শিল্প ঐতিহাসিকরা এতদিন বিখ্যাত শিল্পী লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চির নিজস্ব নোটবুকে আঁকা কিছু হিজিবিজি রেখা বা ডুডলকে অপ্রাসঙ্গিক বলে ঘোষণা করেন। কিন্তু সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাঁদের দাবি, এই ডুডলের মাঝেই পদার্থবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ সূত্র লুকিয়ে রয়েছে।
ক্যাম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইয়ান হাচিংস এই পরিত্যক্ত চিত্রকর্ম নিয়ে অনেক বছর গবেষণা করেন। গবেষণাকালে তিনি একটি চিত্রকর্ম বেশ ব্যতিক্রম হিসেবে চিহ্নিত করেন।পরবর্তীতে বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়, সেখানে মূলত ঘর্ষণের সূত্র ছবির মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ঘর্ষণ সম্পর্কে বিস্তর গবেষণা ও অধ্যয়নের পথপ্রদর্শক ভিঞ্চি নিজেই। তিনিই সর্বপ্রথম ঘর্ষণ,লুব্রিকেটিং ও বস্ত্র সম্পর্কে গবেষণার সূত্রপাত করেন। তবে তিনি কিভাবে ও কখন এই বিষয়ে ধারণা অর্জন করেন তা এখনও অজ্ঞাত।
হাচিংস প্রকৃতপক্ষে ভিঞ্চির এই নোটবুক সম্পর্কে বিভিন্ন সময়ে প্রাপ্ত তথ্যগুলো একত্রিত করতে সক্ষম হন। হঠাৎ করে এর একটি পাতার হিজিবিজি রেখাগুলোর দিকে তার নজর পড়ে। এই পাতায় ১৪৯৩ সালে লাল রংয়ের চক দিয়ে ভিঞ্চি কিছু একটা আঁকিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯২০ সালে এই নোটবুক যে জাদুঘরে সংরক্ষিত ছিল,তার প্রধান পরিচালক এই পাতাটিকে “অপ্রাসঙ্গিক ও অবাঞ্ছিত” বলে আখ্যায়িত করে। এর ফলে সেই পাতাটিকে ভিঞ্চির চিত্রকর্মের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়।
তবে এই পাতার অস্পষ্ট অঙ্কন বিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানীদের মনোযোগ আকর্ষণ করে। এই পাতার উপরের দিকে একজন বিবর্ণ বৃদ্ধ মহিলার মুখাবয়ব আঁকানো রয়েছে। তার নিচে ফরাসী ভাষায় একটা শ্লোক লেখা আছে। বাংলায় অনুবাদ করলে এর অর্থ দাঁড়ায়, ইহজাগতিক সৌন্দর্য চলে যায় ও বেশিদিন স্থায়ী থাকে না।
পরিত্যক্ত ঘোষণার প্রায় ১০০ বছর পরে হাচিংস এটি নিয়ে পুনরায় গবেষণার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। পরবর্তীতে তিনি আবিষ্কার করেন,ছবিতে লাল চকের সেই লেখাটির নিচে যে অস্পষ্ট জ্যামিতিক প্রতীক রয়েছে,তা একটি বিশেষ অর্থ বহন করে। এতে দেখা যায়,সারিবদ্ধ ব্লককে একটি ওজন বা বস্তু নিজের দিকে টানছে। এই ওজন আবার পুলির সাথে ঝুলন্ত অবস্থায় আছে। বর্তমান সময়ে পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা ঘর্ষণের সূত্র প্রমাণে এই একই ধরনের পরীক্ষা ল্যাবে করে থাকে।
তাই হাচিংস কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন,ভিঞ্চির আঁকা নকশা থেকে বোঝা যায়,তিনি ১৪৯৩ সালেই ঘর্ষণের মৌলিক বিষয়টি ধরতে পেরেছিলেন।ছবি দেখলে বোঝা যায়,তিনি জানতেন,২ টি মসৃণ ও পিচ্ছিল পৃষ্ঠের মাঝে যে ঘর্ষণবল কাজ করে,তা পৃষ্ঠ দুইটির মাঝে বিদ্যমান ওজনের সমানুপাতিক।এক্ষেত্রে ওজন যত বাড়বে,একটি পৃষ্ঠকে অপর পৃষ্ঠের উপর দিয়ে চালানোর সময় তত বেশি ঘর্ষণ বলের প্রয়োজন হবে। তবে এই ঘর্ষণ বল পৃষ্ঠ দুইটির সংযোগকারী ক্ষেত্রের উপর নির্ভরশীল নয়।এটাকেই মূলত “ঘর্ষণের সূত্র” বলা হয়। তবে এই সূত্র আবিষ্কারের কৃতিত্ব প্রদান করা হয় ফ্রান্সের বিজ্ঞানী গুইলাওউমি অ্যামন্টনসকে। তিনি ভিঞ্চির এই চিত্রকর্মের প্রায় ২০০ বছর পরে এই সূত্র নিয়ে গবেষণা শুরু করেন।
এছাড়াও হাচিংস দেখিয়েছেন,কিভাবে পরবর্তীতে দুই দশকে ঘর্ষণের এই জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে ভিঞ্চি বিভিন্ন জটিল যন্ত্রের নকশা আঁকতেন। দ্যা ভিঞ্চিই সর্বপ্রথম ঘর্ষণবলের উপকারিতা ও এর কার্যকারিতা উপলব্ধি করেন। তিনি এই ধারণা ব্যবহার করেই চাকা,অক্ষরেখা,পুলি ইত্যাদির ধর্ম ব্যাখ্যা করেছেন।
হাচিংসের ভাষায়,ঘর্ষণবল নিয়ে দ্যা ভিঞ্চির ২০ বছরের গবেষণা বিভিন্ন ধরনের যান্ত্রিক পদ্ধতির নকশা প্রণয়নে তাকে আরও দক্ষ করে তুলেছিল। আর তারই সূত্রপাত হয়ত ঘটেছিল এই অস্পষ্ট শিল্পকর্ম থেকে।
-নাসরুল্লাহ্ মাসুদ