কয়েক সহস্রাব্দকাল আগের কথা, যখন বিজ্ঞান বলতে কিছুই ছিলো না, যখন জ্ঞানের সর্বোচ্চ স্তর ছিল প্রাকৃতিক দর্শন এবং সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তিরা ছিলেন দার্শনিক তখন দুনিয়াতে একটি বিদ্যা প্রচলিত ছিলো। এই বিদ্যাটির নাম আলকেমি। আজকের যুগে আলকেমী বলতে আমরা বুঝি তুচ্ছ এবং সহজপ্রাপ্য এবং ক্ষয়িষ্ণু ধাতু যেমন সীসা কিংবা লোহাকে অতিমূলবান এবং সমাদৃত ধাতু যেমন: সোনা এবং রূপায় পরিণত করার বিদ্যাকে। মধ্যযুগে যখন আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান এখনকার মতো বিস্তৃতিলাভ করেনি তখন একশ্রেনীর মানুষের মনে ধারনা তৈরি হয় যে তুচ্ছ ও অকিঞ্চিৎকর ধাতুগুলোকে একধরনের পরশপাথরের (Philosopher’s stone) ছোঁয়ায় দুস্প্রাপ্য এবং মূল্যবান ধাতুতে পরিণত করা সম্ভব। শুধু তাই নয়, আরো কিছু বিষয় এই বিদ্যার অন্তর্গত ছিলো। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সঞ্জীবনী সুধা (elixer) তৈরি যা পানের মাধ্যমে সকল রোগ-ব্যাধি হতে মুক্ত থেকে সুদীর্ঘ জীবন লাভ করা যায়। মানুষের অজ্ঞানতার অন্ধকার যুগে তৈরি হওয়া সেই আলকেমির বিদ্যাকে প্রভাবিত করেছিলো পৌরাণিক কাহিনী, যাদুবিদ্যা, ধর্ম এবং আধ্যাত্মিকতা। আলকেমি যদিও অধিভৌতিক এবং অবৈজ্ঞানিক একটি বিদ্যা তথাপি আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানে আলকেমির প্রভাব স্বীকার না করে উপায় নেই। কেননা আধুনিক রসায়নের উদ্ভব হয়েছে আলকেমি চর্চা থেকে এবং আধুনিক ‘Chemistry’ শব্দটিরও উদ্ভব ‘Alchemy’ শব্দ হতে।
আলকেমি শব্দটির উদ্ভব হয়েছে খুব সম্ভবত: ফরাসি alquimie শব্দ হতে যা আবার এসেছে ল্যাটিন alchimia, যেটি আর এসেছে আরবি al-kimia (الكيمياء)) শব্দ হতে । এই শব্দটি প্রচীন মিশরের নামের একটি সংস্করণ Keme থেকে এসেছে যার অর্থ কালোমাটি। মরুভূমির লাল শুষ্ক বালির বিপরীতে মিশরীয় উর্বর ভূমি বোঝাতে এই শব্দ ব্যবহৃত হত। আলকেমির বিষয়বস্তু বেশ বিস্তৃত। প্রায় চার সহস্রাব্দের ঐতিহ্যগত ধ্যানধারনার প্রভাব আলকেমিতে পাওয়া যায়। যদিও প্রাচীন চিহ্নাবলী এবং গুপ্তবার্তার পাঠোদ্ধারের দুষ্করতার কারনে প্রকৃত ইতিহাস এবং পারষ্পরিক সম্পর্কগুলো বের করা বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে তবে এসব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও প্রাচীন আলকেমির চর্চাকে প্রধান কিছু ধারায় ভাগ করা যায়। এগুলো হচ্ছে চায়নীজ আলকেমি, ভারতীয় আলকেমি, এবং পশ্চিমা আলকেমি। পশ্চিমা আলকেমি ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় উদ্ভুত হয়ে ক্রমশ মিশরের দিকে ছড়িয়ে পড়ে, অতঃপর তা ইসলামী বিশ্বে গমন করে এবং একেবারে শেষের দিকে ইউরোপে বিস্তার লাভ করে। চায়নীজ আলকেমি চীনা ধর্মীয় মতবাদ টাওইজমের (Taoism) সাথে জড়িত এবং ভারতীয় আলকেমি চর্চা সনাতন ধর্মীয় বিশ্বাস ও চর্চার সাথে একীভূত ছিল।
আলকেমির চর্চা মূলতঃ আধ্যাত্মিকতা কেন্দ্রিক। সীসাকে সোনায় পরিণত করার বিষয়টির সাহায্যে ব্যক্তিসত্বাকে রূপান্তরের মাধ্যমে পবিত্র ও নিখূঁত করার একটি উপমা পাওয়া যায়। প্রথমদিকের আলকেমিবিদগণ মূলতঃ আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে আলকেমির চর্চা করেছেন যেখানে মানবসত্ত্বার রূপান্তরটি মূল উদ্দেশ্য ছিলো। মধ্যযুগ পর্যন্ত এই প্রবণতা চলতে থাকে এবং এইসময় আলকেমির সাথে চার্চের সম্পৃক্ততাও লক্ষ্ করা যায়। এই সময়ের আলকেমি চর্চাকারীদের মধ্যে মেলকিয়র গিবিনেসিস (Melchior Cibinensis) এবং পোপ অষ্টম ইনোসেন্ট (Pope Innocent VIII) উল্লেখযোগ্য। মার্টিন লুথার (Murtin Luther) আলকেমিকে খৃষ্টীয় শিক্ষার সাথে সাযুয্যতার কারনে বিপুলভাবে উৎসাহীত করেন। এই সময় পর্যন্ত আলকেমি ছিলো মোটামুটি রূপকধমী এবং সাধারণ ধাতু থেকে মহামূল্যবান ধাতুর রূপান্তের প্রক্রিয়াটি আক্ষরিক ভাবে না বুঝিয়ে ত্রুটিপূর্ণ, রোগাক্রান্ত, ক্ষয়িষ্ণু, বিপথগম্য মানুষকে নিখুঁত, স্বাস্থ্যবান, আদর্শবান এবং চিরতরুন ব্যক্তিত্বে রূপান্তেরের একটি রূপক সাদৃশ্য হিসেবে দেখা হতো। এই দুই ধরনের প্রয়োগকে চিহ্নিত করা হতো অজ্ঞতা, অশিক্ষা থেকে আলোকিত, প্রজ্ঞাময় অবস্থায় রূপান্তরের মাধ্যমে। ধাতু রূপান্তরের পরশপাথরটিকে তুলনা করা হয় আধ্যাত্মিক শক্তি এবং সত্যের সাথে।
ক্রমশঃ আলকেমির চর্চা বস্তুগত বিষয়ের দিকে ঝুঁকে পড়ে। আলকেমি আধ্যাত্মিক সীমানা অতিক্রম করে পুরোপুরি ভৌতবিজ্ঞানের দিকে প্রবেশ করে। বিপুল সংখ্যক ‘আলকেমিষ্ট’ সীসা বা অন্যকোনো সহজলভ্য বস্তুকে সোনায় পরিণত করার বিদ্যা অর্জনের জন্য সারাজীবন কাটিয়ে দেন। এমনকি স্বনামধন্য চিত্রকর লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি এবং সর্বকালের অন্যতম সেরা বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটনও আলকেমির চর্চা করেছেন বলে জানা যায়! পঞ্চদশ শতকে ইউরোপের রেঁনেসার উদ্ভবকালে আলকেমি সম্পূর্ণ পৃথক দুটি পথে বেঁকে যায়। এই সময় সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের দুইদল আলকেমি চর্চাকারীর উদ্ভব ঘটে। একদল শুধু মাত্র আধ্যত্মিকতার অবলম্বন হিসেবে আলকেমির চর্চা করতে থাকে আর অপরদল পুরোপুরি ভৌত এবং বস্তুগত চর্চায় মগ্ন হয়ে যায়। মূলত: এই পরিবর্তনের বাতাস বইতে শুরু করে বেশ আগে থেকেই। অষ্টম শতাব্দীর শেষ ভাগে আরব ‘আলকেমিষ্ট’ যাবির ইবনে হাইয়ান (ইউরোপে জেবার নামে পরিচিত) প্রথম আলকেমির জন্য বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি এবং গবেষনাগারনির্ভর এবং নিয়ন্ত্রিত পরীক্ষা-নীরিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে থাকেন। যা তাঁর সমসাময়িক অন্যান্য রূপক আধ্যাত্মবাদ ও অধিভৌতিক ও ধর্মীয় তত্ত্বনির্ভর চর্চার সম্পূর্ণ বিপরীত। এই দৃষ্টিভঙ্গীর কারনে যাবিরকে অনেক ইতিহাসবিদ রসায়নের জনক অভিধা দিয়ে থাকেন। কিছু ঐতিহাসিক দলিলপত্র থেকে তার পরীক্ষা-নিরীক্ষাধর্মী গবেষনা চর্চা এবং যন্ত্রপাতির ব্যবহার বিষয়ক তথ্য পাওয়া যায়।
তবে অনেক ইতিহাসবিদ এই মর্যাদা ষোড়শ শতকের গবেষক রবার্ট বয়েলকে দিতে আগ্রহী। কেননা রবার্ট বয়েলের বক্তব্য থেকে তাঁর বৈজ্ঞানিক গবেষনার প্রতি উৎসাহের সরাসরি প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি বলেন: “রসায়ন চর্চার জন্য সবচেয়ে অত্যাবশ্যক বিষয় হলো ব্যবহারিক কাজ এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পাদন। যারা ব্যবহারিক কাজ এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিষয়ে আগ্রহী নয় তারা কখনোই এই বিষয়ে ন্যূনতম দক্ষতাও অর্জন করতে পারবে না”। শুধু তাই নয়, তাঁর বেশকিছু গবেষনার ফলাফল আধুনিক রসায়নের অন্যতম ভিত্তি। গ্যাসের চাপের সাথে আয়তনের সম্পর্কস্থাপনকারী গুরুত্বপূর্ণ বয়েলের সূত্রটি তাঁরই পরীক্ষালব্ধ আবিষ্কার। এইকারনে তাঁকে আধুনিক রসায়নের প্রথম রসয়নবিদ আখ্যায়িত করা যায়। তাঁর সময়ের আলকেমিষ্টগণ বিভিন্ন খনিজ পদার্থ নিয়ে চর্চা করতে করতে রসায়ন শিল্পের বেশ উন্নতি সাধন করেন। এবং সম্ভবত এই সময়েই Alchemy শব্দটি রূপান্তরিত হয়ে Chemistry শব্দটি চালু হয়। এর বাইরেও এন্থনি ল্যাভয়সিয়েকেও রসায়নের অগ্রযাত্রার অন্যতম দিকপাল হিসেবে অভিহিত করা হয়।
ল্যাভয়সিয়ের কাজকর্ম সম্পর্কে আলাদাভাবে কিছুকথা বলতেই হয়। ল্যভয়সিয়ে-ই প্রথম পরিমাপগত রাসায়নিক গবেষনা শুরু করেন। তিনিই সর্বপ্রথম অক্সিজেন এবং হাইড্রোজেন সনাক্ত করেন এবং তাদের নামকরণ করেন। বস্তুর দহনের বিষয়ে তিনি পূর্বোক্ত ফ্লোজিস্টন থিওরিকে (Phlogiston theory) ভুল প্রমাণিত করেন যেখানে ধারনা করা হয় যেকোন দাহ্য বস্তু ফ্লোজিস্টন নামক দ্রব্য ধারন করে; দহনের ফলে সেই বস্তু ফ্লোজিস্টনমুক্ত হয় এবং যতক্ষণ কোনো বস্তুর মধ্যে ফ্লোজিস্টন অবশিষ্ট থাকে ততক্ষণ তার দহন চলতে থাকে। ল্যভয়সিয়ের গবেষণা হতে প্রমাণিত হয় বস্তুর দহনের কারন অক্সিজেন। তিনি অক্সিজেন এবং হাইড্রোজেনের বিক্রিয়ায় পানি তৈরি করেন এবং প্রমাণ করেন যে পানি কোনো মৌলিক পদার্থ নয়। এর আগে কয়েক শতাব্দী ধরে প্রচলিত ছিলো যে, চারটি মৌলিক পদার্থ মাটি, পানি, বায়ু আর আগুনের সমন্বয়ে এই মহাবিশ্ব তৈরি হয়েছে। তাঁর গবেষণার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হলো তিনি পরিমানগত গবেষণার মাধ্যমে দীর্ঘদিনের অনুমান নির্ভর রসায়নের আমূল পরিবর্তন তৈরি করে দেন। তিনি বিক্রিয়ারত বিভিন্ন পদার্থের ভর সূক্ষভাবে নির্নয় করেন এবং ভরের নিত্যতা সূত্র আবিষ্কার করেন। তিনি অন্য গবেষকদের সাথে মিলে বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে চার মৌলিকপদার্থের ধারনা ভেঙ্গে দেন এবং তাঁর জীবদ্দশায় ৫৫ টি মৌলিক পদার্থ সনাক্ত করেন। এসব মৌলিক পদার্থ এবং অন্যান্য অনেক পদার্থের নামকরনে তাঁর অবদান রয়েছে।
ল্যাভয়সিয়ের গবেষণার হাত ধরে রসায়ন আজ আধুনিক পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। আজ আমরা জানি একটি মৌলিক পদার্থের সাথে অপর মৌলিক পদার্থের পার্থক্যটি ঠিক কোথায় এবং এটিও জানি, স্বাভাবিক রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে এক মৌলিক পদার্থকে অন্য মৌলিক পদার্থে রূপান্তর করা সম্ভব নয়। এর মানে হচ্ছে রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় সীসাকে সোনায় পরিণত করা সম্ভব নয়। তবে বিংশ শতাব্দীর শুরুতে সত্যিই একজন আলকেমিস্টের আবির্ভাব ঘটেছিলো যিনি কৃত্রিম পদ্ধতিতে এক মৌলিক পদার্থকে অন্য মৌলিক পদার্থে রূপান্তর করে দেখিয়েছেন। তাঁর নাম আর্নেষ্ট রাদারফোর্ড। রাডারফোর্ডকে মানব ইতিহাসের প্রথম প্রকৃত আলকেমিষ্ট হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। রাদারফোর্ড পরমানুর নিউক্লিয়াসের উপস্থিতি প্রথম সনাক্ত করেন এবং এরই ধারাবাহিকতায় আমরা জানতে পারি মূলত পরমানুর নিউক্লিয়াসে অবস্থানরত প্রোটনের সংখ্যার তারতম্যের কারনেই মৌলিক পদার্থগুলোর রসায়নিক ধর্ম ভিন্ন হয়। তিনি এই ঘটনা উপলব্ধি করে নাইট্রোজেনের পরমানুর মধ্য দিয়ে তেজষ্ক্রিয় আলফা কণিকার বিচ্ছুরণ ঘটান এবং নাইট্রোজেনের নিউক্লিয়াসে অবস্থিত প্রোটনের সংখ্যাকে বদলে দিয়ে তাকে অক্সিজেনে রূপান্তর করেন। আলফা কণিকাকে প্রথম প্রকৃত পরশ পাথর (Philosopher’s stone) বলা যায়!
রাদারফোর্ডের গবেষণার পথ ধরে নিউক্লিয়ার পদার্থবিদ্যার উদ্ভব ঘটে এবং এক মৌলিক পদার্থকে অপর মৌলিক পদার্থ পরিণত করার বিদ্যা মানুষের আয়ত্বে আসে। অদ্যাবধি সীসাকে সোনায় রূপান্তর যদিও সম্ভব হয় নি, তবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রসরতার সাথে সাথে সেই সম্ভাবনা দিন দিন উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হচ্ছে।
-ইমতিয়াজ আহমেদ
সম্পাদক, বিজ্ঞান পত্রিকা
[ফেসবুক প্রোফাইল]
বিজ্ঞান পত্রিকা প্রকাশিত ভিডিওগুলো দেখতে পাবেন ইউটিউবে। লিংক:
১. টেলিভিশনঃ তখন ও এখন
২. স্পেস এক্সের মঙ্গলে মানব বসতি স্থাপনের পরিকল্পনা
3. মাইক্রোস্কোপের নিচের দুনিয়া