বিজ্ঞান পত্রিকা

রহস্যময় ভ্রাম্যমান পাথরের রহস্য উন্মোচিত এক শতাব্দীব্যাপী গবেষনার পর!

ক্যালিফোর্নিয়ার ডেথ ভ্যালি ন্যাশনাল পার্কের সমতল ভুমিতে কিছু পাথর দেখা যায় যেগুলো কোনো রকম মানুষ বা প্রানীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই একস্থান থেকে অপর স্থানে ঘুরে বেড়ায় এবং এদের যাওয়ার পথে ভুমিতে চিহ্নরেখা রেখে যায়! এধরনের আচরণের কারনে পাথরগুলোকে sailing stone, sliding stone বা gliding stone (পিছলে যাওয়া পাথর) বলা হয়। চিহ্নরেখাগুলো পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় এদের গতিপথ নিজে নিজে পরিবর্তিত হয়েও যেতে পারে। তবে এই সরণ চোখে পর্যবেক্ষণ করা দুঃসাধ্য কেননা পাথরগুলো অধিকাংশ সময়ই (বছরাধিক কালও হতে পারে) স্থির থাকে এবং হঠাৎ হঠাৎ কয়েক সেকেন্ডের জন্য সচল থাকে।

যেসব পাথরের তলা অমসৃণ সেগুলো সাধারণত একটি খাঁজকাটা পথরেখা এঁকে সোজা পথে চলে যায়। তবে মসৃণ পাথরগুলোর গতিপথ যত্রতত্র পরিবর্তিত হতে দেখা যায়। গতিপথ দৈর্ঘ্যে এবং দিকে উভয় ক্ষেত্রেই পরিবর্তিত হয়। একই সাথে যাত্রা শুরু করা দুটি পাথর কিছুটা পথ সমান্তরালে চলে পরবর্তীতে যেকোনোটি ডানে, বাঁয়ে এমনটি পেছনেও সরে আসতে পারে। এদের পথের দৈর্ঘ্যেও পরিবর্তন দেখা যায়। একই আকারের দুটি পাথর হয়তো কিছু সময় একই গতিতে চলল, পরে দেখা যায় একটি বেশী এগিয়ে গেছে, আরেকটি কম।

গত এক শতাব্দী যাবৎ গবেষকরা এই ঘটনার ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। স্লাইডিং পাথরগুলোর বিষয় সর্বপ্রথম জনসম্মুখে প্রতিবেদন তুলে ধরা হয় ১৯১৫ সালে। পরবর্তী বেশ কিছু বছরে এই ঘটনা ভূতাত্তিকদের আগ্রহের কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং  ১৯৪৮ সাল নাগাদ আমেরিকার বৈজ্ঞানিক জার্নালে স্থান পায়। এই গবেষণাপত্রে পাথর পিছলে যাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা না করতে পারলেও এই উপত্যাকার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য যেমন: বায়ু প্রবাহ, মাটির প্রকৃতি ইত্যাদি বর্ণনা করা হয় এবং পাথরগুলো ঠেলে সরানোর পেছনে শক্তিশালী বায়ুপ্রবাহের ভুমিকার প্রভাব থাকতে পারে বলে অনুমান করা হয়।

রহস্যময়তা বিবেচনা করে এই ধরনের ঘটনা অন্যত্র ঘটে কিনা সেই বিষয়ে অনুসন্ধান করা হয় এবং নেভাডা অঙ্গরাজ্যের লিটল বনি ক্লেয়ার প্লায়াতে একই ধরনের পরিস্থিতি খুঁজে পাওয়া যায়।

তবে ওই সময় পর্যন্ত পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য বা প্রমাণিত কোনো ঘটন-কৌশল পাওয়া যায় নি। সর্বশেষ ধারনা অনুযায়ী পাথরগুলোর নিচে শিশির জনিত কারনে এবং নিন্মতাপমাত্রায় পাতলা বরফের আচ্ছাদন তৈরি হয় যা একে ভুমি সাপেক্ষে পিচ্ছিল করে তোলে এবং বায়ু প্রবাহ এদেরকে কিছুটা স্থানান্তরিত করে দেয়।

১৯৭২ সালে বব শার্প এবং ডুইট ক্যারে পাথর সরে যাওয়া পর্যবেক্ষণ করার সিদ্ধান্ত নেন এবং পর্যায়ক্রমে ৩০ টি নতুন ট্র্যাক বা পথ সনাক্ত করেন। এগুলোকে ল্যাবেলিং করে সূচনা ও শেষ বিন্দু ইত্যাদি নিরুপন করা হয় এবং নানাবিধ বৈশিষ্ট্য লিপিবদ্ধ করা হয়। পাথরগুলোকে শীতকালেই ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায়। গ্রীষ্মকালে প্রবাহিত হয়েছে এমন কোনো নজির তাঁরা খুঁজে পান নি। এইগুলো কৃত্রিমভাবে সরানোর সম্ভাবনাও নাকচ করে দেওয়া হয়, কেননা মানুষের আনাগোনার কোনো ছাপ আবিষ্কৃত হয় নি।

নব্বইয়ের দশকেও এই পাথরগুলো নিয়ে ব্যাপক গবেষনা চলে। পদার্থবিদ বেকন এবং তাঁর সহকর্মীবৃন্দ ১৯৯৬ সালে গবেষণায় খুঁজে পান ভূমিরূপের কারনে এই উপত্যাকার সমতলে বায়ু প্রবাহ ঘনীভূত হয়ে উঠতে পারে। এবং সমতলের সংযোগস্থলটি (বাতাস এবং ভুমির ব্যবধান) কেবলমাত্র ২ ইঞ্চি পুরু হতে পারে এবং পাথরগুলো তীব্র বাতাসের আঘাতের মুখে পড়তে পারে। শীতকালের ঝড়োবাতাসের এই বেগ ঘন্টায় ১৪০ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে। কিন্তু এই তীব্র বাতাসও ভারী পাথরকে ঠেলে সরিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। সেই কারণে অনুমান করে নেওয়া হয়, শীতকালে পাথর আর মাটির সংযোগস্থলে পাতলা ও পিচ্ছিল বরফের আবরণ তৈরি হয় যা এই পাথরগুলোকে পিছলে যেতে সাহায্য করে।

২০০৯ সালে প্রথমবারের মতো এই পাথরগুলোর গড়িয়ে যাওয়ার ঘটনা ক্যামেরায় ধারণ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর আগে গবেষণা চালানো হলেও পাথর গড়ানোর দৃশ্য ধারণ করা সম্ভব হয় নি। বেশ কিছু ক্যামেরা উপত্যকায় নানা ভাবে তাক করে রাখা হয়। এটি অত্যন্ত দুঃসাধ্য একটি কাজ। কেননা, ধারনা অনুযায়ী পাথরগুলো তিনবছরে একবার মাত্র গতিশীল হয় এবং এই গতি কেবল ১০ সেকেন্ডের মতো স্থায়ী হয়। ক্যামেরাগুলোর সাথে সেন্সর যুক্ত করা হয় যেন তীব্র বাতাসে এবং পাথরের চলমান অবস্থাতেই এগুলো ভিডিও রেকর্ড করে।

অবশেষে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে জিপিএস এবং টাইম ল্যাপ্স ফটোগ্রাফির মাধ্যমে গবেষকগণ প্রথমবারের মতো পাথরগুলোর চলাচল সরাসরি পর্যবেক্ষণ করেন। ২০১৪ সালের জানুয়ারী পর্যন্ত প্রায় ৬০ টি পাথরের বিভিন্ন দিকের এবং বেগের গতি শনাক্ত করা হয়, যার মধ্যে কিছু পাথর ২২৪ মি পর্যন্ত চলাচল করেছে। এই পর্যবেক্ষণ এর আগের ধারণাগুলোকে বাতিল করে দেয়।

গবেষণায় দেখা যায় শীতকালের জমে যাওয়া বরফে এই এলাকায় ক্ষণস্থায়ী পুকুর সৃষ্টি হয়। দিনের বেলায় পুকুরের কিছু কিছু বরফ গলে গিয়ে বরফের ভেলা তৈরি হয় যা গলে যাওয়ার বরফের পানিতে ভেসে বেড়ায়। এই বরফের ভেলাগুলো বাতাসের প্রবাহে প্রবাহিত হয় এবং পাথরগুলোকে ধাক্কা দিয়ে এদের সচল করে। মিনিটে একটি পাথর প্রায় ৫ মিটার পর্যন্ত সরে যেতে পারে বরফের ধাক্কায়। এধরনের ধাক্কা ১৬ মিনিট পর্যন্ত প্রযুক্ত হওয়ার রেকর্ড করা হয়েছে জিপিএসের মাধ্যমে।

অনেকের কাছেই পাথরগুলো সংগ্রহযোগ্য। ২০১৩ সালের ৩০ মে লসএঞ্জেলেস টাইমে ডেথ ভ্যালি ন্যাশনাল পার্কের বেশ কিছু গড়িয়ে যাওয়া পাথর চুরি যাওয়ার রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে।

-ইমতিয়াজ আহমেদ
সম্পাদক, বিজ্ঞান পত্রিকা
[লেখকের ফেসবুক প্রোফাইল]

Exit mobile version