[বইটির সূচীপত্র এবং সব খন্ডের লিংক একত্রে দেখুন এখানে]
বিজ্ঞানীরা বর্ণালীকে দুই ভাগে ভাগ করে ফেললেন। নিরবিচ্ছন্ন বর্ণালী ও রেখা বর্ণালী। নিবিচ্ছিন্ন বর্ণালী হলো তাপীয় বর্ণালী। কঠিন বস্তুকে উত্তপ্ত করলে তা থেকে বিকিরণ নিঃসরণ করে। এসব বর্ণালীতে সবগুলো তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের বর্ণ থাকে। কেনো বিভাজন রেখা থাকে না এসব বর্ণালীতে। তাই এদেরকে বিচ্ছিন্ন বর্ণালী বলে। এরা কিন্তু পারমাণবিক বর্ণলী নয়। তাই নিরবিচ্ছিন্ন বর্ণালী নিয়ে আমরা বেশি কথা বলব না।
নিন্মচাপে গ্যাসের ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত করলে গ্যাসের অণু-পরমাণুগুলো উত্তেজিত হয়ে ওঠে। এসব উত্তেজিত পরমাণু বিকিরণ নিঃসরণ করে। তবে এ ধরনের বিকিরণ সব তরঙ্গ দৈর্ঘ্যরে বিকিরণ নিঃসরণ করতে পারে না। তাই এ ধরনে বর্ণালীতে বিচ্ছিন্ন রেখা দেয়। এজন্য এদেরকে বিচ্ছিন্ন বর্ণালী বলে। এদের নিয়েই আমাদের যত কারবার। সুতরাং এদের ঠিকুজি-কোষ্ঠি জেনে নেওয়া জরুরি।
একটা মৌলিক পদার্থের সবগুলো পরমাণুই একই ধরনের রেখা বর্ণালী তৈরি করে। আবার একটা মৌলের পরমাণু একটা রঙের বর্ণালী তৈরি করবে তা কিন্তু নয়। একটা পরমাণু একাধিক রঙের বর্ণালী তৈরি করতে পারে। এক মৌলের বর্ণালীর সাথে অন্য মৌলের বর্ণালী হুবহু মেলে না। কয়েকটা রেখা হয়তো মিলতে পারে। রেখা বর্ণালীর এই বৈশিষ্ট্যলো ম্যাক্সওয়েল লক্ষ্য করেছিলেন। লক্ষ্য করেছিলেন বোলৎজম্যানও। তবে এটা নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী জোসেফ নরম্যান লকইয়ার। ১৯৭৪ সালে। তিনিই মূলত রেখা বর্ণালীর বৈশিষ্ট্যগুলো লিপিবদ্ধ করে যান।
আমরা বলেছি, হ্যানস হ্যানসেন, বোরকে বামার সিরিজের কথা জানিয়েছিলেন। কিন্তু বামার সিরিজ কীভাবে এলো সেটাও জানা দরকার। জোহান জ্যাকব বামার ছিলেন সুইজ্যারল্যান্ডের নামকরা গণিতবিদ। তিনি গণিত পড়াতেন একটা স্কুলে। আবার ছিলেন একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের খন্ডকালীন শিক্ষকও। এক সহাকর্মী তাঁকে হাইড্রেজন পরমাণুর চারটি বর্ণালী রেখার খোঁজ দেন। উত্তেজিত হাইড্রেজেন পরমাণু যে বিকিরণ নিঃসরণ করে তা থেকেই তৈরি হয় এই চারটি বর্ণালী রেখা। লাল, সবুজ, নীল ও বেগুনী। ১৮৫০ সালে এই রেখা আবিষ্কার করেন সুইডিশ বিজ্ঞানী অ্যান্ডার্স জোনস অ্যাংস্ট্রম। নামটা চেনা চেনা লাগছে? আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্যরে খুব ক্ষুদ্র এককের নাম অ্যাংস্ট্রম। ওই বিজ্ঞানীর নামানুসারেই। তো অ্যাংস্ট্রম হাইড্রোজেন বর্ণালীর চারটি রেখার তরঙ্গ দৈর্ঘ্যও মাপতে সক্ষম হলেন। তিনি হাইড্রোজেন বর্ণালী চারটি বর্ণেরই নামকরণ করলেন। লাল বর্ণের রেখাটির নাম দিলেন
এত কিছু করলেন অ্যাংস্ট্রম কিন্তু এই রেখাগুলোর জন্য কোনো গাণিতিক সমীকরণ তৈরি করে যেতে পারেননি। বন্ধুর কথা শুনে সেই কাজেই হাত লাগালেন বামার। তিনি গাণিতিক সূত্র তৈরি করলেন এদের জন্য। সেই সূত্রের সাহায্যে ফের তরঙ্গ দৈর্ঘ্য বের করলেন রেখাগুলোর। আশ্চর্যের বিষয়, চারটি রেখার জন্য অ্যাংস্ট্রম যে যে তরঙ্গ দৈর্ঘ্য পেয়েছিলেন, বামার সেই মানই পেলেন। একচুলও এদিক-ওদিক হলো না। তারপর থেকে ওই রেখাগুলোর সাধারণ নাম হয়ে গেল বামার সিরিজ।
বামারের সমীকরণের আদলে আরেকটি সমীকরণ তৈরি করেন আরেক সুইডিশ বিজ্ঞানী জোহান রবার্ট রিডবার্গ। এজন্য তিনি একটা ধ্রুবকের আশ্রয় নেন। সেই ধ্রবকের নামকরণ হয়ে যায় তাঁর নামানুসারে রিডবার্গ ধ্রুবক। রিডবার্গ সমীকরণের সুবিধা হলো, শুধু ওই চারটি বর্ণলীর তরঙ্গ দৈর্ঘ্যই নয়, যেকোনো দৃশ্যমান বর্ণালীর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য নির্ণয় করা যায়।
বামার কিংবা রিডবার্গের সমীকরণেও কিন্তু সীমাবদ্ধতা রয়ে গেল। আগে আমরা দৃশ্যমান বর্ণালীর কথাই শুধু জানতাম। কিন্তু দৃশ্যমান বর্ণালীর বাইরেও তো আলো রয়েছে। সেসব আলো আলো দেখতে পাই না আমরা। যেমন লালের চেয়ে বেশি তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের আলো হচ্ছে অবলোহিত রশ্মি, বেতার তরঙ্গ ইত্যাদি। তেমনি অতি বেগুনি রশ্মি, গামা রশ্মি ইত্যাদি আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য বেগুনি আলোর চেয়ে কম। এখন যদি কোনো পরমাণু অতিবেগুনী কিংবা অবলোহিত রশ্মি বিকিরণ করে তাহলে তাদের জন্য বর্ণালী সূত্র কেমন হবে? বামার কিংবা রিডবার্গ সমীকরণের সাহায্যে সেগুলোর ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। দৃশ্যমান আলোর বাইরের অঞ্চলের বর্ণালীর ব্যাখ্যার জন্য বেশ কয়েকটি সমীকরণ আবিষ্কার করেন বিজ্ঞানীরা। যুক্তরাষ্ট্রের পদার্থবিদ থিওডর লাইম্যান জন্ম দেন লাইম্যান সিরিজের। এই সমীকরণের সাহায্যে অতি বেগুনি রশ্মি অঞ্চলের বর্ণালীর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য নির্ণয় করা সম্ভব হলো। প্যাশেন সিরিজ নামের আরেক ধরনের সমীকরণ আবিষ্কার করলেন জার্মান বিজ্ঞানী ফ্রেডেরিখ প্যাশেন। তাঁর সমীকরণ দিয়ে অবলোহিত অঞ্চলের বর্ণালী রেখার তরঙ্গ দৈর্ঘ্য বের করা যায়। এছাড়াও অবলোহিত অঞ্চলের বর্ণালী রেখাগুলোর ব্যাখ্যার জন্য আরো দুটি সমিকরণ আবিষ্কার হয়। একটা ব্রাকেট সিরিজ, এর আবিষ্কর্তা যক্তরাষ্ট্রের পদার্থবিদ ফ্রেডেরিখ ব্রাকেট। অন্যদিকে হারম্যান ফান্ড আবিষ্কার করেন ফান্ড সিরিজ।
রিডবার্গ সমীকরণকে একটু অন্যভাবে ব্যবহার করেন সুইস বিজ্ঞানী ওয়ালথার রিৎজ। তিনি তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের বদলে বর্ণালীর কম্পাঙ্ক নির্ণয়ের একটা সমীকরণ দাঁড় করালেন। সমীকরণের নাম দেওয়া হয় রিডবার্গ-রিৎজ সমীকরণ।
মোটামুটি এগুলোই ছিল বর্ণালীবিজ্ঞানের গাণিতিক সূত্র। সেই সূত্রের দিকেই হাত বাড়ালেন বোর। তার পরমাণু মডেলে সংশোধন আনলেন। ইলেকট্রন এক শক্তিস্তর থেকে লাফ দিয়ে যখন আরেকটি শক্তিস্তরে যায় তখন যে শক্তি শোষণ অথবা নিঃসরণ করে তার মান প্ল্যাঙ্ক-আইনস্টাইনের কোয়ান্টাম তত্ত্ব থেকে বের করা যায়। সেটা
বোর বললেন, ইলেকট্রন যখন উচ্চ শক্তিস্তর থেকে নিন্ম শক্তিস্তরে যায় তখন শক্তি হিসেবে একটা নির্দিষ্ট শক্তির ফোটন নিঃসরণ করে। আবার যখন নিন্ম শক্তিস্তর থেকে উচ্চ শক্তিস্তরে যায় তখন ইলেকট্রন একটা নির্দিষ্ট শক্তির ফোটন নিঃসরণ করে। সেই ফোটনের শক্তি কতটুকু হবে সেটা নির্ভর করবে ফোটন কোন কক্ষপথ থেকে কোন কক্ষপথে লাফ দিচ্ছে তার ওপর। কিন্তু কোনো একটা নির্দিষ্ট কক্ষপথে ফোটন যখন অবস্থান করে তখন কোনো ফোটন শোষণ বা বিকিরণ করে না।
এখন দেখা যাক কোয়ান্টাম লাফের সময় কী পরিমাণ শক্তি ইলেকট্রন শোষণ বা বিকিরণ করে।
ইলেকট্রনের মোট শক্তি ধরা যাক
এখন একটা প্রশ্ন হতে পারে। ইলেকট্রন এক শক্তিস্তর থেকে আরেক শক্তিস্তরে কোয়ান্টাম লাফ দেওয়ার সময় নির্দিষ্ট শক্তির একটাই মাত্র ফোটন শোষণ বা বিকিরণ করে। তারজন্য একটা নির্দিষ্ট তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের বর্ণালী পাওয়ার কথা, কিন্তু হাইড্রোজেন পরমাণুর বর্ণালীতে চারটে রেখা কেন দেখা যায়?
বোর বললেন, উত্তেজিত হাইড্রোজেন পরমাণু নিয়ে গবেষণার সময় সেখানে একটা মাত্র হাইড্র্রোজেন পরমাণু থাকে না। থাকে হাইড্রোজেন গ্যাসের কোনো টিউব। তাতে লক্ষ-কোটি হাউড্রোজেন পরমাণু থাকে। সবগুলো পরমাণু একইভাবে উত্তেজিত নয়। কেনোটা বেশি উত্তেজিত, কোনটার উত্তেজনা কম। তাই সব পরমাণু একই তরঙ্গ দৈর্ঘ্যরে বর্ণালী বিকিরণ করে না। তবে হাইড্রোজেন পরমাণুর ক্ষমতা নেই বামার সিরিজের বাইরে কোনো বর্ণালী বিকিরণ করে। তাই উত্তেজিত সব পরমাণুই চারটি বর্ণালীর যেকোনো একটি বর্ণালী বিকিরণ করে। সবগুলো পরমাণুর বর্ণালী মিলে চারটি বর্ণালী রেখা তৈরি করে।
এভাবেই বোর বামার সিরিজের সাথে তাঁর পরমাণু মডেলের মেলবন্ধন ঘটালেন। ব্যাখ্যা দিলেন হাইড্রোজেন পরমাণুর বামার সিরিজের ব্যাখ্যা। সেই সাথে উত্তর দিলেন বহবছর ধরে না পাওয়া একটা প্রশ্নের। সেটা হলো হাইড্রোজেন পরমাণুর বিকিরণের মূল উৎস কী। সাথে সাথে বামার সিরিজের বর্ণালীকেও কোয়ান্টাম তত্ত্বের আওতায় নিয়ে আসতে সক্ষম হলেন।
[বইটির সূচীপত্র এবং সব খন্ডের লিংক একত্রে দেখুন এখানে]
-আব্দুল গাফফার রনি
বিজ্ঞান লেখক
[লেখকের ফেসবুক প্রোফাইল]