অধ্যায়-৩: ইলেক্ট্রন
অনুচ্ছেদ-২: ক্যাথোড রশ্মি কণিকা
[বইয়ের সূচীপত্র তথা প্রকাশিত সবগুলো আর্টিকেলের জন্য এখানে দেখুন]
তড়িৎক্ষেত্রের উপস্থিতিতে একটি চার্জযুক্ত কণিকা কী পরিমাণ বেঁকে যাবে তা নির্ভর করে তিনটি বিষয়ের উপর: কণিকা কর্তৃক পরিবাহিত চার্জের আকার, যে গতিতে কণিকা ভ্রমণ করে এবং কণিকার ভর। চৌম্বক ক্ষেত্রের উপস্থিতিতেও চার্জযুক্ত কণিকার বিচ্যূতি এই তিনটি বিষয়েরই উপর নির্ভর করে, কিন্তু তা তড়িৎক্ষেত্রের চেয়ে ভিন্ন ঢংএ। থমসন যদি দুই ধরনের বিচ্যূতিই পরিমাপ করতেন, তাহলে তাদের পারস্পরিক পরিমাণ থেকে কণিকার চার্জ বনাম ভরের অনুপাত নির্ণয় করা সম্ভব ছিল। এবং এই অবস্থায় যদি কণিকার বৈদ্যুতিক চার্জ জানা থাকত তাহলে কণিকার ভরও বের করার সুযোগ ছিলো।
কণিকার বৈদ্যুতিক চার্জ বের করা পুরোপুরি অসম্ভব ছিলো না। ফ্যারাডে বিদ্যুৎ প্রবাহ কিভাবে রাসায়নিক বিক্রিয়াকে আবিষ্ট করে তা নিয়ে ব্যাপকতর গবেষণা করেন এবং ১৮৩২ সালে তড়িৎ রসায়নের সূত্রাবলী প্রতিষ্ঠিত করেন। এসব সূত্র হতে এবং একটি ধাতুর আয়নের দ্রবণ হতে সেই ধাতুকে নির্দিষ্ট মাত্রায় পৃথক করে সঞ্চিত করতে কী পরিমাণ বিদ্যুৎ প্রয়োজন হয় তা সতর্কতার সাথে পরিমাপ করার মাধ্যমে ধাতুর একটিমাত্র পরমাণু সঞ্চিত করার জন্য বৈদ্যুতিকর চার্জের আকার কী পরিমাণ হবে তা গণনা করা সম্ভব।
এই সিদ্ধান্ত নিতে খুব বড় ধরনের ঝুঁকি হবে না যে, একটিমাত্র পরমাণু সঞ্চিত করতে যে পরিমাণ বৈদ্যুতিক চার্জ দরকার হবে সেটিই হয়তোবা বৈদ্যুতিক চার্জের বিদ্যমান সবচেয়ে ক্ষুদ্র পরিমাণ। সেই ক্ষেত্রে এটি ধরে নেওয়া বেশ যুক্তি-সঙ্গত হবে যে, ক্যাথোড-রশ্মি কণিকাগুলো সবচেয়ে ক্ষুদ্র্র বৈদ্যুতিক চার্জ বহন করতে পারে। অন্যভাবে বললে, বস্তুর তুলনায় পরমাণু যেমন, বিদ্যুতের তুলনায় ক্যাথোড রশ্মি কণিকাও হয়তো তেমনই- কিংবা শক্তির তুলনায় একটি কোয়ান্টামও একই ভাবে তুলনীয় (তখনো কোয়ান্টামের বিষয়গুলো আবিষ্কৃত হয় নি) ।
এই অনুমান ধরে নিয়ে এবং তড়িৎক্ষেত্র কর্তৃক ক্যাথোড রশ্মির বিচ্যূতি হিসেব করে এবং একটি জ্ঞাত শক্তির চৌম্বক ক্ষেত্রের মাধ্যমে থমসন একটিমাত্র ক্যাথোড রশ্মি কণিকার ভর নির্ণয় করতে সক্ষম হলেন। এই অর্জনের জন্য তিনি ১৯০৬ সালে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন।
ফলাফলটি ছিলো খুবই হতবুদ্ধিকর। বস্তুর পরমাণু হিসেবে থমসনের সময়ে (আমাদের এই সময়েও) সবচয়ে ছোট পরমাণু ছিলো হাইড্রোজন পরমাণু। বস্তুতপক্ষে, আমরা এখন যথেষ্ট নিশ্চিত যে, হাইড্রোজন পরমাণুই সম্ভব সবচেয়ে ক্ষুদ্র পরমাণু যার অস্তিত্ব থাকতে পারে। ক্যাথোডের কণিকার ভর নির্ণয় করার পর দেখা গেলো, এর ভর হাইড্রোজনের পরমাণুর তুলনাতেও অনেক ক্ষুদ্র্র। এর ভর ছিলো সবচেয়ে ক্ষুদ্র পরমাণুটির ভরের ১৮৩৭ ভাগের ১ ভাগ।
এক শতাব্দী ধরে বিজ্ঞানীরা মোটামুটি নিশ্চিত ছিলেন যে, পরমাণুই হচ্ছে সবচেয়ে ক্ষুদ্র্র বস্তু যার অস্তিত্ব থাকতে পারে। এবং সবচেয়ে ছোট পরমাণুই হচ্ছে সবচেয়ে ক্ষুদ্র কোনো কিছু যার ভর থাকতে পারে। এখন এই ভাবনা বিচূর্ণ হয়ে গেলো; কিংবা অন্ততপক্ষে পুরোপুরি এই ভাবনা বাতিল না করতে হলেও সংশোধন করতেই হবে। তবে তা খুব ব্যাপকভাবে না-ও করতে হতে পারে। থমসনের পরীক্ষার পরেও এই তর্ক করা যেতেই পারে যে, এখনো পরমাণুই সবচেয়ে ক্ষুদ্র বস্তু যার অস্তিত্ব আছে। এমনও হতে পারে বিদ্যুৎ কোনো পদার্থ নয় বরং শক্তির এক ধরনের রূপ যা পদার্থের চেয়ে অনেক অনেক সূক্ষ। এটি মোটেও বিস্ময়কর হবে না যদি ক্যাথোড রশ্মি কণিকা, যেগুলোকে “বিদ্যুতের পরমাণু” বলা যায় সেগুলো পদার্থের পরমাণুর চেয়ে অনেক অনেক ক্ষুদ্র হয়।
ক্যাথোড রশ্মি কণিকার ক্ষুদ্রত্বই এদেরকে বস্তুর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে যেতে কিংবা পাতলা ধাতব পর্দা ভেদ করে যেতে দেয়। ধাতুর মধ্য দিয়ে এদের প্রবেশ্যতাই এগুলো কণিকা নয় এই ধারণার পেছনে শক্তিশালী আলামত হিসেবে ধরে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এই ধরনের প্রবেশ্যতা যখন প্রথম আবিষ্কৃত হয় তখন কারো ধারণা ছিলো না যে, এই কণিকাগুলো কতটা ক্ষুদ্র হতে পারে। (এমনকি সেরা বিজ্ঞানীটির পরীক্ষা-নিরীক্ষাও বিভ্রান্তিকর হতে পারে যদি খুব গুরুত্বপূর্ণ কোন বিষয় অজ্ঞাত থেকে যায় ।)
যেহেতু ক্যাথোড রশ্মি কণিকা যেকোনো পরমাণুর চেয়ে অনেক অনেক ক্ষুদ্র তাই এগুলোকে বলা হয় সাব-এ্যাটমিক কণিকা (sub-atomic particle)। এ ধরনের সাব-এ্যাটমিক কণিকা এবং সেগুলোর প্রবাহই পদার্থের গঠন সম্বন্ধে প্রথমবারের মত আমাদের ধ্যান-ধারণা পুরোপুরি বদলে দিয়েছিল। এদের আবিষ্কার আমাদের জ্ঞান বৃদ্ধি করেছে, প্রযুক্তির বিপ্লব ঘটিয়েছে এবং জীবন-যাপন পদ্ধতি আমূল বদলে দিয়েছে। (প্রযুক্তির বিষয়াবলী এবং জীবন যাপন পদ্ধতি এই বইয়ের আলোচ্য সীমার বাইরে কিন্তু বাস্তবতা উল্লেখ করা যেতেই পারে। একটি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার যতোই অভিজাত মনে হোক না কেন সেগুলো আমাদেরকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করার খুব উজ্জ্বল সম্ভাবনা থেকেই যায়।)
ক্যাথোড রশ্মি কণিকাকে কী নামে ডাকা যেতে পারে? কোনো কিছুর নাম প্রদান সেই জিনিসটির উপর আমাদের জ্ঞান বাড়ায় না কিন্তু বিভিন্ন সময় সেটিকে উল্লেখ করা কিংবা সেটি নিয়ে আলোচনা করা সহজতর করে। ১৮৯১ সালে আইরিশ পদার্থবিদ জর্জ জনস্টোন স্টোনি (George Johnstone Stoney, ১৮২৬-১৯১১) পরামর্শ দিলেন সবচেয়ে ক্ষুদ্র বৈদ্যুতিক চার্জ যা ফ্যারাডের সূত্র থেকে প্রতিপাদন করা যায় তার নাম দেওয়া হোক ইলেক্ট্রন। থমসন এই নাম পছন্দ করলেন এবং সবচেয়ে ক্ষুদ্র চার্জের নয় বরং সবচেয়ে ক্ষুদ্র চার্জ যে কণিকা বহন করে তার ক্ষেত্রে এই নাম প্রয়োগ করলেন। এই নামটি কণিকাটির সাথে যুক্ত হয়ে গেলো এবং এমনকি বিজ্ঞানের সাথে সংশ্লিষ্ট নয় এমন জনগণের কাছেও পরিচিত হয়ে উঠল (সেসব ‘ইলেক্ট্রনিক’ যন্ত্রপাতির কথা ভেবে দেখুন যেগুলো নিয়ে আমরা ঘাটাঘাটি করি যেমন: টেলিভিশন সেট, রেকর্ড প্লেয়ার ইত্যাদি)। কাজেই বলা যেতে পারে ১৮৯৭ সালে থমসন ইলেক্ট্রন আবিষ্কার করেছিলেন।
[বইয়ের সূচীপত্র তথা প্রকাশিত সবগুলো আর্টিকেলের জন্য এখানে দেখুন। বিজ্ঞান পত্রিকায় সম্পূর্ণ বইটিই পড়া যাবে, তবে মুদ্রিত সংস্করণটি সংগ্রহ করতে চাইলে যোগাযোগ করুন: ছায়াবিথী প্রকাশনী, ফোন: ০১৯১৫৯৩৯৬৬৮]
-ইমতিয়াজ আহমেদ
সম্পাদক, বিজ্ঞান পত্রিকা
[লেখকের ফেসবুক প্রোফাইল]