা মশাদের ত্বক ভেদ করে ঢুকে যেতে পারে, এবং তাদের স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি করে পক্ষাঘাতের কারণও হতে পারে। মশাদের গতি শ্লথ করে দেয়। Transfluthrin মাছি, মশা এবং আরশোলার বিরুদ্ধে ঘরোয়া পরিবেশে ব্যবহার করা যেতে পারে। এটা একটি অপেক্ষাকৃত উদ্বায়ী pyrethroid গোষ্ঠীর কীটনাশক পদার্থ। এটি দ্রুত কাজ করতে পারে। পরিমিত ব্যবহার মশা তাড়াতে যেমন সক্ষম, তেমনই এই রাসায়নিকটির যথেচ্ছ ব্যবহারে মাথা ঘোরা, মাথা ব্যাথা, নার্ভাসনেস, উদ্বেগ, কম্পন, খিঁচুনি, চামড়ায় এলার্জি, হাঁচি, নাক-জ্বালা সহ নানান উপসর্গ দেখা দিতে পারে। অতএব, সাবধান। মশা মারতে কামান না দাগা হয়ে যায়!

 

অতিরিক্ত

[a] Pyrethrum : Chrysanthemum cinerariifolium এবং Chrysanthemum coccineum প্রজাতির শুকনো ফুল থেকে তৈরি একটি প্রাকৃতিক কীটনাশক।

[b] PM2.5, PM10 : Particulate Matter : পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে উপস্থিত আণুবীক্ষণিক কঠিন বা তরল বস্তুকণা। ২.৫ মাইক্রোমিটার ও ১০ মাইক্রোমিটার ব্যাসের কণাগুলিকে যথাক্রমে PM2.5 ও PM10 বলে। এই কণাগুলির ব্যাস মানুষের একটি চুলের প্রস্থের চেয়েও কম হয়। ফলে এরা সরাসরি ফুসফুসের মধ্যে পোঁছে যেতে পারে এবং মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যা ঘটাতে পারে।

[c] মশক-তাড়ক বাষ্পক : Mosquito Repellent-এর বাংলা প্রতিশব্দ। সম্ভবত আগে ব্যবহৃত হয়নি।

[d] রিফিল : একটি তাপ পরিবাহী দণ্ডযুক্ত তরলপূর্ণ পাত্র। মশার স্বাভাবিক কার্যকলাপ বিঘ্নিত করতে পারে সে রকম একটি তরল এই পাত্রে থাকে।

[e] Transfluthurin-এর ধর্মাবলী সংক্রান্ত কিছু তথ্য

ধর্মাবলী
IUPAC নাম (1R,3S)-3-(2,2-Dichlorovinyl)-2,2-dimethyl-1-cyclopropanecarboxylic acid (2,3,5,6-tetrafluorophenyl) methyl ester
আনবিক সঙ্কেত C15H12Cl2F4O2
রাসায়নিক সঙ্কেত  
আনবিক ভর 371.15 gm·mol−1
রাসায়নিক গঠন/চেহারা বর্ণহীন স্ফটিক
ঘনত্ব 1.507 gm.cm-3 (23° C)
গলনাঙ্ক ~ 32°C
স্ফুটনাঙ্ক ~ 250° C (সাধারন বায়ুমণ্ডলীয় চাপে)
জলে দ্রাব্যতা 5.7×10−5 gm.L-1
হেক্সেন, আইসোপ্রোপানল, টলুইন প্রভৃতি জৈব দ্রাবকে দ্রাব্যতা অত্যন্ত দ্রবনীয়

 

তথ্যসূত্র

[১] EPCOS-TDK গ্রুপের কোম্পানির ওয়েবসাইট

[২] EngineersGarage-এর ওয়েবসাইট

[৩] উইকিপিডিয়া-এর বিভিন্ন পেজ

-সুমন পাল
পদার্থবিদ্যার গবেষক, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়

 

E-mail: paul_suman30@yahoo.co.in

 

Exit mobile version