বিজ্ঞান পত্রিকা

পরমাণুর গহীন নিসর্গে | ৩: ইলেক্ট্রন | ৩.১: তড়িৎ বিভাজন

অধ্যায়-৩: ইলেক্ট্রন
অনুচ্ছেদ-১: তড়িৎ বিভাজন
[বইয়ের সূচীপত্র তথা প্রকাশিত সবগুলো আর্টিকেলের জন্য এখানে দেখুন]

তড়িৎ বিষয়ক প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা গুলো খুব অল্প বৈদ্যুতিক চার্জের উপর করা হয়েছিলো। তবে ১৭৪৬ সালে ডাচ পিটার ভন মুশানব্রক (Pieter van  Musschenbroek, ১৬৯২-১৭৬১) যখন লেইডেন বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করছিলেন, তখন লেইডেন জার নামক একটি বস্তু উদ্ভাবন করেছিলেন যা বিপুল পরিমাণ চার্জ জড়ো করতে পারে।

লেইডেন জার

চার্জ যতো বেশী জড়ো করা হবে, তার উপর ততোই সেই চার্জ নিষ্ক্রিয় করার জন্য বাইরে থেকে চাপ তৈরি হবে। লেইডেন জারকে যদি কোনো কিছুর সাথে স্পর্শ করানো হয়, তাহলে বিদ্যুৎ সেই বস্তুতে প্রবাহিত হয়ে অতিরিক্ত চার্জ নিষ্ক্রিয় করে দেয় (যদি কোনো মানুষ তা স্পর্শ করে তাহলে তার মধ্য দিয়েই বিদ্যুৎ প্রবাহিত হবে যা নিঃসন্দেহে যন্ত্রণাদায়ক)।

যদি লেইডেন জার যথেষ্ট পরিমাণে চার্জ উৎপন্ন করে তাহলে এমনকি স্পর্শ না করলেও চলে। এই ধরনের পরিস্থিতিতে একটি বস্তুকে লেইডেন জারের বেশ কাছাকাছি আনা হলেই চার্জ অবমুক্ত হবে; তার চার্জের চাপ এতো বেশী হবে যে, চার্জ লেইডেন জার হতে বায়ুর মধ্য দিয়ে নিকটবর্তী বস্তুতে প্রবাহিত হতে বাধ্য হবে। ফলশ্রুতিতে আলোর ঝলকানি দেখা যাবে এবং চেরা শব্দ শোনা যাবে। এই আলো নিজে অবশ্য বিদ্যুৎ নয় বরং বিদ্যুৎ যখন বায়ুর মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে তখন বায়ুকে উত্তপ্ত করে এবং বায়ু তাৎক্ষণিক ভাবে এতোই তপ্ত হয়ে উঠে যে, তা আলো বিকিরণ করতে শুরু করে। সেই সাথে উত্তপ্ত বায়ু প্রসারিত হয়ে যায় এবং শীতল হয়ে যখন আবার সংকুচিত হয় তার ফলাফল স্বরূপ শব্দ শোনা যায়।

কেউ কেউ লেইডেন জারের এই চার্জ নিষ্ক্রিয়করণ প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন আলো ও শব্দের সাথে বজ্রপাতের সময় উৎপন্ন আলো ও শব্দের মিল খুঁজে পেলেন। তাঁরা ভাবলেন, বজ্রের সময় সৃষ্ট আলো এবং শব্দ কি মেঘের বৃহৎ পরিসরে উৎপন্ন কোনো লেইডেন জারের কারণে হতে পারে? ১৭৫২ সালে বেঞ্জামিন ফ্রা’ঙ্কলিন বজ্রসহ ঝড়ের মধ্যে ঘুড়ি উড়িয়ে মেঘের চার্জকে তারের মধ্যদিয়ে ভূমিতে অবস্থিত একটি লেইডেন জারের মধ্যে স্থানান্তর করে এই ধারণা সত্য প্রমাণ করলেন। লেইডেন জারে সঞ্চিত সেই চার্জ থেকে দেখা গেলো আকাশে উৎপন্ন বিদ্যুৎ এবং পৃথিবীতে উৎপন্ন বিদ্যুতের ধর্ম একই।

কিন্তু বিদ্যুৎ নিজে আসলে কেমন যা একটি চার্জযুক্ত বস্তুর মধ্যে কিংবা উত্তপ্ত বাতাসে উৎপন্ন আলোর মাঝে লুকিয়ে থাকে? এর একটি উত্তর পাওয়া যেতে পারে শূন্যের মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ চালিয়ে তা কেমন দেখায় সেটি পর্যবেক্ষণ করা। অবশ্য অনেক আগেই, ১৭০৬ সালে একজন ইংলিশ পদার্থবিদ লেইডেন জারে উৎপন্ন চার্জের চেয়ে অনেক ক্ষুদ্র চার্জকে একটি বায়ুশূন্য পাত্রের মধ্য দিয়ে প্রেরণ করে আলো দেখতে পেয়েছিলেন।

সেই সময় একটি পাত্রকে যথাযথভাবে বায়ুশূন্য করার ভালো ব্যবস্থা ছিলো না। এ ধরনের প্রক্রিয়ায় সর্বদাই কিছু না কিছু বায়ু পাত্রে রয়েই যেত যা বিদ্যুৎ ক্ষরণের ফলে ঔজ্জ¦ল্য তৈরির জন্য যথেষ্ট হতে পারে। ফলে এখান থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় না যে, এই আলো নিজেই বিদ্যুৎ কিনা। শুধুমাত্র বিদ্যুৎ পাওয়ার জন্য দুটি বিষয়ে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। এক হলো এমন একটি পাত্র তৈরি করা যা এতটাই বায়ুশূন্য হবে যে, এর মধ্যে থাকা বায়ু বৈদ্যুতিক প্রবাহে বাধা সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট হবে না। অপর বিষয়টি হলো, যথেষ্ট পরিমাণ শূন্য পাত্রটির মধ্য দিয়ে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ বিদ্যুৎকে প্রবাহিত হতে বাধ্য করা। লেইডেন জার দিয়ে হয়তোবা এই কাজটি করা যেতে পারে কিন্তু এর প্রবাহ কেবলমাত্র একটি ক্ষুদ্র মুহূর্তের জন্য বিদ্যমান থাকে। এমন কোনো ব্যবস্থা কি করা যায়, যাতে বিদ্যুৎ প্রবাহ বেশ দীর্ঘ সময়ের জন্য পাওয়া যায়?

১৮০০ সালে ইতালীয় পদার্থবিদ আলেসান্দ্রো ভোল্টা (Alessandro Giuseppe Volta, ১৭৪৫-১৮২৭) দ্বিতীয় সমস্যাটির সমাধান করেন। তিনি দেখালেন যে, যদি দুটি ভিন্ন ধরনের ধাতুকে লবণের দ্রবণে ডোবানো হয় তাহলে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হতে পারে। এই ঘটনাটি ঘটে একটি রাসায়নিক বিক্রিয়ার প্রভাবে, যতক্ষণ বিক্রিয়াটি ঘটবে ততক্ষণই বিদ্যুৎ উৎপন্ন হতে থাকবে। যদি কিছুটা বিদ্যুৎ তারের মধ্য দিয়ে সরিয়ে নেওয়া হয় তাহলে রাসায়নিক বিক্রিয়া যতক্ষণ চলবে ততক্ষণ তারের মধ্যেও প্রবাহ থাকবে।

ফলস্বরূপ, অকিঞ্চিৎকর স্থির বৈদ্যুতিক চার্জের পরিবর্তে আমরা বড় আকারে তড়িৎ প্রবাহ পেয়ে যাচ্ছি। ভোল্টা বিপুল পরিমাণে বৈদ্যুতিক প্রবাহ পাওয়ার জন্য এক নাগাড়ে অনেকগুলো এইরকম দ্বি-ধাতব ব্যবস্থা পরপর যুক্ত করে তাদের মাঝে লবণের দ্রবণ রাখেন। এধরনের একটি সমাবেশকেই বলা হয় ব্যাটারী। এই পদ্ধতির মাধ্যমে ভোল্টা একধরনের বৈদ্যুতিক ব্যাটারীর উদ্ভাবন করেছিলেন।

ভোল্টার আবিষ্কারের ঘোষণা করার সাথে সাথে আরো বড় এবং আরো উন্নত ধরনের ব্যাটারী নির্মাণ শুরু হয়ে গেলো এবং এক প্রজন্মের মধ্যেই ফ্যারাডে বিদ্যুৎ প্রবাহ উৎপাদনের একটি পদ্ধতি উদ্ভাবন করলেন যা আরো সস্তায়, তেল পোড়ানোর মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে। এর ফলে শূন্য মাধ্যমের মধ্য দিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে বিদ্যুৎ প্রবাহের আর কোনো বাধা থাকল না, অবশ্য যদি একটি ভালো ‘শূন্য মাধ্যম’ সরবরাহ করা সম্ভব হয়।

শেষপর্যন্ত সেই কাঙ্খিত শূন্যমাধ্যম সরবরাহকারী হলেন জার্মান উদ্ভাবক উইলহেম গিজলার (Wilhelm  Geissler, ১৮১৪-১৪৭৯) যিনি ১৮৫৫ সালে এক ধরনের বায়ুর পাম্প উদ্ভাবন করেন, যা ইতিপূর্বে ব্যবহৃত অন্য যে কোনো পাম্পের চেয়ে অনেক উন্নতমানের। কোনো যান্ত্রিক ব্যবস্থার বদলে গিজলার ব্যবহার করলেন পারদের ওঠা-নামার ধর্ম। পারদের নির্দিষ্ট মাত্রার জন্য তা কিছুটা বায়ু এর মধ্যে আটকে ফেলে যা সাথে সাথে সরিয়ে নেওয়া হয়। এটি যদিও একটি ধীর প্রক্রিয়া কিন্তু এর মাধ্যমে কোনো পাত্রের প্রায় শতকরা ৯৯.৯ ভাগ বায়ু সরিয়ে নেওয়া সম্ভব ছিলো।

এই আধুনিক সময়েও গলিত কাচ বাতাস দিয়ে ফুলিয়ে বোতল তৈরি করা হয়। গিজলার এই কাজে খুব দক্ষ ছিলেন। তিনি এই পদ্ধতিতে দুই প্রান্তে ধাতুর পাত বিশিষ্ট কাচপাত্র তৈরি করলেন এবং এগুলোকে তাঁর পাম্পের মাধ্যমে বায়ুশূন্য করলেন। জার্মান পদার্থবিদ এবং গিজলারের বন্ধু ও সহকর্মী জুলিয়াস প্লুকার (Julius  Plücker, ১৮০১-১৮৬৮) এই পাত্রগুলোর নাম দিলেন গিজলার টিউব। প্লুকার এই টিউবের দুটি ধাতব পাতকে একটি তড়িৎ-উৎপাদন যন্ত্রের দুই প্রান্তের সাথে যুক্ত করলেন। যার ফলে একটি পাত ধনাত্মক চার্জযুক্ত  হলো যাকে বলা হয় ‘এ্যানোড’ এবং অপর প্রান্ত ঋনাত্মক চার্জ লাভ করলো এবং এই প্রান্তকে বলা হয় ‘ ক্যাথোড ’।

এই শব্দ দুটো সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন মাইকেল ফ্যারাডে। ধনাত্মক চার্জযুক্ত এ্যানোড এসেছে গ্রীক শব্দ হতে যার অর্থ ‘উচ্চতর পথ (upper way)’। গ্রীক হতে আগত ঋনাত্মক চার্জযুক্ত ক্যাথোড এর অর্থ নিম্নতর পথ (lower way)। বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের সময় থেকেই ধারণা করা হয়, তড়িৎ ধনাত্মক হতে ঋনাত্মকের দিকে প্রবাহিত হয় অর্থাৎ এ্যানোড (উচ্চতর) থেকে ক্যাথেড (নিম্নতর) এর দিকে প্রবাহিত হয়, যেমন পানি উচ্চতর অবস্থান থেকে নিম্নতর অবস্থানে প্রবাহিত হয়।

প্লুকার বিদ্যুৎ প্রবাহকে গিজলার টিউবের শূন্য মাধ্যমের মধ্য দিয়ে চালিত করলেন। এবং এই সময়ে টিউবের মধ্যে যথেষ্ট বায়ু ছিলো না যা দৃশ্যমান আভা তৈরি করবে- কিন্তু যেভাবেই হোক বিদ্যুৎ প্রবাহের ফলে একধরনের আভা উৎপন্ন হলো। এটি হচ্ছে একধরনের সবুজাভ আভা যা সর্বদাই ক্যাথোডের প্রান্তের কাছে পাওয়া যায়। প্লুকার তাঁর পর্যবেক্ষণ ১৮৫৮ সালে প্রকাশ করলেন এবং এর মাধ্যমেই প্রথম ধারণা হলো যে, ফ্র্যাঙ্কলিন সম্ভবতঃ ভুল অনুমান করেছিলেন, এবং বিদ্যুৎ আসলে এ্যানোড থেকে ক্যাথোডের দিকে প্রবাহিত হয় না বরং ক্যাথোড থেকে এ্যানোডের দিকে প্রবাহিত হয়। প্লুকার ভাবলেন, এই সবুজাভ আভা কি নিজেই বৈদ্যুতিক প্রবাহটিকে নির্দেশ করার কোনো সম্ভাবনা আছে? কিন্তু নিশ্চিত হতে পারলেন না। তিনি ভাবলেন, এটি হয়তো ধাতব পাতদ্বয়ের মধ্য থেকে উৎপন্ন গুঁড়ো যা বিদ্যুৎ প্রবাহে উজ্জ্বল হয় কিংবা পাত্রের ভেতরে যে নগণ্য পরিমাণ বায়ু অবশিষ্ট আছে তারই দৃশ্যায়ন।

জার্মান পদার্থবিদ ইউজেন গোল্ডস্টেইন (Eugen  Goldstein, ১৮৫০-১৯৩০) এই ঘটনাটি নিয়ে যত্নের সাথে চর্চা চালিয়ে গেলেন এবং ধাতব পাত এবং পাত্রের ভিতরের বায়ুর উৎস পরিবর্তন করে দেখলেন যে, শুরুতে পাত্রে যে ধরনের গ্যাসই থাকুক না কেন কিংবা যে ধরনের ধাতব পাতই নেওয়া হোক না কেন এই আভার কোনো ধরনের পরিবর্তন হয় না। এই পরীক্ষাগুলোতে কেবলমাত্র একটি জিনিসই অপরিবর্তনীয় রাখা হয়েছিলো আর তা হচ্ছে বিদ্যুৎ প্রবাহ। তাই গোল্ডস্টেইন এই ধারণা পুষে রাখলেন যে, এই আভা শুধু মাত্র প্রবাহের সাথেই সংশ্লিষ্ট। ১৮৭৬ সালে তিনি এই শূন্য অতিক্রমকারী রশ্মিকে নাম দিলেন ক্যাথোড রশ্মি  (cathode ray)।

এই নাম থেকে বোঝা যায়, প্রবাহ ক্যাথোড থেকে নির্গত হয় এবং এ্যানোডের দিকে ভ্রমণ করে। প্রকৃতপক্ষে, কাচের পাত্র এ্যানোডের নিকট ঔজ্জ্বল্য দেখায় যেন মনে হয় ক্যাথোড থেকে উৎপন্ন রশ্মি এ্যানোডে আঘাত করছে এবং এটিকে উত্তেজিত করছে।

১৮৬৯ সালে জার্মান পদার্থবিদ জোহান উইলহেম হিটর্ফ (Johann Wilhelm Hittorf, ১৮২৪-১৯১৪), যিনি প্লুকারের একজন ছাত্র ছিলেন, দেখালেন যদি একটি কঠিন বস্তুকে ক্যাথোডের সামনে রেখে পাত্রটিকে বদ্ধ করে দেওয়া হয়, তাহলে সেই বস্তুটির একটি ছায়া পড়ে এ্যানোডের উপর। স্পষ্টভাবেই, ক্যাথোড থেকে কোনো কিছু নির্গত হয় এবং প্রতিবন্ধক দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে এ্যানোডে তার ছায়া তৈরি করে।

ব্রিটিশ পদার্থবিদ উইলিয়াম ক্রুকস (William Crookes, ১৮৩২-১৯১৯) একটি অপেক্ষাকৃত উন্নতমানের যন্ত্র তৈরি করেন, যা আগের চেয়ে ভালো বায়ুশূন্যতা তৈরি করে এবং এর মাধ্যমে তিনি ১৮৭৮ সালে ক্রুকস টিউব তৈরি করেন, যাতে অবশিষ্ট বায়ুর পরিমাণ পূর্ববর্তী গিজলার টিউবের চেয়ে ৭৫০০০ ভাগের এক ভাগ করা যায়। (এ ধরনের সব টিউবকে শ্রেণীবদ্ধভাবে ক্যাথোড রশ্মি টিউব বলা হয়)। এই নতুন টিউবটি ব্যবহারে ক্যাথোড রশ্মি  আরো স্পষ্ট হলো এবং ক্রুকস দেখাতে সক্ষম হলেন যে, এই রশ্মি গুলো সরল রেখায় চলে এবং এমনকি চলার পথে রাখা একটি ছোট চাকাকে ঘোরাতে পারে।

কিন্তু ক্যাথোড থেকে যা প্রবাহিত হচ্ছে তা আসলে কী? ক্যাথোড রশ্মি কী কণা দিয়ে তৈরি নাকি তরঙ্গ দিয়ে? বিজ্ঞানীরা দুইভাগে বিভক্ত হয়ে উভয় ধরনের সম্ভাবনাকেই সমর্থন করলেন, যে ধরনের পরিস্থিতি দেখা গিয়েছিলো আলোর বিষয়ে নিউটন এবং হাইগেনস মধ্যে যুক্তি-তর্ক নিয়ে। ক্যাথোড রশ্মি  কে কণা হিসেবে ধরে নেওয়ার পেছনে একই যুক্তি দেখানো হলো, যা দেখানো হয়েছিলো আলোর ক্ষেত্রে, প্রধানতঃ এই দৃষ্টিকোণ থেকে যে ক্যাথোড রশ্মি  তীক্ষ্ণ ছায়া তৈরি করতে পারে।

কিন্তু আলোর ক্ষেত্রে যেহেতু কণা তত্ত্ব শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয়েছিলো, তাই কিছু বিজ্ঞানী এই ক্ষেত্রেও কণা ধরে নিতে সংশয়গস্থ ছিলেন যেহেতু এই ক্ষেত্রেও পরাজিতদের দলে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। (সেনাবাহিনীতে জেনারেলদের অভিযুক্ত করা হয় যে, তারা যেন যে যুদ্ধ ইতিমধ্যে হয়ে গেছে তার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করছেন। বিজ্ঞানীরাও মানুষ আর তাই তাঁরাও পুর্ববর্তী লড়াই মনে রাখেন এবং নতুন কোনো ঘটনার ক্ষেত্রে সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগান)।

উপরে: ক্রুকস-এর তৈরি ক্যাথোড রশ্মি টিউব। নিচে: ক্যাথোড রশ্মি বাম পাশের ক্যাথোড থেকে উৎপন্ন হয়ে সরলরেখায় ভ্রমন করে এবং দেয়ালে সবুজ আভা তৈরি করে।

ক্যাথোড রশ্মি  এক প্রকার তরঙ্গ এই বিষয়ে সবচেয়ে জোরালো কন্ঠস্বর ছিলো হার্জের, যিনি বেতার তরঙ্গের আবিষ্কর্তা । ১৮৯২ সালে তিনি দেখালেন ক্যাথোড রশ্মি  ধাতুর পাতলা পর্দা ছেদ করে যেতে পারে। তাঁর কাছে মনে হয়নি যে, কোনো কণার পক্ষে এটি সম্ভব কিন্তু তরঙ্গ হলে তা অনায়াসে ঘটতে পারে। কেননা ধাতব পর্দা যথেষ্ট পাতলা হলে এমনকি আলোর তরঙ্গও এদেরকে ভেদ করে যেতে পারে।

হার্জের শিষ্য ফিলিপ এডুয়ার্ড এন্টন ভন লেনার্ড (Philipp Eduard Anton von Lenard, ১৮৬২-১৯৪৭) এমন একটি ক্যাথোড রশ্মি টিউব তৈরি করলেন, যার মধ্যে একটি পাতলা এ্যালুমিনিয়ামের ‘জানালা’ স্থাপন করা হয়। ক্যাথোড রশ্মি  এই জানালা দিয়ে ছড়িয়ে গিয়ে বাইরে বায়ুর সংস্পর্শে চলে আসতে পারত। যদি ক্যাথোড রশ্মি  খুব ক্ষুদ্র  তরঙ্গদৈর্ঘ্য বিশিষ্ট তরঙ্গ হয়ে থাকে, তাহলে তারা সরলরেখায় ভ্রমণ করবে এবং তীক্ষ্ন ছায়া তৈরি করবে যেমনটি আলোর ক্ষেত্রে হয়। ১৮৯০ সালের শুরুর দিকে কিছু সময়ের জন্য ক্যাথোড রশ্মির তরঙ্গ ধারণা তাই বেশ উঁচু পর্যায়ে অবস্থান করে।

এরপরও কথা থাকে, ক্যাথোড রশ্মি যদি ঋনাত্মক চার্জ যুক্ত ক্যাথোড থেকেই উৎপন্ন হয় তাহলে কি তারা ঋনাত্মক চার্জ বিশিষ্ট হওয়ার কথা নয়? যদি তা-ই হয় তাহলে এটি ইঙ্গিত দেয় যে, ক্যাথোড রশ্মি তরঙ্গ নয় কেননা সেই সময়ে এমন কোনো তরঙ্গের অস্তিত্ব সম্বন্ধে ধারণা ছিলো না, যা বৈদ্যুতিক চার্জ বহন করে এবং যদি ক্যাথোড রশ্মি বৈদ্যুতিক চার্জ বহন করে, তাহলে তারা বিদ্যুৎ ক্ষেত্র দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার কথা।

১৮৮৩ সালে হার্জ এই অনুমিত বিষয়টি পরীক্ষা করে দেখলেন। তিনি ক্যাথোড রশ্মি কে দুটি সমান্তরাল ধাতব পাতের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হতে দিলেন, যাদের একটিকে ধনাত্মক এবং অপরটিকে ঋনাত্মকভাবে চার্জিত করা হলো। যদি ক্যাথোড রশ্মি  চার্জযুক্ত  হয় তাহলে এই পাতদুটির প্রভাবে তাদের সরলরৈখিক পথ বেঁকে যাওয়ার কথা। কিন্তু দেখা গেলো যে, ক্যাথোড রশ্মির পথের কোন পরিবর্তন হয় নি। তাই হার্জ উপসংহার টানলেন এই বলে যে, ক্যাথোড রশ্মি চার্জবিহীন যা তরঙ্গ ধারণাকে আরো সমর্থন দান করলো।

হার্জ যা উপলব্ধি করতে পারেন নি তা হলো, ক্যাথোড রশ্মি মাত্রাতিরিক্ত ভাবে উচ্চগতি সম্পন্ন। তাই এরা এত দ্রুত চার্জিত ধাতব পাত দু’টো অতিক্রম করে যায় যে, এদের বেঁকে যাওয়ার সুযোগ থাকে কম এবং তাই এই বক্রতা অনুভবক্ষম নয়। এই সমস্যাটি উপেক্ষা করা যেত যদি প্লেট দুটি খুব উচ্চ চার্জ বিশিষ্ট হতো কিন্তু সেগুলো আসলে তেমন ছিলো না। উচ্চ গতির ক্যাথোড রশ্মি এবং দুর্বল তড়িৎক্ষেত্রের সমন্বয়ে যে প্রভাব তৈরি হলো, তা পর্যবেক্ষণ যোগ্য ছিলো না তাই হার্জের উপসংহারও বৈধ ছিলো না। (বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা সবসময় শেষ কথা নয়। সততার সাথে এবং বুদ্ধিমত্তার সাথে সংগঠিত সুনির্দিষ্ট কোনো পরীক্ষা অনেক কারণেই ভুল ফলাফল দিতে পারে। এজন্য পরীক্ষাগুলো অন্যান্য বিজ্ঞানীদেরও যাচাই করা উচিত বিশেষ করে ভিন্ন যন্ত্রপাতি, ভিন্ন পরিস্থিতি এবং যদি সম্ভব হয় ভিন্ন চিন্তাধারার মাধ্যমে।)

এভাবেই, ১৮৯৫ সালে পের‌্যাঁ (যিনি পরবর্তী দশকে পরমাণুর বাস্তবতা নিয়ে কাজ করছিলেন যা আমরা এর আগে আলোচনা করেছি) দেখালেন যে, ক্যাথোড রশ্মি  আসলে ক্যাথোড থেকে বিপুল পরিমাণ ঋনাত্মক চার্জ নিয়ে আসে এবং যে সিলিন্ডারে তারা পতিত হয় তাতে স্থানান্তর করে। কিন্তু এই বিষয়টি বোধগম্য হয় নি, কিভাবে ক্যাথোডের মাঝপথে তড়িৎক্ষেত্র দ্বারা রূপান্তর না হয়েও সিলিন্ডারে ঋনাত্মক চার্জ নিয়ে আসে। এই বিষয়টি হার্জের অনুসন্ধানকে মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

এরপর ব্রিটিশ পদার্থবিদ জোসেফ জন থমসন (Joseph John Thomson, ১৮৫৬-১৯৪০) সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি তড়িৎগ্রস্থ ধাতব পাত বসিয়ে হার্জের পরীক্ষাটি আবারো করে দেখবেন। থমসনের সুবিধা ছিলো, তিনি জানতেন ক্যাথোড রশ্মি  কত দ্রুত ভ্রমণ করে। ১৮৯৪ সালে তিনি আনুমানিক ভাবে হিসাব করেন যে, ক্যাথোড রশ্মি সেকেন্ডে দু’শ কিলোমিটার বেগে অতিক্রম করে। এর বাইরেও সুবিধা হিসেবে তাঁর কাছে হার্জের চেয়ে আরো কার্যকর বায়ুশূন্য টিউব ছিলো এবং তিনি যথেষ্ট শক্তিশালী চার্জযুক্ত ধাতব পাত ব্যবহার করতে পেরেছিলেন।

১৮৯৭ সালে থমসন তাঁর চার্জযুক্ত পাতের মধ্য দিয়ে ক্যাথোড রে’কে অতিক্রম করতে দিলেন এবং দেখলেন যে, ক্যাথোড রশ্মি তড়িৎক্ষেত্র দ্বারা আবিষ্ট হয়ে সুস্পষ্ট বাঁক নিয়ে ঋনাত্মক চার্জ যুক্ত পাত থেকে দুরে সরে যাচ্ছে এবং ধনাত্মক চার্জযুক্ত পাতের দিকে গমন করছে। এই ঘটনা তাঁকে এবং অন্যান্য বিজ্ঞানীদের আশ্বস্ত করল যে, ক্যাথোড রশ্মি  দ্রুত গতির ক্যাথোড রশ্মি  কণা দিয়ে গঠিত যারা ঋনাত্মক বৈদ্যুতিক চার্জ বহন করে।

এই ক্ষেত্রে যে পরিস্থিতি দেখা গেলো তা আলোর বিপরীত। যেখানে আলোর বিষয় আসে সেখানে তরঙ্গ, কণার উপরে জয়ী হয়। কিন্তু ক্যাথোড রশ্মি’র ক্ষেত্রে কণা, তরঙ্গের উপর জয়ী হয়েছে। (যদিও আমরা সামনে দেখব কোনো বিজয়ই পরম নয়। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রায়ই দেখা যায় কোনো একটি বিকল্প বাছাই করে নেওয়াটা খুব যথাযথ হয় না যদিও প্রথমে সেরকমই ধারণা করে নেওয়া হয়।)

[বইয়ের সূচীপত্র তথা প্রকাশিত সবগুলো আর্টিকেলের জন্য এখানে দেখুন। বিজ্ঞান পত্রিকায় সম্পূর্ণ বইটিই পড়া যাবে, তবে মুদ্রিত সংস্করণটি সংগ্রহ করতে চাইলে যোগাযোগ করুন: ছায়াবিথী প্রকাশনী, ফোন: ০১৯১৫৯৩৯৬৬৮]

-ইমতিয়াজ আহমেদ
সম্পাদক, বিজ্ঞান পত্রিকা
[লেখকের ফেসবুক প্রোফাইল]

Exit mobile version