অধ্যায়-৩: ইলেক্ট্রন
অনুচ্ছেদ-৫: ইলেক্ট্রন ও কোয়ান্টাম
[বইয়ের সূচীপত্র তথা প্রকাশিত সবগুলো আর্টিকেলের জন্য এখানে দেখুন]
১৯০২ সালে ফিলিপ লেনার্ড আলোক-তড়িৎ ক্রিয়া নিয়ে গবেষণা করেন। তিনি দেখাতে সক্ষম হলেন যে, বিভিন্ন ধাতু থেকে উৎসরিত ইলেক্ট্রনের ধর্ম সর্বদাই মিলে যায়। অন্যভাবে বলা যায়, যদিও প্রকৃতিতে বিভিন্ন ধরনের পরমাণু বিদ্যমান আছে কিন্তু তারা প্রত্যেকেই এক ধরনের ইলেক্ট্রনই ধারণ করে। বিজ্ঞানীরা সর্বদা সরলতা পছন্দ করেন এটি বিবেচনা করলে এই ছোট তথ্যটি বেশ আশাব্যাঞ্জক।
অন্যদিকে লেনার্ড দেখতে পেলেন, আলোক-তড়িৎ ক্রিয়া আবিষ্ট করার ক্ষেত্রে সব আলো সমান নয়। দেখা গেলো লাল আলোর ক্ষেত্রে ইলেক্ট্রন কখনোই উৎসরিত হয় না এমনকি যদি আলোর তীব্রতা বৃদ্ধি করা হয় তার পরেও না। কিন্তু যদি কেউ একটি নির্দিষ্ট ধাতুকে ক্রমশঃ ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোর নিচে ধরে তাহলে তরঙ্গদৈর্ঘ্যের একটি নির্দিষ্ট মানে ইলেক্ট্রন নিঃসরণ শুরু হবে। তরঙ্গদৈর্ঘ্যের এই মানকে নি¤œসীমা মান কিংবা প্রারম্ভিক মান (threshold value) বলা যায়।
প্রারম্ভিক মানে যেসব ইলেক্ট্রন নিঃসৃত হয় তাদের গতি থাকে খুবই কম। কেননা তারা এই অবস্থায় সেটুকু শক্তিই লাভ করে যা তাদেরকে পরমাণু থেকে বের করার জন্য প্রয়োজন হয় এবং এর বেশি শক্তি তারা পায় না। যদি প্রারম্ভিক মানের তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের আলোর তীব্রতা বৃদ্ধি করা হয়, তাহলে আরো বেশি পরিমাণে ইলেক্ট্রন নিঃসৃত হয় কিন্তু তাদের গতি আগের মতোই কম থাকে।
যদি ধাতুকে প্রারম্ভিক মানের তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের চেয়ে আরো ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতম মানের তরঙ্গদৈর্ঘ্য বিশিষ্ট আলোর মধ্যে উন্মুক্ত করা হয় তাহলে ইলেক্ট্রন ক্রমশঃ অধিক থেকে অধিকতর বেগে নিঃসৃত হয়। ইলেক্ট্রনের গতি নির্ভর করে তরঙ্গদৈর্ঘ্যের উপর আর নিঃসৃত ইলেক্ট্রনের সংখ্যা নির্ভর করে আলোর তীব্রতার উপর। বিভিন্ন ধরনের ধাতুর জন্য প্রারম্ভিক তরঙ্গদৈর্ঘ্যের মান বিভিন্ন কেননা কিছু ধাতু অন্য ধাতুর চেয়ে ইলেক্ট্রনকে অপেক্ষাকৃত শিথীল অবস্থায় ধরে রাখে।
লেনার্ড এই ঘটনা ব্যাখ্যা করতে পারলেন না। জে.জে. থমসনও চেষ্টা করে দেখলেন কিন্তু তিনিও সফল হলেন না। উনিশ শতকের সাধারণ পদার্থ বিজ্ঞান এই ঘটনা ব্যাখ্যা করতে ব্যার্থ হলো। সমাধান যখন এসে পৌঁছালো তা আসলো কোয়ান্টাম তত্ত্বের হাত ধরে যা ম্যাক্স প্ল্যাংক পাঁচ বছর আগেই বিবৃত করেছিলেন।
প্ল্যাংক ধরে নিয়েছিলেন যে, তড়িৎ-চৌম্বক তরঙ্গ নির্দিষ্ট আকারের কোয়ান্টামের মাধ্যমে বিকিরিত হয়। তরঙ্গদৈর্ঘ্য ক্ষুদ্রতর হওয়ার সাথে সাথে একটি কোয়ান্টামের আকার বৃদ্ধি পায়।
একই সাথে এটিও সত্য যে, তরঙ্গদৈর্ঘ্য যতই ক্ষুদ্র হবে প্রতি সেকেন্ডে বিকিরিত তরঙ্গের পরিমাণ ততোই বেশি হবে। প্রতি সেকেন্ডে বিকিরিত তরঙ্গের পরিমাণকে কম্পাঙ্ক বলে। অর্থাৎ তরঙ্গদৈর্ঘ্য যতই ক্ষুদ্র হবে কম্পাঙ্ক ততোই বেশি হবে। কাজেই আমরা বলতে পারি, একেকটি কোয়ান্টামের আকার এর কম্পাঙ্কের সমানুপাতিক।
১৯০৫ সাল পর্যন্ত কোয়ান্টামের ধারণাটি কেবলমাত্র কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণের ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হতো। তবে সেই সময় কোয়ান্টামের ধারণাকে খুব বেশী গুরুত্বও দেওয়া হয় নি। কোয়ান্টামের বিষয়টিকে কী দেখে মনে হয় না যে, এটি কেবল মাত্র একটি গাণিতিক কৌশল যা কেবল মাত্র একটি ঘটনাই ব্যাখ্যা করতে পারে এবং আর কিছুই ব্যাখ্যা করতে পারে না? সত্যিই কি কোয়ান্টামের অস্তিত্ব আছে?
আইনস্টাইনই প্রথম ব্যক্তি যিনি কোয়ান্টাম তত্ত্বকে ঐকান্তিকভাবে নিলেন এবং কোয়ান্টাম তত্ত্বটিকে কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণ ব্যাখ্যার একটি সামান্য হাতিয়ারের বদলে আরো বৃহৎ কিছু হিসেবে বিবেচনা করলেন। তিনি ধরে নিতে চাইলেন যে, আলো যে কোনো সময় এবং যেকোনো পরিস্থিতিতেই কোয়ান্টাম হিসেবেই বিকিরিত হয় যেন শুধু কৃষ্ণবস্তু নয় বরং শক্তি সংক্রান্ত সমস্যাগুলো কোয়ান্টামের বিবেচনাধীন আসে।
এর অর্থ দাঁড়ায়, আলোর বিকিরণ যখন ধাতুর উপর আঘাত করে তখনো এটি কোয়ান্টাম হিসেবেই বিদ্যমান থাকে। এটি কোয়ান্টাম হিসেবেই আঘাত করে এবং যদি ধাতু কর্তৃক শোষিত হয় তাহলে কোয়ান্টাম হিসেবেই শোষিত হয়। একটি নির্দিষ্ট মুহূর্তে, একটি নির্দিষ্ট অবস্থানে একটি গোটা কোয়ান্টাম শোষিত হয়, এর চেয়ে কমও হয় না এবং এর চেয়ে বেশীও হয় না।
যদি আঘাতকৃত আলো বৃহৎ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের তথা ক্ষুদ্র কম্পাঙ্কের হয় তাহলে তাহলে এর কোয়ান্টামের শক্তিও কম হবে। এ ধরনের একটি কোয়ান্টাম যখন ধাতু কর্তৃক শোষিত হবে তখন তা ধাতুর পরমাণু থেকে একটি ইলেক্ট্রনকে ধাক্কা দিয়ে অপসারণ করার মতো যথেষ্ট শক্তিধর না-ও হতে পারে। এই পরিস্থিতিতে কোয়ান্টামটি তাপ হিসেবে শোষিত হবে এবং ইলেক্ট্রন হয়তো আরো দ্রুত কম্পমান হবে কিন্তু পরমাণু থেকে বিচ্যুত হবে না। এই ধরনের যথেষ্ট পরিমাণ কোয়ান্টাম একটি ধাতবখন্ডে সরবরাহ করলে তা হয়তো তাপে সেই বস্তুকে গলিয়ে দিতে পারে কিন্তু যতো দীর্ঘ সময়ই রাখা হোক না কেন তা একটি ইলেক্ট্রনকে ঝাঁকুনি দিয়ে পরমাণু থেকে বের করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট হবে না।
তরঙ্গদৈর্ঘ্য হ্রাস এবং কম্পাঙ্ক বৃদ্ধির সাথে সাথে একটি কোয়ান্টামের শক্তি আরো বেশি হবে এবং প্রারম্ভিক মানে পৌঁছানোর পর তার শক্তি একটি ইলেক্ট্রনকে স্রেফ বিচ্যুত করার জন্য যথেষ্ট হবে। এতে এতো বেশি শক্তি থাকবে না যা ইলেক্ট্রনের গতিশক্তি প্রদান করবে তাই ইলেক্ট্রনের গতি হবে অত্যন্ত ধীর।
ক্রমশঃ আরো ক্ষুদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্য এবং আরো অধিক শক্তির কোয়ান্টামের জন্য ইলেক্ট্রনকে রূপান্তর করার পরেও আরো শক্তি থেকে যাবে যা ইলেক্ট্রনের গতিশক্তি প্রদান করবে এবং তাকে মোটামুটি বেগে গতিশীল করবে। তরঙ্গদৈর্ঘ্য যত ক্ষুদ্র হবে কোয়ান্টামের শক্তি ততো বেশী হবে এবং ইলেক্ট্রনের গতিও ততোই বাড়বে।
কোয়ান্টাম তত্ত্ব আলোকতড়িৎ ক্রিয়ার প্রতিটি পর্যবেক্ষণকেই সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করে এবং সেই সময় এটি ছিলো খুবই হৃদয়গ্রাহী। যখন কোনো একটি তত্ত্ব একটি বিশেষ ঘটনাকে ব্যাখ্যা করার জন্য প্রদান করা হয় এবং পরবর্তীতে সেই ঘটনার সাথে আপাত সম্পর্কহীন অন্যান্য ঘটনাকেও সেটি ব্যাখ্যা করতে পারে তখন সেই তত্ত্বটি বাস্তব হিসেবে গ্রহণ করার জন্য খুবই প্রলুব্ধকর হয়ে ওঠে। (আপনি এখানে একটি তত্ত্বের ব্যবহারের উদাহরণ দেখতে পেলেন; যা বেশ ভিন্ন দুই প্রকারের পর্যবেক্ষণকে ব্যাখ্যা করে। কোয়ান্টাম তত্ত্ব ছাড়া কারো পক্ষেই কৃষ্ণব¯ুÍর বিকিরণ এবং আলোক-তড়িৎ ক্রিয়ার মধ্যে কিংবা আরো অনেক ঘটনার মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করা সম্ভব হতো না।) এই ধরনের সম্পর্ক স্থাপনে কৃতিত্বের জন্য আইনস্টাইন ১৯২১ সালে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন।
[বইয়ের সূচীপত্র তথা প্রকাশিত সবগুলো আর্টিকেলের জন্য এখানে দেখুন। বিজ্ঞান পত্রিকায় সম্পূর্ণ বইটিই পড়া যাবে, তবে মুদ্রিত সংস্করণটি সংগ্রহ করতে চাইলে যোগাযোগ করুন: ছায়াবিথী প্রকাশনী, ফোন: ০১৯১৫৯৩৯৬৬৮]
-ইমতিয়াজ আহমেদ
সম্পাদক, বিজ্ঞান পত্রিকা
[লেখকের ফেসবুক প্রোফাইল]