বিজ্ঞান পত্রিকা

কোয়ন্টাম ফিজিক্স ১১ : প্রাচীন পরমাণুবাদ

[বইটির সূচীপত্র এবং সব খন্ডের লিংক একত্রে দেখুন এখানে]

পরমাণু ধারনার প্রথম প্রবক্তা ভারতীয় বিজ্ঞানী কণাদ। খ্রিস্টের জন্মের ৫০০ বছর আগে তিনি বস্তুর ক্ষুদ্রতম এককের কথা বলেন। অনেকের মতে ‘কণাদ’ নাম থেকে ভারতীয় ভাষাগুলোর মধ্যে ‘কণা’ শব্দটি ঢুকে গেছে। তবে আজকের পরমাণুর সাথে কণাদের সেই ‘কণা’র মিলের চেয়ে অমিলই বেশি।

তবে পরমাণু নিয়ে সত্যিকার অর্থে ভাবতে শুরু করেন গ্রিক বিজ্ঞানীরা। গ্রিসের তখন স্বর্ণযুগ। তখন একজন দার্শনিক ছিলেন গ্রিসে। লিউসিপ্পাস। তিনি খুব ভালভাবে উপলব্ধি করেন, কোনো বস্তুকে ইচ্ছে মত একের পর এক ভাঙা যাবে না। ভাঙতে ভাঙতে এমন একটা অবস্থায় পৌঁছাবে, তখন আর বস্তুটিকে শত চেষ্টা করলেও সম্ভব নয় ভাঙা। বস্তুটি পৌঁছেবে একটা ক্ষুদ্রতম আকারে। কিন্তু সেই ক্ষুদ্রতম আকারের নাম-ধাম, বৈশিষ্ট্য কেমন হবে একথা বলে যাননি লিউসিপ্পাস।

পরমাণু তত্ত্বের সবচেয়ে আলেচিত প্রবক্তা ডেমেক্রিটাস। লিউসিপ্পাসের ছাত্র। ডেমেক্রিটাস বস্তুর ক্ষুদ্রতম অবস্থার নাম দিলেন, ‘অ্যাটোম’। অ্যাটোম শব্দের অর্থাৎ অভিভাজ্য। বাংলায় আমরা যাকে বলি ‘পরমাণু’। কণাদ বা লিউসিপ্পাসের মতো ডেমেক্রিটিসের পরমাণুকেও আধুনিক পরমাণুর সাথে মেলানো যাবে না। কিন্তু ডেমোক্রিটাসের সাফল্যটা অন্য জায়গায়। তিনি বস্তুর ক্ষুদ্রতম কণার যে নামটা দিয়েছিলেন। আড়াই হাজার পরেও সেই ‘অ্যাটোম’ নামটা বহাল তবিয়তে রয়েছে বিজ্ঞানের রাজ্যে।

লিউসিপ্পাস

ডেমেক্রিটাসের জীবদ্দশাতেই জন্ম সর্বকালের অন্যতম সেরা দার্শনিক অ্যারিস্টোটলের। সবকিছুতেই তিনি পা-িত্যের বহর দেখিয়েছেন। সমাজে ব্যাপক প্রভাব ছিল তাঁর। তাঁর কথাকে অমর বাণী মনে করত গ্রিকবাসীরা। পরবর্তীকালে অনেক ধর্মগ্রন্থেই অ্যারিস্টোটলের মতের প্রতিফলন দেখা গেছে। দার্শনিক হিসেবে যতো দূরদর্শীই হোন অ্যারিস্টোটল, বিজ্ঞান বক্তা হিসেবে তাঁর ব্যর্থতা অনেক। পৃথিবী আর সূর্যের ঘূর্ণন সম্পর্কে তাঁর ভুল মতবাদ পদার্থবিজ্ঞানকে দেড় হাজার বছর ঢেকে রেখেছিল অন্ধকারে। বল ও জড়তা এমনকি পড়ন্ত বস্তু নিয়ে দেওয়া তাঁর মত ভুল ছিল পুরোপুরি। ভুল মন্তব্য করেন তিনি পরমাণুর বিষয়েও।

ডেমোক্রিটাস

ডেমোক্রিটাসের পরমাণু তত্ত্ব মানতে পারেননি অ্যারিস্টোটল। তিনি ভাবতেন, বস্তুকে ইচ্ছে মত একের পর এক ভাঙা যায়। সেই মত তিনি প্রকাশ্যে প্রচারও করেন। তাঁর কথা ধর্মের বাণীর মতো। তাই সবাই গ্রহণ করল অ্যারিস্টোটলের মত। পরবর্তীতে খ্রিস্ট ধর্মেও সেই মতের প্রতিফলন দেখা যায়।

এপিকারুস

তবে ডেমোক্রিটাসকে সবাই কিন্তু উড়িয়ে দেননি। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকের দার্শনিক ছিলেন এপিকারুস। ছিলেন তিনি শিক্ষকও। এপিকারুস পরমাণুবাদকে গ্রহণ করে ছিলেন পরম মমতায়। তাঁর পড়ানোর বিষয়গুলোতে যুক্ত করেন পরমাণুবাদ। পরমাণুবাদের ওপর ভিত্তি করে তিনি বেশকিছু পাঠ্য বইও লেখেন।

খ্রিস্টিও প্রথম শতাব্দীতে আবির্ভাব ঘটে লুক্রেটিয়াস নামে আরেক কবি ও দার্শনিকের। রোমান ছিলেন তিনি। তিনি এপিকারুস দর্শনে অনুপ্রাণীত হন। একটি দীর্ঘ কবিতায় এপিকারুসের পরমাণুবাদ তুলে ধরেন তিনি।

এরপর আবার পরমাণুবাদের অন্ধকার যুগের শুরু। খ্রিস্ট ধর্মের প্রভাব দিন দিন বাড়তে থাকে। সমাজে শক্তিশালী জায়গা করে নেয় অ্যারিস্টোটলের দর্শন। মধ্যযুগ। পোপ ও পাদ্রীদের ব্যাপক দাপট তখন। সেই দাপটের কাছে তুচ্ছ ইউরোপিয় স¤্রাটরাও । তাই তো পোপ আর তার চ্যালারা বিজ্ঞান চর্চার বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হতে পেরেছিল। মৃত্যুদ- দিয়েছিল হাইপেশিয়া, ব্রুনোকে। গ্যালিলিওকে দেওয়া হয়েছিল কঠিন সাজা ।

লুক্রেটিয়াস

অ্যারিস্টোটল পরামাণু ধারণা মানতে পারেননি। ধর্মও সেটা মানবে কেন? খ্রিস্ট ধর্মে তাই পরমাণুর কথাও বলা পাপ। তখন লুক্রেটিয়াসের লেখা বইটিকে নাস্তিকতার অভিযোগে নিষিদ্ধ করা হয়। ধ্বংস করা হয় তাঁর বইয়ের সব কপি। একটা কপিই কেবল টিকে ছিল। ১৪১৭ সালে সেটা উদ্ধার করেন বিজ্ঞানীরা। তৈরি করা হয় সেটার প্রতিলিপিও।

রবার্ট বয়েল আর রেনে দেকার্তের মতো বিজ্ঞানীরা বস্তুর তৌত গঠন ব্যাখ্যা করতে গিয়ে পরমাণু ধারণায় ফিরে গেলেন। তবে সে যাওয়াতেও বেশি জোর ছিল না। তারপর তো  আইজ্যাক নিউটনের আবির্ভাব আর পদার্থবিদ্যার স্বর্ণযুগের শুরু।
নিউটনের ক্ষেত্র ব্যাপক। তিনি গ্রহ-নক্ষত্রের ব্যাপারে অসামান্য সব কাজ করে গেছেন। কাজ করে গেছেন, গণিত, আলোকবিদ্যা, তাপবিদ্যার ওপরে। গ্যাসের গতিতত্ত্বও, বস্তুর ভৌত গঠন নিয়ে গবেষণাতেও নিউটন অগ্রগণ্য ছিলেন। তবে নিউটন ছিলেন গভীর ধর্মবিশ্বাসী মানুষ। তাই বলে গোঁড়া-অন্ধ ধার্মিকদের সাথে তাঁকে মেলানো যাবে না। তবু তিনি ‘পরমাণু’কে সেইভাবে তার লেখাতে তুলে ধরেননি। কারণ সেটা সরাসরি খ্রিস্ট ধর্ম বিরোধী হয়ে যেতে পারে। তবে পরমাণু ধারণায় অবিশ্বাসীও ছিলেন না নিউটন। নিউটন পরীক্ষা-নিরীক্ষামূলক বিজ্ঞানের অগ্রদূত। গ্যালিলিওর মতো। কিংবা গ্যালিলিওর চেয়ে বেশিই। কত রকম যন্ত্রপাতি তৈরি করেছেন, কত রকম পরীক্ষা করে দেখেছেন! সেকালে তাঁর মতো করে বিজ্ঞানকে পরীক্ষা-পর্যবেক্ষণের মধ্যেমে যাচাই করার লোক খুব কমই ছিল। অ্যারিস্টোটলের মতো শুধু নিজের ভাবনাটাকেই প্রকৃতির নিয়ম বলে চালানোর মতো লোক ছিলেন না নিউটন। তাই পরমাণু ধারণাকে তিনি মেনে নিয়েছিলেন। কণা ধারণায় তার আস্থা ছিল প্রবল। আলোকেও তিনি কণা হিসেবে দেখতেন। সে গল্প আমরা এই বইয়ের একেবারে প্রথম অধ্যায়েই করেছি।

তবে নিউটনের ‘কণা’ ধারণা আধুনিক ‘পরমাণু’ ধারণার চেয়ে অনেকটাই ব্যতিক্রম ছিল। তিনি ‘কণা’দের আকর্ষণী ও বিকর্ষণী বল আছে এটাই শুধু মনে করতেন। যেমন আলোর প্রতিফলনের জন্য তিনি আলোর কণিকাদের বিকর্ষণী ক্ষমতাকেই দায়ী করেছেন। তেমনি প্রতিসরণকে মনে করতেন আলোর কণাদের আকর্ষণী ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু একই কণা একই বস্তুর ওপর পড়লে কিছু আকর্ষণকারী কিছু বিকর্ষণকারী ধর্ম কেন দেখায়, যে ব্যাখ্যা নিউটনের কাছে ছিল না।

রবার্ট বয়েল ও তার কাঁচনল পরীক্ষা

গ্রহ-নক্ষত্রের চলাচলের ব্যাপারে খ্রিস্ট ধর্ম ও পোপেরা যত বেশি কঠোরতা দেখিয়েছেন  ততো বেশি কঠোরতা দেখাননি পরমাণুবাদী প্রতি। আসলে গ্রহ-নক্ষত্রদের গতিপ্রকৃতির ব্যাপারে মধ্যযুগের বিজ্ঞানীদের যতটা বেশ স্বচ্ছ ধারণা ছিল। কিন্তু পরমাণু সম্পর্কে অতটা স্বচ্ছ ধারণা তাঁরা করতে পারেননি। ছিল না পরমাণুবাদের পক্ষে আকাট্য প্রমাণও। পরমাণু নিয়ে বিজ্ঞানীরা তাই জোর গলায় কথা বলেননি। তারপরও পরমাণুবাদ রেহায় পায়নি চার্চ-পোপের সাজা থেকে। নিউটনের যুগেরই এক ফরাসী দার্শনিক ছিলেন। পিয়েরে গাসেন্ডি। লুক্রেটিয়াসের বই-ই মূলত পরমাণুবাদে অনুপ্রাণীত করে গাশোন্ডিকে। তিনি পরমাণুবাদ নিয়ে অনেক লেখালেখি করেন। পরমাণুবাদ প্রচারের জন্য ধর্মগুরুরা তাঁকে নির্যাতন করেছিল।

গ্যাসেন্ডির লেখা বইয়ের অনুপ্রাণীত হন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী রবার্ট বয়েল। গ্যাসের চাপ বিষয়ক একটা বিখ্যাত সূত্র আছে। সেটার নাম বয়েলের সূত্র। একটা  ‘ট’ আকৃতির কাঁচ নলে গ্যাস ও পারদ ঢুকিয়ে তিনি পরীক্ষা চালানা। দেখান, বায়ুম-লের স্বাভাবিক চাপে গ্যাসের আয়তন একরকম। পারদের চাপ বাড়লে গ্যাসের চাপ আরেকরকম। পারদের চাপ ধীরে ধীরে বাড়লে গ্যাসের আয়তনও কমতে থাকে। একই পরিমাণ গ্যাস, শুধুমাত্র চাপ কমবেশি হওয়ার কারণে আয়তন বাড়ছে-কমছে কেন?  তাহলে কি গ্যাসীয় পদার্থগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কোনো কণা দিয়ে তৈরি? সেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা মধ্যে নিশ্চয়ই ফাঁকা জায়গা আছে। চাপ বাড়ালে ফাঁকা জায়গাগুলো নিশ্চয় কমে যায়। তার ফলে কণাগুলো পরস্পরের কাছাকাছি চলে আসে। বয়েলের অনুমান ঠিক ছিল। তিনি ওই ঘটনার পরে চাপ ও গ্যাসের আয়তনের সম্পর্ক নির্ণয়ের একটি সূত্র আবিষ্কার।

অতএব ক্ষুদ্র কণা সম্পর্কে বয়েল নিশ্চিত হলেন। নিশ্চিত হলেন, ডেমোক্রিটাস যে অবিভাজ্য কণা অ্যাটোমের কথা বলেছিলেন গ্যাসীয় পদার্থ তার সমষ্টি। কঠিন বস্তুকে তাপ ও চাপ প্রয়োগ করে তরল ও গ্যাসীয় বস্তুতে পরিণত করা যায় সহজেই।

কঠিন ও তরলও নিশ্চিতভাবে পরমাণু দিয়ে তৈরি। তবে গ্যাসের তুলনায় তরলের পরমাণুগুলোর মধ্যে ফাঁক কম থাকে। তরলের তুলনায় কঠিন পদার্থের পরমাণুগুলোর মধ্যে ফাঁক থাকে না বললেই চলে। তাই অল্প স্বল্প চাপে কঠিন পদার্থের আয়তনের তেমন পরিবর্তন হয় না। বয়েলের পরীক্ষাই পরমাণুবাদ তত্ত্বের ওপর প্রথম পরীক্ষা। অবশ্য এই ধারণায় ত্রুটি আছে। আমরা এখন জানি, যেটাকে বয়েল পরমাণু করতেন, আসলে তা ছিল পদার্থের অণু। তবে অণু-পরমাণুর মধ্যে পার্থক্য তৈরি হয়েছে অনেক পরে।

রবার্ট বয়েলের পরীক্ষার পরে বিজ্ঞানীরা আরেকটা বিষয় নিশ্চিত হন। সব বস্তুই মৌলিক পদার্থ নয়। একই বস্তুতে ভিন্ন ভিন্ন পদার্থের মিশ্রণ থাকতে পারে । অবশ্য এসব মিশ্রণ পানি আর চিনির মিশ্রণের মতো নয়। একেবারে রসায়নিক প্রক্রিয়ায় মিশ্রণ।

– জোসেফ লুই প্রাউস্ট

ফরাসী রসায়নবিদ জোসেফ লুই প্রাউস্ট আরেক যুগান্তকারী আবিষ্কার করেন তিনি। যৌগিক পদার্থের মধ্যে মৌলিক পদার্থগুলোর অণুপাত কেমন হবে, সে বিষয়ে একটা পরীক্ষা চালাল প্রাউস্ট। ১৭৯৯ সালে তিনি কপার কার্বনেটের একটি অংশে কী পরিমাণ কপার, কী পরিমাণ কার্বন ও কী পরিমাণ অক্সিজেন আছে সেই অনুপাতটা মাপতে সক্ষম হলেন। তিনি দেখলেন, কপার কার্বনেটের ক্ষুদ্রতম অংশকে ঠিক পরমাণু বলা বলা চলে না। বরং পরমাণু গুচ্ছ বলা যায়। প্রতিটি গুচ্ছে একটি করে কপার পরমাণু একটি করে কার্বন পরমাণু থাকে। এই পরমাণু গুচ্ছকেই আজকাল অণু বলে। সেকালে অণু ও পরমাণুর মধ্যে পার্থক্য করতে শেখেনি মানুষ। প্রাউস্টের চরম বিরোধিতা করেন আরেক রসায়নবিদ ক্লাউদ বার্থেলট। বার্থেলটের সে বিরোধিতা ধোপে টেকেনি। প্রাউস্টের ধারণাকে সমর্থন সুইডিশ রসায়নবিদ জন জ্যাকব বার্জেলিয়াস। ১৮০৪ সালে তিনি স্থিরানুপাত প্রমাণ দেন।

জন ডালটন

ঊনবিংশ শতাব্দীতে সত্যিকার অর্থেই হাওয়া লাগে পরমাণুবাদের পালে। পরমাণুর নাট্যমঞ্চে হাজির ব্রিটিশ গণিতজ্ঞ জন ডালটন। ডালটনকে বলা হয় আধুনিক পরামাণুবাদের জনক। ১৮০৩ সালে তিনি সর্বপ্রথম একটা পরমাণু মডেল দাঁড় করান। সেই মডেলটি  ‘ডালটনের পরমাণু মডেল।’  নামে বিজ্ঞানে পরিচিত।

ডালটন দেখালেন, দুটি ভিন্ন যৌগিক পদার্থে একই মৌলিক পদার্থ থাকতে পারে। তবে তাদের অনুপাতগুলো আলাদা বলে যৌগদুটিও একে অপরের থেকে আলাদা। তিনি দেখালেন কার্বন-মনো-অক্সইড গ্যাসের পরমাণুতে (আসলে অণু) একটি অক্সিজেন ও একটি পরে কার্বন পরমাণু থাকে। কার্বন আর অক্সিজেন দিয়ে তৈরি আরেকটা গ্যাস আছে। সেটার নাম দিলেন কার্বন-ডাই-অক্সাইড। সেটির পরমাণুতে একটি কার্বন পরমাণু ও দুটি করে অক্সিজেন পরমাণু আছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে দুটো মৌলিক পদার্থ দিয়ে একাধিক যৌগিক পদার্থের পরমাণু তৈরি করা যায়। যৌগিক পরামাণুতে মৌল দুটির অনুপাত শুধু আলাদা। তবে দুটি যৌগিক পরমাণুই (অণু) স্থিরাণুপাত সূত্র ঠিক ঠিক মেনে চলে। তিনি একটা সূত্রের মাধ্যমে এর ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করলেন। সেই সূত্রটার নাম ‘গুণানুপাত সূত্র’। গুণানুপাত সূত্র ধরেই তিনি পদার্থের ক্ষুদ্র কণিকার নাম করলেন ‘অ্যাটোম’ বা ‘পরামাণু’।  আসলে তিনি ডেমেক্রিটাসকে সম্মানিত করার জন্যই পুরানো নামটিকে নতুন করে প্রতিষ্ঠিত করলেন।

ডালটন পরমাণু বিষয়ে কয়েকটি সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন। তিনি বললেন, প্রতিটা মৌল পরমাণু নামে অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা দিয়ে তৈরি। একটা নির্দিষ্ট মৌলের প্রতিটা পরমাণুর ভর ও ধর্ম সমান। পরমাণুতে মৌলের বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ন থাকে। তিনি যৌগিক পদার্থের ক্ষুদ্রতম কণার নাম দিলেন যৌগিক পরমাণু। যৌগিক পদার্থের পরমাণু একাধিক মৌলিক পদার্থের পরমাণু দিয়ে তৈরি।

গ্রিক পরমাণুবাদের চেয়ে ডালটনের পরমাণুবাদ পুরোপুরি আলাদা। এবং বেশ গোছালো। কিন্তু ডালটনের পরমাণুবাদ পুরোপুরি নির্ভরযোগ্য নয়। তবে অস্বীকার করার উপায় নেই ডালটনের পরমাণুবাদ আধুনিক পরমাণুবাদের ভিত্তি গড়ে দিয়েছিল। ডালটনের পরমাণুবাদ তত্ত্বে ক্রটি ছিল। তবে বাতিল করার উপায়ও ছিল না। তাছাড়া পরমাণু ধরে নিয়ে হিসাব করলে রাসায়নিক ক্রিয়া-বিক্রিয়াগুলোর ফল পেতে বেশ সুবিধাই হয়। কিন্তু বিজ্ঞান সব সময় প্রমাণ চায়। রাসায়নিক ক্রিয়া-বিক্রিয়ার ফলাফল থেকে পরমাণুর পরোক্ষ প্রমাণ মেলে। কিন্তু সত্যিকারের প্রমাণ তো চাই! কেউ তো আর পরমাণু দেখেননি। তখন দেখার উপায়ও ছিল না। তাই পরমাণু-তত্ত্ব স্বীকার করে নিলেও একটা অস্বস্তিকর ব্যাপার ছিল বিজ্ঞানীদের মনে।

ডাল্টনের পরমাণুবাদকে একটু শুধরে দিলেন ইতালিয়ান পদার্থবিজ্ঞান অ্যামাদিও অ্যাভোগেড্রো। তিনি বললেন, মৌলিক ও যৌগিক উভয় পদার্থের ক্ষেত্রে ঢালাওভাবে পরমাণু-তত্ত্ব চাপিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না। হ্যাঁ, মৌলের ক্ষুদ্রতম কণাকে পরমাণু বলতে আপত্তি নেই। কিন্তু যৌগিক পদার্থের ক্ষেত্রেও কেন পরমাণু বলব? পরমাণু মানে অভিবাজ্য। যৌগিক পদার্থের ক্ষেত্রে পরমাণু বললে শব্দটারই অপব্যবহার হয়। ডালটন যাকে যৌগিক পরমাণু বলছেন, সে তো অবিভাজ্য নয়, বেশকটি মৌলিক পরমাণু দিয়ে তৈরি। সুতরাং যৌগিক পদার্থের ক্ষেত্রে ‘মলিকুল’ বা ‘অণু’ বলা হোক। অণু যৌগিক পদার্থের সেই ক্ষুদ্রতম কণা যাতে ওই যৌগটির ধর্ম ও বৈশিষ্ট্য বজায় থাকে। সেটাকে ভাঙলে আর যৌগের বৈশিষ্ট্য থাকে না। তখন পরমাণুগুলো আলাদা হয়ে যায়। পরমাণুগুলো যে যে মৌলের ক্ষুদ্রতম কণা, সে সে মৌলের ধর্ম ও বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করে।

পানির কথাই ধরা যাক। পানি যৌগিক পদার্থ। হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন দিয়ে তৈরি। পানির প্রতিটা অণু যদি আলাদা আলাদা করে পর্যবেক্ষণ করা হয়, তা হলে প্রতিটাতেই পানির বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া যাবে। পানির অণুকে ভেঙে দেখা যেতে পারে। প্রতিটা পানির অণু থেকে একটা করে অক্সিজেন ও দুটো করে হাইড্রোজেন পরমাণু পাওয়া যাবে। অক্সিজেন পরমাণুটি অক্সিজেনের বৈশিষ্ট্য দেখাবে, হাইড্রোজেনের দুটো পরমাণু হাইড্রোজেনের বৈশিষ্ট্য দেখাবে। কোনো পরমাণুতেই পানির বৈশিষ্ট্য পাওয়া যাবে না।

অণুগুলো ভেঙে পরমাণুর বৈশিষ্ট্য পর্যবেক্ষণ করার কথা লিখলাম। সেটা এ যুগে যতটা সহজে দেখা সম্ভব, সে যুগে ততটা সহজ ছিল না।

[বইটির সূচীপত্র এবং সব খন্ডের লিংক একত্রে দেখুন এখানে]

-আব্দুল গাফফার রনি
বিজ্ঞান লেখক
[লেখকের ফেসবুক প্রোফাইল]

Exit mobile version