বিজ্ঞান পত্রিকা

দ্যা মোজার্ট ইফেক্ট: ধ্রুপদী সঙ্গীত কি সত্যিই বুদ্ধিমত্তার বিকাশে কার্যকর?

১৯৯৩ সালে নেচার জার্নালে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার মনোবিজ্ঞানী ফ্রান্সেস এইচ. রশার এবং তাঁর সহকর্মীবৃন্দ একটি গবেষণা প্রকাশ করেন যাতে তাঁরা দাবী করেন মোজার্টের সঙ্গীত শুনতে দেওয়ার পর একদল কলেজ ছাত্রের বিশেষ কিছু বুদ্ধিবৃত্তিক কাজে পারদর্শিতা বৃদ্ধি পেয়েছে। মোজার্টের ১৭৮১ সালের D-মেজর স্কেলে কম্পোজকৃত দুই পিয়ানোর সোনাটা শোনার পর ছাত্রদের মস্তিষ্কের চিন্তাধারা উন্নত হয়েছে বলে মনে করা হয়। এই গবেষনায় ৩৬ জন ছাত্র অংশগ্রহণ করে। এদের তিনভাবে ভাগ করে একদলকে ১০ মিনিট নিরবতার মাঝে রাখা হয়, অপর একটি দলকে দশ মিনিট শিথীলতার বয়ান শোনানো হয় এবং শেষ দলটিকে মোজার্টের পিয়ানো সোনাটা শোনানো হয়।

যেসব ছাত্র মোজার্টের পিয়ানো শুনেছে তাদের মনে মনে বিশেষ কিছু আকৃতি তৈরি করতে অপেক্ষাকৃত দক্ষতার পরিচয় দিতে দেখা গেল। একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বিশেষভাবে ভাঁজ করা একটি কাগজকে খোলা অবস্থায় কেমন আকৃতিতে দেখা যাবে তা সঠিকভাবে নির্ধারণ করতে তারা অন্যদের চেয়ে ভালো ফলাফল দেখালো। তবে দুঃখজনক ভাবে এই উন্নত কার্যকারিতা সঙ্গীত শ্রবণের ১৫ মিনিটের বেশী স্থায়ী করা যায় নি যা গবেষকগণ তাঁদের গবেষণাপত্রে উল্লেখও করেছেন।

এতদসত্ত্বেও “মোজার্ট ইফেক্ট” প্রবচনটি চালু হয়ে গেলো। সঙ্গীতের সাথে মেধার এই বিকাশ আপাতদৃষ্টিতে যুক্তিসঙ্গতও মনে হলো। মোজার্ট নিজে একজন অসাধারণ প্রতিভাধর সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন। তাঁর সঙ্গীত কম্পোজিশন বেশ বৈচিত্রময় এবং জটিল ছিলো। কাজেই তাঁর সঙ্গীত যথেষ্ট পরিমান শ্রবণে প্রতিভার কিছুটা বিকাশ হলেও হতে পারে!

সেই সময় হাজার হাজার বাবা-মা তাঁদের সন্তানের জন্য এই ধারনা ঝড়ের বেগে গ্রহণ করলেন। ১৯৯৪ সালে নিউইয়র্ক টাইমসের কলামিস্ট এলেক্স রস “গবেষকগণ নিশ্চিত হয়েছেন মোজার্ট শ্রবণে আপনি সত্যিই আরো প্রতিভাবান হয়ে উঠবেন” শিরোনামে একটি আর্টিকেল লিখেন। মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বৃদ্ধির জন্য হাসপাতালগুলোতে হেডফোনের মাধ্যমে নবজাতক শিশুদের জন্য সঙ্গীতের ব্যবস্থা করা হয়। ১৯৯৮ সালে জর্জিয়ার গভর্ণর বাজেটে এই বাবদ অর্থ বরাদ্দেরও দাবী করলেন যেন নবজাতকের জন্য ধ্রুপদী সঙ্গীতের সিডি পাঠানো যায়। শুধু শিশুদের জন্যই নয় মনোবিজ্ঞানী ডেলা সালার ভাষ্য অনুযায়ী, তিনি যখন ইতালিতে একটি দুগ্ধ খামার পরিদর্শন করছিলেন সেখানে কৃষকেরা গর্বের সাথে তাকে শুধিয়েছিলেন যে, সেই খামারের গরুদের দিনে তিনবেলা করে মোর্জাট শুনতে দেওয়া হয় যাতে করে তারা ভালো মানের দুধ উৎপাদন করে!


সত্যিই মোজার্ট শ্রবণে দুধের মান বাড়ে কিনা সেই বিতর্ক কৃষকদের জন্যই তোলা থাক। আপাততঃ আমরা নেচারে প্রকাশিত গবেষকদের গবেষনা বিশ্লেষণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকি। প্রথম বিষয় হলো গবেষকরা তাঁদের গবেষণাপত্রের কোথাও “মোজার্ট ইফেক্ট” টার্মটিই ব্যবহার করেন নি।তার ওপরে তাঁরা এই সঙ্গীতের প্রভাব শিশুদের উপরেও গবেষণা করেন নি বরং প্রাপ্তবয়ষ্ক কলেজ ছাত্রদের বেছে নিয়েছিলেন। এবং মাত্র ৩৬ জন ছাত্রকে এই কাজের জন্য ব্যবহার করা হয়েছিলো যা একটি বৈজ্ঞানিক ‘ট্রেন্ড’ পাওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। অধিকন্তু, আগেই যা বলা হয়েছে এই প্রভাব কেবলমাত্র ১৫ মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।

ঘটনা যা-ই হোক না কেন এই গবেষনার পর কেন সুনির্দিষ্টভাবে মোজার্টের সঙ্গীতই এই ধরনের প্রভাব সৃষ্টি করে তা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের তত্ত্ব দেওয়া শুরু হয়ে গেলো। অনেক ভাবলেন মোজার্টের জটিল কম্পোজিশন মস্তিষ্কের সেই অংশগুলোকে উদ্দীপিত করে যা বিভিন্ন ধরনের পাজলের সমাধানের সময় উদ্দীপিত মস্তিষ্কের অংশের অনুরূপ। এই বিষয়টি নিয়ে তাই আরো বিস্তারিত গবেষনা শুরু হলো এবং অন্ততঃ ১৬ টি গবেষনা দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হলো যে সঙ্গীত শ্রবণে মনে মনে বিভিন্ন বস্তুর আকৃতি হিসেব করার ক্ষমতা সাময়িক ভাবে বৃদ্ধি পায়। তবে এই সুবিধা খুব অল্প সময়ের জন্যই পাওয়া যায় এবং তা স্থায়ী ভাবে আমাদের বুদ্ধিমান করে তোলে না। সেই সাথে আরেকটি বিষয় জানা গেলো, তা হচ্ছে মোজার্টের সঙ্গীতের আলাদা কোনো বিশেষত্ব নেই। ২০১০ সালে আরো অনেক গবেষনা মিলিয়ে দেখা গেলো অন্যান্য সঙ্গীতও মস্তিষ্কে একই ভাবে প্রভাব ফেলতে পারে। পরবর্তীতে দেখা গেলো শুধু সঙ্গীতই নয় বরং একটি উপন্যাসের অংশ বিশেষ জোরে জোরে পড়ার মাধ্যমেও মস্তিষ্ক এই ভাবে প্রণোদিত হতে পারে। এখান থেকে যা বোঝা গেলো তা হচ্ছে সঙ্গীতের বিশেষ বিশেষ নোট শ্রবণ নয় বরং মস্তিষ্ক উদ্দীপিত হয় উপভোগ্য কোনো অভিজ্ঞতা লাভের মাধ্যমে।

যদিও মোজার্ট ইফেক্ট শিশুদের উপর আরোপ করা হয় কিন্তু এই বিষয়টি নিয়ে অধিকাংশ গবেষণাই করা হয় প্রাপ্তবয়ষ্ক মানুষের উপর। শিশুদের মস্তিষ্ক অবশ্যই প্রাপ্ত বয়ষ্ক মানুষের মস্তিষ্ক হতে বেশ খানিকটা ভিন্ন। তবে ২০০৬ সালে ব্রিটেনে আটহাজার শিশুর বিশাল বহরের উপর এই গবেষণা চালানো হলো। এই ক্ষেত্রে শুধু মোজার্টের D-মেজর স্কেলের সোনাটাই নয় বরং পাশাপাশি বিভিন্ন পপ সঙ্গীতও শিশুদেরকে শুনতে দেওয়া হলো এবং আরেকবার মস্তিষ্কের উপর সঙ্গীতের সুপ্রভাব পর্যবেক্ষণ করা গেলো। তবে দেখা গেলো শুধু মোজার্টের সঙ্গীতই নয় বরং পপ সঙ্গীতও একই ভাবে শিশুতের কাগজের নকশা অনুযায়ী এর আকৃতি শনাক্ত করতে সাহায্য করছে। সঙ্গীত যা-ই বাছাই করা হোক না কেন পাজল জাতীয় সমস্যা সমাধানে আপনার প্রয়োজন মস্তিষ্কের চিন্তনের সূচনা, তা আপনি যে কোনো ধরনের সঙ্গীত থেকেই পেতে পারেন যা আপনার ভালো লাগে। প্রকৃতপক্ষে শুধু সঙ্গীতই নয়, বরং অন্য কোনো কাজ যেমন: কফি পান করা, খেলাধুলা করার মাধ্যমেও আপনার মস্তিষ্ক প্রয়োজনীয় উদ্দীপনা পেয়ে যেতে পারে।

তবে হ্যাঁ, এমন ব্যবস্থাও আছে যাতে করে সঙ্গীত সত্যিই আপনার আইকিউ বৃদ্ধি করতে পারে। দুর্ভাগ্যবশতঃ স্রেফ মোজার্ট শোনার চেয়ে এই কাজে আপনাকে আরেকটু বেশী শ্রম দিতে হবে। কোনো একটি বাদ্যযন্ত্র বাজানো শেখার মাধ্যমে আপনার মস্তিষ্কে কিছু স্থায়ী উপকারী প্রভাব পাওয়া যেতে পারে। মস্তিষ্কের কার্মকান্ড নিয়ে গবেষনারত ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের বিজ্ঞানী মতামত দেন এক বছর পিয়ানো প্রশিক্ষণ এবং নিয়মিত চর্চা চালু রাখার মাধ্যমে আপনার আইকিউ ৩ পয়েন্ট পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে।

কাজেই মোজার্ট ইফেক্টের আসলে কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। তবে তারপরও আপনার সন্তানের জন্য মোজার্টের সঙ্গীত শোনার ব্যবস্থা করে দিলে আখেরে তা মঙ্গলজনক প্রমানীত হতে পারে। পরবর্তীতে আপনার সন্তানের ধ্রূপদী সঙ্গীতের প্রতি আকর্ষণ তৈরি হয়ে যেতে পারে। অন্য অনেক বদ অভ্যাসের চেয়ে এটি নিশ্চয়ই আপনার পছন্দনীয় হবে।

-ইমতিয়াজ আহমেদ
সম্পাদক, বিজ্ঞান পত্রিকা
[ফেসবুক প্রোফাইল]

Exit mobile version