বিজ্ঞান পত্রিকা

ঘুম-চক্রের পালাবদলের কাজ কি?

ঘুম-চক্র কি কাজ করে এ প্রশ্নটাকে দুইটি ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন উভচর ও সরীসৃপসহ কিছু অমেরুদন্ডী প্রাণীদের মাঝে নন-রেম-ঘুমের মূল কাজটা আসলে কি? দ্বিতীয়তঃ, স্তন্যপায়ী ও পাখিদের ঘুমচক্রে রেম ও নন-রেম-ঘুমের পালাবাদলের মূল কাজটা কি? প্রথম প্রশ্নের জন্য হয়তো পূর্বে বর্ণিত শক্তি সঞ্চয়, দিনের সেই সময়টায় কার্যক্ষম থাকা যখন বড় প্রাণীর শিকার না হয়ে নিজের খাবার পাওয়ার সম্ভাবনা বেশী, পুরোদমে খাটার মতো দৈহিক-অবস্থায় ফেরত যাওয়া, ক্ষয়পূরণ ইত্যাদি ভাবনাগুলো কিছু উদ্দীপক চিন্তার খোরাক দিতে পারে। এসব মতামত শুধু নন-রেম-ঘুমের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। তবে ঘুমচক্র, মানে রেম ও নন-রেম ঘুমের পর্যায়ক্রমিক পরিবর্তন, সম্ভবত এমন কোন কাজের দায়িত্বে রয়েছে যার প্রয়োজন উষ্ণরক্তের প্রাণী উদ্ভব হওয়ার আগে ছিলো না। আমরা জানি উষ্ণরক্তের প্রাণীরা শৈশবে বেশি ঘুমায়; বয়সের সাথে সাথে ঘুমের পরিমাণ কমে আসে। সুতরাং ঘুমচক্রের সেই গুরুত্বপূর্ণ কাজ এসব আধুনিক প্রাণীদের জীবনের প্রথম ভাগেই বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে আমরা আন্দাজ করতে পারি। এই লেখাটিতে ঘুমচক্রের কাজ অনুসন্ধানের জন্য বেশ কিছু গবেষণার খবরাখবর জানবো আমরা।

জটিল সমস্যার সমাধানে রাতের ভালো-ঘুম অন্তর্দৃষ্টি দিতে পারে।

ঘুমচক্রের কাজ সম্পর্কে সবচেয়ে সরল প্রস্তাবনা হলো যে এটা দেহে তাপীয় সাম্যবস্থা বজায় রাখার জন্য কাজ করছে। যেমন কিছু গবেষণায় দেখা যায়, নন-রেম ঘুমে মস্তিস্ক ঠান্ডা হতে থাকে, আর রেম-ঘুমে মস্তিষ্ক উষ্ণ হয়। হতে পারে পর্যায়ক্রমে নন-রেম ও রেম-ঘুম মস্তিষ্ককে খুব-ঠান্ডা বা খুব-গরম হওয়া থেকে বিরত রাখছে। তবে এ ব্যাখ্যার একটা সমস্যা হলো বয়স বাড়ার সাথে সাথে কেন ঘুমচক্রে রেম-ঘুমের পরিমাণ কমে যায় তার কোন সদুত্তরের অনুপস্থিতি।

মস্তিষ্কের বিকাশ স্মৃতিসঞ্চয়

ঘুমচক্রের কাজ বিষয়ে আরেকটা অনুকল্প হলো জীবনের শুরুর দিকে ঘুমচক্র কোন না কোন ভাবে মস্তিষ্কের বিকাশকে প্রভাবিত করে। সদ্যজাত মস্তিষ্কে অভিজ্ঞতা-পরিচালিত নমনীয়তার (experience-driven plasticity) প্রয়োজন হয় এমন ধরনের বিকাশের ক্ষেত্রে ঘুমচক্র বিশেষায়িত দায়িত্ব পালন করতে পারে। বিড়ালছানাদের উপর করা কিছু গবেষণা এই মতামতের ভিত্তি। প্রথমে বিড়ালছানাদের একচোখ বেঁধে রাখা হয় কিছু সময়ের জন্য। তারপর দেখা গেলো, বন্ধ থাকা চোখ থেকে আসা সংকেতে নিয়ে কারবার করা দৃশ্যকর্টেক্সের স্নায়ুগুলোর আলোর প্রতি উদ্দীপনা খোলা চোখের সংকেত নিয়ে কাজ করা দৃশ্যকর্টেক্সের স্নায়ুগুলোর সমরূপ উদ্দীপনা থেকে কম। তারপর বিড়ালছানাদের ঘুমাতে দিলে দেখা যায় উভয় দৃশ্যকর্টেক্সের স্নায়ুগুলোর উদ্দীপন ক্ষমতার তুলনামূলক পার্থক্য আগের মতোই আছে — এমনকি বেড়েও গেছে। কিন্তু যখন বিড়ালছানাদের ঘুমাতে বাধা দেয়া হলো কিংবা সুনির্দিষ্টভাবে রেম ঘুমে বাধা দেয়া হলো, দেখা গেলো দৃশ্যকর্টেক্সের স্নায়ুসমূহে এক-চোখা-উদ্দীপন-বৈষম্য ভিত্তিক অভিজ্ঞতা হারিয়ে গেছে। তার মানে এখানে ঘুমচক্র অভিজ্ঞতা-নির্ভর-নমনীয়তা ভিত্তিক মস্তিষ্ক বিকাশে কোন না কোন ভাবে ভূমিকা রাখছে।

এ অনুকল্পেরো কিছু সমালোচনা আছে। যদি ঘুমচক্র শুধুমাত্র অভিজ্ঞতা নির্ভর মস্তিষ্ক গঠনেই অংশ নিতো তাহলে বড় হওয়ার পর এ প্রক্রিয়ার আর কোন প্রয়োজনীয়তা থাকে না। তবে হতে পারে সাবালকত্ব পাওয়ার পরেও কোন কাজ ছাড়াই ঘুমচক্র টিকে গেছে। কিন্তু এমনটা হবার সম্ভাবনা কম। এখানে বলে রাখা ভালো, নবজাতকদের মস্তিষ্ক গঠনের সময়ে অভিজ্ঞতা-নির্ভর ধাপগুলোতে বিভিন্ন স্নায়ুর সিন্যাপ্স সংযোগে পরিবর্তন হয়। সাবালক মস্তিষ্কে কোন ঘটনা বা তথ্য স্মৃতিতে সংরক্ষণের সময় একই রকম সংযোগ পরিবর্তন ঘটতে দেখা যায়। হতে পারে, নন-রেম ও রেম-ঘুমের চাক্রিক আবর্তন শৈশবে মস্তিষ্ক গঠনে অংশ নেয়; আর জীবনের পরের ভাগে একটু ভিন্ন ভাবে স্মৃতি সংরক্ষণের কাজটি করে।

ঘুমচক্রের সাথে স্মৃতির সম্পর্ক নিয়েও বেশ কিছু চমকপ্রদ গবেষণা হয়েছে। মানুষ ও ইঁদুরের উপর করা বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে কোন কিছু শেখার জন্য নির্ধারিত অনুশীলন করে একটা ঘুম দিলে পরের দিন ঐ কাজের দক্ষতা বেড়ে যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব কাজে ঘুমের মাধ্যমে মস্তিষ্কে স্মৃতি সংরক্ষণের কোন প্রয়োজন ছিলো না। অনেক গবেষণায় প্রশিক্ষণের পর টানা আট ঘন্টা জেগে থাকলেও অনুশীলন-সংক্রান্ত স্মৃতি অটুট থাকতে দেখা গেছে। রাত বা দিনে জেগে থাকা এ ক্ষেত্রে তেমন কোন পার্থক্য তৈরি করে নি। তবে ঘুমের বিভিন্ন পর্যায়ের চাক্রিক আবর্তন শেখার ক্ষেত্রে লক্ষ্যনীয় উন্নতি সৃষ্টি করে। জটিল সমস্যায় পড়েছো? রাত্রে সে বিষয়ে চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ো। দেখবে, সকালে একটা ভালো বুঝ্ তৈরি হয়ে গেছে — বিশ্বের অনেক সংস্কৃতিতেই এরকম একটা কথা প্রচলিত আছে। মানুষের হাজার বছরের পুরনো এই পর্যবেক্ষণের সাথে উপরে বর্ণিত পরীক্ষার ফলাফল মিলে যায় ভালোভাবেই।

ছবি: বেনজিনের গঠন সমস্যা ও নিজ-লেজ খাওয়া সাপ। ছবি ইন্টারনেট।

ঘুমচক্র, স্বপ্ন অন্তর্দৃষ্টি

স্বপ্নে জটিল কোন বিষয়ে অন্তর্দৃষ্টি পাওয়ার অনেকগুলো বর্ণনা পাওয়া যায় বিজ্ঞানের ইতিহাসে। উনবিংশ শতাব্দীতে জার্মান বিজ্ঞানী ফ্রিডরিখ কেকুল স্বপ্নে এক সাপকে তার লেজ কামড়াতে দেখেন। সেখান থেকেই তিনি জৈবযৌগ বেনজিনের গাঠনিক সংকেত বের করেন। আমেরিকান উদ্ভাবক এলিয়াস হাওই চেষ্টা করছিলেন কিভাবে সেলাই-যন্ত্র তৈরি করা যায়। একসময় স্বপ্নে দেখেন একদল আদিবাসী তাকে বর্শা দিয়ে মারতে আসছে। সেসব বর্শার মাথায় ফুটা। সেখান থেকে তিনি সেলাই-যন্ত্রের নকশার মূল সমস্যার সমাধান করেন – সুঁইয়ের মাথার দিকে ফুটা করে। কিন্তু স্বপ্ন ও অন্তর্দৃষ্টির মাঝে কি কোন সম্পর্ক আছে নাকি কাকতালীয়ভাবে এ দুটো জিনিস ঘটে যায়?

মানুষের শেখার সাথে ঘুম-বঞ্চনার কোন সম্পর্ক আছে কিনা তা দেখার জন্য জার্মানীর লুয়েবেক বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি আগ্রহোদ্দীপক গবেষণা চালানো হয়। সেটার উদ্দেশ্য ছিলো স্বপ্ন ও অন্তর্দৃষ্টির মধ্যে কাকতাল-ভিন্ন অন্য কোন সম্পর্ক আছে কিনা খুঁজে বের করা। এজন্য গবেষকরা একটি গাণিতিক সমস্যা তৈরি করেন। এ সমস্যা সমাধানের জন্য কিছু সাধারণ নিয়ম একের পর এক করে বারবার প্রয়োগ করতে হবে। গবেষকরা সমস্যা সমাধানের জন্য আবার অন্য একটা পদ্ধতিও ভেবে রেখেছিলেন যার মাধ্যমে খুব দ্রুত চূড়ান্ত সমাধানে পৌঁছানো যাবে মধ্যবর্তী হিসাব না কষেই। পরীক্ষার প্রথম চেষ্টায় কোন অংশগ্রহণকারীই সেই সংক্ষিপ্ত উপায়টি খুঁজে পায় নি। কিন্তু যখন তাদের রাত্রে ঘুমাতে দেয়া হলো, বাইশজনের মধ্যে তেরজনই সেই সংক্ষিপ্ত পদ্ধতির অন্তর্দৃষ্টি পেয়ে গেলেন। অন্যদিকে আরেকটি দলের কাউকেই ঘুমাতে দেয়া হয় নি। দেখা গেলো, সেই না-ঘুমানো-দলের বাইশ জনের মধ্যে মাত্র পাঁচজন সংক্ষিপ্ত উপায়টি খুঁজে পান। এ থেকে পরীক্ষকরা সিদ্ধান্ত টানেন – রাত্রের সুনিদ্রায় অন্তর্দৃষ্টি পাওয়া যায়!

পরীক্ষাধীন স্বেচ্ছাসেবী কিংবা অন্য প্রাণীদের রেম-ঘুমের সময় হঠাৎ জাগিয়ে দিলে কি ঘটে তা দেখার জন্য অনেকগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা  চালানো হয়েছে। এ ধরনের রেম-ঘুম-বঞ্চনা শেখার-কাজের সাথে সম্পর্কিত কয়েক রকমের স্মৃতি একত্রীকরণের ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করতে দেখা গেছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বেশ নাটকীয় ফলাফল পাওয়া গেছে। যেমন একটি গবেষণায় স্বেচ্ছাসেবীদের বিভিন্ন দৃশ্য-জমিনের (visual texture) তারতম্য শেখানো হয়। তাদেরকে ঘুমাতে দিলে পরবর্তী পরীক্ষায় সেই তারতম্য চিনতে পারে। কিন্তু ঘুমাতে না দিলে কিংবা রেম-ঘুমে মাত্র প্রবেশ করার পরেই তাদের ঘুম থেকে জাগিয়ে দিলে আগের দিনের প্রশিক্ষণ ফলপ্রসু হওয়ার কোন লক্ষণই দেখা যায় না তাদের মধ্যে। এখানে বলে রাখা দরকার যে বিভিন্ন নিয়ম, দক্ষতা, কর্মপদ্ধতির মধ্যে অবচেতন যোগসংযোগ বের করা সম্পর্কিত স্মৃতি একত্রীকরণের কাজে ব্যাঘাত ঘটায় এরকম রেম-ঘুম-বঞ্চনা। কিন্তু যেসব স্মৃতি তথ্য ও ঘটনার সাথে সম্পর্কিত, সেগুলো রেম-ঘুম-বঞ্চনা দিয়ে তেমন একটা ক্ষতিগ্রস্থ হয় না। তাই উল্লিখিত বিভিন্ন দৃশ্যের জমিন তারতম্য চেনার গবেষণায় যেসব স্বেচ্ছাসেবী রেম-ঘুম থেকে বঞ্চিত হয়েছে, তাদের আগের দিনের প্রশিক্ষণের কথা মনে থাকে (ঘটনা)। কিন্তু পরের দিনের পরীক্ষায় উত্তর দেয়ার ক্ষেত্রে তারা পূর্বের থেকে বেশি সময় নেয় (দক্ষতা)।

রেম-ঘুম কখন হচ্ছে সেটাও স্মৃতি একত্রীকরণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। স্মৃতি একত্রীকরণ ভালোভাবে হওয়ার জন্য প্রশিক্ষণের চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে রেম ঘুম হতে হবে। কেউ নতুন কোন দক্ষতা শেখার পর যদি ঐ রাতের ঘুমটি থেকে কোনভাবে বঞ্চিত হয় তাহলে এক দিন পরের রাতে ঘুমের ফলে তার কোন উন্নতি হবে না। একই ঘটনা পরীক্ষাগারের ইঁদুরদের মাঝেও লক্ষ্য করা যায়। তবে তাদের ক্ষেত্রে মধ্যবর্তী বিরতীটা বেশ কম – প্রশিক্ষণের চার থেকে আট ঘন্টার মধ্যে তাদের রেম ঘুম হতে হবে প্রশিক্ষণের ইতিবাচক ফলাফল পাওয়ার জন্য।

ফ্ল্যাশব্যাক

বিগত দিনের স্মৃতিদের আবার ‘ফিরে দেখা’-র প্রপঞ্চও রেম-ঘুমের সাথে সম্পর্কিত। এ নিয়ে এমআইটি বিশ্ববিদ্যালয়ে চালানো একটি গবেষণার কথা জানা যাক। দু’জন গবেষক, কেনডাল লুই আর ম্যাট উইলসন, অনেকগুলো ইলেকট্রোডের একটি সজ্জা ব্যাবহার করেন। ইলেকট্রোড হচ্ছে কোন সংবেদন মাপার জন্য এক ধরনের বিদ্যুৎ-বাহক তারের প্রান্ত। তারা এই ইলেকট্রোড-সজ্জা দিয়ে ইঁদুর-মস্তিষ্কের হিপোক্যাম্পাস অঞ্চলের স্থান-সম্পর্কিত একদলা স্নায়ুকোষের সংবেদন মাপার ব্যবস্থা করেন। ঐ ইঁদুরকে খাবার খোঁজার জন্য একটি একমুখী রাস্তা বরাবর দৌঁড়াতে দেয়া হয়। দৌঁড়ানোর সময় স্থান-সম্পর্কিত স্নায়ুকোষগুলোর একের পর এক উদ্দীপিত হওয়ার অনুক্রম লিপিবদ্ধ করতে সক্ষম হন তারা। ইঁদুররা ঘুমানোর সময়েও ইলেকট্রোড-সজ্জা দিয়ে সংবেদন লিপিবদ্ধ করার কাজটি চলতে থাকে। দেখা যায়, রেম-ঘুমের সময় একই অনুক্রমে ঐ স্থান-সম্পর্কিত স্নায়ুগুলো পরপর উদ্দিপীত হয়ে ওঠে। অবশ্য এই ‘ফিরে দেখা’-র ঘটনাটি জেগে থাকা অবস্থার সম্পূর্ণ অনুকরণ নয়, কিছুটা ভিন্নতা থাকে।

পূর্ণ অনুকরণ বা নকল না হলেও বিভিন্ন গবেষণাগারে চালানো একাধিক পরীক্ষায় দেখা গেছে কোন প্রশিক্ষণের পর রেম-ঘুমে প্রশিক্ষণ সম্পর্কিত স্নায়ুগুলো বেশ তাৎপর্যপূর্ণভাবেই উদ্দীপিত হয়ে উঠে। এখন প্রশ্ন হলো, এই উদ্দীপনা-অনুকরণ ইঁদুরের স্মৃতি-একত্রীকরণের জন্য অপরিহার্য ছিল কি না? তাই যদি হয়ে থাকে তাহলে এই উদ্দীপনার সাথে কি কোন অভিজ্ঞতা জড়িয়ে ছিলো ইঁদুরদের মস্তিষ্কে? তারা কি ঐ একমুখী রাস্তায় দৌঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছিলো? আমরা এখনো এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানি না।

এই গবেষণার ফলাফল দেখে অনেকেই ভাববেন যে রেম-ঘুম ও মস্তিষ্কে স্মৃতি-একত্রীকরণের মধ্যে কার্যকারণ সম্পর্ক বেশ শক্তিশালী। তবে পরবর্তী কিছু গবেষণায় এই সম্পর্কে ফাটল দেখা যায়। যেমন ইঁদুর ও মানুষ উভয়ের উপর করা কিছু গবেষণায় দেখা গেছে নন-রেম ঘুম থেকে বঞ্চিত করলেও তা কিছু কিছু দক্ষতা সম্পর্কিত স্মৃতি-একত্রীকরণের কাজে বাধা সৃষ্টি করে। এই বাধা অবশ্য রেম-ঘুম থেকে বঞ্চিত করার বাধার তুলনায় কম। সম্প্রতি আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, কোন অভিজ্ঞতার পরে ঘুমের সময় স্নায়ুর “ফিরে-দেখা” প্রপঞ্চ রেম-ঘুমের তুলনায় ঘুম চক্রের তৃতীয় ও চতুর্থ ধাপে গভীর নন-রেম-ঘুমের সময় তুলনামূলক শক্তিশালী ভাবে ঘটে। এছাড়াও রেম-ঘুম থেকে বঞ্চিত করলে রক্তপ্রবাহে দৈহিক ও মানসিক চাপের জন্য দায়ী হরমোনের পরিমাণ বেড়ে যায়। আমরা জানি যে চাপ মানুষ কিংবা ইঁদুরের শেখার ক্ষমতাকে বাধাগ্রস্থ করে। কৃত্রিমভাবে চাপের জন্য দায়ী হরমোন রক্তে প্রবেশ করালে দেখা যায় ইঁদুরের মস্তিষ্কে স্নায়ুসংযোগ ও স্নায়ুকোষের আকৃতি নমনীয় হওয়ার ক্ষমতা বাধাগ্রস্থ করে।

নন-রেম ঘুমের সাথে স্মৃতি-সংরক্ষণের পারস্পারিক সম্পর্ক বিষয়ক যে অনুকল্পটি আছে তার বিপক্ষে সবচেয়ে বড় প্রমাণটি আসে বিষন্নতার চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করা বিভিন্ন ঔষুধের ব্যবহার থেকে। এসব বিষন্নতারোধী ঔষুধ রেম-ঘুম কমিয়ে দেয়, কিংবা একেবারেই বন্ধ করে দেয়। এছাড়া ব্রেনস্টেমে আঘাতজনিত ক্ষতির ফলে রেম-ঘুম বন্ধ হয়ে গেলেও স্মৃতি-সংরক্ষণের ক্ষমতায় তেমন কোন পরিবর্তন দেখা যায় না। আবার, উত্তেজনারোধী কিছু ঔষুধ ব্যবহার করলে স্মরণ শক্তির উপর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়। এ ঔষুধগুলো কিন্তু ঘুম-চক্রে কোন হস্তক্ষেপ করে না।

এতো সব পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফল থেকে আমরা কি কোন উপসংহার টানতে পারি? ঘুম-চক্র আর স্মৃতি-সংরক্ষণের মধ্যে যে কিছু সম্পর্ক আছে তার পক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। তবে রেম-ঘুমই যে এই স্মৃতি-সংরক্ষণের কাজে মূল ভূমিকা পালন করে এই দাবীটা বেশ দুর্বল। প্রতিটি পরীক্ষারই বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সমালোচনা রয়েছে। আসলে এভাবেই বিজ্ঞান অগ্রসর হয়। তাই রেম-ঘুম ও নন-রেম-ঘুমকে আলাদা না করে এখনকার মতো বলা যায়, ঘুমের এই চাক্রিক আবর্তন স্মৃতি-সংরক্ষণের জ্ন্য অত্যন্ত উপযোগী। এ বিষয়ে আরো গভীরে না গিয়ে করে বরং অন্যান্য বিষয়ের দিকে নজর দেয়া যাক।

ঘুমের কাজ কি — এ প্রশ্ন থেকে আমরা এই আলোচনা শুরু করেছিলাম। হতে পারে ঘুমের সময়ে যেভাবে মস্তিষ্কে বিভিন্ন সংশ্লিষ্ট তথ্য যেভাবে পরস্পর বিভিন্ন সম্পর্কে সম্পর্কিত হয়, তা জেগে থাকার সময় পারস্পারিক সম্পর্কে সম্পর্কিত হওয়া ধরনের চাইতে আলাদা। ঘুমের সময় যেহেতু আমাদের ইন্দ্রিয়ের কার্যক্রম অনেক কমে যায়, মস্তিষ্ককে দৃশ্য-স্পর্শ-শ্রবণ ইত্যাদি অনুভূতি নিয়ে খুব একটা কাজ করতে হয় না। একারণে মস্তিষ্কে বিচ্ছিন্ন স্মৃতির বিভিন্ন দিকের মধ্যে পারস্পারিক সম্পর্ক স্থাপন করা সম্ভবপর হয়। জাগ্রত অবস্থায় মস্তিষ্কে বিভিন্ন ইন্দ্রিয় ক্রমাগত ব্যপক পরিমাণে তথ্য পাঠাতে থাকে বলে হয়তো স্মৃতি একত্রীকরণ জেগে থাকার সময় করা সম্ভব না।

ঘুম, রেম-ঘুম, ঘুমচক্র, ঘুমচক্রের কাজ ইত্যাদি নিয়ে তো অনেক কথা বলা হলো। এদের পেছনে দৈহিক একটা ব্যবস্থা কাজ করে। পরবর্তীতে  ঘুমের জীববিজ্ঞান সম্পর্কে আমরা জানবো।

একটি চাবি মাইরা দিলা ছাইড়া / জনম ভইরা চলিতেছে / মন আমার দেহ ঘড়ি সন্ধান করি / কোন মিস্তরী বানাইয়াছে। আবদুর রহমান বয়াতির দেহতত্ত্বের গান। দেহ সম্পর্কে অপরিসীম কৌতুহল বাউলদের, সেই আগ্রহ বার বার ফিরে এসেছে তাঁদের গানের কথায়, সাধনায়, দর্শনে। বাউলদের গানের একটা বৈশিষ্ট্য হলো রূপকের ব্যবহার, যেমন এই গানে দেহ ঘড়িকে আবদুর রহমান বয়াতি তুলনা করেছেন ঘড়ির সাথে, সেখানে চাবি মেরে দেয়া আছে। এখনকার ঘড়ি যদিও ব্যাটারির শক্তিতে চলে, একসময় ঘড়িকে প্রতিদিন চাবি দিতে হতো। ঘড়িতে থাকতো একটা স্প্রিঙ, সেই স্প্রিঙকে ঘুরিয়ে যে বিভব শক্তি সঞ্চিত করা হতো চাবি ঘুরিয়ে, সে শক্তিকে নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের মাধ্যমে ঘড়ি ছন্দে ছন্দে সময় মাপতো। বাউলদের এই দেহের সাথে ঘড়ির তুলনা সহজেই আমাদের বোধগম্য হয়। আমাদের ঘুম-জাগরণ যে ছন্দে, তার পেছনে আসলেই কি কোন ঘড়ির মতো কোন কলকব্জা কাজ করে? এর উত্তর পাওয়া যাবে পরবর্তী লেখায়।

[আরাফাত রহমানের মস্তিষ্ক, ঘুম ও স্বপ্ন বই থেকে । বইটি ধারাবাহিকভাবে বিজ্ঞানপত্রিকায় প্রকাশ করা হবে।]
[বইয়ের সূচীপত্র তথা সবগুলো লেখা একত্রে পাবেন এখানে]

আরাফাত রহমান
প্রভাষক,  অণুজীববিজ্ঞান বিভাগ, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
[লেথকের ফেসবুক প্রোফাইল]

Exit mobile version