[বইটির সূচীপত্র এবং সব খন্ডের লিংক একত্রে দেখুন এখানে]
আগের পর্বগুলোতে আমরা আগের জ্যাঁ ব্যাপিস্ট পেরিনের কথা বলেছিলাম। তিনি ব্রাউনীয় গতির ব্যাখ্যা খোঁজার চেষ্টা করছিলেন। অর্থাৎ পরমাণুর সন্ধান করছিলেন। কিন্তু পাননি। ক্যাথোড রশ্মির আচরণ তাকে উৎসাহিত করল আবার। ভাবলেন, ক্যাথোড রশ্মি যদি কণার স্রোত হয়, তবে সেই কণাগুলো কী? সেগুলোই বোধহয় পরম কাঙ্খিত পরমাণু। ক্যাথোড রশ্মি আসলে পরমাণু। সেই পরমাণুই বিপুল পরিমাণ চার্জ বয়ে নিয়ে আসে ক্যাথোড দন্ড থেকে। কিন্তু পেরিন কীভাবে এই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন তা বিস্তারিত জানা যায়নি। তবে তাঁর এই পর্যবেক্ষণ হার্জের পরীক্ষাকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়।
পেরিনের পরীক্ষাটি ছিল ১৮৯৫ সালে। ঠিক একই সময়ে ক্যাথোড রশ্মি নিয়ে কাজ করছিলেন আরেক ব্রিটিশ পদার্থবিদ জোসেফ জন থমসন। যাকে আমরা চিনি স্যার জে জে থমসন নামে। তিনি আরও উন্নতমানের টিউব যোগাড় করতে পেরেছিলেন। হার্জের টিউবের চেয়ে আরও বেশি বেশি বায়ুশূন্য, আরও কার্যকরী।
থমসন ক্যাথোড রশ্মির গতিও অনুমান করে নিয়েছিলেন। সেকেন্ডে ২০০ কিলোমিটার।
এই গতি অবশ্য আসল গতির চেয়ে বহু গুণে কম। তবু এই অনুমানটুকুই তার পরীক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তিনি অনুমান করেছিলেন উচ্চ গতির কারণেই ক্যাথোড রশ্মি ধাতব পাত দ্বারা আকৃষ্ট হয়নি। তাই তিনি আরও উচ্চ চার্জযুক্ত ধাতব পাত নিলেন। তারপর হার্জের পরীক্ষাটি আবার করলেন। এবার ফল এলো আলাদা। ক্যাথোড রশ্মি প্রভাবিত হয়েছে ধাতব পাতদুটির তড়িৎ ক্ষেত্র দ্বারা। সরলরেখায় আর চলছে না ক্যাথোড রশ্মি। তৈরি হচ্ছে খুবই স্পষ্ট একটা বাঁক। রশ্মিটা তড়িৎক্ষেত্রের কাছাকাছি এসে বেঁকে যাচ্ছে ধণাত্মক পাতের দিকে। আর ঋণাত্মক পাতের সাথে বেড়ে যাচ্ছে দূরত্ব।
থমসন নিশ্চিত হলেন, ঋণাত্মক চার্জ বহন করে ক্যাথোড রশ্মি। তাই আকর্ষিত হয় ধনাত্মক পাত দ্বারা। ধনাত্মক পাত দ্বারা হয় বিকর্ষিত। সুতরাং নিশ্চিত হলো ক্যাথোড রশ্মি চার্জ বহন করে। আরো জোরালো হলো ক্যাথোড রশ্মির কণা ধারণা। কারণ সাধারণ কোনো আলোই চার্জ বহন করতে পারে না।
তবে এতেই সমস্যার সমাধান হলো না। সত্যিই যদি কণা হয় তাহলে তার ভর আছে। আছে নির্দিষ্ট আকার। সেটা কে বের করবে?
১৮৯৭ সালে থমসন কণাটির ভর ও আকার বের করতে সক্ষম হলেন। আসলে তড়িৎক্ষেত্রের উপস্থিতে একটা গতিশীল কণা কী পরিমাণ বিচ্যুত হবে সেটা থেকেই অনেক হিসাব-নিকাষ বেরিয়ে আসে। ফ্যারাডের তড়িৎ সঞ্চালন সূত্রের ভেতর লুকিয়ে আছে এই ধারণা। থমসন নিশ্চিত করলেন, ক্যাথোড কণাই সর্বনিন্ম চার্জ ধারণ করে। এরচেয়ে কম চার্জ ধারণ করা আর কোনো বস্তুর পক্ষে সম্ভব নয়। একটি ক্যাথোড কণার ভর হলো 〖১০〗^(-২৭)গ্রাম। এর গতি আলোর গতির দশভাগের এক ভাগ।
এখন আসা যাক নামের ব্যাপারে। ইলেকট্রনের নামকরণ হয়েছে কিন্তু আরো আগে। ১৮৯১ সালে জর্জ জনস্টোন স্টোনি বিদ্যুতের ক্ষুদ্রতম এককের জন্য ইলেকট্রন নামটি প্রস্তাব করেন।
থমসন থমসন ক্যাথোড কণা আবিষ্কারের পরেও কিন্তু সেটার নাম ইলেকট্রন বলা হত না। বিজ্ঞানীরা দেখলেন, ক্যাথোড কণাই সর্বনি¤œ চার্জ ধারণ করে। তাই কিছু বিজ্ঞানীর প্রস্তাবে ক্যাথোড কণার নাম হলো ইলেকট্রন । ১৯০৬ সালে ইলেক্ট্রনের সঠিক চার্জ নির্ণয় করতে সক্ষম হন মিলিকন। তাঁর বিখ্যাত তৈল-বিন্দু পরীক্ষা দ্বার নির্ণয় করেন ইলেকট্রনের চার্জ। সেই চার্জের মান ১.৬০২১৭৬৬২ x ১০^(-১৯) কুলম্ব। ততোদিনে পরমাণু বিষয়ক সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। জানা গেছে হাইড্রোজন পরমাণু সম্পর্কে নানা তথ্য। হিসেব করে দেখা গেছে, হাইড্রোজেন পরমাণুর চেয়ে ইলেক্ট্রনের ভর ১৮৩৭ গুন কম। আকারে তো আরও ছোট। বিজ্ঞানীরা পড়লেন মহা সমস্যায়। ইলেকট্রন তাহলে কী?
অনেকেই ধরে নিলেন, ইলেকট্রন একটা বস্তুকণা। পরমাণুর মতোই। বস্তুর ভেতরে ইলেকট্রন স্বাধীনভাবে বিরাজ করে। কিন্তু কীভাবে থাকে তার ব্যাখ্যা ওই বিজ্ঞানীরা দিতে পারলেন না। তাছাড়া পরমাণুবাদীদের জন্যও এটা অস্বাস্তির কারণ হয়ে দাঁড়াল। এতদিন তাঁরা বলে এসেছেন, পরমাণুই বস্তু জগতের সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম কণা। এখন তারচেয়ে অনেক অনেক ক্ষুদ্র এক কণার কথা বলছেন থমসন। বিষয়টা মেনে নিতে কষ্ট হলো পরমাণুবাদীদের। তবে ভিন্ন যুক্তিও আছে। পরমাণুকে ক্ষুদ্রতম কণিকা বললেও কিছুটা ঝামেলা থেকে যায়। যেমন, হাইড্রোজনের ক্ষুদ্রতম কণা হলো হাইড্রোজেন পরমাণু। তেমনি লোহার পরমাণু হলো লোহার ক্ষুদ্রতম কণা। তুলনা করলে দেখা দেখা যায়, হাইড্রোজেনের পরমাণুর চেয়ে লোহার পরমাণু অনেক অনেক গুণ ভারি। তাহলে ঢালাওভাবে পরমাণুকেই প্রকৃতির সবচেযে ক্ষুদ্রতম কণিকা বলা যাচ্ছে না। অথচ তাঁদের হিসাব অনুযায়ী হাইড্রোজেন পরমাণু কণা জগতের সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম কণা। নিশ্চয়ই পরমাণুর আকার বা আপেক্ষিক, একেক মৌলের জন্য একেক রকম!
এমন কিছু কি থাকা সম্ভব নয়, যে কণাটিই সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম?
ইলেকট্রন আবিষ্কারের পর সেই সম্ভাবনটা আরও জোরদার হলো। প্রমাণ তো হয়েই গেছে ইলেকট্রন সবচেয়ে ক্ষুদ্র কণা। কিন্তু এর অবস্থান কোথায়। পরমাণু দিয়েই সব মৌলিক পদার্থ তৈরি। সেখানে আলাদাভাবে ইলেকট্রন বাস করার জায়গা কোথায়?
তাহলে কি ইলেকট্রন পরমাণুর ভেতর থেকেই আসছে। অনেক বিজ্ঞানী সেটাই ভাবলেন। থমসনের সেই মত।
আবার একটু পেছনে ফিরে যাই। আগেই বলেছি, তড়িৎ বিশ্লেষণের আবিষ্কারর্তা মাইকেল ফ্যারাডে। ফ্যারাডে দেখেন, পানিতে লবণ গুলিয়ে যে লবণ তৈরি করে তা তড়িৎ প্রবাহ জন্ম দিতে পারে। কিন্তু চিনি পানির দ্রবণে এমনটা ঘটে না। ফ্যারাডে ধরে নিলেন লবণ-পানির দ্রবণে দ্রবণের পরমাণুগুলো বিশেষভাবে ভাগ হয়। সেই পরমাণুগুলো স্বাভাবিক কণার মতো নয়। সেগুলো চার্জ বহন করতে পারে। ধনাত্মক ও ঋণাত্মক দুই ধরনের চার্জই বহন করে। তবে একটা পরমাণু দুই ধরনের চার্জই বহন করতে পারে না। কিছু কণা ধনাত্মক চার্জ বহন করতে পারে। কিছু কণা বহন করে ধনাত্মক চার্জ। ধনাত্মক চার্জবাহী কণাগুলোকে তিনি নাম দিলেন অ্যানায়ন। আর ধনাত্মক চার্জবাহী, কণাগুলো ক্যাটায়নÑ সে কথা আগেই বলেছি।
আবার ফিরে আসি ঊনবিংশ শতাব্দীতে। ১৮৮০ সাল। সুইডিশ রসায়নবিদ স্ভান্তে অগাস্ত আরহেনিয়াস তখন পিএইচডির ছাত্র। তিনি বললেন, লবণ বা সোডিয়াম ক্লোরাইড দ্রবণে যেহয আয়নিত কণা থাকে সেগুলো আসলে চার্জযুক্ত পরমাণু। সোডিয়াম পরমাণু ধনাত্মক চার্জ বহন করে। আর ক্লোরিন পরমাণু বহন করে ঋণাত্মক চার্জ।
১৮৮৪ সালে আরহোনিয়াস তাঁর পিএইচডি থিসিস পেপারে তড়িৎ বিশ্লেষণের ব্যাখ্যা দিলেন। তাতে লিখলেন, সোডিয়াম আর ক্লোরিন পরমাণুদের চার্জ বহনের কথা। আরহোনিয়াসের বক্তব্য বেশ যুক্তিসঙ্গত ছিল। কিন্তু তাঁর শিক্ষকরা সেটা মানতে রাজি ছিলেন না। কোনোরকম পাস মার্ক দিয়ে ছেড়ে দেন আরহেনিয়াসকে। ১৮৯৭ সালে থমসনের ইলেকট্রন আবিষ্কারের পর আরহোনিয়াসের থিসিস পেপারটির গরুত্ব বেড়ে গেল অনেক। ১৯০৯ সালে সেই পেপারটির জন্যই তাঁকে দেওয়া হলো নোবেল প্রাইজ।
আরহেনিয়াসের যুক্তি আর থমসনের পরীক্ষা থেকে কিছু কিছু বিজ্ঞানী একটা সমাধানে আসতে চাইলেন। আরহেনিয়াসের মত অনুযায়ী লবণ-দ্রবণে চার্জিত পরমাণুগুলি আসলে একটা দুটো ইলেকট্রন ধারণ করতে পারে। তারমানে ইলেকট্রনগুলো থাকতে পারে পরমাণুর ভেতরেই। আবার ক্যাথোড নলে যে ইলেকট্রন স্রোত দেখা যায় তাও আসে ক্যাথোড দন্ডের পরমাণু থেকে। সেটাই আমরা ক্যাথোড রশ্মি হিসেবে দেখতে পাই।
এবার একটু ফটো তড়িৎ-ক্রিয়ায় যাব। ফটো তড়িৎ ক্রিয়ায় ধাতুর ওপর আলো দিয়ে আঘাত করা হয়। এর ফলে ধাতু থেকে নির্গত হয় বিটা রশ্মি। এই বিটা রশ্মি যে কী, তা বুঝতে সময় লেগেছে। থমসনের ইলেকট্রন আবিষ্কারের পর দেখা গেল বিটারশ্মির সাথে ইলেক্ট্রনের ¯্রােতের অনেক মিল পাওয়া যাচ্ছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা গেল, বিটারশ্মি মূলত ইলেক্ট্রনেরই স্রোত। তো সেই স্রোত এলো কোথা থেকে?
ইলেকট্রনপন্থী বিজ্ঞানীরা বললেন, ধাতুর পরমাণু থেকে। এ নিয়ে তর্ক-বির্তক চলল। আগেই বলেছি, একদল বিজ্ঞানী মনে করতেন, ইলেকট্রন পরমাণুর ভেতর থেকে আসে না। কারণ, তখনো তারা পুরোনো তত্ত্ব আঁকড়ে বসে আছেনÑ পরমাণু অবিভাজ্য কণা। তাই তার ভেতরে ইলেকট্রন থাকার প্রশ্নই ওঠে না। তারা মনে করতেন, ইলেকট্রন আলাদাভাবে বস্তুর ভেতরে অথবা সিস্টেমে বিদ্যমান থাকে। এই তর্ক-বিতর্ক চলতে চলতেই এসে গেল ১৯০৫ সাল। আইনস্টাইন তার বিশেষ আপেক্ষিতা প্রকাশ করলেন। সেখানে তার বিখ্যাত সমীকরণ E=mc^২ এর প্রতিপাদন দেখালেন। এই সূত্র বলে, ভরকে পরিণত করা যায় শক্তিতে। আবার শক্তিকে পরিণত করা সম্ভব ভরে। সেই হিসেবে আলোক-তড়িৎ ক্রিয়ায় যে আলোক শক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে, সেই শক্তিই হয়তো ইলেকট্রনে পরিণত হচ্ছে। কিন্ত আইনস্টানের সমীকরণ এও বলে, শক্তিকে ভরে অর্থাৎ ইলেকট্রনে পরিণত করার জন্য যে পরিমাণ শক্তির দরকার তা আলোক-তড়িৎ ক্রিয়ায় নিক্ষেপ করা আলোর নেই। সুতরাং ইলেকট্রন পরমাণুর ভেতর থেকেই আসছে। বেঁধে ঝামেলা। তবে শেষমেষ সবাই মেনে নিতে বাধ্য হলেন ইলেকট্রন পরমাণুর ভেতরে থাকে। কীভাবে থাকে তা ব্যাখ্য এ অধ্যায়ে নয়। পরবর্তীতে ফটো-তড়িৎ ক্রিয়া নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করতে গিয়ে ইলেক্ট্রনের দেখা আবার পাবো। পাবো বোরের তত্ত্ব আলোচনা করতে গিয়েও। শুধু তাই নয়। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের জগতে প্রবেশের পর পদে পদে আমাদের সাক্ষাত হবে এই ক্ষুদ্র কণাটির সাথে।
[বইটির সূচীপত্র এবং সব খন্ডের লিংক একত্রে দেখুন এখানে]
-আব্দুল গাফফার রনি
বিজ্ঞান লেখক
[লেখকের ফেসবুক প্রোফাইল]