বিজ্ঞান পত্রিকা

কোয়ান্টাম ফিজিক্স-২৪ : কোয়ন্টাম বর্ণালী

[বইটির সূচীপত্র এবং সব খন্ডের লিংক একত্রে দেখুন এখানে]

নীলস বোর কোয়ন্টাম তত্ত্ব ব্যবহার করে একটা পরমাণু মডেল দাঁড় করালেন ঠিকই। কিন্তু সেটা অসম্পূর্ণ রয়ে গেল। কারণটা হলো ইলেকট্রনের শক্তি বিকিরণ। বিকিরণ বলতে আমরা আলোকে বুঝি। ইলেকট্রনের শক্তি বিকিরণ ও শোষণের ক্ষেত্রেও নিশ্চয়ই আলোর ভূমিকা আছে। অর্থাৎ শক্তি হিসেবে ইলেকট্রন নিশ্চয়ই আলোক শক্তি বিকিরণ করে। একথাটা বোরের অজানা ছিল না, আগেই সেকথা আমরা বলেছি। আর সেজন্যই তো ঝামেলা সৃষ্টি হয়েছিল। আলো মানেই তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ। আর তুড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ বিকিরণ বা শোষণ মানেই ম্যাক্সওয়েলের তড়িচ্চুম্বকীয় তত্ত্বের আনাগোনা। পরমাণুর ভেতরে ম্যাক্সওয়েল তত্ত্ব এসে কীভাবে ঝামেলা বাঁধাল, বলেছি সে কথাও। তাই বোর কোয়ান্টাম তত্ত্ব ব্যবহার করলেন। বোর দেখালেন, ইলেকট্রন নিউক্লিয়াসের চারপাশে ঘোরার জন্য কেন সব কক্ষপথ ব্যবহার করতে পারবে না। কিন্তু ইলেকট্রন নিজে যে শক্তি বিকিরণ বা শোষণ করছে সেগুলোরও একটা হিল্লে হওয়া দরকার। তখন পর্যন্ত বোর ইলেকট্রনের সেই শক্তিকে গাণিতিক কাঠামোতে রূপ দিতে পারেন নি। এজন্য তাঁর আরো কিছু তথ্যের দরকার ছিল। বিশেষ করে পরমাণু বর্ণালীর ব্যাপারে।

পরমাণু যে আলোক রশ্মি বিকিরণ করে সে ধারণা অনেক পুরোনো। বোর জানতেন তা। কিন্তু সেগুলো নিয়ে কী কী কাজ হয়েছে সে সম্পর্কে তেমন ধারণা ছিল না। বোর তখন কোপেনহেগেনে। স্কুল জীবনে তাঁর এক জুনিয়র বন্ধু ছিল। নাম হ্যানস হ্যানসেন। তিনি জার্মানির গটিংগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। তারপর গবেষণা। তাঁর গবেষণার বিষয় অণু-পরমাণু থেকে নির্গত হওয়া বর্ণালী। হ্যানসেন কিছু দিনের জন্য কোপেনহেগেনে এসেছেন। বোরের সাথে তাঁর প্রায়ই আড্ডা জমে। একদিন বোরকে বললেন পরমাণবিক বর্ণালীর কথা। বললেন, রাদারফোর্ডের মডেলে হয়তো কাজে লাগতে পারে। তিনিই দিলেন বামার সিরিজের হদিস। পারমাণকি বর্ণালীর বিষয়টা আমরাও জেনে নিতে পারি এই ফাঁকে।

আমরা নিউটনের কথা বলেছিলাম একেবারে প্রথম অধ্যায়ে। তিনি সূর্যের সাদা আলোকে প্রিজমের মধ্যে দিয়ে চালিয়ে দেখেছিলেন, সাদা আলো ভেঙে সাতটি রংয়ের বর্ণালী তৈরি করে। রংধনুর মতো সাত রংয়ের বর্ণালী। পাঠক যদি সে কথা ভুলে যান, আরেকবার ঘুরে আসুন প্রথম অধ্যায়ে

উইলিয়াম হাইড ওয়ালস্টোন

নিউটনের প্রিজম পরীক্ষাটিই আরেকবার করেছিলেন বিট্রিশ বিজ্ঞানী উইলিয়াম হাইড ওয়ালস্টোন। তবে আরেকটু ভালোভাবে। তিনি লক্ষ্য করেন সাত রংয়ের বর্ণালীর মধ্যে কিছু কালো রেখা দেখা যাচ্ছে। তিনি বিষয়টাকে পাত্তা দেননি। ভেবেছিলেন প্রিজমের হয়তো সমস্যা আছে। অথবা তাঁর পরীক্ষা পদ্ধতিরই হয়তো ত্রুটি আছে। ঘটনাটা ১৮০২ সালের। এর কিছুকাল পরে জার্মান পদার্থবিদ জোসেফ ভন ফ্রনহোফার দেখেন একই দৃশ্য। তিনি বিষয়টিকে হালকভাবে নেননি। বরং বর্ণালীর ভেতরে এই অনাকাংখিত কালো রেখাগুলো নিয়ে তিনি গবেষণা শুরু করেন।


জোসেফ ভন ফ্রনহোফার

আলোক যন্ত্রপাতি নিয়েই ছিল ফ্রনহোফারের কারবার। বয়স এগরো বছর পূর্ণ হতে না হতেই মা-বাবা দুজনকেই হারান। ছোট্টকালেই তাই জীবিকার জন্য মাঠে নামতে হয়েছিল। তখন তিনি এক বিখ্যাত লেন্স ও আয়না তৈরির কোম্পানিতে একটা কোর্স করেন। সেই কোর্সই তাঁকে একটা চাকরি পাইয়ে দেয়। মিউনিখের একটা বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি তৈরির কারকানায় কাজ শুরু করেন। সেখানকার অভিজ্ঞতা তাঁর গবেষণায় দারুণ কাজে লাগে। উন্নতমানের বর্ণালীবিক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কার করেন। প্রিজমের চেয়ে আরো ভালোভাবে বর্ণালী বিশ্লেষণ করতে পারত সেই যন্ত্র।

ফ্রনহোফার সৌর বর্ণালীর কালো রেখাগুলো নিয়ে রীতিমতো গবেষণা শুরু করে দিলেন। নিশ্চিত হলেন এই কালো রেখা সুর্যালোকের বর্ণালীরই অংশ। তিনি সৌরবর্ণালীতে মোট ৫৭৪টি কালো রেখা খুঁজে পেয়েছিলেন। পরে তাঁর নামে সৌর বর্ণালীর এই রেখগুলোর নাম হয়ে যায় ফ্রনহোফার বর্ণালী। ফ্রনহোফার শুধু কালোরেখাগুলো দেখেই দাায়িত্ব শেষ করেননি। রেখাগুলোর অবস্থান ঠিক কোন কোন জায়গায় সেগুলোও আলাদা আলাদাভাবে চিহ্নিত করতে সক্ষম হন তিনি। একটা উদহারণ দেওয়া যেতে পারে। সৌরবর্ণালীতে হলুদের এলাকায় দুটো স্পষ্ট কালো রেখা দেখা যায়। এই দুটো রেখার নাম দেন ডার্ক লাইন বা D লাইন।

ফ্রনহোফার বর্ণালী নিয়ে উৎসাহী হয়ে উঠলেন। D লাইনের ব্যাখ্যা চান তিনি। এজন্য আকাশ থেকে নেমে এলেন গবেষণাগারে। শুধু সৌর বর্ণালীতে তাঁর মন ভরল না। কৃত্রিম আলোর বর্ণালীবিক্ষণ করতে চান। স্পিরিট ল্যাম্পের সাদা আলোর বর্ণালীবিক্ষণ করে দেখলেন। দেখলেন ল্যাম্পের আলোও বর্ণালী তৈরি করে। আরো দেখলেন সৌর বর্ণালীতে D লাইন যেখানে থাকে, ল্যাম্পের আলোর বর্ণালীতে D লাইনের অবস্থান ঠিক সেখানেই।

ফ্রনহোফার তাঁর পরীক্ষা আরো এগিয়ে নিলেন। এবার তিনি বুধগ্রহ থেকে প্রতিফলিত হয়ে আসা আলোর বর্ণালী বিশ্লেষণ করলেন। বর্ণালী বিশ্লেষণ করলেন সিরিয়াস নক্ষত্রমন্ডলী থেকে আসা আলোক রশ্মিরও। ফল একই, প্রত্যেকের D লাইনের অবস্থান একই জায়গায়।

ফ্রনহোফার D লাইনের কারণ বের করতে পারতেন কিনা কে জানে। ১৮২৬ সালে মৃত্যু এসে থামিয়ে দেয় তাঁর সকল গবেষণা। তবু ৩৯ বছরের ক্ষুদ্র জীবনে বিজ্ঞানকে তিনি বড় কম কিছু দেননি।

ফ্রনহোফারের পর বর্ণালী বিজ্ঞানে প্রাণ সৃষ্টি হয়। এর মূলে দুই জার্মান গবেষক গুস্তাভ কার্শফ আর রবার্ট উইলহেম বুনসেন। দুজনই হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যলয়ের অধ্যাপক ছিলেন। কার্শফের কথা কিছুটা আমরা প্ল্যাঙ্কের কোয়ন্টাম তত্ত্ব আলোচনার সময় বলে এসেছি। বুনসেনও কিন্তু রসায়ন বিজ্ঞানে পরিচিত নাম। তাঁর নামেই নামকরণ করা হয়েছে বুনসেন শিখা আর বুনসেন ল্যাম্পের। কিন্তু ওসব আমাদের আলোচনার বিষয় নয়।

গুস্তাভ কার্শফ

দুই বিজ্ঞানী বর্ণালী নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করেন ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে। ফ্রনহোফারের মতো তাঁরাও বর্ণালী বিশ্লেষণের পরীক্ষাটি নামিয়ে নিয়ে এলেন গবেষণাগারে। তবে একটু অন্যভাবে। তাঁরা একটা কাপড়কে ভিজিয়ে নেন লবণ মেশানো পানিতে। তারপর সেটাতে আগুন ধরিয়ে দেন। সেই আগুন থেকে তৈরি হওয়া আলোর বর্ণালী বিশ্লেষণ করেন। দেখেন, সেই বর্ণালীর সাথে সৌর বর্ণালীর মিল নেই বলতে গেলেই চলে। বর্ণালী থেকে উধাও হয়ে গেছে ছয়টা রং। একটা মাত্র রং টিকে আছে। সেটা হলুদ। D লাইনের কাছাকাছি সেটার। এ থেকেই তাঁরা ধরে নিলেন হলুদ রেখাটি জন্ম লবণের (NaCl) কারণে।
অনেকে হয়তো ভাবছেন, কাপড়ের কারণেও তো হতে পারে, কাপড়ের তো রাসায়নিক পদার্থ আছে? হতে পারে। তবে দুই বিজ্ঞানী বোধহয় লবণ পানি ভেজানো কাপড় পোড়ানোর আগে শুধু কাপড় পুড়িয়েও দেখেছিলেন। হয়তো সৌর বর্ণালীর চেয়ে আলাদা কোনো বর্ণালী পাননি।

পানির কারণেও তো হতে পারে? সেটা হওয়া কঠিন। কারণ পানি একশো ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাতেই শুকিয়ে যায়। তাই কাপড়ে আগুন ধরার আগেই পানি শুকিয়ে যাবে। কিন্তু লবণ মেশানো পানিতে ভেজা কাপড় পোড়াতে গেলে ঘটবে অন্য ঘটনা। পানি শুকিয়ে যাবে। কিন্তু লবণ লেগে থাকবে কাপড়ের গায়ে। সেই লবণই পুড়বে কাপড়ের সাথে। সেই কাপড় পোড়া আগুন যেহেতু একটা মাত্র হলুদ রেখা তৈরি করে তাই নিশ্চিত, লবণই দায়ী ওই হলুদ রেখা তৈরির জন্য।

রবার্ট উইলহেম বুনসেন

লবণের আছে দুটি উপদান। সোডিয়াম আর ক্লোরাইড। কোনটা থেকে এই হলুদ বর্ণটা আসছে? হয় সোডিয়াম থেকে অথবা ক্লোরিন থেকে।

কোন পদার্থ থেকে আসছে সেটা সহজেই বের করে ফেলা যায়। দুই বিজ্ঞানী সেটাই করলেন। তাঁরা আরো দুবার পরীক্ষাটি করলেন। একবার সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইড (NaOH) মেশানো কাপড় পুড়িয়ে। আরেকবার কাপড় হাইড্রোক্লোরিক এসিড (HCl) দ্রবণে ভিজিয়ে, সেই কাপড় পুড়িয়ে তার আগুন থেকে পরীক্ষা করা হলো। বিজ্ঞানীরা দেখলেন হাইড্রোক্লোরিকের পরীক্ষায় হলুদ রেখার বর্ণালী আর পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু সোডিয়াম হাইড্রাক্সইডের পরীক্ষায় হলুদ রেখা আবার পাওয়া গেল। কার্শফ আর বুনসেন নিশ্চিত হলেন বর্ণালীর হলুদ রেখার উৎস সোডিয়াম মৌল। তখনো পরমাণুর আকার-আয়তন পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কিন্তু রসায়ন বিজ্ঞানে পরমাণু নামের মৌলিক কণার অস্তিত্ব অনেক আগে থেকেই ছিল। তাই দুই বিজ্ঞানী নিশ্চিত হলেন হলুদ বর্ণালী তৈরি করে সোডিয়াম পরমাণু।

এই একটা পরীক্ষা খুলে দিল বিজ্ঞানের নতুন দুয়ার। বর্ণালী বিশ্লেষণের ওপর একটা গবেষণাপত্র লেখেন কার্শফ। ১৮৫৯ সালে। মাত্র দুই পৃষ্ঠা কলেবরের সেই প্রবন্ধটিতে ব্যাখ্যা করা হয়েছিল বর্ণালীর কিছু বৈশিষ্ট্য। তাতে বলা হয়, প্রতিটা মৌলিক পদার্থের পরমাণুই বর্ণালী তৈরি করতে পারে। কিন্তু কারো বর্ণালীর সাথে অন্য কোনো মৌলের বর্ণালী হুবহু মেলে না। কিছুটা মিল হয়তো থাকতে পারে। তবে পুরোপুরি কখনো নয়। বর্ণালী বিশ্লেষণ করে জানা সম্ভব তাঁর ভেতরে কী কী মৌলিক উপাদন আছে।

আমরা জানি, সূর্যের ভেতর কী কী মৌল আছে, কোনটা পুড়ছে, এসব সম্ভব হয়েছে সূর্যের আলোর বর্ণালী বিশ্লেষণ করে। দূর নক্ষত্র, নীহারিকা, গ্যালাক্সি ইত্যাদির নাড়ির খবর পাই বর্ণালী বিশ্লেষণ থেকে। সেই প্রবন্ধে সূর্যের কেন্দ্র ও বহিস্থস্তর সম্পর্কেও কিছু ধারণা দিলেন কার্শফ। আর নিশ্চিত করে একটা কথা বললেন, সুর্যের ভেতরে আছে সোডিয়াম মৌল। সেই মৌলই সৌর বর্ণালীর হলুদ অঞ্চলটি তৈরি করে। D লাইনের জন্মও হয় সোডিয়ামের কারণে।

১৮৮৬ সালে সূর্যগ্রহণের দিন সৌর বর্ণালীর এসব চুলচেরা পরীক্ষা-নীরিক্ষা করা হয়। কার্শফ আর বুনসেনের দেওয়া তথ্যের অধিকাংশেরই সত্যতা মেলে সেইসব পরীক্ষা থেকে।

[বইটির সূচীপত্র এবং সব খন্ডের লিংক একত্রে দেখুন এখানে]

-আব্দুল গাফফার রনি
বিজ্ঞান লেখক
[লেখকের ফেসবুক প্রোফাইল]

Exit mobile version