প্রাইম নম্বর সম্বন্ধে আমরা সবাই শুনেছি। বাংলায় এইগুলো কে বলা হয়ে থাকে মৌলিক সংখ্যা। নাম থেকেই আমরা বুঝতে পারি প্রাইম হচ্ছে সংখ্যার কিছু মৌলিক ভিত্তি যেগুলোকে ভাঙ্গা হলে আর একই রকম কিছু পাওয়া যায় না এবং যেগুলোর মাধ্যমে অন্য যৌগিক সংখ্যাগুলো তৈরি হয়ে থাকে। এগুলো অনেকটা রসায়নের অলোচিত মৌলিক পদার্থের মতো, মৌলিক পরমানুর বিভিন্ন বিন্যাসের মাধ্যমে যেমন যৌগিক অণু তৈরি হয়। উদাহরন হিসেবে বলা যায়, হাইড্রোজেন একটি মৌলিক পদার্থ এবং অক্সিজেন একটি মৌলিক পদার্থ। এই দুই মৌলিক পদার্থের পরমানুগুলো পূর্ণ সংখ্যায় যুক্ত হয়ে পানি তৈরি করে যেটি একটি যৌগিক পদার্থ। কিংবা বিপরীতভাবে বলা যায় পানিকে ভাঙ্গলে দুটি মৌলিক পদার্থ হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন পাওয়া যায়। গণিতেও মৌলিক সংখ্যা তথা প্রাইমের বিষয়টি একই ভাবে কাজ করে। মৌলিক নয় এমন দুটি পূর্ণ সংখ্যাকে একাধিক একই বা ভিন্ন ধরনের প্রাইমের গুণফল রূপে বিশ্লেষণ করে দেখানো যায়। তবে এই সংখ্যার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হচ্ছে সংখ্যার প্রাইম উৎপাদকগুলো ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে এবং একই হতে পারে। প্রাইমের ক্ষেত্রে আরেকটি ব্যতিক্রম আছে যেটি নিয়ে অনেকেরই মনে প্রশ্ন এবং বিভ্রান্তি আছে। সেটি হচ্ছে: ১ প্রাইম সংখ্যা নয়!
১ কে কেন প্রাইম বলা হবে না? ১ হচ্ছে সংখ্যা গঠনের একক। যেকোন পূর্ণ সংখ্যা গঠনে এক অবধারিতভাবে চলে আসে। অর্থাৎ প্রত্যেকটি ক্রমিক পূর্ণ সংখ্যা ১ করেই বৃদ্ধি পায় এবং আমারা একের সাথে এক ক্রমান্বয়ে যোগ করে যে কোনো স্বাভাবিক পূর্ণ সংখ্যা তৈরি করে ফেলতে পারি। সংখ্যা তৈরির কোনো মৌলিক একক যদি থেকে থাকে তাহলে সেতো হচ্ছে ১। কিন্তু তারপরেও ১ কে প্রাইমের স্বীকৃতি দেয়া হয়নি কেননা ১ যদি প্রাইম হয় তাহলে পাটীগণিতের কিছু মৌলিক স্বীকার্য বা থিওরেমের কার্যত কোনো অস্তিত্ব থাকে না। বিস্তারিত কারণগুলো এখন একে একে আলোচনা করা যাক।
এক প্রাইম নয় এর প্রথম কারণ হচ্ছে প্রাইমের সংজ্ঞা। প্রাইমের সংজ্ঞা নির্ধারনের সময় কৌশলে(!) এককে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রাইমের সংজ্ঞা হচ্ছে: “যেসব স্বাভাবিক পূর্ণ সংখ্যা একের চেয়ে বড় এবং এক ও সেই সংখ্যা ছাড়া অন্য কোনো সংখ্যা দ্বারা বিভাজ্য নয় সেগুলোই প্রাইম সংখ্যা”। যেহেতু সংজ্ঞার শুরুতেই বলে দেয়া হয়েছে প্রাইম হতে হলে কোনো সংখ্যাকে একের চেয়ে বড় পূর্ণ সংখ্যা হতে হবে তাই এক প্রাইম নয়। কিন্তু পাঠকের মনে প্রশ্ন আসতেই পারে সংজ্ঞা তো মানুষই নির্ধারন করেছে। তাহলে সংজ্ঞা নির্ধারনের সময় এক কে জোর পূর্বক তালিকা থেকে বাদ না দিলেও চলত। এককে আসলেই জোরপূর্বক বাদ দেয়া হয়েছে কিনা দেখা যাক।
প্রাইমের ধারনাটি গণিতবিদ ইউক্লীড সর্বপ্রথম আনুষ্ঠানিক ভাবে উপস্থাপন করেন যখন তিনি “পারফেক্ট নম্বর” নিয়ে চিন্তা করছিলেন। তাঁর গবেষনায় জানা প্রয়োজন ছিলো কখন কোনো পূর্ণ সংখ্যাকে অন্য সংখ্যা দিয়ে নিঃশেষে ভাগ করা যায় এবং সেই জন্য তাঁর সেই সংখ্যাগুলোকে খুঁজে বের করার প্রয়োজন হয়েছিলো যাদের একের চেয়ে বড় উৎপাদক বা ফ্যাক্টর নেই। এই সংখ্যাগুলো নিয়ে চর্চা করতে করতেই তিনি পাটীগণিতের মৌলিক থিওরেমটি বিবৃত করেন।
“প্রতিটি পূর্ণ সংখ্যাকে কেবলমাত্র একভাবেই তার প্রাইম উৎপাদকসমূহের গুণফলরূপে প্রকাশ করা যায় যেখানে উৎপাদকগুলোর ক্রম নির্দিষ্ট থাকবে।“
এই থিওরেমে “কেবলমাত্র একভাবেই” শব্দগুচ্ছ ভীষন গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণ হিসেবে আমরা ২১ সংখ্যাটিকে বিবেচনা করি। এই সংখ্যাটিকে তার প্রাইম উৎপাদকে বিশ্লেষণ করলে আমরা পাই:
২১ = ৩ × ৭ এবং উৎপাদক ৩ এবং ৭ এর ক্রম নির্দিষ্ট করা হলো। অর্থাৎ ৩ এবং ৭ ক্রমপরিবর্তন করে যদিও লেখা যায় ২১ = ৭ X ৩ কিন্তু ক্রম ছোট থেকে বড় সংখ্যায় নির্দিষ্ট করায় এটাকে কেবল একভাবেই লেখা সম্ভব। এখন আমরা যদি ১ সংখ্যাটিকে প্রাইম হিসেবে স্বীকৃতি দিই তাহলে ২১ এর মধ্যে ১ কেও অন্তর্ভূক্ত করতে হয়।
২১ = ১ × ৩ × ৭
কিংবা
২১ = ১ × ১ × ৩ × ৭
এই সমীকরণকে ইচ্ছেমত প্রলম্বিত করে ফেলা যায়।
২১ = ১ × ১ × ৩ × ৭
২১ = ১ × ১ × ১ × ৩ × ৭
২১ = ১ × ১ × ১ × ১ × ৩ × ৭
—————————–
কাজেই দেখা যাচ্ছে ১ সংখ্যাটিকে যদি প্রাইম ধরে নেয়া হয় তাহলে পাটীগণিতের মৌলিক থিওরেম হুমকীর মুখে পড়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ কোনো পূর্ণ সংখ্যাকে “কেবল একভাবেই” প্রাইম উৎপাদকের গুণফল হিসেবে প্রকাশ করা যাচ্ছে না বরং অসীম সংখ্যক ভাবে প্রকাশ করা যাচ্ছে। তাহলে মৌলিক সংখ্যার যেই প্রয়োজনীয়তা সেটার কার্যত আর কোনো ভিত্তি থাকে না। কেননা প্রাইম সংখ্যাকে অন্যান্য সংখ্যার সুনির্দিষ্ট ভিত্তিমূল ধরা হয়।
কিন্তু তারপরও কথা থেকে যায়। পাটিগণিতের থিওরেম অনুসারে যদি ১ কে প্রাইম হিসেবে ধরা না যায় তাহলে আমরা কেন থিওরেমটি বদলে ফেলছি না! গণিতের জন্য থিওরেম নাকি থিওরেমের জন্য গণিত? যুক্তিসংগত চিন্তা-ভাবনাই বটে। অবশ্য এই একই যুক্তিসংগত চিন্তা করা যায় প্রাইমের জন্যও। প্রাইমের জন্যেও গণিত নয় বরং গণিতের জন্য প্রাইম। ১ কে প্রাইমের অন্তভূক্ত করার জন্য থিওরেমটিকেই বদলে ফেলতে হবে এমন কোনো কথা নেই। তারচেয়ে বরং আমরা প্রাইম সংখ্যাগুলোকে স্রেফ সংখ্যার একটি তালিকা হিসেবে বিবেচনা পারি যার অন্তর্ভুক্ত সংখ্যাগুলো হচ্ছে ২, ৩, ৫, ৭, ১১, ১৩ …. ইত্যাদি ইত্যাদি এবং সেখানে আমরা ১ কে বিবেচনা করিনি আমাদের ইচ্ছা অনুযায়ী।
এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে। আমরা যদি পাটিগণিতের থিওরেমটির দিকে তাকাই তাহলে দেখব ১ এমনকি পূর্ণসংখ্যারও অন্তর্ভুক্ত নয়! কেননা থিউরেম অনুযায়ী প্রতিটি পুর্ণসংখ্যাকে প্রাইম উৎপাদকের গুণফল হিসেবে প্রকাশ করা যায়।
যেমন: ৮১ = ৩ × ৩ ×৩ ×৩
২৭ = ৩ × ৩ ×৩
৯ = ৩ × ৩
৩ = ৩
১ = –
উপরের সমীকরনগুলো থেকে দেখতে পাচ্ছি ৮১, ২৭, ৯, ৩ এর যথাক্রমে ৪ টি, ৩ টি, ২ টি ও ১ টি মৌলিক উৎপাদক আছে। অথচ ১ এর কোনো মৌলিক উৎপাদক নেই (এই কারণে কোনো সংখ্যার পাওয়ার শূন্য হলে তার মান ১ হয়।)। তাই ১ কে পূর্ন সংখ্যার অন্তর্ভুক্ত করে থিওরেমটি লেখা হয়:
“১ এর চেয়ে বড় প্রতিটি পূর্ণ সংখ্যাকে কেবলমাত্র একভাবেই তার প্রাইম উৎপাদকসমূহের গুণফলরূপে প্রকাশ করা যায় যেখানে উৎপাদকগুলোর ক্রম নির্দিষ্ট থাকবে।“
ইমতিয়াজ আহমেদ
সম্পাদক, বিজ্ঞান পত্রিকা
বিজ্ঞান পত্রিকা প্রকাশিত ভিডিওগুলো দেখতে পাবেন ইউটিউবে। লিংক:
১. টেলিভিশনঃ তখন ও এখন
২. স্পেস এক্সের মঙ্গলে মানব বসতি স্থাপনের পরিকল্পনা