মাধ্যমিকের রসায়ন বই পাঠকরা সবাই জানেন, হিলিয়াম একটি নিস্ক্রিয় গ্যাস। পর্যায় সারণির অষ্টম গ্রুপের (আধুনিকতম পর্যায় সারণির ১৮ নম্বর গ্রুপের) মৌল গুলোকে নিস্ক্রিয় বা অভিজাত গ্যাস বলা হয়। এই মৌলগুলোর মূল বিশেষত্ব হচ্ছে, এরা সাধারণত কোন ধরনের রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অংশ নেয় না। কারণ এদের সর্ববহিস্থ শক্তিস্তরের ইলেকট্রন বিন্যাস স্থিতিশীল। ফলে এরা ইলেকট্রন গ্রহন, বর্জন বা শেয়ার- কিছুই করতে পারে না। তাই প্রচলিত তত্ত্ব অনুসারে, হিলিয়াম অন্য কোন মৌলের সাথে যুক্ত হয়ে একটি সুস্থিত যৌগ গঠন করতে পারে না।
অন্যান্য কিছু নিস্ক্রিয় গ্যাস প্রচণ্ড চাপে যৌগ গঠনের প্রবণতা দেখালেও এত দিন হিলিয়াম গ্যাস তার আগের অবস্থান ধরেই রেখেছিল। তবে সম্প্রতি তার এই অনড় অবস্থানের অবসান ঘটেছে। কারণ বিজ্ঞানীদের দাবি, তাঁরা গবেষণাগারে সোডিয়াম ও হিলিয়ামের একটি স্থিতিশীল যৌগ সফলভাবে তৈরি করেছেন। তাদের এই আবিষ্কার রসায়ন বিজ্ঞানের বেশ কিছু মৌলিক ধারণাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে।
রসায়নের কিছু প্রাথমিক জ্ঞান আবার ঝালিয়ে নিলে পাওয়া যায়, প্রাচুর্যের দিক থেকে মহাবিশ্বে হাইড্রোজেনের পরেই হিলিয়ামের অবস্থান। এটি পর্যায় সারণিতে ৬ সদস্য বিশিষ্ট একটি ব্যাতিক্রমধর্মী গ্রুপের অন্তর্গত। এদেরকে সম্মিলিতভাবে নিস্ক্রিয় বা অভিজাত গ্যাস বলে। রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অনাগ্রহ দেখানোর জন্যই এমন নামকরণ করা হয়েছে। তবে অভিজাত নামধারী হলেও গ্রুপের কিছু সদস্য কোন চরম শর্তাধীন অবস্থায় রাসায়নিক বিক্রিয়ার কিছুটা প্রবণতা দেখায়। তাই নিস্ক্রিয় গ্যাসকে আবার সক্রিয়তার ভিত্তিতে ২ ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে ক্রিপ্টন, জেনন ও রেডনকে অপেক্ষাকৃত সক্রিয় এবং আর্গন, নিয়ন ও হিলিয়ামকে অপেক্ষাকৃতভাবে নিস্ক্রিয় গ্যাস হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
গবেষকরা এর আগেও হিলিয়াম গ্যাসকে বিভিন্ন মৌলের সাথে বন্ধনে আবদ্ধ করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তাঁরা খুব বেশি সুবিধা করে উঠতে পারেননি।
হিলিয়ামের এই নিস্ক্রিয়তার জন্য এর শক্তিস্তরের ইলেকট্রনবিন্যাস মূল ভূমিকা পালন করে। এর পারমাণবিক সংখ্যা ২। ফলে এর ইলেকট্রন সংখ্যাও ২। এই ২ টি ইলেকট্রন হিলিয়াম পরমাণুর প্রথম শক্তিস্তরে অবস্থান করে। যেহেতু ১ম শক্তিস্তর সর্বোচ্চ ২ টি ইলেকট্রন ধারণ করতে পারে, তাই এর কক্ষপথ ইলেকট্রন দ্বারা পুরোপুরি পূর্ণ থাকে, যার কারণে ইলেকট্রনের আদান-প্রদান বা শেয়ারিং কোনটাতেই হিলিয়ামের পরমাণু আগ্রহ দেখায় না। অন্যান্য নিস্ক্রিয় গ্যাসের পরমাণুতে ফাঁকা অরবিটাল থাকার কারণে উত্তেজিত অবস্থায় ইলেকট্রনগুলো সেই অরবিটালে প্রবেশ করে। ফলে সেই ইলেকট্রনগুলোর পক্ষে বন্ধনে অংশ নেয়াটা সহজ। তবে হিলিয়ামের ক্ষেত্রে ফাঁকা অরবিটাল না থাকায় ইলেকট্রন কোথাও যেতে পারে না। ফলে রাসায়নিক বন্ধন গঠন করা তার পক্ষে প্রায় অসম্ভব।
তবে অন্য কোন মৌলের সাথে হিলিয়ামের যুক্ত হবার সম্ভাবনা নেই- তা কিন্তু নয়। কারণ হিলিয়াম সহ যত ধরনের মৌলিক পদার্থ আছে, তাদের পরমাণুতে ভ্যান ডার ওয়ালস নামে এক ধরনের মৃদু আকর্ষনবল বিদ্যমান রয়েছে। ফলে অতি নিম্ন তাপমাত্রায় হিলিয়াম ভ্যান ডার ওয়ালস অণু তৈরি করতে সক্ষম। এই অণুতে হিলিয়ামের পরমাণু খুবই দুর্বলভাবে একে অপরের সাথে যুক্ত থাকে। তবে এই আকর্ষণ বল বেশি সময় স্থায়ী হয় না। ফলে সেটি স্থিতিশীল যৌগ তৈরি করতে পারে না।
শুধুমাত্র পৃথিবী পৃষ্ঠে করা বিভিন্ন পরীক্ষণের দ্বারা বিজ্ঞানীরা হিলিয়াম সম্পর্কে এই মতবাদ দিয়েছিলেন। কিন্তু এই মহাবিশ্বে হিলিয়ামের আধিক্য এবং নক্ষত্র ও গ্যাস সমৃদ্ধ গ্রহ সৃষ্টিতে এর ভূমিকা গবেষকদের পুনরায় ভাবিয়ে তোলে। তারা ধারণা করেন, মহাশূন্যে এবং পৃথিবীর গভীরে হিলিয়াম হয়ত ভিন্ন কোন রূপে থাকতে পারে। এই প্রসঙ্গে গবেষক দলের সদস্য অ্যালেক্স বোলডিরেভ বলেন, “বৃহৎ গ্রহ-নক্ষত্র অথবা পৃথিবীর কেন্দ্রের প্রচণ্ড চাপে হিলিয়ামের রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য পরিবর্তিত হতে পারে।“
বিজ্ঞানীরা প্রথমে তাত্ত্বিকভাবে গবেষণার জন্য কেলাসের গঠন অনুমানকারী কম্পিউটার মডেল ব্যাবহার করেন। এই মডেল ব্যাবহার করে তাঁরা নিশ্চিত হন, প্রচণ্ড চাপে হিলিয়াম ও সোডিয়ামের পক্ষে মিলিতভাবে একটি স্থিতিশীল যৌগ তৈরি করা সম্ভব। এরপর তাঁরা এটি ভৌতভাবে তৈরি করার পরিকল্পনা করেন। প্রচণ্ড চাপ তৈরির জন্য তাঁরা ডায়মণ্ড অ্যানভিল সেল নামক চাপ সৃষ্টিকারী যন্ত্র ব্যাবহার করেন। এই যন্ত্র দ্বারা তাঁরা সোডিয়াম ও হিলিয়ামের পরমাণুর উপর পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলীয় চাপের ১.১ মিলিয়ন গুণ (১১৩ গিগা প্যাসকেলের অধিক) চাপ প্রয়োগ করেন। আর এই অত্যাধিক চাপের ফলেই সোডিয়াম ও হিলিয়ামের পরমাণু একত্রিত হয়ে এক বিস্ময়কর যৌগের জন্ম দেয়। এর রাসায়নিক সংকেত Na2He।
গবেষনার ফলস্বরূপ বিজ্ঞানীরা অনুমান করছেন,সোডিয়াম খুব সহজেই হিলিয়ামের সাথে যুক্ত হয়ে Na2He তৈরি করতে পারবে। তবে যৌগটি স্থিতিশীল করতে হলে এটি উৎপাদনে যে পরিমাণ চাপ প্রয়োজন, তার চেয়ে ১০ মিলিয়ন গুণ বেশি চাপ প্রয়োগ করতে হবে।
তবে আশ্চর্যের বিষয় হল, যৌগটিতে পরমাণুগুলো কোন রাসায়নিক বন্ধনের দ্বারা যুক্ত হয়নি বলে বিজ্ঞানীরা মনে করে করছেন। আরেক গবেষক চীনের নানকাই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জিয়াও ডং বলেন, আবিষ্কৃত যৌগটি বেশ অদ্ভুত। হিলিয়াম গ্যাসের পরমাণু সাধারণত কোন রাসায়নিক বন্ধন গঠন করে না। তবে যৌগটিতে এর অবস্থানের ফলে সোডিয়াম পরমাণুর বেশ কিছু মৌলিক পরিবর্তন দেখা যায়। হিলিয়ামের উপস্থিতিতে ইলেকট্রনগুলো যৌগের ঘনকীয় কাঠামোর মাঝে ফাঁকা শূন্য স্থানগুলোতে অবস্থান করে। ফলে সেগুলো কাঠামো ছেড়ে মুক্ত হতে পারে না। আর এই কারণেই যৌগটি বিদ্যুৎ অপরিবাহী। তবে যৌগটিতে আয়নিক বা সমযোজী- কোন ধরনের প্রকৃত রাসায়নিক বন্ধনের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাই যৌগটির বিভিন্ন অজানা রহস্য উদ্ঘাটনে আরও পরীক্ষা নিরীক্ষার প্রয়োজন রয়েছে। Na2He এর কেলাসের গঠন নিচে কয়েকটি চিত্রের সাহায্যে বর্ণনা করা হল ।
২০১৭ সালের শুরু থেকেই রসায়নের বিভিন্ন মৌলিক ধ্যান ধারণা যেন পাল্টে যাচ্ছে। গত জানুয়ারি মাসেই বিজ্ঞানীরা ধাতব হাইড্রোজেন ও ৬ যোজনী বিশিষ্ট কার্বন পরমাণুর সন্ধান পান। এবার খুঁজে পেলেন হিলিয়ামের স্থিতিশীল যৌগ। সামনে হয়ত আরও অনেক চমক অপেক্ষা করছে। [ Science Alert এবং Chemistry World অবলম্বনে]
-নাসরুল্লাহ মাসুদ