বিজ্ঞান পত্রিকা

কোয়ন্টাম ফিজিক্স-১৪ : ভেলকিবাজ ক্যাথোড রশ্মি

[বইটির সূচীপত্র এবং সব খন্ডের লিংক একত্রে দেখুন এখানে]

গত পর্বে দেখেছিলাম নতুন ক্যাথোড টিউব তৈরি করলেন প্ল্যাকার। তাতে আলোর ঝলকও দেখলেন। ক্যাথোড টিউবের ভেতরে আলোক রশ্মির কেন দেখা যায়, সে বিষয়ে প্লাকার শতভাগ নিশ্চিত হতে পারলেন না। গিজলার টিউব আসলেই সম্পূর্ণ বায়ুশূন্য হয়েছে কিনা তাও নিশ্চিত জানতেন না তিনি। সে সময় শতভাগ বায়ুশূন্য করার পদ্ধতিই জানা ছিল না বিজ্ঞানীদের। তাই প্লাকার ভাবলেন টিউবের ভেতর হয়তো কিছুটা বাতাস রয়ে গেছে। বাতাসের ভেতর বিদ্যুৎ প্রবাহিত হচ্ছে বলেই দেখা দিচ্ছে আলোক আভা। প্লাকার সমাধান বের করতে পারলেন না। কিন্তু অন্যরা চেষ্টা চালিয়ে গেলেন। প্ল্যাকারের ছাত্র ইউগেন গোল্ডস্টাইনের কথা বলতেই হয়। তিনি কাচের টিউব নিয়ে নানা পরীরক্ষা-নিরীক্ষা চালালেন। বদলে দিলেন ধাতব দন্ড। টিউবের ভেতর বাতাসের বদলে বিভিন্ন গ্যাস ভরে করলেন পরীক্ষা। আলাদা কোনো ফল পাওয়া গেল না। অর্থাৎ একই রকম আভা পাওয়া গেল ক্যাথোড দন্ডের পাশে। তবে গোল্ডস্টাইনের প্রতিটা পরীক্ষায় একই বিদ্যুৎ প্রবাহ রাখা হয়েছিল।

গোল্ডস্টাইন নিশ্চিত হলেন, টিউবের ভেতরে যে সবুজ আভা দেখা যাচ্ছে তার উৎস কেবল বিদ্যুৎ প্রবাহ। আভাটা দেখা যায় ক্যাথোড দন্ডের কাছে।

গোল্ডস্টাইন একটা ব্যাপারে নিশ্চিত হলেন, সেটা তাঁর শিক্ষক প্লাকার হতে পারেনি। ক্যাথোড রশ্মির পাশেই আভাটা স্থির হয় না। টিউবটাকে যত ভালোভাবে বায়ুশূন্য করা যায় ক্যাথোড রশ্মির উজ্জ্বলতা ততো বাড়ে। রশ্মি ছড়িয়ে পড়ে ক্যাথোড দন্ড থেকে অ্যানোডের দিকে। গোল্ডস্টাইন নিশ্চিত হলেন ক্যাথোড রশ্মি ক্যাথোড থেকে আনোডের দিকে প্রবাহিত হয় বলে তিনি সেই আলোর নাম দিলেন ক্যাথোড রশ্মি।

ইউগেন গোল্ডস্টাইন

প্লাকারের আরেক ছাত্র জোহান উইলহেম হিটর্ফ। তিনি পরীক্ষাটাকে এগিয়ে দিলেন আরেক ধাপ। শুধু দুটো ধাতব দন্ড ঢুকিয়ে দয়িত্ব শেষ করেননি হিটর্ফ। অ্যানোড আর ক্যাথোড দন্ডের মাঝখানে রাখলেন আরেকটা কঠিন বস্তু। এরপর চালালেন বিদ্যুৎ প্রবাহ। আশ্চর্য একটা ব্যাপার দেখলেন, ক্যাথোড পাতের ওপর বস্তুটির ছায়া পড়ে। এই পরীক্ষাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এতে নিশ্চিত হওয়া গেল বেশ কয়েকটা বিষয়। ক্যাথোড রশ্মি কাচনলের ভেতরে উৎপন্ন হয় না। হলে কাচনলের সব জায়গায় তার সমান উজ্জ্বলতা থাকত,  অ্যানোডের ওপর পড়ত না বস্তুটির ছায়া। ক্যাথোড রশ্মি শুধুমাত্র ক্যাথোড থেকেই উৎপন্ন হয়। অ্যানোড থেকে নয়। ক্যাথোড রশ্মি ক্যাথোড থেকে আনোডের দিকে নির্গত হয় বলেই বস্তুর ছায়াটা পড়ে অ্যানোডের ওপর। অ্যানোড থেকে ক্যাথোডে গেলে ছায়া পড়ত অ্যানোডের ওপর।

জোহান উইলহেম হিটর্ফ

অনেকে ভাবছেন, গোল্ডস্টাইনই তো বলেছিলেন এসব কথা। হ্যাঁ, তা ঠিক। গোল্ডস্টাইনই বলেছিলেন, কিন্তু বেশিরভাগই ছিল অনুমাননির্ভর। হিটর্ফ সেটা পরীক্ষা করে দেখিয়ে দিলেন।

এরপর দৃশ্যপটে হাজির হলেন ব্রিটিশ পদার্থবিদ উইলিয়াম ক্রুকস। তিনি গিলজার টিউবটাকেই আমূলে বদলে দিলেন। বলতে গেলে, বাতিল হয়ে গেল গিলজার টিউব। নতুন টিউবটার নাম হলো ক্রুকস টিউব। ক্রুকস তাঁর টিউবকে গিলজার টিউবের চেয়ে বায়ুশূন্য কতে পারলেন ৭৫ হাজার গুণ।

উইলিয়াম ক্রুকস

ক্রুকসের পরীক্ষায় আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠল ক্যাথোড রশ্মি। ক্যাথোড রশ্মি সরলরেখায় চলে, এটা দেখাতে সক্ষম হলেন ক্রুকস। তিনি আরেকটা বৈপ্লাবিক সিদ্ধান্ত নিলেন। কেন জানি না, হয়তো সন্দেহ হয়েছিল ক্যাথোড রশ্মি আসলেই আলো, নাকি বস্তু-কণা? তখন কিন্তু আলোর তরঙ্গ-তত্ত্বই শুধু প্রতিষ্ঠিত। আগেই বাতিল হয়ে গেছে কণা-তত্ত্ব। ক্যাথোড রশ্মিকে কণা হিসেবে দেখতে চাওয়া তাই বৈপ্লাবিক ভাবনা। ক্রুকস ক্যাথোড রশ্মির চলার পথে রাখলেন ছোট্ট একটা চাকা। কোন কিছুর সাথে আটকে। এমনভবে, যেন কোন বস্তুর সাথে ধাক্কা লাগালেই চাকাটা ঘুরতে পারে। ক্রুকস অবাক হয়ে দেখলেন, ঘুরছে তার বসানো চাকাটা! তারমানে, ক্যাথোড রশ্মিই চাকাটা ঘোরাচ্ছে। টিউবের ভেতর বাতাস বা অন্য কোনও গ্যাস নেই বললেই চলে। তাহলে ক্যাথোড রশ্মি ছাড়া আর কারও সুযোগ নেই চাকাটা ঘোরানোর। সমস্যা বাঁধল এখানেই। ক্যাথোড রশ্মি যদি শুধুই আলোক রশ্মি হয়, তাহলে চাকা ঘোরানো সম্ভব নয়। চাকা ঘোরাতে হলে সেটাকে কণা হতে হবে এবং থাকতে হবে সেই কণার ভর। তবেই না তার ধাক্কায় ঘুরবে চাকা। ক্রুকস প্রস্তাব করলেন, ক্যাথোড রশ্মি আসলে আলোকরশ্মি নয়, বস্তু কণার স্রোত।

ক্যাথোড রশ্মি তার চলার পথের বসানো চাকা ঘোরাতে পারে।

সে যুগে ক্ষুদ্র বস্তু কণা ছবি স্পষ্ট হয়নি। পরমাণুর ধারণাও তখন ভাসা ভাসা। তাই ক্রুকসের প্রস্তাব মানতে পারলেন না অনেক বৈজ্ঞানিক। ক্যাথোড রশ্মি তরঙ্গ না কণা তা নিয়ে লেগে গেল ধুন্ধুমার কান্ড। ক্রুকস টিউবে দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট আলোর ঝলকানি। বিজ্ঞানীরা সেটাকে আলো ছাড়া অন্য কিছু ভাবতেই পারেন না। তার ওপর ততোদিনে আবার প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে আলোর তরঙ্গধর্ম। আলোর কণাধর্মের কথা কেউ উচ্চারণ করতেই সাহস পান না।

তাই বলে ক্রুকসের প্রস্তাবও একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার উপায় ছিল না। জলজ্যান্ত প্রমাণ তিনি দেখিয়েছেন। সুতরাং একটা বড় সমস্যায় নিমজ্জিত হলেন বিজ্ঞানীরা। ক্রুকস বললেন, আসলে এটা বস্তুর একেবারে নতুন এক ধরনের অবস্থা। কঠিন নয়, তরল নয় আবার নয় বায়বীয়ও । ক্রুকস পদার্থের এই নতুন অবস্থার নাম দিলেন ‘চতুর্থ অবস্থা’। কেন এই অবস্থার জন্ম তার ব্যাখ্যা কিন্তু দিতে পারেননি ক্রুকস। সুতরাং পদার্থবিজ্ঞান নতুন এক সমস্যায় পড়ল। যেমনটা হয়েছিল ‘ব্রাউনীর গতি’ আবিষ্কারের পর। কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণের ব্যাখ্যা দিতে গিয়েও পদার্থবিজ্ঞান পড়েছিল তেমন এক সমস্যায়।

হেররিখ রুডল্ফ হার্জ

অনেকেই তখন এ বিষয়টা নিয়ে ভাবতে লাগলেন। হেনরিখ হার্জের কথা বলা যায়। হার্জ কিন্তু সর্বপ্রথম ম্যাক্সওয়েলের তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন। বেতার তরঙ্গের আবিষ্কারকও তিনি। অবশ্য একই বিষয়ে গবেষণা করেন আমাদের জগদীশ চন্দ্র বসুও। হার্জ ক্রুকস-টিউবের ভেতর স্থাপন করলে ধাতব পাত। খুব পাতলা। পাতটা বসানো হলো ক্যাথোড রশ্মির চলার পথের দুদিকে। হিটর্ফের পরীক্ষার মতোই ছিল অনেকটা। তবে হিটর্ফের পরীক্ষায় কী বস্তু রাখা হয়েছিল অ্যানোড আর ক্যাথোডের মধ্যে তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। বস্তুটার ছায়া পড়েছিল কাচের টিউবের ওপর। কিন্তু নিশ্চিত সেটা হার্জের ধাতব পাতের মতো অতটা সরু ছিল না। যাই হোক, হার্জ দেখলেন, টিউবের গায়ে ধাতব পাতের ছায়া পড়ছে না। বরং ক্যাথোড রশ্মি চলে যাচ্ছে ধাতব পাত ভেদ করে। এখানেই বাঁধল বিপত্তি, ধাতব পাত ভেদ করে গেল কেন? হার্জ ভাবলেন ক্যাথোড রশ্মি বস্তুকণা হলে এমনটা ঘটত না। নিশ্চয়ই এটা আলোক তরঙ্গ।

হ্যাঁ, এটা ঠিক আমাদের সাধারণ দৃশ্যমান আলোক তরঙ্গ কোন দেয়াল, পর্দা কিংবা ধাতব পাত ভেদ করে যেতে পারে না। কিন্তু যে বেতার তরঙ্গ নিয়ে হাজের্র গবেষণা, সেই তরঙ্গের ভেদনক্ষমতা আশ্চর্য। পুরু দেয়াল, ঘর-বাড়ি পর্যন্ত ভেদ করে চলে যায় বেতার তরঙ্গ। সুতরাং হার্জ ভাবলেন, ক্যাথোড রশ্মিও বোধহয় ভেদনক্ষমতা সম্পন্ন আলোক তরঙ্গ।

ভালো বিপাকে পড়ে গেলেন বিজ্ঞানী মহল। ক্রুকস আর হার্জ কারও পরীক্ষাই ফেলে দেবার মতো নয়। কিন্তু, দুজনের পরীক্ষার ফল বলছে দুরকম কথা! তখন আরেকটা বিষয় ঘুরেফিরে আসছিল। ক্যাথোড রশ্মির কি চার্জ আছে? সাধারণ আলোক রশ্মি বা তরঙ্গের চার্জ থাকে না। চার্জ থাকে কণার। ক্যাথোড রশ্মিকে যারা কণা বলে ভাবছিলেন তারাই হয়তো এ প্রশ্ন তুলেছিলেন। তখন হার্জ আরেকটা পরীক্ষা করলেন। এবার কাচের টিউবের ভেতর আরও দুটি চার্জিত পাত বসানো হলো। এদের একটা ধনাত্মক আরেক ধনাত্মক চার্জে চার্জিত। পাত দুটি বসানো হলো ক্যাথোড প্রবাহের সমান্তরালে ক্যাথোড যদি চার্জিত কণা হয় তাহলে এরা যেকোনো একটি পাত দ্বারা আকর্ষিত হবে। কারও কারও ধারণা ছিল, যেহেতু ঋণাত্মক চার্জিত ক্যাথোড দন্ড থেকে ক্যাথোড রশ্মি নির্গত হচ্ছে সুতরাং ক্যাথোড রশ্মিও ধণাত্মক চার্জের চার্জিত।

হার্জ ভাবলেন, তাই যদি হয় তাহলে ক্যাথোড রশ্মি দুই পাতের মাঝখান দিয়ে যাওয়ার সময় আকর্ষিত হবে যেকোনো একটা পাতের দ্বারা। ক্যাথোড রশ্মি ঋণাত্মক চার্জযুক্ত হলে আকর্ষিত হবে  ধনাত্মক চার্জযুক্ত পাত দ্বারা। আর বিকর্ষণ করবে ঋণাত্মক পাতকে। ক্যাথোড রশ্মির গতিপথ আর সোজা থাকবে না। কিছুটা বেঁকে যাবে ধনাত্মক পাতের দিকে।


পরীক্ষাটি করলেন হার্জ। কিন্তু বাড়তি কোনো ফল পেলেন না। বাঁকল না ক্যাথোড রশ্মির গতিপথ। সুতরাং হার্জের অনুমান আরও দৃঢ় হলো। তিনি প্রায় নিশ্চিত হলেন ক্যাথোড রশ্মি আসলে তরঙ্গের ¯্রােত। তবে ক্রুকস কিছুটা নমনীয় ছিলেন। তিনি বলেছিলেন ক্যাথোড রশ্মি আসলে একইসানে কণা ও তরঙ্গের মতো আচরণ করে। ক্যাথোড রশ্মি কণা বলেই ঘোরাতে পারে গতিপথে বসানো চাকা। আবার তরঙ্গ বলে ভেদ করে যেতে পারে ধাতব পাত। তবুও হার্জের কথাই বেশি গুরুত্ব পেল বিজ্ঞানীদের কাছে।

[বইটির সূচীপত্র এবং সব খন্ডের লিংক একত্রে দেখুন এখানে]

-আব্দুল গাফফার রনি
বিজ্ঞান লেখক
[লেখকের ফেসবুক প্রোফাইল]

Exit mobile version