এক বন্ধু আমাকে তার কলেজের একটি ঘটনা বলছিল। পদার্থবিদ্যার ক্লাস। ছাত্র-ছাত্রীরা ক্লাসে এসে দেখে ঘর অন্ধকার, বাতি জ্বলছে না। দোতলায় ক্লাস, নিচের তলায় সুইচ। কে একজন দৌড়ে গিয়ে সেই সুইচ অন করল, কিন্তু তবু বাতি জ্বলে না। ক্লাসে ইতিমধ্যে শিক্ষক উপস্থিত, শিক্ষক বললেন তা নিচ তলায় সুইচ টিপেছে তো, একটু সময় লাগবে। এই কাহিনীটা সেই কলেজে একটা ইতিহাস হয়ে গেলে। আমিও এটা শুনে খুব হেসেছিলাম, সুইচ টেপার সঙ্গে সঙ্গেই বাতিটা জ্বলার কথা, তড়িৎ তামার তারে আলোর গতিতে না হোক, আলোর গতির অন্ততঃ অর্ধেক গতিতে ভ্রমণ করে।
কিন্তু আসলেই কি এটা হাসার বিষয়? কোনো ধাতব তারে তড়িৎ সৃষ্টি হয় কেমন করে, এবং সুইচ টেপার সাথে সাথে সেটা আলোর গতিতে চলে কেমন করে? প্রথম দৃষ্টিতে এই প্রশ্নটা সহজ মনে হলেও কার্যতঃ সেরকম নয়। ধরা যাক তড়িৎ প্রবাহ মূলতঃ সংঘঠিত হয় ইলেকট্রন দ্বারা। ইলেকট্রন যখন গতিতে ভ্রমণ করে তাকে আমরা তড়িৎ বলি, তড়িৎ (এম্পিয়ার) = আধান (চার্জ, কুলম্ব)/ সময় (সেকেন্ড)। ধাতব পরিবাহী তারে ইলেকট্রনের এই গতিকে বলা হয় তাড়ন বেগ (drift velocity)। এই তাড়ন বেগ কিভাবে সৃষ্টি হয়? এর জন্য দরকার একটি তড়িৎ ক্ষেত্রের (electric field)। কারণ তড়িৎ ক্ষেত্র ছাড়া ইলেকট্রন কোনো বল অনুভব করবে না। বল (নিউটন) = আধান (কুলম্ব) x তড়িৎ ক্ষেত্র (নিউটন/কুলম্ব)।
এবার দেখা যাক এই তাড়ন বেগ বা drift velocityর মানটা কত। তাড়ন বেগের মান সেকেন্ডে এক মিলিমিটারের থেকেও কম (প্রায় ০.০৫ মিলিমিটার সেকেন্ডে)। আমাদের বৈদ্যুতিক সার্কিটটি যদি ব্যাটারি চালিত বা একমুখী তড়িৎ প্রবাহের (অর্থাৎ DC) হয়, তবে ইলেকট্রনগুলো খুব ধীরে ধীরে ব্যাটারির ঋণাত্মক (negative) দিক থেকে ধনাত্মক (positive) দিকে রওনা হয়। আর সার্কিটটি যদি পরিবর্তী বা পর্যাবৃত্ত প্রবাহের (অর্থাৎ AC) হয়, তবে ইলেকট্রনের গতিমুখ সেকেন্ডে ৫০ বা ৬০ বার (কোন দেশে আমরা আছি তার ওপর নির্ভর করে) বদলাতো। অর্থাৎ সেই ইলেকট্রনগুলো একদিকে ০.০০১ মিলিমিটারের বেশী ভ্রমণই করতে পারবে না। সেক্ষেত্রে সুইচ দিয়ে সার্কিটের যোগাযোগ সম্পন্ন করলেই মুহূর্ত মধ্যে কেন বাতি জ্বলে উঠবে? যেই ইলেকট্রনের শক্তি দিয়ে বাতি জ্বলার কথা সেই ইলেকট্রন তো বাতির ফিলামেন্টে পৌঁছাবেই না। তাহলে কি ব্যাটারির তড়িৎ বিভব (potential difference) তারের মধ্যে কোন তড়িৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গের সৃষ্টি করছে যা কিনা আলোর গতিতে ভ্রমণ করে?
আমি অনেক আগে মনে করতাম ব্যাপারটি তাই, অর্থাৎ একটি ইলেকট্রন তড়িৎক্ষেত্রে তাড়িত হয়ে তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ বিকিরণ করছে, সেই তরঙ্গে পরবর্তী আর একটি ইলেকট্রন কম্পিত হয়ে আবার তরঙ্গ বিকিরণ করছে এবং এইভাবে তরঙ্গ আলোর গতির সমান না হলেও তার কাছাকাছি গতিতে তারের মধ্যে ভ্রমণ করছে, আর ইলেকট্রনের কম্পন হল তড়িৎ। ব্যাপারটা একেবারেই তা নয়। কিন্তু এমন একটি গুরুত্ব্পূর্ণ জিনিস দু-একটি বই ছাড়া সাধারণ পদার্থবিদ্যার পাঠ্যপুস্তক কোনো কারণে একেবারেই এড়িয়ে যায়।
আলোচনাটা খুব সাধারণ ও সহজ রাখার জন্য আমরা একটি ব্যাটারিসম্পন্ন DC সার্কিটকে বিশ্লেষণ করব। ধরা যাক আমাদের সার্কিটে শুধুমাত্র দুটি জিনিস আছে – একটি ব্যাটারি ও একটি ফিলামেন্টের বাল্ব। ব্যাটারি ও বাল্বটি ধাতব পরিবাহী তার দিয়ে যুক্ত, তবে ধরা যাক প্রথমে সার্কিটটি খোলা, অর্থাৎ একদিকের তার ব্যাটারি থেকে বাল্বে যুক্ত নয়, সেখানে একটা সুইচ আছে, সুইচটি অফ।
ব্যাটারি এমন একটি জিনিস যার দুটি টারমিনালের মধ্যে একটা বিভব পার্থক্য (potential difference) থাকে যেমন ১.৫ ভোল্ট বা ৯ ভোল্ট ইত্যাদি। কোনো রাসায়নিক বা যান্ত্রিক উপায়ে এই পার্থক্যটা সৃষ্টি করা সম্ভব। ধরে নেয়া যাক ব্যাটারির পজিটিভ টারমিনালে অনেক পজিটিভ আধানের (চার্জের) সমাবেশ আর নেগাটিভ টারমিনালে নেগাটিভ আধানের সমাবেশ। আমি যদি পরিবাহী তার দিয়ে এই দুটি টারমিনাল যুক্ত করি তবে নেগাটিভ আধান পজিটিভ টারমিনালের দিকে রওনা দেবে (এবং পজিটিভ নেগাটিভের দিকে)। ধাতুতে ঋণাত্মক ইলেকট্রন কিছুটা মুক্ত এবং তার গতিই তড়িৎ সৃষ্টি করে।
এবার দেখা যাক “সুইচ অফ” অবস্থাটি। ব্যাটারির থেকে পরিবাহী তারটি বাল্বের সঙ্গে বিযুক্ত। আমরা জানি কোনো আধানযুক্ত পরিবাহীর মধ্যে কোনো আধান থাকতে পারে না। ধরা যাক আমরা একটা পরিবাহীতে কিছু ধনাত্মক আধান যুক্ত করেছি। যেহেতু ধনাত্মক আধানেরা একে অপরকে পছন্দ করে না তারা একে অপর থেকে যত দূরে যাওয়া সম্ভব যাবে এবং একটি গোলকের উপরিভাগে সমদূরত্বে অবস্থান করবে। কেন তাদের গোলকের মধ্যে পাওয়া যাবে না? কারণ একটি আধানও যদি গোলকের মধ্যে থাকে সেটি একটি তড়িৎ ক্ষেত্রের সৃষ্টি করবে এবং সেই ক্ষেত্রে সেটি একটি বল অনুভব করবে এবং ত্বরান্বিত হবে। অর্থাৎ তড়িতের সৃষ্টি হবে। কিন্তু একটি আধানযুক্ত গোলক স্থিতি অবস্থায় তড়িৎ সৃষ্টি করতে পারে না, সেটা হলে আমরা বিনা পয়সায় শক্তির একটা উৎস পেতাম। এই অবস্থার আর একটি উপসংহার হল ঐ পরিবাহী গোলকের মধ্যে কোনো তড়িৎ ক্ষেত্র থাকতে পারবে না। আসলে স্থিত অবস্থায় কোনো যে কোনো জ্যামিতির পরিবাহকের মধ্যেই কোন তড়িৎ ক্ষেত্র থাকবে না, তবে তার উপরিভাগে থাকতে পারে।
[এই ছবিগুলি নেয়া হয়েছে Chabay & Sherwood, Matter and Interactions বই থেকে]
এবার একটু বিস্তারিতভাবে আমরা দেখতে চাই তারের এই বিযুক্ত অংশে আধানরা নিজেদের কিভাবে সাজিয়েছে।
এবার দেখা যাক বিযুক্ত অংশ ব্যতীত অন্যান্য আধান কিরকম ক্ষেত্র সৃষ্টি করবে। তাদের তড়িৎ ক্ষেত্র হবে ডানমুখী। দেখাই যাচ্ছে বিযুক্ত অংশের ক্ষেত্র ও অন্যান্য অংশ দ্বারা সৃষ্ট ক্ষেত্র একে অপরকে বিলীন করে দেবে যাতে পরিবাহী তারের ভেতর কোনো তড়িৎ ক্ষেত্র থাকবে না।
চার্জ বা আধানের পুনর্বিন্যাস
কিন্তু যেই মুহূর্তে দুটি বিযুক্ত অংশকে এক করা হবে দুদিকের পজিটিভ ও নেগাটিভ আধান একে অপরকে নিষ্ক্রিয় করে দেবে। এর ফলে বামমুখী তড়িৎ-ক্ষেত্রটি পুরো উধাও হয়ে যাবে।
আর উপরিভাগের কিছু পজিটিভ আধান ডানদিকে সরবে আর নেগাটিভ আধান বাঁ দিকে যাবে, এর ফলে বাঁদিকে পজিটিভ আধানে ঘনত্ব কমবে ও ডানদিকে নেগাটিভ আধানের ঘনত্ব কমবে। এর ফলে আর ডানমুখী তড়িৎক্ষেত্রটির কিঞ্চিৎ পরিবর্তন হবে এবং পরিবাহী তারের মধ্যে একটি তড়িৎক্ষেত্রের আবির্ভাব হবে যেটা আগে ছিল না।
তাহলে দেখা যাচ্ছে যে অংশটা জোড়া লাগল (ড্যাশ দিয়ে গোল অংশ) সেখানে একটা তড়িৎক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে এবং তারের মধ্যের ইলেকট্রনরা ইতিমধ্যে সেই তড়িৎক্ষেত্রের উল্টোদিকে রওনা হবে। কিন্তু জোড়া অংশের উপরিভাগের আধানদের যে পুনর্বিন্যাস হল (যার ফলে তারের মধ্যে তড়িৎক্ষেত্র দেখা দিল) সেই খবরটি তখনো তারের অন্যান্য অংশে পৌঁছায় নি। তাই সেখানে তারের ভেতর তড়িৎ-ক্ষেত্র তখনো শূন্য।
কিন্তু এই অবস্থাটা মুহূর্তমাত্র থাকে। তারের উপরিভাগের আধানের পুনর্বিন্যাস প্রায় আলোর গতিতে জোড়া অংশের দুদিকে ভ্রমণ করবে। এবং সাথে সাথে ঐসব অংশে তড়িৎ ক্ষেত্র সৃষ্টি করবে। তারের ওপরে আধান সমসত্ত্বভাবে ভাবে আর থাকবে না। আর যেহেতু সমসত্ত্বভাবে থাকবে না, সেজন্য তারের ভেতর সব জায়গায় তড়িৎ ক্ষেত্র সৃষ্টি হবে প্রায় আলোর গতিতে। সাধারণতঃ এই তড়িৎ ক্ষেত্রের মান খুবই কম, কিন্তু যেহেতু নেগাটিভ আধান ইলেকট্রনের পরিমাণ অনেক সেইজন্য তড়িৎ বা কারেন্টের পরিমাণ বেশ বড়।
তাই বিযুক্ত অংশকে জোড়া লাগানো মাত্র বাল্বে আলো জ্বলে উঠল কারণ বাল্বের ফিলামেন্টের ইলেকট্রনগুলি তড়িৎক্ষেত্র দিয়ে তাড়িত হয়ে চলা শুরু করা মাত্র ফিলামেন্ট তাদের শক্তি গ্রহণ করে উত্তপ্ত হয়ে উঠল এবং সেই উত্তাপে আলো বিকিরণ করতে লাগল। ঠিক কিভাবে এই আলো বিকিরিত হয় সেটা আর একদিনের আলোচ্য বিষয় হতে পারে।
তাহলে মূল ব্যাপারটা হল, সার্কিটকে যুক্ত করা মাত্র পরিবাহী তারের ওপরের আধানের পুনর্বিন্যাস (redistribution) ঘটে মুহূর্তের মধ্যে প্রায় আলোর গতিতে। এর ফলে তারের মধ্যে, প্রতিটি বিন্দুতে, তড়িৎ ক্ষেত্রের আবির্ভাব ঘটে। সেই তড়িৎ ক্ষেত্র ধাতব পরিবাহে ইলেকট্রনকে চলমান করতে বাধ্য করে। একটি একমুখী DC সার্কিটে আধানের পুনর্বিন্যাস হয়ে আধানগুলির অবস্থান স্থির হয়ে যাবে এবং তারের মধ্যের ইলেকট্রনরা খুব আস্তে, প্রায় ০.০৫ মিলিমিটার বেগে ভ্রমণ করবে, কিন্তু সেই ভ্রমণ একদিকে হলেও কিছুটা বিক্ষিপ্তভাবে, বিভিন্ন পরমাণুতে “ধাক্কা” খেতে খেতে হবে। এই ধাক্কার পরিমাণ বাল্বের ফিলামেন্টে বেশী হয় যার ফলে ফিলামেন্ট অতি দ্রুত উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ও আলো বিকিরণ করে।
অন্যদিকে একটি পরিবর্তী AC সার্কিটে ইলেকট্রনগুলি দূরে কোথাওই যাবে না, বরং পর্যাবৃত্ত আন্দোলন করতে থাকবে, তাদের বিস্তার (amplitude) হবে মাত্র ০.০০১ মিলিমিটার। কিন্তু যেটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হল সুইচ অন করা মাত্রই এই আন্দোলনের সূত্রপাত হবে। আর এই AC সার্কিটে তারের উপরিভাগে আধানের পুনর্বিন্যাস হবে সেকেন্ডে ৫০ বা ৬০ বার।
তারের ভেতরের ইলেকট্রন প্রবাহ না,পরিবাহী তারের উপরিস্থিত আধানের দ্রুত পুনর্বিন্যাসই তড়িতের তড়িৎ উপস্থিতি সৃষ্টি করে।
[রেফারেন্স:
১) Ruth W. Chabay & Bruce A. Sherwood, Matter and Interactions
২) The Feynman Lectures in physics, Volume II
৩) David Griffiths, Introduction to Electrodynamics]
-দীপেন ভট্টাচার্য
বিজ্ঞানী ও গল্পকার