বিজ্ঞান পত্রিকা

সমস্যা যখন প্রযুক্তি-আসক্তি

১.
তথ্যপ্রযুক্তি যখন আরাধ্য হয়ে ওঠে, তখন মনে হতেই পারে আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপটি পাওয়া গেছে। ঠিকমতো ‘ঘষতে’ পারলে (পড়ুন সঠিক ‘App’-এ ‘টাচ’ করতে পারলে) দারিদ্র্য থেকে এইডস পর্যন্ত সকল সমস্যার সমাধান করা যাবে। এটা একটুকুও বাড়িয়ে বলা নয় – সিলিকন ভ্যালিতে এরকম ধারণা প্রচলিত আছে যে ‘সঠিক’ প্রযুক্তির প্রয়োগের মাধ্যমে জটিল সামাজিক সমস্যাগুলোর সমাধান করা যাবে। যেমন ‘একটি শিশুর জন্য একটি ল্যাপটপ’-প্রচারণার উদ্যোক্তা নিকোলাস নেগ্রোপন্টে মনে করেন কমদামী ল্যাপটপ দিয়ে উন্নয়নশীল বিশ্বের সকল পীড়া সারিয়ে ফেলা যাবে।

আসলেই কি তাই? এটা অস্বীকার করা বোকামীর নামান্তর যে প্রযুক্তি (বিশেষত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি) দিনকে-দিন অতিদ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। এর প্রভাবও দৃশ্যমান। অধিকাংশ মধ্যবিত্ত তরুণরা ল্যাপটপ বা ডেস্কটপ কম্পিউটার ব্যবহার করেন। সকলের হাতেই মোবাইল। বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে স্মার্টফোন ব্যবহারে আগ্রহটা বেশ লক্ষ্যণীয়। স্মার্টফোনে ইন্টারনেট সংযোগের মাধ্যমে বিশ্বের সকল তথ্য আক্ষরিক অর্থেই ‘হাতের মুঠোয়’ এখন। অবশ্য এ ইন্টারনেট ব্যবহার মূলত বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এ কারণে বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন সময় ফেসবুক বন্ধ করে দেয়ায় দেখা গেছে মোবাইল কোম্পানীগুলোর ইন্টারনেট প্যাকেজ বিক্রি কমে গেছে, ধসে গেছে ফেসবুক ভিত্তিক ফ্রি-ল্যান্সিং ও ই-কমার্স ব্যবসা। বিভিন্ন মোবাইল এপস্ (Apps) স্মার্টফোন ব্যবহারকারীদের নিত্য সহযোগী এখন। অনেকগুলো যোগাযোগ এপস্ বার্তা পাঠানো, চ্যাটিং, ভয়েস ও ভিডিও কলকে এতো সহজ করে দিয়েছে যে স্মার্টফোনে কথা বলার ব্যালেন্স না থাকলেও কেবল ইন্টারনেট সংযোগ থাকলেও হয়। সরাসরি ফোন না দিয়ে এসব এপস্ ব্যবহার করে পরিবার ও বন্ধু-পরিচিতদের সাথে যে কোন সময়েই যোগাযোগ করা যায়। এছাড়া বিকাশের মতো সেবাগুলো প্রত্যেকের মোবাইল ফোনকে একটি মানিব্যাগে পরিণত করে দিচ্ছে। যার ফলে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে আর্থিক লেনদেন থেকে শুরু করে মোবাইলের মাধ্যমে ব্যাংকিং করার মতো ইত্যাদি সেবা অনেক সহজ হয়ে গেছে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি জীবনযাত্রাতে নানা রকমের সুবিধা এনে দিয়েছে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। ফলে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি যে ‘আরাধ্য’ হয়ে উঠবে এটা আর অস্বাভাবিক লাগে না।

তবে আরাধ্য তথ্য-যোগাযোগ-প্রযুক্তির জয়ধ্বনির ডামাডোলে এর অসুবিধা ও সমস্যাগুলো তলিয়ে যাওয়াটাও অস্বাভাবিক নয়। একটু খতিয়ে দেখলে বোঝা যাবে এ প্রযুক্তিগুলোর বিভিন্ন সমস্যা তৈরি করছে। অনেকক্ষেত্রেই এ সংকটগুলোর জন্য প্রযুক্তিগুলো সরাসরি দায়ী না। আসলে যে কোন নতুন প্রযুক্তিই নিরপেক্ষ (যদি না সেটা জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে)। তবে নিরপেক্ষ হলেও এগুলো ব্যবহারের ধরণ থেকে নানা রকম সংকটের উৎপত্তি হতে পারে। এজন্য তথ্য-যোগাযোগ-প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার ব্যক্তি-জীবন  ও সমাজে কি ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে সে বিষয়টা ভেবে দেখা প্রয়োজন। পাশাপাশি এটাও যাচাই করে দেখা দরকার  ‘সঠিক’ প্রযুক্তির উদ্ভাবন কিংবা প্রয়োগ আসলেই সমাজের গোড়ার সমস্যাগুলো সমাধান করতে পারে কি না।

২.
এ মুহূর্তে বিশ্বজুড়ে যে নতুন উদ্ভাবন নিয়ে প্রযুক্তিপ্রেমিরা আগ্রহভরে খোঁজখবর রাখছেন তা হলো ভার্চুয়াল বাস্তবতা। স্যামসাঙ ও ফেসবুকসহ বিভিন্ন কোম্পানী ভার্চুয়াল বাস্তবতার অভিজ্ঞতা পাওয়া যায় এমন হেডসেট প্রযুক্তি বাজারে এনেছে। এসব হেডসেটে স্মার্টফোনটি যুক্ত করুন, চশমার মতো করে চোখে লাগান – ব্যাস, আপনি উপভোগ করতে পারবেন ত্রিমাত্রিক ভার্চুয়াল বাস্তবতা। কিছু কিছু প্রযুক্তি দিয়ে সেই ত্রিমাত্রিক ভার্চুয়াল জগতে আপনি নানাভাবে মিথস্ক্রিয়াও করতে পারবেন। ত্রিমাত্রিক কম্পিউটার গেমের অন্যজগতের ভেতর প্রবেশ করে খেলা সম্ভব হবে। চলে যাওয়া যাবে মঙ্গলের পরিবেশে। ঘরে বসে ঘুরে বেড়ানো যাবে বিশ্বের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে। কাল নিউপোর্টের মতো অনেক কম্পিউটারবিদ আশা করছেন, এ প্রযুক্তিটি মানুষকে কর্মস্থলের ব্যাঘাত থেকে দূরে সরিয়ে গভীর মনযোগের সাথে জটিল সমস্যা সমাধান করতে সাহায্য করবে। হতে পারে একজন পেশাজীবি তাঁর হেডসেটটি পড়ে ভার্চুয়াল জগতে পাহাড়ি ঝরনার পাশে ল্যাপটপে প্রোগ্রামিং করবেন, কিংবা কোন গাণিতিক তত্ত্ব প্রতিপাদন করবেন। এছাড়াও গুগলের কার্ডবোর্ডের মতো কিছু প্রযুক্তি আছে যেগুলো যে কোন স্মার্টফোনে যুক্ত করে চোখে লাগালে তা বড় পর্দার টেলিভিশনের মতো হয়ে যাবে – যে পর্দা মানব-চোখের দৃশ্যক্ষেত্র জুড়ে ছড়ানো থাকবে। ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ মনে করেন, ভবিষ্যতে সামাজিক মাধ্যমগুলো ইন্টারনেটের ওয়েবসাইট না হয়ে একটা ত্রিমাত্রিক ভার্চুয়াল জগত হবে। সেখানে মানুষজন তাদের ভার্চুয়াল বাস্তবতার হেডসেটের মাধ্যমে একে অপরের সাথে মিথষ্ক্রিয়া করবে।

স্যামসাঙ ও ফেসবুকের ত্রিমাত্রিক বাস্তবতা উপভোগের অকুলাস হেডসেট সম্ভ্রম-সৃষ্টিকারী ত্রিমাত্রিক অভিজ্ঞতা দিতে পারে। তবে এ প্রযুক্তির উদ্ভাবকরা অনেকটা হতবাক হয়েই দেখছেন – প্রযুক্তিটি বিস্ময়কর ত্রিমাত্রিক জগতে কম্পিউটার গেম খেলা বা ভার্চুয়াল ভ্রমণের জন্য তেমন একটা ব্যবহার হচ্ছে না। অধিকাংশ ব্যবহারকারীরা এ প্রযুক্তিটি ব্যবহার করছেন দ্বিমাত্রিক চলচিত্র ও টেলিভিশন দেখার কাজে! ভার্চুয়াল বাস্তবতার এই হেডসেটগুলো যেহেতু মানব-চক্ষুর দৃশ্যক্ষেত্র জুড়ে চলচিত্র ছড়িয়ে দিতে পারে, তাই ব্যবহারকারীরা এটিকে নিজস্ব দানবীয়-পর্দার টেলিভিশনের মতো ব্যবহার করছেন। ভোক্তা হয়তো কোন ঘুপচিঘরে অন্ধকারে শুয়ে বা উড়োজাহাজের কমদামী সিটে কোনঠাসা হয়ে বসে আছেন। কিন্তু ভার্চুয়াল বাস্তবতার এই দানবীয় পর্দাতে টেলিভিশন, চলচিত্র ও ধারাবাহিক নাটক উপভোগ করতে বেশি পছন্দ করছেন। এছাড়া চীনে অনেকগুলো কোম্পানী যাত্রা শুরু করেছে যারা কম খরচে ভার্চুয়াল বাস্তবাত হেডসেট বানায়। এ কমদামী হেডসেটগুলোর মূল উদ্দেশ্যই হলো টেলিভিশন বা এ ধরনের দ্বিমাত্রিক চলচিত্র দেখা।

দেখা যাচ্ছে প্রযু্ক্তিবিদরা যেরকমটা আশা করেছিলেন সেরকম হয় নি। তারা ভেবেছিলেন ভার্চুয়াল বাস্তবতার হেডসেট মানুষ ত্রিমাত্রিক জগতে মিথস্ক্রিয়া করার জন্য ব্যবহার করবে। কিন্তু চলতি প্রবণতা হলো, মানুষ আগে টিভি-তে যা করতো, এখনো অধিকাংশই কম্পিউটার/ল্যাপটপে যা করেন,  ভার্চুয়াল বাস্তবতার হেডসেটেও অধিকাংশ ব্যবহারকারীরা তাই করছেন – অর্থাৎ টিভি, চলচিত্র ও ধারাবাহিক নাটক দেখছেন।

আমরা আবার আমাদের প্রথম প্রশ্নটি মনে করি – নতুন প্রযুক্তি (বিশেষতঃ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি) কি কোন মৌলিক পরিবর্তন করতে পারে? অনেকে মনে করেন – হ্যাঁ পারে। যেমন যখন বাংলাদেশে প্রথম মোবাইল ফোন এসেছিলো, তখন অনেক বিশেষজ্ঞই ভাবা শুরু করেছিলেন যে এর ফলে দেশ থেকে দারিদ্র্য চলে যাবে। তবে অনেকেই ভিন্নমত পোষণ করেন। যেমন প্রযুক্তিবিদ ও উদ্যোক্তা কেনটারো তোয়ামা তাঁর ২০১৫ সালে প্রকাশিত ‘Geek Heresy’ বইটিতে বলছেন, “প্রযুক্তির প্রাথমিক প্রভাব হলো এটি মানুষের কর্মশক্তিকে বিবর্ধিত করে। লিভারের মতো (একই ভাবে) প্রযুক্তি মানষের ধারণক্ষমতা তাদের অভীষ্ট দিকে বিবর্ধিত করে।” তোয়ামা ব্যাখ্যা করছেন – প্রযুক্তি প্রচলিত সামাজিক শক্তিকে ছাড়িয়ে যেতে পারে না; প্রযুক্তি প্রচলিত উদ্দেশ্যকে রূপান্তরিত করতে পারে না। বরং সমাজে যেসব প্রবণতা বর্তমান, সেগুলোকেই নতুন প্রযুক্তি বিবর্ধিত করে। যেমন যখন ইন্টারনেট ভিত্তিক সামাজিক মাধ্যমগুলো জনপ্রিয় হওয়া শুরু করলো, তখন অনেকেই ভাবলেন যে এ সামাজিক সাইটগুলো সাধারণ মানুষকে জ্ঞান-নির্ভর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ে রূপান্তরিত করবে। কিন্তু সেটা কি হয়েছে? বরং ইন্টারনেট ভিত্তিক সামাজিক মাধ্যমগুলো আমাদের গুজব করার প্রবণতা, নিজেদের সফলতাগুলো অতিগৌরবে অতিরঞ্জন করে প্রকাশ করা, আর যেখানে মনোযোগ দেয়া দরকার সেখান থেকে খুব সহজে চিত্তবিক্ষেপ হওয়ার বিদ্যমান প্রবণতাকেই বহুগুণে বাড়িয়েছে।

৩.
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আরো সহজ হয়ে গেলে কিংবা নতুন আবিষ্কার হলে তা মানুষের কাজের ধরণে মৌলিক রূপান্তর আনতে পারে কি না – এর পাশাপাশি নতুন উদ্ভাবনগুলোর প্রতিক্রিয়া নিয়েও আলোচনা করা প্রয়োজন। যেহেতু এসব নতুন উদ্ভাবনের অধিকাংশ ব্যবহারকারীরা তরুণ, তাঁদের উপর প্রযুক্তিগুলোর কোন নেতিবাচক প্রভাব আছে কিনা সেটাও খতিয়ে দেখা দরকার। পাশ্চাত্যে ইতিমধ্যে এ প্রভাবগুলো নিয়ে নানা রকমের আলোচনা ও গবেষণা শুরু হয়ে গেছে। জোলে রেনস্ট্রম যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখালেখি ও গবেষণা বিষয়ে শিক্ষকতা করেন। তিনি সম্প্রতি অনলাইন ম্যাগাজিন Aeon-এ একটি প্রবন্ধে প্রশ্ন তুলেছেন ‘Can students who are constantly on their devices actually learn?”

প্রথমেই বলে রাখা ভালো শিক্ষাক্ষেত্রে প্রযুক্তি ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অসংখ্য সুবিধা আছে। জোলে রেনস্ট্রর্ম তাঁর শিক্ষার্থীদের টুইটার একাউন্টে তাদের গবেষণার বিষয় সংক্রান্ত প্রকাশনা, গবেষক, বিদ্বানব্যক্তি, সম্পর্কিত সংগঠন ও বিভাগকে অনুসরণ (follow) করতে উৎসাহ দেন। তাঁরা ক্ষুদেব্লগে থিসিসের বিষয়বস্তু ও গবেষণার মূল প্রশ্নগুলো একে অপরের কাছে ‘টুইট’ করার মাধ্যমে উপস্থাপনা করেন। কিভাবে উইকিপিডিয়াতে বিভিন্ন নিবন্ধ থেকে প্রাথমিক গবেষণা, গুরুত্বপূর্ণ সংজ্ঞাবদ্ধ-শব্দ, বিতর্কিত বিষয়বস্তু ও বিভিন্ন মৌলিক রেফারেন্স-উৎস সংগ্রহ করতে হয় সে বিষয়ে তিনি শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দেন। তাঁরা সামাজিক সংযোগ মাধ্যম রেডিট (Reddit) এর বিভিন্ন উপবিভাগ এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপে গবেষণা সম্পর্কিত বিষয়ে তথ্য খোঁজেন।

এতো সুবিধা থাকা সত্ত্বেও প্রযুক্তি-আসক্তি শেখার ক্ষেত্রে একটা বড় বাঁধা হয়ে দাড়িয়েছে। নেব্রাস্কা-লিঙ্কন বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি গবেষণায় দেখা গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী ক্লাসে পাঠদানের সময়ে টেক্সট মেসেজ পাঠান। শিক্ষার্থীরা স্বীকার করছেন যে ক্লাসের ৫০ মিনিট সময়ে তারা স্মার্টফোন চেক না করে থাকতে পারেন না। খুব অল্প সংখ্যক শিক্ষার্থী এই আগ্রহ দমন করতে পারেন। ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট বিশ্বিবিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, উচ্চমাধ্যমিক ও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর পনেরো মিনিট গবেষণা করতে বলা হলে দুই মিনিট চলে যেতে না যেতেই তাদের মনোযোগ সরে যায়। তারা মোবাইল ফোনে মেসেজ চেক করা কিংবা অসম্পর্কিত ওয়েবসাইট ব্যবহার করা শুরু করেন। জোলে রেনস্ট্রমের শিক্ষার্থীরাও এসব সমস্যা সম্পর্কে সচেতন। কিন্তু তাঁরা কোনভাবেই এ সমস্যাগুলো থেকে দূরে থাকতে পারছেন না। তিনি উল্লেখ করেন, It is almost like the student is describing a Body Snatchers scenario, getting taken over by forces he’s aware of but can’t seem to control। অণুজীববিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে আমিও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটা প্রবণতা খেয়াল করছি যে তাঁরা চূড়ান্ত পরীক্ষার আগের রাত্রের মতো চাপপূর্ণ সময়েও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রবেশ করে তাদের চাপপূর্ণ অবস্থা বর্ণনা করার (অনেকক্ষেত্রে হাস্যরসাত্মক ভাষায়) লোভ সামলাতে পারছেন না।

ঘন ঘন স্মার্টফোন চেক করা বা ইন্টারনেটে তথ্য খুঁজতে গিয়ে অসম্পর্কিত ওয়েব সাইট ঘাঁটার সাথে সাথে শেখার সম্পর্ক কি? সমস্যা হলো মানব-মস্তিষ্ক সমান্তরালে দুইটি কাজ করতে পারে না। কম্পিউটার অতীতের থ্রেডিং প্রযুক্তি বা হালের মাল্টি-কোর প্রসেসরে সমান্তরাল গণনার মাধ্যমে একই সাথে একাধিক সফটওয়্যার চালাতে পারে। দূর্ভাগ্যক্রমে, মস্তিষ্ক এমন নয়। হ্যাঁ, আমরা খাওয়ার সময় টিভি দেখতে পারি কিংবা হাঁটতে হাঁটতে কথা বলতে পারি।  এখানে এ ধরনের কাজের কথা বলা হচ্ছে না, বলা হচ্ছে মস্তিষ্কের মনোনিবেশ করার ক্ষমতার কথা। আমরা একসাথে দুইটি কাজে মনোযোগ দিতে পারি না। কখনো কি একসাথে দু’জনের সাথে কথা বলে দেখেছেন কি? মস্তিষ্কের মনোযোগ দেয়ার নিজস্ব পদ্ধতির কারণে একসাথে দুইটি কথোপকথোন চালানো অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। ঠিক একই কারণে গাড়িচালকরা গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোনে কথা বললে দূর্ঘটনার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। শিক্ষার্থীরা যখন ক্লাসরুমে কিংবা পড়ার সময় স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় নানা রকম প্রযুক্তি দিয়ে বাধাগ্রস্থ হন, তার ফলাফল কি হবে তা সহজেই অনুমেয়। তাঁরা আর যাই হোক, পাঠে সহজে মনোনিবেশ করতে পারবেন না। সকল শিক্ষার্থীরই সম্ভবত এ অভিজ্ঞতা আছে – পড়তে বসার কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ ফোন বা মেসেজ এলে সেটার পেছনে কিছুক্ষণ সময় দিয়ে পড়ায় ফিরলে আগে যা পড়েছিলেন তা দূর্বোধ্য ঠেকে। গবেষণায় দেখা গেছে একবার কোন কারণে মনোযোগ ভেঙে গেলে তা আবার কেন্দ্রীভূত হতে ২৫ মিনিটের মতো সময় লাগতে পারে। অর্থাৎ মনোযোগ দেয়াটা একটা ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া।

তাছাড়া দুইটি কাজে মনোযোগ পরিবর্তন করলে ভুলের সংখ্যাও বাড়ে। ১৯৯৫ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, কোন কাজ করার সময় বার বার ব্যাঘাত ঘটিয়ে অন্য কাজে মনোযোগ দিলে (অর্থাৎ সমান্তরালে এক সাথে একাধিক কাজ করতে চাইলে) ভুলের সংখ্যা শুধুমাত্র একটি কাজ করার তুলনায় কয়েকগুণে বেড়ে যায় (চিত্র ১ দ্রষ্টব্য)।

চিত্র-১: জার্নাল অফ এক্সপেরিমেন্টাল সাইকোলজিতে প্রকাশিত একটি গবেষণার ফলাফল (রজার ও মনসেল, ১৯৯৫)। প্রতিটি পরীক্ষাতে নিরবচ্ছিন্ন ও বিঘ্নিত কাজ ছিলো। উপাত্তগুলো সংখ্যা- ও অক্ষর-ভিত্তিক কাজের পরীক্ষা থেকে নেয়া হয়েছে।

তাই যখন জোলে রেনস্ট্রম অভিযোগ করেন যেসব শিক্ষার্থীরা সবসময় তাদের বিভিন্ন প্রযুক্তি-যন্ত্রের সাথে যুক্ত তারা প্রকৃতপক্ষেই শিখতে পারেন কি না, তখন অভিযোগটি আর অবান্তর মনে হয় না। যুক্তরাষ্ট্রে ১৮-২৪ বছর বয়সীরা প্রতিদিন গড়পড়তা ৭৪-বার মোবাইল ফোন চেক করেন। কিন্তু কেন? এই আসক্তির কারণ কি?

বিভিন্ন অনলাইন একাউন্ট বার বার চেক করার প্রবণতাকে বলে প্রযুক্তি-আসক্তি। এসব একাউন্টে হালনাগাদ পুনরায় চেক করা সম্ভব বলেই আমরা এটা করি। এছাড়াও অনেকেই ‘হারিয়ে ফেলার ভয়’ (fear of missing out বা FOMO) থেকেও প্রযুক্তি আসক্ত হয়ে পড়েন। যেহেতু এসব একাউন্টে সব সময়েই কিছু না কিছু ‘ঘটছে’, একাউন্টের বন্ধুমহলে কেউ না কেউ তাদের ‘আপডেট’ দিচ্ছে, তাই একাউন্ট থেকে বিচ্ছিন্ন হলে ব্যবহারকারী কিছু না কিছু ‘হারিয়ে’ ফেলছেন। সেজন্য আমরা প্রায়ই একাউন্টে প্রবেশ করতে ‘বাধ্য’ হই আগেরবার প্রবেশের পর থেকে নতুন কি ঘটলো তা দেখার জন্য। অথবা ‘নতুন কিছুই ঘটে নি’ নিশ্চিত করার জন্য। অনেক গবেষক বলছেন এটা মাদকাসক্তির মতোই মস্তিষ্কের ‘ডোপামিন প্রণোদনা চক্র’ ব্যবহার করে। মাদকাসক্তরা মাদক গ্রহণ করলে মস্তিষ্কে নিউরোট্রান্সমিটার ডোপামিন নিঃসৃত হয়। ডোপামিন আমাদের আনন্দানুভূতির জন্য দায়ী। তারা ধারণা করছেন ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়া বা কোন ছবিতে ‘লাইক’-এর সংখ্যা গণনার মতো আচরণ মস্তিষ্কে ডোপামিন প্রণোদনা চক্র প্রতিষ্ঠা করে বলেই আমরা এভাবে প্রযুক্তি-আসক্ত হয়ে পড়ি।

৪.
বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে তথ্য-যোগাযোগ প্রযুক্তির বিবিধ উদ্ভাবন ইতিবাচকের পাশাপাশি কি কি নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে তা নিয়ে এখন পর্যন্ত কোন গবেষণা বা জরিপ নেই। তবে দেশেও এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে সচেতনতা তৈরি হচ্ছে। গত ৭ অক্টোবর অনুসন্ধিৎসু চক্রের আয়োজনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যলায়ের মোকাররম ভবন মিলনায়তনে ‘তরুণ প্রজন্মের উপর স্মার্টফোনের প্রভাব’ শীর্ষক একটি আলোচনা হয়ে গেল। সেখানে বাংলাদেশ একাডেমী অব সায়েন্সেসে-র ফেলো, গবেষক ও প্রবীণ বিজ্ঞান লেখক অধ্যাপক ড. আলী আসগর স্যার বললেন, সৃজনশীলতার জন্য দরকার একাকীত্বতার। গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলো কঠিন হয়, সে সমস্যাগুলোতে গভীর মনোযোগ দিতে হয়। আধুনিক প্রযুক্তিগুলো দেখা যায় অনেক ক্ষেত্রেই মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটায়। আবার সৃজনশীলতার ফলাফলটা সহজে ছড়িয়ে দিতে আধুনিক প্রযুক্তি খুবই উপযোগী। তিনি বলেন, কিভাবে নিজের জীবনের সাথে প্রযুক্তির সমন্বয় করতে হবে সেটা তরুণদেরকেই খুঁজে নিতে হবে। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিক্যাল ফিজিক্স বিভাগের অধ্যাপক ড. খন্দকার সিদ্দিক-ই-রব্বানী প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে ‘বেছে’ নেয়াটাকে গুরুত্ব দেন। কোন প্রযুক্তি কিভাবে ব্যবহার করবো তা বেছে নিতে সক্রিয়ভাবে চেষ্টা করতে হবে, কাজে মনোযোগের ক্ষেত্রে প্রযুক্তি যাতে বাধা হয়ে না দাঁড়ায় সেই ভারসাম্যটা শিখতে হবে। তিনি উল্লেখ করেন এ বেছে নেয়ার ক্ষেত্রে আমরা কি ধরনের সমাজ চাই সেটা ঠিক করে নেয়া গুরুত্বপূর্ণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সৌরবিদ্যুৎ নিয়ে কাজ করা প্রকৌশলী মো: সাজেদুল হোসেন সরকার জানালেন মোবাইলফোন সহ বিভিন্ন প্রযুক্তিগুলো ঠিক কি ধরনের বিকিরণজাত দূষণ ছড়াচ্ছে তা বিজ্ঞানীরা এখনো সঠিকভাবে জানতে না পারলেও এটা গণস্বাস্থ্যের জন্য সাম্ভাব্য স্বাস্থ্যঝুঁকি হতে পারে।

সম্প্রতি জনপ্রিয় বিজ্ঞান-কল্পকাহিনি লেখক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ফেইসবুক আমাদের তরুণ সমাজের এত পরিমান সময় নষ্ট করেছে তা চিন্তার বাইরে।” শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তি-আসক্তির একটি দিক সম্পর্কে তিনি বলছেন, আমি ফেইসবুকের বসলাম কিন্তু উঠতে পারছি না। আমি জানি আমাকে হোমওয়ার্ক করতে হবে তবুও নেশা ছাড়তে পারছি না এই মাধ্যমটির। পড়া বাদ দিয়ে ফেইসবুকিং করছি। তখনই বুঝতে হবে ফেইসবুকের নেশায় আক্রান্ত হয়েছে গেছি আমি। এটি মাদকের মতই ভয়ংকর একটি নেশা।

বাংলাদেশে বিভিন্ন মোবাইলফোন কোম্পানীগুলো স্মার্টফোনে নানাভাবে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে উৎসাহিত করে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। কারণ এই প্রযুক্তি ও সেবাগুলো শুধু জীবনকে সহজকরে দেয়ার উপায় শুধু নয়, এগুলো পণ্যও বটে। একটি প্রজন্ম এই প্রলুব্ধকর পণ্যে আসক্ত হয়ে লেখাপড়ার ক্ষতি হলেও এ কোম্পানীগুলোর লাভ ক্রমাগত বেড়েই চলবে।

এই প্রযুক্তি-আসক্তির নেতিবাচক প্রভাব থেকে দূরে থাকার উপায় কি? আমি নতুন প্রযুক্তি বর্জনের বিপক্ষে। বর্জন কোন সমাধান নয়। আমাদের প্রযুক্তি ব্যবহারের নিয়ন্ত্রনটা আয়ত্ত্ব করতে হবে। ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল যেমন বলেছেন, “প্রযুক্তি ব্যবহার করো কিন্তু প্রযুক্তি যেনো তোমাকে ব্যবহার না করে।” শিক্ষার্থীরা পড়াশুনার একটা রুটিন মেনে চললে, পড়ার সময়টাতে স্মার্টফোন বন্ধ করে বা নীরব করে দূরে সরিয়ে রাখলে উপকার পাবেন। একই কথা শিক্ষক, গবেষক, প্রোগ্রামারসহ, প্রযুক্তিবিদ অন্যান্য জ্ঞানকেন্দ্রীক সৃজনশীল পেশাজীবিদের জন্যেও প্রযোজ্য যাদের পেশাগত কারণেই কম্পিউটার, ইন্টারনেট ইত্যাদির উপর অনেকাংশে নির্ভর করতে হয়। বিভিন্ন ইন্টারনেট ব্রাউজার সফটওয়্যারগুলোতে কিছু এড-অনস পাওয়া যায় যেগুলো নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নির্দিষ্ট সাইটের ব্যবহার সীমাবদ্ধ করে রাখতে পারে। সচেতন ব্যক্তিকেই খুঁজে নিতে হবে তিনি কিভাবে প্রযুক্তি-আসক্তি থেকে দূরে থাকবেন।

লেখাপড়া, গবেষণা, সৃজনশীলতা একাকী গভীর মনোযোগ দেয়া নিরবচ্ছিন্ন সময় দাবী করে। প্রযুক্তি-আসক্তি যাতে এ বিষয়ে বাঁধা হয়ে না দাঁড়ায়।

তথ্যসূত্র:
১) Technology Alone Won’t Make You Better at What You Do, Cal Newport, http://calnewport.com/
২) Can students who are constantly on their devices actually learn?,  Joelle Renstrom, aeon.co
৩) VR’s Big Surprise: 3-D Worlds Have Little Appeal,  Tom Simonite, MIT Technology Review
৪) ফেসবুক বন্ধ থাকায় ফ্রিল্যান্সিং ও ই-কমার্সে ধস, দৈনিক জনকন্ঠ, ৬ ডিসেম্বর ২০১৫
৫) তরুণ প্রজন্মের উপর স্মার্টফোনের প্রভাব, আলোচনা অনুষ্ঠান, ৭ অক্টোবর ২০১৬, http://achokro.org
৬) ফেইসবুক ভয়ংকর, দেশে এটি পুরোপুরি বন্ধে আপত্তি নেই, ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের সাক্ষাৎকার, ২২ অক্টোবর ২০১৬,  http://techshohor.com
৭)  Meet the Life Hackers,  Clive Thompson,  http://www.nytimes.com/

আরাফাত রহমান
প্রভাষক,  অণুজীববিজ্ঞান বিভাগ, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
[লেথকের ফেসবুক প্রোফাইল]

Exit mobile version