বিজ্ঞান পত্রিকা

জয়-পরাজয়ে রংয়ের ভূমিকা

এশিয়া কাপ ক্রিকেটে বাংলাদেশ দলের জার্সি ছিল লাল রঙের। বাংলাদেশের পতাকার রঙের অনুপাতের সাথে একদমই অমিল হওয়াতে, এবং চিরাচরিত সবুজ-প্রধান প্রথার বিপরীতে লাল-প্রধান জার্সি তৈরি করাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবাদের ঝড় বয়ে গিয়েছিল। অনেকেই জার্সির সমর্থনের ব্যাপারে নিজেদের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছেন।

সবুজ রঙটা বাংলার পরিবেশ, মাটি ও মানুষের সাথে মিশে আছে, তাই জন সমর্থনের ব্যাপারে সবুজ রঙ বেশিই প্রাধান্য পাবে। তবে বৈজ্ঞানিকভাবে চিন্তা করলে সবুজ রঙের পোশাকের চেয়ে লাল রঙের পোশাক ব্যবহার করাই বেশি যুক্তিযুক্ত। বেশ কয়েকটি গবেষণা বলছে আপনার পরিধানকৃত পোশাকের রঙ আপনার শারীরিক ও মানসিক পারফরমেন্সের উপর প্রভাব রাখতে পারে। আপনার চিন্তাভাবনা, মধ্যস্থতা করার দক্ষতা, হরমোন লেভেল, এমনকি হৃৎস্পন্দনের হারের উপরও প্রভাব রাখতে পারে পোশাকের রঙ। গবেষণা বলছে পোশাক পরিধানের ধরণ অনুসারে মানবদেহে কিছু জৈবিক ব্যাপার স্যাপার ঘটে যায়। কোনো পোশাক পড়লে নিজের কাছে অস্বস্তি লাগতে পারে, আবার কোনো পোশাক পড়লে নিজেকে নতুন এক উদ্দীপ্ত মানব বলেও মনে হতে পারে। এই ব্যাপারটা নিজেদের পারফরমেন্সের উপরও প্রভাব রাখে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে লাল রঙ কেন প্রভাব রাখার ব্যাপারে অন্য রঙ থেকে বেশি ইতিবাচক হবে? সে প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে মানুষের দীর্ঘকালীন বিবর্তনের ইতিহাসে।

২০০৪ সালের কথা দারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন মনোবিজ্ঞানী রাসেল হিল ও রবার্ট বার্টন খেয়াল করে দেখলেন মানুষের সাফল্যের সাথে রঙের সম্পর্ক রয়েছে। আগ্রহোদ্দীপক হলেও উপযুক্ত পরিবেশ পাচ্ছিলেন না এই ব্যাপারটি পরীক্ষা করে দেখার। রঙ ও সাফল্য সম্পর্কিত এই পরীক্ষাটি করার জন্য দরকার সত্যিকার প্রতিযোগিতার ময়দান। ঘটনাক্রমে তখন ২০০৪ সালের অলিম্পিক খেলার ইভেন্ট। তারা ঐ ইভেন্টে তাদের পরীক্ষাটি করতে চাইলেন এবং সুযোগ পেয়েও গেলেন একদম মোক্ষম পরীক্ষাগার। খেলায় এথলেটদের লাল ও নীল রঙের পোশাক পড়িয়ে খেলতে দেয়া হয়। পরীক্ষাটি এমন সব খেলোয়াড়ের বেলায় করা হয় যাদের প্রতিপক্ষ প্রায় সম বয়সী ও সমান আকার আকৃতির অধিকারী। এই পরীক্ষার ফলাফল থেকে গবেষকরা দেখেন যে লাল রঙের পোশাক পরিধানকারী খেলোয়াড় সাধারণের তুলনায় ৫% বেশি পরিমাণ খেলায় জয়লাভ করেন তাদের ভাষায়, লাল রঙের পোশাক পরিধান করলে তা আপনাকে তা ভালো মানের খেলোয়াড় বা প্রতিযোগী বানিয়ে দিবে না কিন্তু দুজন খেলোয়াড়ই যখন সমমানের হবে তখন লাল রঙ আপনার পাল্লাটা ভারী করতে সাহায্য করবে।

যেকোনো প্রতিযোগিতার বেলাতেই এটি প্রযোজ্য। ক্রিকেট খেলায় নিজের চেয়ে শক্তিশালী দলের বিরুদ্ধে লাল রঙের পোশাক গায়ে চাপিয়ে খেললে হয়তো জয় এনে দেবার সম্ভাবনা বাড়াতে পারবে না, কিন্তু শক্তির দিক থেকে সম পর্যায়ের দলের সাথে খেললে পোশাকের রঙ জয়ের সম্ভাবনা কিছুটা বাড়িয়ে দিতে পারে।

২০০৪ সালের এই রক্তিম লাল রঙের গবেষণা বা শার্লক হোমসের ভাষায় ‘স্টাডি ইন স্কার্লেট’ পরবর্তীতে অন্যান্য অনেক গবেষণার দুয়ার খুলে দিয়েছিল। ফুটবল খেলায় পেনাল্টি শটের চমৎকার একটি গবেষণাতেও এরকম ফলাফলই দেখা যায়। গোল রক্ষকের জার্সির রঙ, যারা পেনাল্টি শট করে তাদের গোল দেবার সফলতার উপর প্রভাব বিস্তার করে। গোল রক্ষক লাল রঙের জার্সি পরিধান করে থাকলে পেনাল্টি শটের সফলতার হার কমে যায়। অর্থাৎ কোনো খেলোয়াড় যদি লাল রঙের পোশাক পরিধান করে তাহলে এই রঙ বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়ের উপর এক অদৃশ্য প্রভাব বিস্তার করে।

প্রতিযোগীরা যখন লাল রঙের পোশাক পড়ে তখন হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায়, টেস্টোস্টেরনের মাত্রা বেড়ে যায় যা পারফরমেন্স ভালো করতে সাহায্য করে। লাল রঙের পোশাক পরিধানকৃত প্রতিযোগী নিজেদের প্রভাবশালী (নেতা!) ভাবতে শুরু করে। লাল রঙ প্রতিপক্ষকে নিজের অজান্তেই ভয় দেখায়। প্রতিপক্ষের বেলায় উল্টোটা ঘটে। আপনি যদি আপনার প্রতিপক্ষকে লাল রঙের পোশাক পরিহিত অবস্থায় দেখেন তাহলে আপনার হৃৎস্পন্দন কিছুটা কমে যেতে পারে, টেস্টোস্টেরনের ক্ষরণও কমে যেতে পারে যা আপনার পারফরমেন্স খারাপ করতে সাহায্য করবে। আপনার অজান্তেই একটা অদৃশ্য ভয় ঢুকে যাবে মনে।

এরকম কঠোর শারীরিক প্রতিযোগিতার খেলার বাইরেও লাল রঙ সাফল্যে প্রভাব বিস্তার করে। ক্যাসিনোতে  যারা লাল রঙের চিপ নিয়ে খেলেন, দেখে গেছে তারা সাদা ও কালো চিপধারীদের তুলনায় বেশি পরিমাণের ‘বেট’ ধরেন লাল রঙ জয়ের প্রতীক। লাল রঙ জুয়াড়ির মনে আত্মবিশ্বাস জন্মায় যে সে জিতবে।

এই দিক থেকে বিবেচনা করলে কোনো ইন্টারভিউতে লাল রঙের পোশাকে গেলে ভালো ফলাফল পাওয়া যেতে পারে। ইন্টারভিউয়ের বেলায় আত্মবিশ্বাস অনেক শক্তিশালী জিনিস। ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ের বেলাতেও লাল রঙ ইতিবাচক হতে পারে। বর্ণ মনোবিজ্ঞানের (color psychology) এক গবেষণায় দেখে গেছে নারী ও পুরুষের কাছে লাল রঙের পোশাক পরিহিত কাউকে অন্য রঙের পোশাকের তুলনায় বেশি দৃষ্টিনন্দন বলে মনে হয় রেস্টুরেন্টে লাল রঙের পোশাক পরিহিত ওয়েট্রেস (নারী) পুরুষদের কাছ থেকে তুলনামূলকভাবে বেশি পরিমাণের টিপস পায়[2] লাল পোশাক পরিহিত নারীরা পুরুষদের কাছ থেকে তুলনামূলকভাবে সহজে ‘লিফট’ পায় পশ্চিমা দেশগুলোতে গাড়ির লিফট দেবার ও নেবার সংস্কৃতি খুব প্রবল।

বিবর্তনের পথে লাল রঙ মানুষের জন্য অনন্য এক আশীর্বাদ। প্রাণের উৎপত্তির অনেক অনেক পরে কিছু কিছু প্রজাতি লাল রঙ দেখার ক্ষমতা অর্জন করে। এমনকি অনেক উন্নত স্তন্যপায়ী প্রজাতি আলাদা করে লাল রঙ দেখতে পায় না। যেমন কুকুর। তারা লাল ও নীল রঙের মাঝে কোনো পার্থক্য করতে পারে না। আমাদের প্রাইমেট পূর্বপুরুষেরা বন জঙ্গলের পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিয়েছিল। বন জঙ্গল হতে পাওয়া পাকা ও কাঁচা ফল মূলের পার্থক্য করতে ধীরে ধীরে চোখের রেটিনায় এমন কিছু কোষ বিবর্তিত হয় যা লাল রঙকে আলাদা করতে পারে।

পাশাপাশি তখনকার সময় থেকেই লাল রঙ অন্য প্রজাতির মাঝে প্রভাব বিস্তার করে আসছে। লালাভ ত্বক, যা চামড়ার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে রক্ত চলাচলের জন্য হয়, অন্যান্য প্রাইমেটকে প্রভাবের অধীনে রাখতে কাজ করে। এর চমৎকার একটি উদাহরণ হচ্ছে ম্যানড্রিল বানর। এই ধরনের বানরের মুখ লাল রঙের হয়ে থাকে। দলের মাঝে কোনো বানর যত বেশি পরিমাণ লাল রঙের অধিকারী হবে, সমস্ত দল তাকে তত বেশি ক্ষমতাবান হিসেবে মেনে নিবে।

রেড এলার্ট! ম্যানড্রিল বানর, এদেরকে কেউ ঘাটাতে চায় না।

আদিম মানুষ যোদ্ধা ছিল। গোত্রে গোত্রে যুদ্ধ লেগেই থাকতো। রক্তের লাল রঙ তখন থেকেই মনে গেথে আছে। সংস্কৃতিতে আধুনিক হয়ে গেলেও রক্তে বহমান আদিমতা এখনো রয়ে গেছে (সূত্র: ভালোবাসা কারে কয়, অভিজিৎ রায়, শুদ্ধস্বর, ২০১২)। পাশাপাশি প্রাইমেট পূর্বপুরুষের লাল রঙ প্রাধান্যের বীজও বয়ে চলছে মানুষের মননে। এই ব্যাপারগুলোর কারণেই হয়তো প্রতিযোগিতার বেলায় মানুষের পারফরমেন্সের উপর প্রভাব বিস্তার করে।

⚫ সিরাজাম মুনির শ্রাবণ

Exit mobile version