বিজ্ঞান পত্রিকা

পরমাণুর গহীন নিসর্গে | ৬: নিউট্রন | ৬.১: প্রোটন এবং ইলেক্ট্রন

অধ্যায়-৬: নিউট্রন
অনুচ্ছেদ-১: প্রোটন এবং ইলেক্ট্রন
[বইয়ের সূচীপত্র তথা প্রকাশিত সবগুলো আর্টিকেলের জন্য এখানে দেখুন]

পদার্থবিদদের জন্য সরলতা তৈরির আকাঙ্খাই শুধুমাত্র নিউক্লিয়াসের গঠনের রাজ্যে উঁকি দেওয়ার একমাত্র চালিকা শক্তি ছিল না। তেজষ্ক্রিয় পদার্থগুলোর প্রকৃত পর্যবেক্ষণ থেকে ধারণা পাওয়া যায় কিছু নিউক্লিয়াসের একটি আভ্যন্তরীণ গঠন রয়েছে, সেটি তৈরি হতে পারে অপেক্ষাকৃত সরল কণিকার গুচ্ছ দ্বারা। এই কারণেই কিছু তেজষ্ক্রিয় নিউক্লিয়াস বিটা কণিকা (ইলেক্ট্রন) নির্গত করে আর কিছু নিউক্লিয়াস আলফা কণিকা  হিলিয়াম নিউক্লিয়াস) নির্গত করে। এধরনের নিঃসরণের সবচেয়ে সহজ ব্যাখ্যা হলো, নিউক্লিয়াসগুলো নিজেরা সরলতর নিউক্লিয়াস এবং ইলেক্ট্রন সহযোগে গঠিত যেগুলো কখনো কখনো কারণবশতঃ শিথিল হয়ে যায়।

আমরা যদি এই ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট থাকি যে, কিছু নিউক্লিয়াস অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র নিউক্লিয়াস এবং সাথে ইলেক্ট্রন সহযোগে গঠিত হয়, তাহলে খুব সহজেই এটি অনুমান করে নেওয়া যায় যে, সব নিউক্লিয়াসই এই ধরনের কাঠামো নিয়ে গঠিত। সরলতার দোহাই দিয়ে আমরা এটিও ধরে নিতে পারি, যখন নিউক্লিয়াসগুলো সরলতর নিউক্লিয়াস দিয়ে গঠিত হয় তখন সেগুলো যথাসম্ভব সরলগুলো দিয়েই গঠিত হবে।

সবচেয়ে ক্ষুদ্র নিউক্লিয়াসটি হাইড্রোজেন-১ এর বলে জানা ছিল। এর ভরসংখ্যা ১ এবং বৈদ্যুতিক চার্জ +১। রাদারফোর্ড হাইড্রোজেন-১ এর নিউক্লিয়াসকে প্রোটন নাম দিয়েছিলেন, এবং ১৯২০ এর দশকের দিনগুলোতে একটি ধারণা ছিল, প্রোটনই হচ্ছে সম্ভাব্য সবচেয়ে সরল কণিকা যা একটি ধনাত্মক চার্জ ধারণ করতে পারে। সেই সময় তাই এই তত্ত্ব জেগে উঠলো যে, পরমাণুর নিউক্লিয়াস হয়তো প্রোটন এবং ইলেক্ট্রনের পারস্পরিক সংঘর্ষে অল্প আয়তনের মধ্যে গঠিত হয়েছে।

বিভিন্ন তেজষ্ক্রিয় পরমাণু হতে উৎপন্ন আলফা কণিকার ভর সংখ্যা ৪, তাই এটি চারটি প্রোটন দিয়ে গঠিত হতে পারে যাদের প্রতিটির ভর সংখ্যা ১। তবে প্রতিটি আলফা কণিকার +২ করে বৈদ্যুতিক চার্জ আছে, আর ৪টি প্রোটনের মোট চার্জ +৪। তাই এখান থেকে মনে হয়, ৪টি প্রোটনের সাথে আলফা কণিকায় দুটি ইলেক্ট্রনও রয়েছে। এরা দুটি ধনাত্মক চার্জকে নিষ্ক্রিয় করে দেয় এবং ইলেক্ট্রনের ভর তুচ্ছ হওয়ায় এরা কণিকায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে অতিরিক্ত ভর যুক্ত করে না। একটি ৪-প্রোটন/২-ইলেক্ট্রন বিশিষ্ট আলফা কণিকায় এভাবেই পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী ভর হবে ৪ এবং চার্জ হবে +২।

এই ধরনের জিনিস অন্যান্য নিউক্লিয়াসের জন্যও নির্ণয় করা যায়। উদাহরণস্বরূপ অক্সিজেন-১৬ নিউক্লিয়াসের ভর ১৬ এবং চার্জ +৮, তাই এতে ১৬ টি প্রোটন এবং ৮টি ইলেক্ট্রন থাকার কথা। অক্সিজেন-১৭ এর দিকে লক্ষ্য করা যাক, এর একটি অতিরিক্ত প্রোটন-ইলেক্ট্রন জোড়া আছে, যা এর ভর ১ বৃদ্ধি করে এবং চার্জে কোনো প্রভাব ফেলে না। ১৭টি প্রোটন এবং ৯ টি ইলেক্ট্রন মিলে মোট ভর হয় ১৭ এবং চার্জ হয় +৮। আবার, অক্সিজেন-১৮ নিউক্লিয়াসকে লক্ষ্য করা যাক, আরো একটি অতিরিক্ত প্রোটন-ইলেক্ট্রন জোড় সহযোগে, যাতে করে তাদের মোট ১৮ টি প্রোটন এবং ১০ টি ইলেক্ট্রন থাকে, যেন মোট ভর সংখ্যা হয় ১৮ এবং মোট চার্জের পরিমাণ হয় +৮।

কিছু সময়ের জন্য পদার্থবিদগণ এই তত্ত্ব নিয়ে হাওয়ায় ভেসে বেড়িয়েছিলেন, বিশেষত এই কারণে যে, এটি মহাবিশ্বকে অতিমাত্রায় সরলীকৃত করে ফেলতে পারছে। এই তত্ত্ব অনুযায়ী মহাবিশ্বের সকল বস্তুগত ব্যাপার যা প্রায় ১০০টির মত বিভিন্ন ধরনের পরমাণু দিয়ে গঠিত, যাদের প্রতিটি এই দৃষ্টিকোণ থেকে সমান সংখ্যক দুই ধরনের সাব-অ্যাটমিক কণিকা, প্রোটন এবং ইলেক্ট্রন দিয়ে গঠিত। প্রতিটি প্রোটন নিউক্লিয়াসের কেন্দ্রে অবস্থান করে, আর কিছু কিছু ইলেক্ট্রন নিউক্লিয়াসে এবং অবশিষ্টগুলো নিউক্লিয়াসের বাইরে অবস্থান করে।

এছাড়াও, দেখে মনে হলো যে, সমগ্র মহাবিশ্ব দুই ধরনের বলক্ষেত্র দ্বারা আবদ্ধ। নিউক্লিয়াস প্রোটন এবং ইলেক্ট্রনের মধ্যকার তড়িৎচৌম্বক আকর্ষণের মাধ্যমে যুক্ত, আর সার্বিকভাবে পরমাণু নিউক্লিয়াস এবং ইলেক্ট্রনের পারস্পরিক তড়িৎচৌম্বক আকর্ষণের মাধ্যমে যুক্ত। ইলেক্ট্রন আদান-প্রদান কিংবা শেয়ারের মাধ্যমে বিভিন্ন পরমাণু পরস্পরের সাথে যুক্ত হয়ে অণু তৈরি করে, কিংবা ক্রিস্টাল তৈরি করে। কিংবা কঠিন বস্তুসমূহ তৈরি করে যা এমনকি গ্রহের সমান বিশাল হতে পারে। এমন কিছু কি আছে যারা নিজেদের মধ্যে তড়িৎ-চৌম্বক ক্ষেত্রের মাধ্যমে আবদ্ধ নয়? হ্যাঁ, নিশ্চয়ই আছে।

গ্যাসের অণুসমূহ দূরে দূরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে এবং কেবলমাত্র খুব সামান্য পরিমাণ তড়িৎ-চৌম্বকত্ব প্রদর্শন করে। কিন্তু শুধুমাত্র যদি এই বলটিই এদের উপর কাজ করত, তাহলে এরা পরস্পরের কাছ থেকে ছড়িয়ে গিয়ে মহাবিশ্বের গহবরে হারিয়ে যেত। তবে গ্যাসসমূহ কোনো একটি বিশাল বস্তুর সাথে অন্য কোনো কিছুর প্রভাবে যুক্ত থাকে। সেটি হচ্ছে মাহাকর্ষীয় আকর্ষণ। এর কারণেই পৃথিবীর বায়ুমন্ডল এর সাথে যুক্ত আছে।

তবে, মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র দুর্বল। গ্যাসীয় পদার্থকে আবদ্ধ রাখার জন্য একটি বিশাল বস্তুর প্রয়োজন হয়। উদাহরণস্বরূপ, কম গলনাঙ্ক বিশিষ্ট গ্যাসসমূহ বাষ্পীভূত হওয়ার প্রবণতা দেখায় এবং মহাকর্ষ বল যথেষ্ট তীব্র না হলে এরা মহাশূন্যে হারিয়ে যেতে পারে। পৃথিবীর মহাকর্ষীয় টানের কারণে আমাদের মহাসাগর আছে কিন্তু চাঁদের পৃষ্ঠে মুক্ত পানি ধরে রাখার জন্য এর যথেষ্ট টান নেই।

মহাশূন্যে দুটি বস্তুর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ দুরত্ব থাকলে সেগুলো মহাকর্ষের মাধ্যমে যুক্ত থাকে। উপগ্রহ-গ্রহের সাথে, গ্রহ-নক্ষত্রের সাথে, নক্ষত্র একে অপরের সাথে গ্যালাক্সি তৈরির মাধ্যমে। গ্যালাক্সিগুলো একে অপরের সাথে যুক্ত থেকে গ্যালাক্সিপুঞ্জ গঠন করে। সার্বিকভাবে মহাবিশ্ব মহাকর্ষীয় আকর্ষণের মাধ্যে আবদ্ধ।

এই সাথে আরো বাস্তবতা হলো, তড়িৎ-চৌম্বক ক্ষেত্র ফোটন বিকিরণের সাথে জড়িত আর মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র জড়িত গ্র্যাভিটন বিকিরণের সাথে। মনে হতে পারে, এই মহাবিশ্ব কেবল চারটি কণিকা দিয়েই গঠিত: প্রোটন, ইলেক্ট্রন, ফোটন এবং গ্র্যাভিটন। প্রোটনের ভর সংখ্যা ১ এবং চার্জ +১ এবং এর ঘূর্ণন +১/২ অথবা -১/২। ইলেক্ট্রনের ভর সংখ্যা ০.০০০৫৫ এবং চার্জ -১ এবং এর ঘূর্ণন +১/২ অথবা -১/২। ফোটনের ভর সংখ্যা ০, চার্জ ০ এবং এর ঘূর্ণন +১ অথবা -১। গ্রাভিটনের ভর সংখ্যা ০, চার্জ ০ এবং এর ঘূর্ণন +২ অথবা -২।

কতই না সরল বিষয়টি! এটি প্রাচীন গ্রিকদের ধারণার চেয়ে সরল, যারা মনে করত পৃথিবীতে চার ধরনের মৌল বিদ্যমান এবং পঞ্চম একটি মৌল স্বর্গীয় বস্তুসমূহ গঠনের জন্য যুক্ত। বাস্তবিকই ১৯২০ এর দশকের কয়েক বছরে মহাবিশ্বকে যতটা সরল হিসেবে দেখা গিয়েছিল তেমনটি আর কখনো দেখা যায় নি।

প্রকৃতপক্ষে, এটিকে আরো সরলীকৃত করার জন্য একটি সাহসী পদক্ষেপ দেখা গেল। কেন দুধরনের বলক্ষেত্র: তড়িৎ-চৌম্বক এবং মহাকর্ষের অস্তিত্ব থাকবে? এগুলোকি একই ঘটনার দুটি দিক হতে পারে না? একগুচ্ছ সমীকরণ কি এই দুটি দিককেই ব্যাখ্যা করতে পারে না?

নিশ্চিতভাবেই, তড়িৎ-চৌম্বক ক্ষেত্র এবং মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রকে সম্পূর্ণ ভিন্ন মনে হয়। তড়িৎ-চৌম্বক ক্ষেত্র কেবলমাত্র বৈদ্যুতিকভাবে চার্জিত কণিকার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কিন্তু মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র ভরবিশিষ্ট সবধরনের কণিকার সাথে যুক্ত, চার্জ থাকুক বা না থাকুক। তড়িৎ-চৌম্বক ক্ষেত্রের সাথে আকর্ষণ ও বিকর্ষণ উভয়টিই জড়িত। অথচ মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রে শুধুমাত্র আকর্ষণই পাওয়া যায়। একজোড়া নির্দিষ্ট কণিকার জন্য তড়িৎচৌম্বক ক্ষেত্র মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের চেয়ে ট্রিলিয়নের ট্রিলিয়নের ট্রিলিয়নগুণ বেশি তীব্র। সেই কারণে একজোড়া ইলেক্ট্রন-প্রোটনের মধ্যে আমার শুধুমাত্র তড়িৎ-চৌম্বক আকর্ষণ আমলে নিই, কেননা এর তুলনায় মহাকর্ষীয় বলটি অত্যন্ত নগণ্য।

তবে তারপরেও এই ধরনের পার্থক্য একীভূতকরণের জন্য বাধা হতেই হবে, এমন কোনো কথা নেই। প্রাথমিক বিবেচনায় চৌম্বকত্ব, বিদ্যুৎ এবং আলোকেও তিনটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের ঘটনা মনে হয়েছিল। কিন্তু ম্যাক্সওয়েল আবিষ্কার করলেন, এই তিনটি ঘটনাকে একই সমীকরণগুচ্ছ দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায়। তিনি দেখালেন এই তিনটি বিষয় একই ঘটনার তিনটি আলাদা দিক।

আইনস্টাইন ছাড়া আর কেউই তাঁদের জীবনের শেষ দশকগুলো ম্যাক্সওয়েলের কাজকে বিবর্ধিত ও পরিপূর্ণ করার জন্য সূত্র খুঁজে বেড়াননি। যেই সূত্রগুলো মহাকর্ষকেও এর মধ্যে অন্তুর্ভুক্ত করে একটি মাত্র তত্ত্ব প্রদান করবে যাকে বলা যাবে একীভূতক্ষেত্র তত্ত্ব। আইনস্টাইন ব্যার্থ হয়েছিলেন, তবে আমরা দেখতে পাব এই প্রচেষ্টা থেমে যায়নি।

অবশ্য শেষ পর্যন্ত নিউক্লিয়াসের গঠনের প্রোটন-ইলেক্ট্রন ব্যবস্থা টিকে থাকেনি। এতে একটি বিশাল ত্রুটি ছিল।

-ইমতিয়াজ আহমেদ
সম্পাদক, বিজ্ঞান পত্রিকা
[লেখকের ফেসবুক প্রোফাইল]

Exit mobile version