[বইটির সূচীপত্র এবং সব খন্ডের লিংক একত্রে দেখুন এখানে]
রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেলের দুর্বলতার কথা আগেই বলেছি। তড়িৎচ্চুম্বকীয় তত্ত্বের কাছে ধরাশায়ী। বোর ভাবলেন, একটু ভিন্নভাবে। তড়িচ্চুম্বকীয় তত্ত্ব দিয়ে রাদাফোর্ডের মডেল ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। পদার্থবিদ্যার নতুন তত্ত্বটা কী ব্যবহার করা যায়? প্লাঙ্ক-আইনস্টাইনের প্রতিষ্ঠা করা কোয়ান্টাম তত্ত্ব। কোয়ান্টাম তত্ত্ব তখনো বিজ্ঞানীরা হজম করতে পারেননি। অনেকের কাছে এটা কাল্পনিক হাইপোথিসিস। এমনকি বোরেরও আস্থা ছিল না ওই তত্ত্বে। তবু তাঁর মনে হলো পরমাণু মডেলে কোয়ান্টাম তত্ত্ব ব্যবহারের কথা। তত্ত্বটির আগের দুটি সাফল্যই বোধহয় বোরকে অনুপ্রাণীত করেছিল।
সাধারণ বলবিদ্যায় ইরেকট্রনের কক্ষপথের স্থায়ী আকার ছিল না। থাকবে কী করে, সর্পিলাকারে যে কক্ষপথ ছোট হতে হতে নিউক্লিয়াসে পতিত হয়, তার আবার নির্দিষ্টতা কী? এই সমস্যার হাত থেকে বাঁচাতে পারে কোয়ান্টাম তত্ত্ব। বোর বললেন, পরমাণুর ভেতরে ইলেকট্রনের কক্ষপথের একটা নির্দিষ্ট আকার থাকা উচিৎ। নির্দিষ্ট আকার না থাকলে পরমাণু স্থায়ী হবে না। তেমনি রাদারফোর্ডের মডেল আর তড়িৎচ্চুম্বকীয় তত্ত্বও মেনে চলবে খানিকটা। অর্থাৎ ঘুরতে থাকা ইলেকট্রন তড়িচ্চুম্বকীয় শক্তিও বিকিরণ করবে। কিন্তু দুটো বিপরীতমুখী ঘটনা এক সাথে কীভাবে ঘটবে?
বোর বললেন ঘটবে, তবে একই সাথে নয়। ইলেকট্রনের জন্য পরমাণুর একটা নয়, একাধিক কক্ষপথ আছে। সেসব কক্ষপথ মোটেও সর্পিল নয়। বৃত্তাকার। একটা নির্দিষ্ট কক্ষপথে যখন ইলেকট্রন অবস্থান করে তখন সেই ইলেকট্রন কোনো শক্তি নির্গমন করে না। বোর ইলকট্রনের কক্ষপথে শক্তির একটা মাপকাঠি তৈরি করে দিলেন। একটা নির্দিষ্ট কক্ষপথ একটা নির্দিষ্ট শক্তি ধারণ করে। সেই শক্তির চেয়ে ইলেকট্রনে শক্তি কমবেশি হলে, সেই কক্ষপথে আর থাকতে পারবে না। চলে যাবে নিচের বা ওপরের কোনো কক্ষপথে। অর্থাৎ বোরের কক্ষপথ নিরবিচ্ছিন্ন শক্তির কক্ষপথ নয়। বরং কক্ষপথগুলো নির্দিষ্ট শক্তি নিয়ে অবস্থান করে পরমাণুর বিভিন্ন স্তরে। নিউক্লিয়াস থেকে সবচেয়ে কাছের কক্ষপথটি সবচেয়ে কম শক্তি ধারণ করে। নিউক্লিয়াস থেকে কক্ষপথের দূরত্ব যত বেশি, কক্ষপথের শক্তিও তত বেশি।
কথা হচ্ছে, কক্ষপথ থাকলেই বা লাভ কি, ইলেকট্রন যদি সব কক্ষপথে থাকতে না পারে? ধরা যাক, হাইড্রোজন পরমাণুর কথা। এই পরমাণুতে একটামাত্র ইলেকট্রন আছে। তাই বলে কি এর কক্ষপথও একটা? তাই যদি হয়, তো রাদারফোর্ডের পরমাণুতেই ফিরে যেতে হবে!
বোর বললেন, হাইড্রোজেন পরমাণুতে একাধিক কক্ষপথ আছে। সেগুলোর সবগুলোতেই থাকতে পারে ইলেকট্রন। কিন্তু ইলেকট্রন তো আর ভূত-প্রেতের গপ্পের মতো নয়, যে একই সাথে সবগুলো কক্ষপথে থাকবে! বোর বললেন, ইলেকট্রন সবগুলো কক্ষপথেই থাকতে পারবে, তবে একসাথে নয়। পরমাণুটি কখন কোন অবস্থায়, কী পরিমাণ শক্তি নিয়ে আছে, তার ওপর নির্ভর করে ইলেকট্রন কোন শক্তিস্তরে থাকবে। একেক সময় থাকতে পারে একেকটা কক্ষপথে।
তারমানে ইলেকট্রন যেমন নিন্ম শক্তির কক্ষপথে থাকতে পারে, তেমনি বেশি শক্তির কক্ষপথেও থাকতে পারে। ধরা যাক, ইলেকট্রন ওপরের দিকের একটা কক্ষপথে আছে। একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ শক্তি নিঃসরণ করে সে নিচের শক্তিস্তরে আসতে পারবে। তাহলে কিন্তু তড়িচ্চুম্বকীয় শক্তি নিঃসরণের একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। কিন্তু নির্দিষ্ট কক্ষপথে যখন ঘোরে, তখন তড়িচ্চুম্বকীয় শক্তি নিঃসরণ করতে পারে না।
তাহলে কি ইলেকট্রন শুধু উচ্চ শক্তির কক্ষপথ থেকে নিচের শক্তিস্তরে আসতে পারে? নিচের থেকে ওপরে যেতে পারে না? তড়িৎচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ তত্ত্বে বলা হয়েছে ঘূর্ণনশীল চার্জিত কণা তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ বিকিরণ করে। তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ বা শক্তি শোষণের কথা বলা হয়নি সেই সমীকরণে। শক্তি বিকিরণ করা মানে ইলেকট্রনের শক্তি কমে যাওয়া। শক্তি কমে গেলে শুধু নিচের কক্ষপথে যেতে পারে। ওপরের কক্ষপথে যেতে হলে শক্তি শোষণ করে ইলেকট্রনকে আরো শক্তিশালী হতে হবে। এখানেই বোরের কৃতিত্ব। তিনি বললেন, একটা নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘুরতে থাকা ইলেকট্রন শক্তি শোষণও করতে পারে। তবে শক্তি শোষণ করলে তার শক্তি বেড়ে যায়, সুতরাং সেই কক্ষপথে সে ঘুরতে পারবে না। লাফ দিয়ে চলে যাবে ওপরের কোনো কক্ষপথে। এই ঘটনার তড়িচ্চুম্বকীয় ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। সম্ভব নয় চিরায়ত বলবিদ্যার কোনো তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করাও। বোর তাই কোয়ন্টাম তত্ত্বের দিকে হাত বাড়িয়েছিলেন।
বোর বলেছিলেন, পরমাণুর ভেতরে ইলেকট্রনের কক্ষপথগুলো নিরবিচ্ছন্ন নয়, বিচ্ছিন্ন। প্ল্যাঙ্ক যেমন বলেনছিলে কৃষ্ণবস্তু নিরবিচ্ছন্নভাবে শক্তি নিঃসরণ করতে পারে না। শক্তি আসে ঝাঁকে ঝাঁকে বা গুচ্ছ আকারে। আইনস্টাইন শক্তির সেই প্যাকেটের নাম দিয়েছিলেন ফোটন। বোর অনেকটা একইরম কথা বললেন পরমাণুর কক্ষপথের ক্ষেত্রেও। পরমাণুর কক্ষপথ নিরবিচ্ছিন্ন নয়। বিকিরণের শক্তি প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবকের সরল গুণিতকে থাকে
কৌণিক ভরবেগ দাঁড়াবে
কৌণিক ভরবেগের সাথে বৃত্তপথের ব্যাসার্ধও জড়িয়ে থাকে। সুতরাং ইলেকট্রনের কক্ষপথের ব্যাসার্ধও কিন্তু আমরা মেপে ফেলতে পারি।
চিরায়ত বলবিদ্যা অনুসারে কৌণিক ভরবেগ
সূতরাং
রাদাফোর্ডের কোয়ান্টাম হিসাব থেকে পাওয়া কৌণিক ভরবেগের মান এখানে বসালে পাব-
এটাই বোরের অনুমোদন করা ইলেকট্রনে কক্ষপথের ব্যসার্ধ। এখানে
বোর কক্ষপথে ইলেকট্রনের শক্তি নির্ধারণ করে দিলেন। ইলেকট্রনের সুস্থিতি এলো। বোরে সূত্র এমন কোনো কক্ষপথ ইলেকট্রনের জন্য অনুমোদন করে না যেটা নিউক্লিয়াসে ঝাপ দেবে। কারণ
[বইটির সূচীপত্র এবং সব খন্ডের লিংক একত্রে দেখুন এখানে]
-আব্দুল গাফফার রনি
বিজ্ঞান লেখক
[লেখকের ফেসবুক প্রোফাইল]