বিজ্ঞান পত্রিকা

পরমাণুর গহীন নিসর্গে | ৪: নিউক্লিয়াসসমূহ | ৪.৩: পারমাণবিক নম্বর

অধ্যায়-৪: নিউক্লিয়াসসমূহ
অনুচ্ছেদ-২: ধনাত্মক চার্জযুক্ত কণিকা
[বইয়ের সূচীপত্র তথা প্রকাশিত সবগুলো আর্টিকেলের জন্য এখানে দেখুন]

যেমনটি আমি বলেছি, নিউক্লিয়াস, যাকে পরমাণুর সারবস্তু বলা যায়, তা একেক বস্তুর জন্য একেক রকম হয়। এই ভিন্নতা দুধরনের হতে পারে। এক, হল তাদের ভর ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। দ্বিতীয়ত, তাদের মধ্যকার ধনাত্মক চার্জের আকারেও ভিন্নতা থাকতে পারে। এই ধারণাটি পূর্ববর্তী জ্ঞানকে বেশ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে এগিয়ে নিয়ে গেল। ১৯ শতকের পুরোটা সময় জুড়ে পরমাণুর ভিতরকার চার্জ সম্বন্ধে কিছুই জানা ছিল না। বিভিন্ন পরমাণুর মধ্যে শুধুমাত্র জ্ঞাত পার্থক্য ছিল ভরে। অথচ শুধু ভরের পার্থক্য জানাটা সন্তোষজনক ছিল না।

এই বইয়ের প্রথম দিকে আমি উল্লেখ করেছিলাম, মৌলিক পদার্থগুলোকে যখন তাদের পরমাণুর ভরের (পারমাণবিক ভর) ত্রমানুসারে সাজানো হয় তখন তাদেরকে একটি পর্যায়-সারণি অনুযায়ী দেখানো যায়। এই সারণিতে মৌলসমূহ এমনভাবে সজ্জিত হয় যে একই ধর্মবিশিষ্ট মৌলগুলো একই সারিতে পড়ে।

তবে শুধুমাত্র পারমাণবিক ভর অনুসারে সজ্জিত এই ধরনের সারণিতে কিছু ত্রুটি থেকে যায়। ভর ধরে এগিয়ে গেলে পরমাণুগুলোর ভরের পার্থক্য সুষমভাবে পরিবর্তিত হয় না। কোনো কোনো সময় এক পরমাণু থেকে অপর পরমাণুতে ভরের পার্থক্য থাকে খুব কম, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভরের পার্থক্য দেখা যায় অনেক বেশি। তিনটি ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট মৌলের পারমাণবিক ভর এমনকি একই লাইনে তার পরবর্তী পরমাণুর চেয়ে কিঞ্চিৎ বেশিও পাওয়া যায়।

সত্যিকার অর্থে, যদি ভরই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে থাকে, তাহলে এই তিনটি মৌলের ক্ষেত্রে পরপর স্থাপিত মৌল দুটিকে বিপরীতক্রমে বসাতে হয়। কিন্তু তাদেরকে বিপরীতক্রমে বসালে তারা উভয়ে এমন গ্রুপে পড়ে যাবে, যাদের সাথে এদের ধমের্র মিল থাকবে না। তাই তাদেরকে বিপরীতক্রমে বসানো হয় না। মেন্ডেলিভ, যিনি পর্যায় সারণির উদ্যোক্তা তিনি মনে করলেন মৌলসমূহকে তাদের ধমের্র সাথে মিল রেখে গোত্রভুক্ত করা, কঠোরভাবে ভরের ক্রমানুসারে সাজানোর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং পরবর্তীকালীন রসায়নবিদগণও এতে একমত হয়েছিলেন।

তাহলে এহেন পরিস্থিতিতে, শুধুমাত্র ভরের পার্থক্যের ভিত্তিতে কারো পক্ষে নিশ্চিত হওয়া সহজ নয়, ইতিমধ্যেই আবিষ্কৃত দুটি পাশাপাশি মৌলের পারমাণবিক ভরের মাঝামাঝি ভর বিশিষ্ট কোন মৌল পরবর্তীতে আবিষ্কৃত হবে কিনা। ১৮৯০ সালের শেষাবধি পর্যন্ত সম্পূর্ণ একটি মৌলের গোত্র আবিষ্কৃত হয়ে গিয়েছিল। তাদেরকে পর্যায় সারণিতে স্থান দেওয়ার জন্য একটি নতুন কলাম এতে যুক্ত করতে হয়েছিল। তবে পর্যায় সারণির এই ধরনের বিভ্রান্তিকর সমস্যা নতুন আবিষ্কৃত এক ধরনের বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে তুলনাপূর্বক সমাধানের সুযোগ তৈরি হয়েছিল। তা হলো নিউক্লিয়াসে অবস্থিত ধনাত্মক চার্জের পরিমাণ।
এই কাজটি করার সুযোগ তৈরি হয়েছিল এক্স রে প্রযুক্তির মাধ্যমে এক্সরে যখন আবিষ্কৃত হয় তখন অনুমান করার কোনো সুযোগ ছিল না, এটি একদিন পর্যায় সারণির ক্রটি সংশোধনের ক্ষেত্রে কাজে আসবে। অবশ্য সকল জ্ঞানই আসলে একীভূত। একটি ঘরের কোণায় যদি একটি বাতি জ্বালানো হয় তাহলে তা সার্বিকভাবে পুরো ঘরটিকে আলোকিত করে। বার বার বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারগুলো এমন সব সমস্যার সমাধান দিয়েছে, এসব সমস্যা যে ধরনের ঘটনার মাধ্যমে সূচনা ঘটেছিল তাদের মধ্যে তখন কোনো সম্পর্কই খুঁজে পাওয়া যায় নি।

বিজ্ঞানী রন্টজেন সর্বপ্রথম এক্স রে সনাক্ত করেছিলেন, উৎপন্ন হয়েছিল ক্যাথোড রশ্মি কর্তৃক বায়ুশূন্য টিউবের কাচের দেয়ালে আঘাতের মাধ্যমে। উচ্চগতির ইলেক্ট্রনগুলো এই সময় হঠাৎ করে ধীর হয়ে পড়ে এবং তাদের গতিশক্তি হারিয়ে যায়। এই শক্তি প্রকৃতপক্ষে হারিয়ে যেতে পারে না বরং শক্তির অন্য কোনো রূপে রূপান্তরিত হয়ে যায়। এবং এই ক্ষেত্রে রূপান্তরিত শক্তির রূপটি হচ্ছে তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ। একটি নির্দিষ্ট মুহূর্তে হারিয়ে যাওয়া শক্তির পরিমাণ এতোই বেশি, তার রূপান্তরের মাধ্যমে যে শক্তি উৎপন্ন হয় তার বিকিরণ এক্স রে হিসেবে নিঃসৃত হয়।

এই বিষয়টি যে মুহূর্তে বোঝা গেল তখন খুব দ্রুততার সাথেই উপলব্ধি করা গেল, কোনো কিছু যদি কাচের চেয়ে আরো ঘন, আরো ভারী পরমাণু দিয়ে গঠিত হয় তাহলে তার মধ্যে ইলেক্ট্রনের গতিহ্রাস ঘটবে আরো দ্রুত। এবং তার ফলে যে এক্স রে উৎপন্ন হবে তার তরঙ্গদৈর্ঘ্য হবে আরো কম এবং শক্তি হবে আরো বেশি। এটি জানার পর নিশ্চিতভাবেই যে কাজটি করতে হবে তা হলো, বিভিন্ন ধাতব পাত ব্যবহার করে ইলেক্ট্রনের গতি হ্রাস করে দেখা। এই ধাতবপাতগুলোকে একটি টিউবে ক্যাথোড রশ্মির উৎসের বিপরীত দিকে স্থাপন করা হলো যাতে ক্যাথোড রশ্মির মাধ্যমে আগত উচ্চ গতির ইলেক্ট্রন এগুলোতে আঘাত করতে পারে। এই ধাতবপাত গুলোকে নাম দেওয়া হলো অ্যান্টি-ক্যাথোড, যেখানে গ্রিক ভাষায় অ্যান্টি দ্বারা বিপরীত বোঝানো হয় (সাধারণত এ্যানোডকে স্থাপন করা হয় ক্যাথোডের বিপরীতে কিন্তু এই ক্ষেত্রে এন্টি-ক্যাথোডকে জায়গা করে দেওয়ার জন্য এগুলোকে টিউবের পাশে স্থাপন করা হয়)।

১৯১১ সালে ব্রিটিশ পদার্থবিদ চার্লস গ্লোভার বার্কলা (Charles Glover Barkla (১৮৭৭-১৯৪৪)) লক্ষ্য করলেন যখন একটি নির্দিষ্ট ধাতুর তৈরি অ্যান্টি-ক্যাথোড থেকে এক্সরে উৎপন্ন হয়, তখন তারা কোনো বস্তুকে একটি সুনির্দিষ্ট পরিমাণ ভেদ করে। প্রতিটি ধাতুর মাধ্যমে উৎপন্ন এক্স রে’র ভেদন ক্ষমতা ঐ ধাতুর জন্য সুনির্দিষ্ট। পরবর্তীতে যখন জানা গেল যে এক্স রে এক ধরনের তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ। তখন বোঝা গেল, প্রতিটি ধাতু একটি নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের এক্স রে-ই উৎপন্ন করবে। বার্কলা এই বিষয়টিকে  ধাতুর সুনির্দিষ্ট এক্সরে ধর্ম বললেন।

বার্কলা আরো দেখলেন, মাঝে মাঝে একটি নির্দিষ্ট ধাতু দুই ধরনের এক্স রে উৎপন্ন করছে। এদের প্রত্যেকের আলাদা আলাদা ভেদন ক্ষমতা আছে কিন্তু এদের মাঝামাঝি তেমন কিছু নেই। তিনি অধিক ভেদনক্ষমতা বিশিষ্ট রশ্মিটিকে ক এক্স রে এবং কম ভেদন ক্ষমতার রশ্মিটি খ এক্স রে নাম দিলেন। পরবর্তীতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এমনকি আরো কম ভেদন ক্ষমতা সম্পন্ন এক্স রে উৎপন্ন হতে দেখা গেল। তাদের জন্য বর্ণমালার পরবর্তী বর্ণগুলো অর্থাৎ গ, ঘ ইত্যাদি বরাদ্দ হলো। এই কাজের জন্য বার্কলা ১৯১৭ সালে নোবেল পুরস্কার পেলেন।

বার্কলার কাজটিকে রাদারফোডের্র একজন ছাত্র হেনরি গোইন-জেফরিস মোসলে (ঐবহৎু  এুিহ-ঔবভভৎবুং  গড়ংবষবু,  ১৮৮৭-১৯১৫) চালিয়ে নিয়ে গেলেন। ১৩১৩ সালে তিনি খুব সতর্কতার সাথে বিভিন্ন ক্রিস্টালের এক্সরের বৈশিষ্ট্যগুলো পর্যবেক্ষণ করলেন। ব্র্যাগ এই বৈশিষ্ট্যগুলো সদ্যই আবিষ্কৃত হয়েছিল।

মোসলে দেখলেন, তিনি যদি পর্যায় সারণির তালিকার সামনের দিকের মৌলগুলোর দিকে যান, তাহলে এক্সরের তরঙ্গদৈর্ঘ্য নিয়মিতভাবে হ্রাস পায়। এন্টিক্যাথোডের পরমাণুগুলোর পারমাণবিক ভর যত বেশি হয়, তরঙ্গদৈর্ঘ্যও ততো ক্ষুদ্র হয়ে আসে। শুধু তা-ই নয়, পারমাণবিক ভরের চেয়ে তরঙ্গদৈর্ঘ্যের পরিবর্তন আরো বেশি নিয়মিত ও সুষম।

পদার্থবিদগণ নিশ্চিত ছিলেন যে, কোনো বস্তুু দ্বারা ইলেক্ট্রনের গতিহ্রাস (মন্দন) হয়, ঐ বস্তুুর পরমাণুর নিউক্লিয়াসে অবস্থিত ধনাত্মক চার্জের পরিমান দ্বারা যা থেকে এই ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, পর্যায় সারণিতে একটি বস্তুর ধনাত্মক চার্জ পারমাণবিক ভরের চেয়ে আরো নিয়মিত ভাবে বৃদ্ধি পায়।

মোসলে প্রস্তাব করলেন, প্রকৃতপক্ষে চার্জের আকার পর্যায় সারণিতে প্রতি ধাপ এগোনোর জন্য এক করে বৃদ্ধি পায়। তার মানে, প্রথম মৌল হিসেবে হাইড্রোজেন যার নিউক্লিয়াস হলো একটি প্রোটন তার চার্জ হচ্ছে +১। দ্বিতীয় মৌল হিলিয়ামের নিউক্লিয়াস (আলফা কণিকা) +২ চার্জ বিশিষ্ট। তৃতীয় মৌল লিথিয়ামের নিউক্লিয়াসের চার্জ হচ্ছে +৩ এবং এভাবে ইউরেনিয়াম পর্যন্ত চলতে থাকবে। সে সময় প্রাপ্ত সবচেয়ে ভারী পরমাণু ইউরেনিয়াম যার নিউক্লিয়াসে চার্জের পরিমাণ ছিল +৯২।

মোসলে পরমাণুর নিউক্লিয়াসের এই চার্জের আকারকে একটি মৌলের পারমাণবিক সংখ্যা হিসেবে আখ্যায়িত করলেন এবং এটি পারমাণবিক ভরের চেয়ে আরো বেশি মৌলিক বৈশিষ্ট্যসূচক বলে প্রমাণিত হলো। প্রকৃতপক্ষে পারমাণবিক সংখ্যা পর্যায় সারণির অনেক সমস্যার সমাধান করে দিল।  মোসলের ধারণাটিকে পরবর্তীতে পদার্থবিদরা আরো পরিমার্জিত ও বিবর্ধিত করেছিলেন।

এভাবেই পর্যায় সারণিতে এর আগে যেমন সামান্য বেশি পারমাণবিক ভরের মৌলকেও ধমের্র  মিলের জন্য কম ভরের মৌলের চেয়ে আগে স্থাপন করতে হয়েছিল, তা আর ঘটার সুযোগ থাকবে না যদি পারমাণবিক ভরে বদলে পারমাণবিক সংখ্যা বিবেচনা করা হয়। একটি পরমাণু যার পারমণবিক ভর তার পরেরটির চেয়ে বেশি হওয়ায় ভুল জায়গায় বসানো হয়েছে বলে মনে হয় তার পারমাণবিক সংখ্যা পরেরটির চেয়ে কমই পাওয়া গেল। যদি প্রতিটি পরমাণুকে পারমাণবিক সংখ্যা অনুযায়ী সাজানো হয়, তাহলে কোনো রকম ব্যতিক্রম ছাড়াই তারা যথার্থভাবে বসে যায় এবং কোনো প্রকার ওলট-পালটের প্রয়োজন হয় না। এছাড়াও, পাশাপাশি দুটি পরমাণু যাদের পারমাণবিক সংখ্যার পার্থক্য ১, তাদের মাঝে অদ্যাবধি আর কোনো অজানা পরমাণুকে পাওয়া যায়নি।

শীঘ্রই এটিও স্পষ্ট হলো, যেকোনো ঋনাত্মক বৈদ্যুতিক চার্জই একটি ইলেক্ট্রনের চার্জের পূর্ণসংখ্যক গুণিতক। যেকোনো ধনাত্মক বৈদ্যুতিক চার্জই প্রোটনের চার্জের পূর্ণসংখ্যক গুণিতক। আপনি নিউক্লিয়াসের চার্জ +১৬ এবং +১৭ পাবেন কিন্তু +১৬.৪ বা +১৬.৮৩৭ ইত্যাদি পাবেন না।

পর্যায় সারণির একটি নিখোঁজ মৌল আছে। সেখানে সেই ফাঁকা স্থানের আগের এবং পরের মৌলটির পারমাণবিক সংখ্যার মধ্যে পার্থক্য পাওয়া গেল পাশাপাশি দুটি মৌলের দ্বিগুণ। এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, ওই ফাঁকা স্থানে একটি মৌল বসবে।
যখন মোসলে পারমাণবিক সংখ্যার ধারণা প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, তখন পর্যায় সারণিতে সাতটি শূন্যস্থান ছিল এর প্রতিটি একেকটি অজানা মৌলের প্রতিনিধিত্ব করে। ১৯৪৮ সালের মধ্যে এই শূন্যস্থানগুলো পূরণ হয়ে গিয়েছিল। পদার্থবিদগণ ৯২ এর চেয়ে বেশি পারমাণবিক সংখ্যা বিশিষ্ট পরমাণুও উৎপন্ন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। পরবর্তীতে সেসব আলোচনা করা হবে। বর্তমানে পারমাণবিক সংখ্যা ১ থেকে ১১৫ পর্যন্ত প্রতিটি মৌল আমাদের পরিচিত। মোসলে নিশ্চিতভাবেই কয়েক বছরের মধ্যে নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত হতেন কিন্তু তিনি ১৯১৫ সালে তুরষ্কের গালিপল্লিতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের একটি ঘটনায় নিহত হন।
পারমাণবিক সংখ্যা একটি পরমাণুর নিউক্লিয়াসে অবস্থিত ধনাত্মক চার্জের পরিমাণ সম্বন্ধে ধারণা দেয়। একটি সাধারণ পরমাণু সার্বিকভাবে বিদ্যুৎ নিরপেক্ষ। তাই নিউক্লিয়াসে অবস্থিত প্রতিটি ধনাত্মক চার্জের জন্য এর বাইরের দিকে একটি করে ইলেক্ট্রন থাকতে হবে। হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াসে চার্জের পরিমাণ +১, তাই হাইড্রোজেন পরমাণুতে অবশ্যই একটি ইলেক্ট্রন থাকবে। +২ চার্জ বিশিষ্ট হিলিয়ামের পরমাণুতে অবশ্যই দুটি ইলেক্ট্রন থাকবে। +৮ চার্জ বিশিষ্ট অক্সিজেনের অবশ্যই ৮ টি ইলেক্ট্রন; +৯২ চার্জ বিশিষ্ট ইউরেনিয়ামের অবশ্যই ৯২ টি ইলেক্ট্রন থাকবে এবং এভাবেই চলতে থাকবে। সংক্ষেপে, পারমাণবিক সংখ্যা শুধুমাত্র নিউক্লিয়াসের চার্জের পরিমাণই প্রকাশ করে না বরং একটি স্বাভাবিক পরমাণুতে অবস্থিত ইলেক্ট্রনের সংখ্যাও নিদের্শ করে।

যখন পরমাণুসমূহের মধ্যে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে স্বাধীন ভাবে কিংবা অণু অবস্থায়, তখন তাদের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে। যদি তাই হয়, তাহলে সংঘর্ষটি হয় মূলত একটি পরমাণুর ইলেক্ট্রনগুলোর সাথে অপর পরমাণুর ইলেক্ট্রনগুলোর মধ্যে। দুটি পরমাণুর নিউক্লিয়াস পরস্পরের কাছে থেকে এতদূরে, ইলেক্ট্রনের পিছনে লুকিয়ে থাকে যে, তাদের রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ কিংবা কোনো তীব্র প্রভাব ফেলার কথা নয়।

পরবর্তী গবেষণা থেকে এটিকে শুধু অর্থপূর্ণই মনে হয় না বরং সত্যিই ঘটে বলেই মনে হয়। কোনো কিছু অর্থপূর্ণ মনে হলেই যে বাস্তবে তা ঘটবে এমন কোনো কথা নেই।  যেমন: আরহেনিয়াসের আয়নিক বিয়োজন জাতীয় বিষয় নিয়ে যদি আমরা চিন্তা করি। একটি পরমাণু থেকে এক বা একাধিক ইলেক্ট্রন অপর পরমাণুতে স্থানান্তরের মাধ্যমেই আয়ন গঠিত হয় বলে মনে হয়।
চিনি জাতীয় যৌগগুলোর অণুতে কোনো আয়ন তৈরি হয় বলে মনে হয় না। এর বদলে অণুগুলো একে অপরের সাথে আটকে থাকে, হয়তোবা তারা পরস্পরের সাথে ইলেক্ট্রন শেয়ার করে। তাই পরস্পরের কাছ থেকে সহজে আলাদা হতে পারে না এবং অবিকৃত পরমাণু হিসেবেই থেকে যায়। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে মনে হয় যে ইলেক্ট্রন আদান-প্রদান আর কিছু কিছু ক্ষেত্রে মনে হয় ইলেক্ট্রন শেয়ারকৃত অবস্থাই বেশি স্থিতিশীল কিন্তু কেন?

একটি ইঙ্গিত পাওয়া যায় ছয়টি মৌলের একটি শ্রেণি হতে। এরা ইলেক্ট্রন আদান-প্রদানে বা শেয়ারে আগ্রহী নয় বরং পূর্ণাঙ্গ পরমাণুরূপেই সর্বদা থেকে যেতে চায়। এই শ্রেণির সবচেয়ে হালকা তিনটি মৌল হলো হিলিয়াম, নিয়ন ও আর্গন। এরা কখনোই ইলেক্ট্রন আদান-প্রদান বা শেয়ার করে না। অন্তত অদ্যাবধি রসায়নবিদগণ এধরনের ঘটনা পর্যবেক্ষণ করেননি। গ্রুপের সবচেয়ে ভারী তিনটি মৌল ক্রিপ্টন, জেনন এবং রেডন বিশেষ বিশেষ কঠোর পরিস্থিতিতে ইলেক্ট্রন শেয়ার করে অবশ্য। তবে তেমন দৃঢ়ভাবে নয়।

এই ছয়টি মৌলকে অভিজাত (noble) গ্যাস বলে ডাকা হয়। “অভিজাত” কেননা তারা নিজেদের মধ্যে থাকতে চায় এবং অন্যান্যদের সাথে মেলামেশায় তেমন আগ্রহী নয়। তাদের এই আভিজাত্য সবচেয়ে ভালোভাবে বোঝা যেতে পারে যদি ধরে নেওয়া হয়, ইলেক্ট্রন নিউক্লিয়াসের চারদিকে কিছু সমকেন্দ্রিক কক্ষপথে আরেকটি ব্যবস্থায় বিন্যাস্ত থাকে। স্বাভাবিকভাবে, যে কক্ষপথটি বাইরের দিকে থাকবে, তা পর্যায়ক্রমিকভাবে আকারে বড় হবে এবং ভিতরের গুলোর চেয়ে বেশি ইলেক্ট্রন ধারণক্ষম হবে।  তাই হিলিয়াম পরমাণুর দুটি ইলেক্ট্রন আছে যা সবচেয়ে ভিতরের কক্ষপথটিকে পূর্ণ করে ফেলতে পারে। এই কক্ষপথটি নিউক্লিয়াসের সবচেয়ে কাছে তাই এটি কক্ষপথগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ছোটই হবে এবং সবচেয়ে কম ইলেক্ট্রন ধারণক্ষম হবে।
আমেরিকান রসায়নবিদ গিলবার্ট নিউটন লুইস (Gilbert Newton Lewis, ১৮৭৫-১৯৪৬) এবং আরভিং ল্যাংমুয়্যার ( Orving Langmuir, ১৮৮১-১৯৫৭) ১৯১৬ সালের শুরুতে পৃথকভাবে কক্ষপথ এবং ইলেক্ট্রন আদান-প্রদান ও শেয়ারের ধারণা নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন। কেননা এই বিষয়টিই রাসায়নিক আচরণ সবচেয়ে ভালোভাবে ব্যাখ্যা করে বলে মনে হয়েছিল।  আসলে, এই বিষয়টি পরবর্তীতে বিশদভাবে পরিমার্জিত করা হয়েছে, তবে আমরা সেগুলো নিয়ে আরো পরে আলোচনা করব।
একেকটি কক্ষপথকে তাদের বৈশিষ্ট্যগত এক্স রে দ্বারা সূচিত করা হয় যা বার্কলা প্রথম আবিষ্কার করেন। এক্স রে’র ক শ্রেণিটি সবচেয়ে বেশি ভেদনক্ষমতা সম্পন্ন এবং নিউক্লিয়াসের সবচেয়ে কাছের কক্ষপথ থেকে উৎপন্ন হয় বলে মনে হয়। এই কারণে এই প্রথম  ইলেক্ট্রন কক্ষপথটিকে ক কক্ষপথ বলা হয়।

একই কারণে ক কক্ষপথের পরেরটিকে খ কক্ষপথ বলা হয়। কারণ অপেক্ষাকৃত কম ভেদনক্ষমতাসম্পন্ন খ শ্রেণির এক্সরে এই কক্ষপথ থেকেই উৎপন্ন হয় বলে মনে হয়। খ কক্ষপথের পরেরটি গ কক্ষপথ, তারপরে ঘ কক্ষপথ এবং এভাবেই যেতে থাকে। স্বতস্ফূর্তভাবে কোনো কিছু অস্থিতিশীলতার দিকে যায় না। কোনো কিছুকে অস্থিতিশীল করার জন্য শক্তি প্রয়োগ করতে হয় কিন্তু স্থিতিশীলতা অর্জন নিজে নিজেই ঘটে। এই বৈশিষ্ট্যগুলো নিয়ে আলোচনা করা হয় তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্রে।
পরবর্তী অভিজাত গ্যাসটি হচ্ছে নিয়ন, যার পরমাণুতে ১০টি ইলেক্ট্রন রয়েছে।  প্রথম দুটি ইলেক্ট্রনে ক কক্ষপথটি পূর্ণ হয় এবং পরবর্তী আটটি ইলেক্ট্রন বিদ্যমান থাকে খ কক্ষপথে। যেটি তুলনামূলকভাবে আকার বড় এবং আরো বেশি ইলেক্ট্রন ধারণ করতে পারে। তাই নিয়নের ইলেক্ট্রন বিন্যাস হচ্ছে ২, ৮।  নিয়নের খ কক্ষপথটি পরিপূর্ণ এবং স্থিতিশীল হওয়ায় এটি একটি অভিজাত গ্যাস।

নিয়নের পরে হলো আর্গন যার পরমাণুতে ইলেক্ট্রন আছে ১৮টি। এরা সজ্জিত হয় এভাবে: ক কক্ষপথে ২টি, খ কক্ষপথে ৮টি এবং গ কক্ষপথে ৮ টি। কিংবা ২, ৮, ৮। গ কক্ষপথটি খ কক্ষপথের চেয়ে বড় হওয়ায় এটি ৮টির চেয়ে বেশি ইলেক্ট্রন ধারণ করতে পারে। প্রকৃতপক্ষে এটি ১৮ টি ইলেক্ট্রন ধারণ করতে পারে। তবে সর্ববহিঃস্থ কক্ষপথে ৮টি ইলেক্ট্রন (যদিও এটি আরো বেশি ইলেক্ট্রন ধারণক্ষম) বিশেষভাবে স্থিতিশীল বিন্যাস, যা আর্গনকে একটি অভিজাত গ্যাসে পরিণত করে।

আর্গনের পরে আসে ক্রিপ্টন। এর ৩৬ ইলেক্ট্রন বিন্যাস্ত হয় ২, ৮, ১৮, ৮ আকারে। তারপর জেনন যার ৫৪টি ইলেক্ট্রন বিন্যাস্ত হয় ২, ৮, ১৮, ১৮, ৮ আকারে। সবশেষে রেডন যার ৮৬টি ইলেক্ট্রন বিন্যাস্ত হয় ২, ৮, ১৮, ৩২, ১৮, ৮ আকারে।

স্পষ্টভাবেই, পরমাণুসমূহ যখন পরস্পরের সাথে তাদের সুযোগ অনুযায়ী ক্রিয়া করে তখন তারা অভিজাত গ্যাসগুলোর ইলেক্ট্রন বিন্যাস অর্জনের চেষ্টা করে। ১১ টি ইলেক্ট্রনবিশিষ্ট সোডিয়ামের ইলেক্ট্রন বিন্যাস ২, ৮, ১। ১১তম ইলেক্ট্রনটি গ কক্ষপথের একমাত্র ইলেক্ট্রন। এটা সহজেই ত্যাগ করা যায়। যখন এই ঘটনা ঘটে তখন সোডিয়াম ১টি ধনাত্মক চার্জ বিশিষ্ট সোডিয়াম আয়নে পরিণত হয়। কেননা তার +১১ চার্জ, বহিঃস্থ মাত্র ১০টি ইলেক্ট্রন দ্বারা পুরোপুরি প্রশমিত হয় না। উল্লেখ্য যে, একটি ইলেক্ট্রন হারিয়ে ফেললেও সোডিয়াম ১০ টি ইলেক্ট্রন বিশিষ্ট নিয়নে পরিণত হয় না। একটি পরমাণুর পরিচয় যার উপর নির্ভর করে তা হল এর নিউক্লিয়াসের চার্জ, ইলেক্ট্রনের সংখ্যা নয়।

অপরদিকে, ক্লোরিনের ১৭টি ইলেক্ট্রন আছে যারা ২, ৮, ৭ হিসেবে বিন্যাস্ত। অভিজাত গ্যাসের ইলেক্ট্রন বিন্যাস অর্জনের জন্য এর আরো একটি ইলেক্ট্রন প্রয়োজন। তাই এর প্রবণতা থাকবে আরেকটি ইলেক্ট্রন গ্রহণ করে ঋনাত্মক ক্লোরিন আয়নে পরিণত হওয়ার, যাতে এর পরমাণুতে ১৮টি ইলেক্ট্রন বিদ্যমান থাকে যা এর নিউক্লিয়াসের চার্জের চেয়ে বেশি হবে।

সোডিয়াম ক্লোরাইড গঠনে সোডিয়াম ও ক্লোরিনের মধ্যে ইলেক্ট্রন আদান-প্রদানের মাধ্যমে উভয়েরই অভিজাত গ্যাসের ইলেক্টন বিন্যাস অর্জন।

এই কারণে সোডিয়াম এবং ক্লোরিন পরস্পরের সাথে সহজেই বিক্রিয়া করে। একটি ইলেক্ট্রনের আদান-প্রদান সোডিয়াম এবং ক্লোরাইড আয়ন তৈরি করে, যারা পরস্পরর সাথে আটকে যায়। কেননা ধনাত্মক এবং ঋনাত্মক চার্জ পরস্পরকে আকর্ষণ করে। লবণ যখন পানিতে দ্রবীভূত হয় তখন এই আয়নগুলো অপেক্ষাকৃত শিথিলভাবে যুক্ত থাকে এবং একজন আরেকজনকে পিছলে যেতে পারে। এই পদ্ধতিতেই এধরনের দ্রবণ বিদ্যুৎ পরিবহন করে।

দুটি ক্লোরিন পরমাণু আরেকধরনের স্থিতিশীলতা অর্জন করতে পারে যদি তারা প্রত্যেকে একটি করে ইলেক্ট্রন শেয়ার করে। প্রত্যেক পরমাণুর শেষ কক্ষপথে ছয়টি ইলেক্ট্রন থাকবে যা একন্তই তার নিজস্ব। এবং দুটি ইলেক্ট্রন সে অন্য পরমাণুটির সাথে শেয়ার করবে। প্রতিটি সর্ববহিস্থ কক্ষপথই এই অবস্থায় পূর্ণ এবং স্থিতিশীল থাকবে এই শর্তে, তারা পরস্পরের সংস্পর্শে অবস্থান করবে যেন নিজের মধ্যে শেয়ারকৃত ইলেক্ট্রনদুটো বজায় রাখতে পারে। ফলাফল হচ্ছে, দুটি ক্লোরিন পরমাণু একটি দ্বি-পারমাণবিক ক্লোরিন অণু (Cl2) তৈরি করে, যা দুটি একক ক্লোরিন পরমাণুর চেয়ে বেশি স্থিতিশীল।

এভাবে পরমাণুতে ইলেক্ট্রন বিন্যাস নিয়ে ঘাটাঘাটি করে রসায়নবিদরা বুঝতে পারলেন, কেন পর্যায় সারণিতে মৌলগুলো এভাবে সজ্জিত হয়। সর্ববহিঃস্থ কক্ষপথের ইলেক্ট্রন বিন্যাসের উপরই রাসায়নিক বিক্রিয়া নির্ভর করে। এছাড়া রসায়নবিদগণ দেখলেন তাঁরা ইলেক্ট্রন বিন্যাস ব্যবহার করে বহু রাসায়নিক বিক্রিয়া ব্যাখ্যা করতে পারছেন। এগুলো এর আগে তাঁরা ব্যাখ্যা ছাড়াই শুধু মাত্র ঘটে থাকে বলে জানতেন।

এখন পর্যন্ত ইলেক্ট্রনকে একটি ক্ষুদ্র, কঠিন কণা হিসেবেই ধরে নেওয়া যথেষ্ট যারা জ্যামিতিক ভাবে বিন্যাস্ত থাকে। তবে এই ধরনের ভাবনা পরমাণুর বর্ণালী রেখা ব্যাখ্যার জন্য যথেষ্ট নয়। যে রেখাগুলো প্রতিটি পরমাণুর জন্য ভিন্ন ভিন্ন।

[বইয়ের সূচীপত্র তথা প্রকাশিত সবগুলো আর্টিকেলের জন্য এখানে দেখুন। বিজ্ঞান পত্রিকায় সম্পূর্ণ বইটিই পড়া যাবে, তবে মুদ্রিত সংস্করণটি সংগ্রহ করতে চাইলে যোগাযোগ করুন: ছায়াবিথী প্রকাশনী, ফোন: ০১৯১৫৯৩৯৬৬৮]

-ইমতিয়াজ আহমেদ
সম্পাদক, বিজ্ঞান পত্রিকা
[লেখকের ফেসবুক প্রোফাইল]

Exit mobile version