বিজ্ঞান পত্রিকা

মানবসৃষ্ট ভূমিকম্পের কেন্দ্রবিন্দু ওকলাহোমা

ইউ.এস. জিওলোজিক্যাল সার্ভে’র (ইউএসজিএস) প্রতিবেদন অনুসারে, ওকলাহোমা ও তার নিকটবর্তী প্রদেশগুলোতে ধ্বংসাত্মক ভূমিকম্পের আশংকা ভূমিকম্পপ্রবণ ক্যালিফোর্নিয়ার সমান। কিন্তু এজন্য দায়ী কে? ইউএসজিএস’র ভূকম্পবিদদের ভাষ্যমতে, ভূগর্ভস্থ তেল ও গ্যাস উত্তোলনের মতো মানবসৃষ্ট কার্যক্রমই পূর্ব আমেরিকায় এই নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে।

ইউএসজিএস সদ্যই তাদের প্রথম মানচিত্রটি প্রকাশ করেছে যেখানে আসন্ন বছরগুলোতে মানবসৃষ্ট ও প্রাকৃতিক কারণে বিদ্যমান ভূমিকম্প ঝুঁকি চিহ্নিত করা হয়েছে। এখনও পর্যন্ত সরকারী সংস্থাগুলো শুধুমাত্র প্রাকৃতিক ভূমিকম্প ঝুঁকিকে স্বীকৃতি দিচ্ছে। ৫০ বছরের জন্য প্রস্তুতকৃত একটি ভূমিকম্প ঝুঁকির পূর্বাভাসের অংশ হিসেবে থাকা প্রতিবেদন ইঙ্গিত করছে প্রায় ৭০ লাখ মানুষ মানবসৃষ্ট ভূকম্পনের ঝুঁকিতে থাকা এলাকায় জীবন যাপন করছে। মধ্য ও পূর্ব আমেরিকার বেশকিছু অঞ্চলে ভূমিকম্প ঝুঁকির মাত্রা ক্যালিফোর্নিয়াতে প্রাকৃতিক কারণে হওয়া ভূকম্পনগুলোর সমান।

ইউএসজিএস ন্যাশনাল সিসমিক হ্যাজার্ড ম্যাপিং প্রোজেক্টের প্রধান মার্ক পিটারসেন তার বক্তব্যে বলেন, ‘ভূমিকম্পের মানবসৃষ্ট কারণসমূহ বিবেচনায় নিয়ে পরিমাপের পর আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলে বিদ্যমান ভূমিকম্প ঝুঁকি উল্ল্যেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এই গবেষনা আরও নির্দেশ করে দেশটির অনেকাংশই ভয়াবহ ধ্বংসাত্মক ভূমিকম্পের আশংকার মুখে রয়েছে।’

ইউএসজিএস’র মতে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে মধ্য-পুর্ব আমেরিকায় সৃষ্ট ভূমিকম্পের পেছনে মূল কারণ অপরিকল্পিত তরল বর্জ্য নিষ্কাশন। তেল ও গ্যাস উৎপাদন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ভূগর্ভের গভীরে নিঃসৃত করা ক্ষতিকারক পদার্থগুলো এই বর্জ্যের সৃষ্টি করে। এটি ‘হাইড্রোলিক ফ্র্যাকচারিং’ (hydraulic fracturing) প্রক্রিয়া থেকে আলাদা। যা অধিকাংশক্ষেত্রে ‘ফ্র্যাকিং’ (fracking) নামেও পরিচিত। ফ্র্যাকিং প্রক্রিয়াতে পাথুরে ভূপৃষ্ঠ ও ভূগর্ভ ভেঙ্গে তেল-গ্যাস নিঃসরণের লক্ষ্যে পানি, বালু ও অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থ ভূগর্ভস্থ গভীর কূপে পাম্প করা হয়। ইউএসজিএস থেকে বলা হচ্ছে, প্রকৃতপক্ষে অনুভূত ভূমিকম্পের কারণ হিসেবে ফ্র্যাকিং তুলনামুলক অনিয়মিত অনুঘটক। (সাধারণত ফ্র্যাকিং থেকে নিঃসৃত হওয়া তরল বর্জ্য একই কূপে প্রবিষ্ট করানো হয়)। তা সত্ত্বেও তরল বর্জ্য প্রবিষ্ট করানোর প্রক্রিয়া আমেরিকার ছয়টি প্রদেশকে ভূমিকম্প ঝুঁকির আওতায় এনে দিয়েছে। ইউএসজিএস’র প্রতিবেদন অনুসারে সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে ওকলাহোমা এবং এর পরে যথাক্রমে রয়েছে ক্যানসাস, টেক্সাস, কলোরাডো, নিউ মেক্সিকো এবং আরক্যান্সাস। ভূমিকম্প ঝুঁকির কেন্দ্রে থাকা অঞ্চলগুলোর মাঝে ওকলাহোমা ও ক্যানসাস সর্বোচ্চ ঘনবসতিপূর্ণ।

পিটারসেন বলেছেন, ‘গত পাঁচ বছরে এই ছয় প্রদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে উচ্চ ঝাঁকুনি এবং তুলনামূলক অধিক ক্ষয়ক্ষতির প্রমাণ পেয়েছে ইউএসজিএস।’ এছাড়াও, “USGS Did You Feel It?” নামক ওয়েবসাইটে উক্ত ছয় প্রদেশে বাস করা জনগনের কাছ থেকে সহস্রাধিক ভূকম্পনের রিপোর্ট পাওয়া গেছে যার মধ্যে উচ্চমাত্রার ভূকম্পন ও ক্ষয়ক্ষতির ১৫০০ রিপোর্ট রয়েছে।’ উদাহরণস্বরূপ, ১৯৭৩ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর গড়ে ২৪টি ৩.০ অথবা অধিক মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে মধ্য আমেরিকা জুড়ে। কিন্ত ২০০৯ থেকে ২০১৫ সময়কাল পর্যন্ত একই মাত্রার ভূমিকম্পের সংখ্যা গড়ে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩১৮ তে। ২০১৫ সালে ৩.০ কিংবা তারচেয়ে উচ্চমাত্রার ভূমিকম্পের সংখ্যাটি গিয়ে পৌঁছেছে ১,০১০ এ।

ইউজিএস এর সূত্র অনুসারে, এই বছরের মার্চ পর্যন্ত মধ্য আমেরিকায় ৩.০ বা তারচে উচ্চমাত্রার ভূমিকম্পের সংখ্যা ইতোমধ্যে ২২৬ এ পৌঁছে গেছে। সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে সর্বোচ্চ মাত্রার ভূমিকম্পটি ঘটে ২০১১ সালে, ওকলাহোমার প্রাগে। ৫.৬ মাত্রার এই ভূমিকম্পটি হয় একটি তরল বর্জ্য নিষ্কাশন সাইটের কাছেই। সব মিলিয়ে, ইউএসজিএস’র গবেষকরা ২১টি অঞ্চল চিহ্নিত করতে পেরেছেন যেখানে মানবসৃষ্ট ভূকম্পনের হার ক্রমবর্ধমান। আলাবামা এবং ওহাইয়োর মতো কিছু অঞ্চল অতীতে মানবসৃষ্ট ভূমিকম্প অনুভব করেছে কিন্তু তুলনামূলক ভাবে আসন্ন বছরগুলোতে কম ঝুঁকিতে রয়েছে কারণ যেসব কার্যক্রমের ফলে এই ভূমিকম্পগুলো হয়েছিল তা উল্ল্যেখযোগ্যভাবে হ্রাস করে ফেলা হয়েছে।

কিন্তু আলাবামার অন্যান্য অঞ্চলসমূহ ও মিসিসিপির কিছু অংশে এই ধরণের কার্যক্রম বৃদ্ধি পেতে দেখা যাচ্ছে। গবেষকরা এখনও নিশ্চিত করার চেষ্টা করছেন এই অঞ্চলের ভূমিকম্পের পেছনে প্রাকৃতিক কারণই মুখ্য নাকি তা মানবসৃষ্ট। বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়েছেন ভূমিকম্পের সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে উত্তর-মধ্য ওকলাহোমা এবং সর্বদক্ষিণ ক্যানসাস। বিজ্ঞানীদের হিসেব অনুসারে এই অঞ্চলগুলোতে এ বছরই উচ্চমাত্রার কম্পনসহ ভূমিকম্প হবার সম্ভাবনা ১০ থেকে ১২ শতাংশ। মোডিফায়েড মার্কেলি (এমএফ) ইন্টেন্সিটি স্কেলে এই ভূমিকম্পের মাত্রা হতে পারে ৬ অথবা তার অধিক। অর্থাৎ, এই ভূকম্পন সহজেই অনুভূত হবে তবে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি নাও হতে পারে। এমএফ স্কেলের এই মাত্রা (৬) রিখটার স্কেলে ৫.০ মাত্রাকে নির্দেশ করে।

যদিও বিজ্ঞানীদের মাঝে এ বিষয়ে দ্বিমত রয়েছে যে প্রাকৃতিক কারণে বড় মাত্রার ভূমিকম্প হয় না তরল বর্জ্য ভূমির গভীরে নিঃসরণের মতো মানবসৃষ্ট কার্যক্রমের ফলে। ইউএসজিএস’র মতে, যদি মধ্য-পূর্ব আমেরিকার অঞ্চলগুলোতে কখনো একটি বড় মাত্রার ভূকম্পনের ঘটনা সত্যিই ঘটে তা হাজারো ফল্ট লাইন বিচ্যুত করায় ভূমিকা রাখতে পারে। আরও উদ্বেগের বিষয় হলো মানবসৃষ্ট ভূমিকম্পগুলো আসে একরাশ ছোট ছোট ভূমিকম্পের সমন্বিত রুপে এবং ভূগর্ভের বেশ অগভীরে যা প্রবলভাবে অনুভূত হবার এবং ক্ষতিসাধনের সম্ভাবনা তুলনামূলক বেশী।

ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে থাকা অঞ্চলগুলোতে কীভাবে নিরাপদে দালানকোঠা ডিজাইন করা যায় সেই বিষয়ে ভূমিকম্প সংক্রান্ত নতুন রিপোর্টটি প্রকৌশলীদের সাহায্য করবে। ভুমিকম্প ঝুঁকি সম্বলিত স্থানগুলোতে বসবাসকারীরা নিরাপত্তামূলক পদক্ষেপ সম্পর্কে   এর তথ্যসমূহ পড়তে পারবেন।

⚫ অলি আহমেদ

Exit mobile version