বিজ্ঞান পত্রিকা

আমরা কিভাবে দেখি?

ক্যামেরা ও চোখ দুইই লেন্সের মাধ্যমে আলোক প্রক্ষেপন করে পেছনের পর্দায়। তাই ক্যামেরাকে অনেকবারই চোখের সাথে তুলনা করা হয়েছে তাদের গাঠনিক মিলের জন্যে। যদি বলি যে চোখ আসলে একটা এন্টেনা, তাহলে কি সেই রূপক মেনে নিতে কষ্ট হবে? এন্টেনা সাধারণত রেডিও কিংবা মোবাইল ফোনের যান্ত্রিক অনুষঙ্গ যা বেতার তরঙ্গ ধরার কাজে ব্যবহৃত হয়। চোখের কাজ তো সেরকম কিছু না, আমরা তো চোখ দিয়ে বেতার তরঙ্গ নয়, আলো ধরি। কিন্তু অন্যভাবে ভাবলে বেতার তরঙ্গ, আলো কিংবা এক্সরে – এরা সবাই আসলে তড়িৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গ, এদের মাঝে পার্থক্য কেবল তরঙ্গদৈর্ঘ্যে। সেক্ষেত্রে এন্টেনা বা চোখের কাজ একই – তড়িৎ চৌম্বকিয় তরঙ্গকে ফাঁদে ফেলে প্রয়োজনীয় তথ্য বিশ্লেষণ করা।

কোন দৃশ্য হতে প্রতিফলিত আলোকের ফোটন কণাকে চোখের মাধ্যমে ধরে তারপর চেনা বস্তুরূপে চেনার কাজটা করে মস্তিষ্ক। দর্শন, মানে দেখার কাজটিতে চোখের দায়িত্ব হলো ফোটনকণাকে বৈদ্যুতিক সংকেতে রূপান্তরিত করে স্নায়ুকোষের মাধ্যমে মস্তিষ্ককে তথ্য সরবরাহ করা। আর মস্তিষ্কের কাজ সে তথ্যের অথৈ সাগর সেঁচে দৃশ্যের পটভূমি (Background) থেকে পুরোভূমি (Foreground) আলাদা করে, বিভিন্ন দিকবরাবর অবস্থিত বস্তুগুলোকে চিহ্নিত করে, দৃশ্যপটের স্থানিক তথ্যের বোধগম্য ব্যাখ্য দেওয়া। মানুষের দৃশ্য-প্রতীতির (Visual Perception) পেছনে কিছু স্নায়বিক ক্রিয়াকৌশল মুখ্য ভূমিকা পালন করে। জটিল এই কাজটি সেরা ক্যামেরা সংযুক্ত পৃথিবীর সুপার কম্পিউটারেরও সাধ্যের অতীত।

রেটিনা থেকে দৃশ্যকর্টেক্স
চোখে ক্যামেরার মতোই লেন্স দিয়ে আলোক রশ্মিকে রেটিনায় কেন্দ্রীভূত করা হয়। দৃশ্য-প্রতীতির শুরু এখান থেকেই। রেটিনায় সজ্জিত আলোক-সংগ্রহী কোষের স্তর আলোক-কণাকে তড়িৎরাসায়নিক সংকেতে পরিণত করে। এই কোষ দু’রকমের, ‘রড’ আর ‘কোন’। অন্ধকারে দেখার জন্য কাজে লাগে ‘কোন’ কোষগুলো। এরা রেটিনা পর্দার প্রান্ত বরাবর অবস্থিত। তাই রাতে কোন মৃদু আলোর তারা দেখতে হলে তারাটি যেখানে থাকার কথা, তার আশেপাশে তাকালে তারাটি ধরা পড়ে।

আর ‘কোন’ কোষেরা রেটিনার মাঝ বারবর জায়গায় জড়ো হয়ে থাকে। বই পড়া কিংবা রঙিন দুনিয়া দেখার মতো কাজে সুতীক্ষ্ম অনুভূতির প্রয়োজন হয়। রেটিনায় প্রক্ষিপিত আলো থেকে এ ধরণের তীক্ষ্ম অনুভূতির বিস্তারিত তর্জমা করে ‘কোন’ কোষেরা। এরা আবার তিন রকমের হয়। লাল, সবুজ বা নীল রঙের আলোর প্রতি সংবেদনশীলতা অনুসারে এদের কর্মবিভাজন হয়। ‘কোন’ কোষের ত্রিদলীয় ঐক্যজোটের সেবায় আমরা বাস্তবতার একটা রঙিন অনুবাদ দেখি। অবশ্য সব প্রাণী আমাদের মতো ভাগ্যবান না। যেমন কুকুর সহ বেশিরভাগ স্তন্যপায়ী প্রাণীদের কেবল দুই ধরনের ‘কোন’ কোষ আছে। তারা নীল ও হলুদ রঙ আলাদা করতে পারলেও লাল-সবুজ আলাদা করে চিনতে পারে না।

যে কোষগুলো আমাদের দেখতে সাহায্য করে। ছবি ইন্টারনেট

আলোক সংবেদী কোষ থেকে তড়িৎ-রাসায়নিক সংকেত রেটিনার দ্বিতীয় একটি আন্তঃস্নায়ুজালিকা স্তরের মধ্য হয়ে গ্যাঙলিয়ন (একধরনের স্নায়ু) কোষ দিয়ে তৈরি তৃতীয় একটি স্তরে যায়। রেটিনার এই দুইস্তর একটি সুগ্রাহী ক্ষেত্র তৈরি করে। প্রক্ষিপ্ত বিম্বে আলোকের তারতম্য পরিবর্তন (কনট্রাস্ট) বোঝার জন্য এই ক্ষেত্রটি সহায়তা করে। আলোক তারতম্য বলতে বোঝানো হচ্ছে ছবিতে থাকা বিভিন্ন বস্তুর কিনারার ধার কিংবা আলোছায়ার পরিবর্তনকে। আর গ্যাঙলিয়ন কোষের কাজ হলো এই তথ্যগুলোকে অন্যান্য তথ্যের সাথে সমন্বিত করে অপটিক স্নায়ুরজ্জুর মাধ্যমে মস্তিষ্কে প্রেরণ করা।

অপটিক স্নায়ুরজ্জু এই তথ্যগুলো থ্যালামাসের মধ্য দিয়ে সেরেব্রাল কর্টেক্সে পাঠানোর ব্যবস্থা করে। সেরেব্রাল কর্টেক্সেই দৃশ্য-প্রতীতির মূল কাজ হয়। তবে অপটিক স্নায়ুরজ্জু দৃশ্য কর্টেক্স ছাড়াও মস্তিষ্কের আদিম অংশ ব্রেনস্টেমের কাছেও কিছু তথ্য সরবরাহ করে। ব্রেনস্টেমের এই অঞ্চলগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রিটেকটাম নামক একদলা কোষ। এদের কাজ হচ্ছে আলোক-তীব্রতা বুঝে চোখের পিউপিলের ছিদ্র বড়-ছোট করা। যখন বাহিরের আলো বেশ তীব্র, তখন ছোট ব্যাসার্ধের ছিদ্র আর যখন বাইরের আলো মৃদু, তখন বড় ব্যাসার্ধের ছিদ্র তৈরি করাই এর কাজ। ঠিক যেন ক্যামেরার এক্সপোজার নিয়ন্ত্রনের মতো। দেখার কাজে আরো কিছু কারিগরী বিষয় আছে। কোন তুলনামুলক স্থির চিত্র দেখার জন্য আমাদের চোখ আপনা-আপনি দ্রুত নড়াচড়া করে পুরো দৃশ্যপটটি চষে যায়। সাথে সাথে এই ছবিগুলোকে জোড়া লাগিয়ে একটি মাত্র সমন্বিত ছবি তৈরি করে মস্তিষ্কে। এই কাজটা অনেকটা প্যানারোমিক ফটোগ্রাফীর অনেকগুলো ছবি জোড়া দেয়া বা স্টিচিঙের মতো। তবে একটা পার্থক্য হলো প্যানারোমিক ফটোগ্রাফীর সময় লক্ষ্য থাকে দুই চোখে চারপাশের যতটুকু কৌনিক দূরত্বের ছবি আমরা দেখি তার চাইতে বিস্তৃত কৌনিক দূরত্বের ছবি তৈরি। বিপরীতক্রমে চোখের এই দ্রুত নড়াচড়ার মাধ্যমে ছবি জোড় দেয়ার কাজের লক্ষ্য  ভিন্ন। একটা দৃশ্যর মধ্য দিয়ে একপাশ থেকে অন্য দিকে তাকানোর সময় যে মসৃণ ছবি তৈরি সম্ভব হয় এই দ্রুত নড়াচাড়ার কারণে। একে বলা হয় চোখের সাক্কাড (Saccade)। চোখের সাক্কাডিয় নড়াচড়া না থাকলে আমাদের দৃশ্যপট ঘোলা হয়ে যেতো। কেউ যখন একদিক থেকে অন্যদিকে তাকাচ্ছে, তখন তার চোখের দিকে খেয়াল করলে আপনি এই সাক্কাডীয় নড়াচড়া পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন।

দেখার প্রক্রিয়ার সাথে মস্তিষ্কের অনেকগুলো অংশ জড়িত। সূত্র ইন্টারনেট।

তো, রেটিনা থেকে অপটিক স্নায়ুরজ্জুর মধ্য দিয়ে যাতায়াত করার সময় বেশিরভাগ তথ্যই মস্তিষ্কের গভীর কেন্দ্রে, থ্যালামাসের একটি অংশে পৌঁছায়। এই অঞ্চলকে বলে ল্যাটেরাল জেনিকুলেট নিউক্লিয়াস। এই অঞ্চল তথ্যস্রোতকে দুইটি ভাগে ভাগ করে, বিভক্ত এক ধারা বহন করে রঙ ও বিম্বের সুক্ষ্ম অংশগুলো সম্পর্কিত তথ্য। অন্য ধারা বহন করে আলোক তারতম্য ও গতি বিষয়ক তথ্য। তথ্যগুলোকে প্রক্রিয়াজাত করা হয় ল্যাটেরাল জেনিকুলেট নিউক্লিয়াসেরই দুইটি জায়গায়। এরা যথাক্রমে পারভোসেলুলার ও ম্যাগনোসেলুলার নামে পরিচিত।

ম্যাগনোসেলুলার ও পার্ভোসেলুলার স্তরের কোষগুলো প্রক্রিয়াজাত তথ্যকে মস্তিষ্কের পেছনে প্রাথমিক দৃশ্য কর্টেক্সে (V1) পাঠিয়ে দেয়। এ প্রাথমিক দৃশ্য কর্টেক্সের কোষগুলো যেনতেন ভাবে নয়, খুব সুনির্দিষ্টভাবে সাজানো থাকে। সুনির্দিষ্ট সাজের কারণেই মস্তিষ্কের দৃশ্য-ব্যবস্থা হিসেব করতে পারে অক্ষির সামনের স্থানে বিভিন্ন বস্তু আসলে কিভাবে সাজানো আছে। প্রথমত, V1 কোষগুলো রেটিনাকোষীয় বিন্যাস অনুযায়ী সাজানো থাকে। রেটিনা-কোষীয় বিন্যাসের অর্থ কি? এর মানে হলো, রেটিনাপর্দায় প্রতিটি বিন্দুর জন্য প্রাথমিক দৃশ্য কর্টেক্সে একটি অনুরূপ বিন্দু আছে। রেটিনার কোন বিন্দুতে আলো হতে পাওয়া তথ্য ওই বিন্দুর প্রাথমিক দৃশ্য কর্টেক্সের অনুরূপ বিন্দুতে সঞ্চারিত হয়। ঠিক তেমনি রেটিনার ওই বিন্দুর আশেপাশের বিন্দুগুলো প্রাথমিক দৃশ্যকর্টেক্সের ওই বিন্দুর আশেপাশের অনুরূপ বিন্দুতেও সঞ্চারিত হয়। এর মাধ্যমে প্রাথমিক দৃশ্য কর্টেক্স বা V1 দৃশ্যপটের একটি দ্বিমাত্রিক ছবি তৈরি করতে সক্ষম হয়। দৃশ্যপটের গভীরতা দুইটি চোখের রেটিনা থেকে আসা তড়িৎ-রাসায়নিক সংকেত তুলনা করে প্রাথমিক দৃশ্য কর্টেক্সেই স্থাপিত হয়। এসব সংকেত ওকুলার-ডমিনেন্স-কলাম বা চাক্ষুস-প্রাধান্য-স্তম্ভ নামক একসারি কোষের মাধ্যমে প্রক্রিয়াজাত হয়। এরা আবার দাবার ছকের মতো একের পর এক, একটি ছকে ডান চোখ হতে আসা সংযোগ, অন্যটিতে বাম চোখ থেকে আসা সংযোগে সংযুক্ত। তারমানে, দৃশ্য কর্টেক্সের কোষগুলোই ‘দেখে’; দেখার অনুভূতি ‘পায়’। কোন বস্তুর দুই রেটিনা থেকে আসা স্থানিক তথ্য পরস্পর তুলনা থেকে পাওয়া সামান্য অমিল দিয়েই দৃশ্যপটের বিভিন্নবস্তুর তুলনামূলক গভীরতা বের করা হয় ত্রিকোণমিতিক হিসাবনিকাশ করে।

ছকের মতো সজ্জিত স্তম্ভাকার স্নায়ুকোষ

আবার, V1-এর কোষেরা সারি সারি কোষ দিয়ে ওরিয়েন্টেশন-কলাম বা দিক-স্তম্ভ গড়ে তোলে। এই কোষের সারিরা আবার নির্দিষ্ট লাইনের দিক অনুযায়ী সক্রিয় হয়। দিক-স্তম্ভের এই সক্রিয়তার কারণে V1 কোষেরা দৃশ্যজগতের বিভিন্ন বস্তুর কিনারা সনাক্ত করতে পারে। চোখের সামনে থাকা দৃশ্যপটের বিভিন্ন বস্তুকে সনাক্ত করা থেকেই দৃশ্য-প্রতীতির শুরু হয়। প্রাথমিক দৃশ্য কর্টেক্সের একটি বিশেষত্ব হলো সারি সারি কোষের স্তম্ভাকার গঠন। এটা কিন্তু কোন সামান্য কিছু নয়, এই গঠন আবিষ্কার করেই ১৯৮১ সালে ডেভিড হাবেল ও টর্স্টেন উইজেল নোবেল পুরস্কার পান।

মস্তিষ্কের দেখতে শেখা
মজার ব্যাপার হলো, শিশুর জন্মের পরে প্রাথমিক দৃশ্য কর্টেক্সে দাবার-ছকের মতো সাজানো স্তম্ভাকার গঠন খুব অস্পষ্ট, অনির্দিষ্ট থাকে। নবজাতকের দৃশ্য কর্টেক্স প্রচুর অসংলগ্ন ও এলোমেলো স্নায়ুসংযোগ দিয়ে গঠিত। এই অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়া সংযোগসমূহ পরবর্তীতে নবজাতকের দৃশ্য-অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ছাঁটাই (Pruned) করে ফেলা হয়। স্নায়ুসংযোগ ছাঁটাইয়ের পরে V1 স্তম্ভাকার গঠন পায়। তারমানে বিষয়টা দাঁড়াচ্ছে যে, স্নায়ুসংযোগের কমে যাওয়ার কারণেই শিশু আকার-আকৃতি ও প্যাটার্ন চিনে দৃশ্যপটের সুক্ষ্ম বিষয়গুলো ধরে ফেলতে পারে।

অভিজ্ঞতার ব্যাপারটিও এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মস্তিষ্ক কোন পরিবর্তনহীন অচলায়তন নয় যেখানে আগে থেকে সব কিছু ঠিক করা থাকে। বরং মস্তিষ্ক অত্যন্ত গতিশীল, অভিজ্ঞতার যোগান অনুসারে স্নায়ুসংযোগগুলো নিজেকে বদলিয়ে নেয়। V1-এর মতো এই অভিজ্ঞতা-নির্ভর স্নায়ুসংযোগ-পরিমার্জন ঘটতে দেখা যায় সমগ্র সেরেব্রাল কর্টেক্স জুড়েই। শিশুর প্রাথমিক দৃশ্য কর্টেক্স যখন কোন বস্তুর প্রান্ত ও নানা রকম রেখা চিনতে আরম্ভ করছে, গৌণ দৃশ্য কর্টেক্স (Secondary Visual Cortex বা V2) একই সাথে সাথে তার রঙ বিশ্লেষণের ক্ষমতা বাড়াচ্ছে। এই V2 অঞ্চল কিন্তু রঙের নিত্যতা নামের প্রপঞ্চের জন্য দায়ী। দিনের ফকফকা আলো হোক, বিকেলের কনে দেখা ক্ষণ হোক, নিয়নের কোমল রঙিন আলো হোক – নানান রোশনাইয়ের মাঝে একটা লাল গোলাপকে সবসময়ই কিন্তু আমরা লালই মনে হয়। শুনতে পানিভাত মনে হলেও বিষয়টা আসলে তত সরল নয়। রঙিন চশমার মধ্য দিয়ে দেখলে যেমন সবকিছুর রঙ বদলে যায়, তেমনি ভিন্ন ভিন্ন আলোর রোশনাইয়ে কোন বস্তুর রঙ বদলে যাওয়ার কথা। কিন্তু আমাদের দৃশ্য-প্রতীতির রঙের নিত্যতা নামক প্রপঞ্চ আছে বলেই ভিন্ন ভিন্ন আলোতে আমরা সবকিছুর রঙ মোটামুটি একই দেখি। কি হয় আসলে এই প্রপঞ্চে? ধারণা করা হয়, V2 কোন বস্তু এবং বস্তুটি পরিবেষ্টন করে থাকা আলো তুলনা করতে পারে। সেই তুলনা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় যোগবিয়োগ করে V2 হিসাব করে নেয় বস্তুটি কোন রঙে উদ্ভাসিত। অবশ্য এই ‘হিসেব’ করাটা অনেকাংশে নির্ভর করে দর্শক কোন রঙে বস্তুটিকে দেখবার আশা করেন। রঙের বিষয়টা তাই সম্পূর্ণ বস্তুগত নয়, ব্যক্তির ঝোঁকের উপরও নির্ভরশীল।

বস্তুত, চাক্ষুস-দর্শনের মাধ্যমে দৃশ্যপটের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য আমরা কি রূপে ‘দেখবো’ তা আমাদের অতীত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা প্রত্যাশার উপর নির্ভর করে। প্রত্যাশা অনুযায়ী কি দেখবো তা আরোপিত হয় মস্তিষ্কের বিভিন্ন অঞ্চলে। যেমন চোখের সামনে বিভিন্ন বস্তুর রঙ ও গঠন চেনার ক্ষেত্রে V1, V2, V3 ও V4 অঞ্চলে। আর চেহারা ও বস্তু চিনতে পারার ক্ষেত্রে গড়ে ওঠে নিম্ন-টেম্পোরাল লোবে; গতি আর স্থান বিষয়ক সচেতনতার ক্ষেত্রে হয় প্যারাইটাল লোবে। এ ধরনের প্রভাব বিস্তার অনেক ক্ষেত্রে চোখ-থেকে-আসা তথ্যের নৈরাজ্যকর বিশ্লেষণ করে, যেমনটা হয় বিভিন্ন বিভ্রমের ক্ষেত্রে। তবুও এ অভিজ্ঞতা-নির্ভর-প্রত্যাশা প্রভাব আছে বলেই আমরা বিভিন্ন চোখে দেখে ঘটনা অনুযায়ী খুব দ্রুত সাড়া দিতে পারি। রেটিনার স্নায়ু কোষে ‘আলো’ ধরা থেকে শুরু করে প্রাথমিক দৃশ্য কর্টেক্সে রেখা ও বস্তুর কিনারা নির্দিষ্ট করে উচ্চতর দৃশ্য কর্টেক্সে আঁখিপটের সামনে থাকা বিভিন্ন বস্তু চিনে তাদের পারস্পারিক স্থানিক অবস্থান বোঝা কাজটি মানব মস্তিষ্কের দর্শন-ব্যাবস্থা খুব দক্ষতা ও দ্রুততার সাথে করে। আমাদের প্রজাতীর টিকে থাকার সংগ্রামে এই নৈপুন্যর অবদান কম নয়।

এ পর্যন্ত আমরা মস্তিষ্কের কর্মবিভাজনের একটি উদাহরণ সম্পর্কে জানলাম। পৃথিবী সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি তথ্য পাই যে চোখ দিয়ে সেটাকে উদাহরণ হিসেবে ধরেছি আমরা। কিন্তু যদি হঠাৎ দূর্ঘটনায় অন্ধ হয়ে যান, প্রিয় জগত দেখার জন্য কোন আশার আলো কি আছে আপনার সামনে? এখন আমরা মনোযোগ দেবো মস্তিষ্কের কর্মবিভাজনের খাপ খায় না এমন একটা বৈশিষ্ট্যের সাথে ব্রেইন প্লাস্টিসিটি বা মস্তিষ্কের নমনীয়তার দিকে।

মস্তিষ্কের নমনীয়তা
আপনার দুই-চোখের পেছনের পর্দায় রয়েছে সামনের দৃশ্যের উল্টো হয়ে থাকা এক জোড়া শীর্ণ প্রতিবিম্ব। সামনের দৃশ্য থেকে আলো চোখের রেটিনা-পর্দায় গিয়ে প্রতিবিম্ব গঠনের প্রায় সাথে সাথে, সেকেন্ডেরও কম সময়ে, সামনের ত্রিমাত্রিক জগতের জরুরী তথ্যে ভরপুর একটি বিস্তারিত দৃশ্য তৈরি হয় আপনার মস্তিষ্কে। আপনি দেখতে পান। এই দৃশ্য-প্রতীতির জন্যেই আমরা ক্রিকেট খেলায় বলে-ব্যাটে-সংঘাতে ছক্কা মারতে পারি, সন্ধ্যার আবছায়া অন্ধকারে পরিচিতদের চিনতে পারি, কেউ মুখ বরাবর তাকিয়ে থাকলে হঠাৎ চোখে চোখ ফেলতে পারি।

যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে চোখ থেকে পাওয়া তথ্য মস্তিষ্কে দেখার অনুভূতি তৈরি করে তা বেশ জটিল। আধুনিক স্নায়ুবিজ্ঞানের গবেষণায় মস্তিষ্কের এই প্রক্রিয়াটা বেশ বিস্তারিতভাবেই বোঝা গেছে। আলোর বিচিত্র বিন্যাস চোখের আলোক-সংবেদী কোষে তড়িৎ-রাসায়নিক সংকেতে পরিণত হয়। তারপর সে সংকেত বিভিন্ন ধাপে মস্তিষ্কে বিশ্লেষিত হয়। দেখার এই কৌশল বর্ণনা করেছি আগের লেখাটিতে। দৃশ্য কর্টেক্সের কারিগরী ব্যাপারস্যাপার খুব ভালোভাবে বোঝার ফলে কারো মস্তিষ্কে হঠাৎ স্ট্রোকের ফলাফল কি হতে পারে স্নায়ুরোগ-বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বেশ সাফল্যের সাথেই আন্দাজ করতে পারেন। V1 কর্টেক্সের একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্থ হলে রোগী সাধারণত দৃশ্যপটের এক-চতুর্থাংশ অংশ দেখতে পারেন না, আংশিক অন্ধ হয়ে যান। অন্যান্য অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্থ হলে হয়তো রোগী ভুবনকে সাতরঙে দেখার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন, কিংবা বস্তুর গতি ধরতে পারেন না, কিংবা পরিচিতদের চেহারা চিনতে পারেন না।

তাহলে কি আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি যে দেখার কাজটি করার জন্য মস্তিষ্কের প্রাথমিক দৃশ্য কর্টেক্সই জন্মের একেবারে শুরু থেকেই বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত? উপসংহারটা লোভনীয় মনে হলেও ঘটনাটা আরেকটু তলিয়ে দেখার আছে। সত্যি ঘটনা বলি। এক মহিলাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে দেখা যায় স্ট্রোকের কষাঘাতে মস্তিষ্কের দুই দিকের V1 অঞ্চলই ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এই ধরনের স্ট্রোকে উভয় V1 অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্থ হলে দেখা গেছে অন্য রোগীরা অন্ধ হয়ে যান। তাই ডাক্তার ভাবলেন রোগী অত্যন্ত ভাগ্যবান, কারণ রোগী ছিলেন জন্মান্ধ। সুতরাং রোগীর কিছুই হারাবার নেই। কিন্তু ডাক্তারের সেই ইতিবাচক ভাবনা ছিলো ভুল। দেখা গেলো রোগীটি সারা জীবনের জন্য ব্রেইল পড়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ, ব্রেইল হচ্ছে অন্ধদের হাত দিয়ে কাগজ স্পর্শ করে পড়ার একটি পদ্ধতি।

এখন একটু নড়েচড়ে উঠে বসে বিষয়টা ভালোমতো বুঝতে হয়। V1 তো দৃশ্য সম্পর্কিত কাজের জন্য ব্যবহার হওয়ার কথা। এইখানে ক্ষতি হলে একজন অন্ধ তার হাত দিয়ে ব্রেইল পড়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবেন কেন? উত্তরটা সহজ। মস্তিষ্ক আসলে অত্যন্ত নমনীয় অঙ্গ। অভিজ্ঞতার ছাঁচ অনুসারে সে নিজেকে গড়েপিটে নেয়। তাই কেউ দৃশ্য সম্পর্কিত কোন অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হলে দৃশ্য-কর্টেক্স বসে না থেকে অন্য কোন দায়িত্ব নিয়ে নেবে — জন্মান্ধ মহিলার ক্ষেত্রে যা ছিলো ব্রেইল পড়ার কাজ।

ইন্দ্রিয় প্রতিস্থাপক যন্ত্র
যীশু খ্রিষ্ট নাকি অন্ধকে পুনরায় দৃষ্টি দিতে পারতেন। এটা আসলে একটা শ্রুতি, অলৌকিক গল্প মাত্র। তবে এখন অন্ধকে আলোর অনুভূতি ফিরিয়ে দেয়া আর অলৌকিক কিছু নয়। কথাটা শুনতে অবান্তর মনে হলেও সত্য বটে। বিজ্ঞানী ড. পল বাখ-ই-রিটা এমন সব কল গড়েছেন করেছেন যারা আসলে চোখের প্রাথমিক কাজটি করে দিতে পারে। এদেরকে বলা হয় ইন্দ্রিয়-প্রতিস্থাপক-যন্ত্র বা সেন্সরি-সাবস্টিটিউশন-ডিভাইস। যদি মস্তিষ্ক নমনীয় হয়েই থাকে তাহলে অন্ধের মস্তিষ্ককে আবারো আলো চিনতে শেখানো যাবে না কেন? এই যন্ত্রগুলো সে কাজটিই করে। এই যন্ত্রগুলো কোন দৃশ্য থেকে আসা আলোক রশ্মি ক্যামেরার দিয়ে ধরে দৃশ্যপটের আলোর নকশাকে একটি গ্রিড বা ছকের মধ্যে তড়িৎ-সঙ্কেতে রূপান্তরিত করে। চোখ যেহেতু নষ্ট, চোখের স্নায়ুপথ ব্যবহার করে এই তড়িৎ-সঙ্কেত না পাঠিয়ে বাখ-ই-রিটা রোগীর ত্বকের খানিকটা জমিনে ওই ছকটি লাগিয়ে দেন। এই ত্বক হতে পারে রোগীর পিঠ কিংবা কপাল অথবা তাদের জিহ্বার অংশ। প্রথম প্রথম রোগীরা তাদের চামড়ায় একধরণের ঝিনঝিন শিহরণ অনুভব করেন। বিভিন্ন দৃশ্য হতে আসা আলোর বিভিন্ন নকশা অনুযায়ী এই শিহরণের অনুভব বদলে যেতে থাকে। যথেষ্ট অনুশীলনের পর রোগীরা এই ঝিনঝিন অনুভূতি আর পান না, বরং তাদের সামনে একটি দৃশ্যপট অনুভব করা শুরু করেন। বাখ-ই-রিটার গবেষণা অনুযায়ী এই যন্ত্রের মাধ্যমে দৃশ্য প্রতীতি এতোটাই ভালো যে অন্ধ ব্যাক্তিরা একটি ব্যাট দিয়ে গতিশীল বলে খুব সাফল্যের সাথেই বাড়ি মারতে পারেন!

ল্যান্স কর্পোরাল ক্রেইগ ল্যান্ডবার্গকে, যিনি ইরাক যুদ্ধে সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। তবে ইন্দ্রিয় প্রতিস্থাপক যন্ত্রের কল্যাণে তিনি বই পড়তে পারেন, হাঁটতে পারেন কোন সাহায্য ছাড়াই। [ছবি Lewis Whyld, http://www.telegraph.co.uk]
বিষয়টা কল্পনাতীত, স্বীকার করতেই হবে। বিস্ময়কর হলেও এর পেছনে সেই অন্ধ মহিলার ব্রেইল পড়ার কাজে V1 ব্যবহার করার মতো একই নিয়ম কাজ করছে। প্রতিটি নবজাত শিশুর মস্তিষ্ক বিভিন্ন ইন্দ্রিয় থেকে পাওয়া পারিপার্শ্বিক অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বিকশিত হয়। ইন্দ্রিয় হতে পাওয়া সংকেতের বিভিন্ন ছাঁদ অনুসারে মস্তিষ্ক এসব ছাঁদ বিশ্লেষণের কাজে নিজেকে সংগঠিত করে তোলে। তবে সংকেত কোন রাস্তা দিয়ে (যেমন অপটিক স্নায়ুপথ, যা চোখ থেকে দৃশ্য-বিষয়ক উপাত্ত দৃশ্য-কর্টেক্সে প্রেরণ করে) আসছে তার উপর দৃশ্য-প্রতীতি খুব বেশি নির্ভরশীল নয়। বরঙ উল্টোভাবে, কোন ধরনের শৃঙ্খলিত ছাঁদে সংকেতেরা মস্তিষ্কে আসছে সেটার উপরই প্রতীতি বেশি নির্ভরশীল।

নমনীয়তার এই নীতি পুরো মস্তিষ্কজুড়েই দেখতে পাওয়া যায়। এর আরেকটা উদাহরণ দেয়া যায় বাকপ্রতিবন্ধীদের ইশারা-ভাষার ক্ষেত্রে। বাকপ্রতিবন্ধীরা কথা বলতে পারেন না। তাই হাত দিয়ে বিভিন্ন ইঙ্গিতের মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশের জন্য ইশারা-ভাষা ব্যবহার করেন। কথ্য-ভাষা হতে ইশারা-ভাষা একেবারেই ভিন্ন। একটি মৌলিক পার্থক্য হলো ইশারা-ভাষা মস্তিষ্কে আসে কান নয়, চোখের মাধ্যমে। আরেকটা পার্থক্য হলো কথ্যভাষায় বিভিন্ন ধ্বনির মাঝে পার্থক্য করা হয় শব্দের কম্পাঙ্ক দিয়ে। আর ইশারা-ভাষায় বিভিন্ন শারীরিক ইঙ্গিত দিয়ে তৈরি দেহ-ভঙ্গিমা দিয়ে মনোভাব প্রকাশ করা হয়। তবে দেখা গেছে, মস্তিষ্কের যে অংশটি কানে-শোনা-শব্দ থেকে কথ্য-ভাষার তথ্যগুলো প্রক্রিয়াজাত করে, ইশারা-ভাষার তথ্যও মস্তিষ্কের একই অংশে প্রক্রিয়াজাত হয়। এই আবিষ্কারটা বেশ চমকে দেয়ার মতো। কারণ ইশারা-ভাষায় তথ্য যেহেতু চোখ দিয়েই মস্তিষ্কে প্রবেশ করছে, দৃশ্য-প্রতীতির জন্য দায়ী অঞ্চলেরই এই তথ্য নিয়ে কাজ করবার কথা।

আরেকটি নাটকীয় উদাহরণ দেয়া যায় অশরীরী অঙ্গের মাধ্যমে। ধরুন, কোন ব্যক্তির হাত অপারেশন করে কেটে ফেলা হলো। তখন মস্তিষ্কের যেসব স্নায়ুকোষ ওই কেটে ফেলা হাত থেকে বিভিন্ন ইন্দ্রিয়জাত-তথ্য নিয়ে কাজ করতো (যেমন চাপ, তাপ ও ব্যাথা), তারা সেই তথ্যের যোগান আর কখনোই পাবে না। তখন কিন্তু সেই স্নায়ুকোষ চুপচাপ বসে থাকবে না। নিয়মিত তথ্যের যোগানের অভাবে তারা আশেপাশের প্রতিবেশী স্নায়ুকোষ থেকে সংকেত ধার নেয়া শুরু করবে। মনে করুন, মস্তিষ্কের সংজ্ঞাবহ-কর্টেক্সের যে স্নায়ুকোষগুলো কেটে ফেলা হাত থেকে পাওয়া তথ্য নিয়ে কাজ করতো, তাদের ঠিক পাশেই রয়েছে একদল স্নায়ু যারা মুখায়বের বিভিন্ন পেশীর প্রতিনিধিত্ব করে। গালে সামান্য রৈখিক পরিবর্তন কেটে-ফেলা-হাতের স্নায়ুকোষে তথ্য পাঠাতে পারে। ফলাফল – হাতে শিরশির অনুভূতি, যেই হাতের বাস্তবে কোন অস্তিত্বই নেই!

মাঝে মাঝে অশরীরী অঙ্গে এই শিরশিরানি বাড়তে বাড়তে তীব্র ব্যাথায় পরিণত হয়। ব্যাথার অনুভূতি অনেক সময় পেশিতে টান পড়া খিঁচুনিতে রূপলাভ করে। কিন্তু পেশির খিঁচুনি ডাক্তার কিভাবে সাড়াবেন, যখন ওই হাতেরই অস্তিত্ব নেই? আশার কথা হলো মস্তিষ্কের নমনীয়তা যে রোগের কারণ, সে রোগের প্রতিকার হিসেবেও কাজ করতে পারে। অশরীরী হাতের উদাহরণে যে স্নায়ুকোষগুলো ব্যাথার জন্য দায়ী তাদেরকে উল্টোটাও বোঝানো সম্ভব। এই সমস্যায় ড. ভি. এস. রামচন্দ্রর সামান্য ছলচাতুরী ব্যবহার করে একটি কার্যকর প্রতিকার উদ্ভাবন করেছেন। তিনি একটি আয়না ব্যবহার করেছেন। এই আয়নায় রোগীর ভালো হাতটিকে প্রতিফলিত করা হয়। যেহেতু আয়নার প্রতিফলন বাস্তব বিম্বের উল্টো, তাই এই প্রতিফলনটি কেটে ফেলা হাতের দৃশ্য-বিভ্রম তৈরি করে। আয়না-হাতটিকে আস্তে আস্তে প্রসারিত করে রোগী তার মস্তিষ্কে একটি চাক্ষুষ প্রমাণ পাঠায় যে না, কেটে-ফেলা-হাতটি ক্ষতিগ্রস্থ নয়, সুস্থই আছে। এভাবে শেষে সাধারণত দেখা যায় এই চাক্ষুস প্রমাণটি অশরীরী অঙ্গে ব্যাথার অনুভূতিকে অগ্রাহ্য করে, রোগীর ব্যাথার আর অস্তিত্ব থাকে না।

রামচন্দ্রের আয়না। সূত্র ইন্টারনেট।

কেটে ফেলা অশরীরী অঙ্গে ব্যাথা আর এর উপশম – দুইটিই মস্তিষ্কের নমনীয়তার উপর দাঁড়িয়ে আছে। বয়স যাই হোক না কেন স্নায়ুকোষেরা ইন্দ্রিয়জাত সংকেত ও অভিজ্ঞতার পরিবর্তনের সাথে সাথে নিজেদের কাজও পরিবর্তন করে ফেলতে পারে। মস্তিষ্কে স্ট্রোক হওয়া রোগী, তাদের পরিবারবর্গ এবং চিকিৎসারত ডাক্তারদের জন্যে এই তথ্যটা অত্যন্ত আশা জাগানিয়া। আগে ধারণা ছিলো মস্তিষ্ক ষ্ট্রোকের কয়েক মাস পরে প্রাথমিক দুর্যোগটি কেটে গেলেও ক্ষতিগ্রস্থ মস্তিষ্ককে আর সারানো যাবে না। মস্তিষ্কের বিনষ্ট কার্যক্ষমতা দুরারোগ্য ব্যাধির মতো স্থায়ী হবে আজীবন। মনে করা হত, এর পুনর্বাসন সম্ভব নয়। তবে বিভিন্নভাবে মস্তিষ্কের নমনীয়তা প্রমাণিত হওয়ায় এই ধারণা আর জোড় পাচ্ছে না। মস্তিষ্কের নমনীয়তার গুণ দেখে উদ্দীপিত হয়ে অনেক হাসপাতাল তাদের রোগীদের নিয়ে নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছে। স্ট্রোকের পর লম্বা সময় ধরে রোগীদের নানা প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে যাতে হারানো কার্যক্ষমতা আবার ফেরত আনানো যায়। অনেক ক্ষেত্রেই তারা সফল হচ্ছেন।

জীববৈজ্ঞানিক প্রেক্ষিত
মনে হতে পারে, মস্তিষ্কের নমনীয়তাই সব। মনে হতে পারে মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ তথ্যের যোগানের প্রকৃতি অনুসারে নিজেকে আমূল বদলে ফেলতে পারে। তবে, এটাই গল্পের পুরোটুকু নয়। মস্তিষ্কের একটি জীববিজ্ঞান আছে, সেটাকে বাদ দিতে গেলে উল্টো ভুল বোঝার সম্ভাবননা।

গল্পের পুরোটা বোঝার জন্যে একটি নির্দিষ্ট উদাহরণ দিয়ে আগানো যাক। ফেরেট হলো মাঝারী আকৃতির স্তন্যপায়ী প্রাণী। এরা আবার মাংশাসী, নিজেদের চেয়ে বড়ো খরগোশদেরকেও এরা কুপোকাত করে ফেলতে পারে। মানুষের মতোই ফেরেটদের মস্তিষ্কে শ্রবণ ও দৃশ্য তথ্য ভিন্ন ভিন্ন স্নায়ুপথ দিয়ে প্রবেশ করে। ভারতীয় বংশদ্ভূত বিজ্ঞানী মৃজ্ঞানকা সুর ফেরেট-শাবকের মস্তিষ্কে শল্যচিকিৎসার খুব নিখুঁত কাটাছেঁড়ার করেন। এই সার্জারীতে চোখ থেকে দৃশ্যতথ্য বহন করে আনা অপটিক স্নায়ুরজ্জুকে মস্তিষ্কের শ্রবণ-পথের দিকে বাড়ার জন্য প্রণোদিত করেন তিনি। এতে ফেরেট-মস্তিষ্কের যে অঞ্চলটি সাধারণত কান থেকে শব্দ-সংকেত-বিশ্লেষণ করতো সেটা চোখ থেকে দৃশ্য-তথ্য গ্রহণ করা শুরু করে। যখন ফেরেটরা একটু বড় হয়ে গেলো, তাদেরকে খাবারের জন্য লাল ও সবুজ বাতির মধ্যে একটি লাল বাতির দিকে তাকাতে শেখানো হয়। কিছুদিন পরে দেখা গেলো ফেরেটদের দৃশ্য-কর্টেক্স এমন ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে গেছে যে তাদের অন্ধ হয়ে যাওয়া উচিত। কিন্তু এর পরেও তারা দেখতে পারছে। তার মানে, দেখার কাজে ফেরেটদের মস্তিষ্ক পুরোপুরি নির্ভর করছে শল্যচিকিৎসার মাধ্যমে সংযুক্ত করা শ্রবণ অঞ্চলের উপর। সেই অন্ধ মহিলার কথা মনে পড়ছে যিনি ব্রেইল পড়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিলেন দৃশ্য-কর্টেক্স ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে যাওয়ার ফলে? অনেকটা তারই মতো দেখা গেলো এই শ্রবণ-অঞ্চলটি নষ্ট করলে ফেরেটরা অন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

এই পরীক্ষায় পরবর্তী জিজ্ঞাসা ছিলো, মস্তিষ্কের শ্রবণ অঞ্চলে অপটিক স্নায়ুরজ্জু জোড়া লাগালে এর গাঠনিক কোন পরিবর্তন হয় কি? মানুষ কিংবা ফেরেট – উভয়ের দৃশ্য কর্টেক্স ছকের মতো নকশায় সাজানো থাকে। মনে আছে নিশ্চয়ই যে ছকের মতো সজ্জায় এই বিশেষায়িত স্নায়ুকোষেরা দৃশ্য-তথ্যের বিভিন্ন বিশেষত্ব অনুযায়ী সাজানো থাকে। কেউ আকৃতি, কেউ রঙ আর কেউবা বিম্বের অবস্থান বিশ্লেষণ করে। ঠিক তেমনি, মস্তিষ্কের শ্রবণ অঞ্চলও ছকের সজ্জায় সাজানো থাকে। এক্ষেত্রে ছকের বিভিন্ন কোষেরা কম্পাঙ্ক, তাল ও লয়ের মতো শব্দের ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়ে কাজ করে। তো, উল্লিখিত প্রশ্ন অনুযায়ী মস্তিষ্কের শ্রবণ অঞ্চল দেখতে কেমন হবে, যখন সে প্রাকৃতিকভাবে গড়ে উঠলেও শব্দ নয়, বরং আলোক তথ্য নিয়ে কাজ করে? তার গঠন কি আগের মতোই থাকবে, নাকি তথ্যের বদলে যাওয়া প্রকৃতি অনুসারে শ্রবণ-অঞ্চল ভিন্নভাবে সংগঠিত হবে? মস্তিষ্কের নমনীয়তার নীতি অনুসারে গঠন বদলে যাওয়ারই কথা। শব্দ-প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চলটি ভিন্ন কাজের প্রকৃতি অনুসারে ছকে বিশেষায়িত স্নায়ুকোষ দৃশ্যকর্টেক্সের মতোই গড়ে ওঠা উচিত। গবেষণার এ পর্যায়ে বিজ্ঞানী সুর বিস্তারিত অণুবীক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করেন । নিরীক্ষার মাধ্যমে দেখা গেল, শব্দ-প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চলের কার্যকরী গঠন বদলে গেছে — যেমনটি ভাবা হয়েছিলো। অবশ্য একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত।

কেবলমাত্র একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত। হ্যাঁ, পরিবর্তিত শব্দ-প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চলে এমন সব স্নায়ু রয়েছে যারা দৃশ্য-প্রতীতির জন্য দরকারী বিভিন্ন দায়িত্ব ভাগাভাগি করে পালন করে। অন্যদিকে এই পরিবর্তিত অঞ্চলেও শব্দ শোনার জন্যে প্রয়োজনীয় কিছু পুরনো অংশ আগের মতো অপরিবর্তিত রয়ে গেছে। তাছাড়া পরিবর্তিত অঞ্চল মোটা দাগে মোটামুটি দৃশ্য কর্টেক্সের মতো হলেও সুক্ষ্ম বিশ্লেষণে এদের মধ্যে ফারাক অনেক। আর এই পরিবর্তিত অঞ্চলে পরপর ছকে গোছানো স্নায়ুরাও তুলনামুলক শিথিলভাবে সজ্জিত।

এ থেকে আমরা তাহলে কি বুঝতে পারি? আসলে পরিবেশ থেকে নানা রকম নকশায় আসা ইন্দ্রিয়জাত সংকেত এবং প্রাণীর জীববৈজ্ঞানিক প্রস্তুতি ও নিয়ন্ত্রণ – উভয়ের উপরেই নির্ভর করে মস্তিষ্কের কোন এলাকার গঠন ও কাজ কি হবে। এখানে জীববৈজ্ঞানিক প্রস্তুতি বলতে বোঝানো হচ্ছে ডিএনএ-তে থাকা পূর্বপরিকল্পনা যার নির্দেশ অনুযায়ী ভ্রুণের দেহের একটি অংশ ধাপে ধাপে বিকশিত হয় শিশু-মস্তিষ্কে। শুধু জীববৈজ্ঞানিক প্রস্তুতি ও নিয়ন্ত্রণ; অথবা শুধু মস্তিষ্কের নমনীয়তা দিয়ে মস্তিষ্কের নতুন কিছু শেখা ও কাজ ভাগাভাগির ক্ষমতা ব্যাখ্যা করলে ভুল হবে। মস্তিষ্কের কোন নির্দিষ্ট এলাকার গঠন ও কাজ এ দুইটি বৈশিষ্ট্যের উপরেই নির্ভরশীল।

মস্তিষ্কে নতুন করে জোড়া দেয়া শ্রবণ অঞ্চল বেশ সাফল্যের সাথে দৃশ্যতথ্য বিশ্লেষণ করলেও শ্রবণ-সংশ্লিষ্ট কিছু পুরাতন-কাঠামো কেন অপরিবর্তিত রয়ে যায় তা উল্লিখিত বিষয় দুইটির পারস্পারিক সম্পর্ক থেকে বোঝা যায়। এ তথ্যটা কিন্তু খুব চমকপ্রদ কিছু নয়। প্রায়ই দেখা যায় যে কোন প্রাণীর কোন বৈশিষ্ট্যের নিয়ন্ত্রণ ও প্রকাশ নির্ভর করে তার চারপাশের পরিবেশ এবং তার অন্তর্নিহিত জীববৈজ্ঞানিক পরিকল্পনার ওপর। তবে প্রশ্ন হলো, এই পারস্পারিক সম্পর্কটা ঠিক কিভাবে কাজ করে? যেমন এক্ষেত্রে কেন পরিবর্তিত শ্রবণ অঞ্চল পুরাতন কিছু কাঠামোকে সংরক্ষণ করে, অন্য পরিবর্তিত কাঠামোগুলোকে কেন রেখে দেয় না?

এই জীববৈজ্ঞানিক প্রেক্ষিতের কথা টানা যায় অশরীরী অঙ্গের ক্ষেত্রেও। কেটে ফেলা অঙ্গ নিয়ন্ত্রণের জন্য নির্ধারিত মগজীয় স্থানে কেবল তার আশেপাশের অঞ্চল থেকেই বিচ্ছিন্ন সংকেত আসতে পারে। যেমন হাতের উদাহরণের ক্ষেত্রে সংকেত আসবে মুখের অভিব্যাক্তি প্রকাশের স্নায়ু থেকে। যদি নমনীয়তাই ঘটনার একমাত্র নায়ক হতো তাহলে হাত-সম্পর্কিত স্নায়ুগুলো তো যে কোন নতুন কাজ করতে পারতো; অন্য কোন নতুন ধরনের সংকেত-রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য কাজ করা শুরু করতো। তা তো দেখা যায় না। অশরীরী অঙ্গে মস্তিষ্কের যে নমনীয়তা কাজ করছে তা আসলে রক্ষণশীল। এই নমনীয়তা স্থানিক এবং জীববৈজ্ঞানিক সীমানার বেড়াজালে বন্দি।

আমরা আসলেই জানিনা মস্তিষ্কের নমনীয়তা কতদূর যেতে পারে, মস্তিষ্কের কতটুকু ক্ষতি সারানো সম্ভব কিংবা ঠিক কোন উপায়ে নতুন করে সেরে ওঠা মস্তিষ্ক তার মূল গাঠনিক কাজ অনুকরণ করতে পারে। তবে আর যাই হোক, প্রথমে যেমন মস্তিষ্কের নমনীয়তা সর্বোরোগহর বলে মনে হয়েছিলো, জীববৈজ্ঞানিক প্রেক্ষিত থেকে দেখা যাচ্ছে তেমন কিছু সম্ভব নয়। বরং মস্তিষ্কে কিছু পুনর্গঠন সম্ভব, কিছু সম্ভব নয়। সন্দেহ নেই, মস্তিষ্কের নমনীয়তা রোমাঞ্চকর একটি বিষয়। অনেক স্নায়ুবিজ্ঞানী এখন এটা নিয়ে কাজ করছেন – তাদের গবেষণার ফলাফল অনেক কিছুই বদলে দেবে।

[আরাফাত রহমানের মস্তিষ্ক, ঘুম ও স্বপ্ন বই থেকে । বইটি ধারাবাহিকভাবে বিজ্ঞানপত্রিকায় প্রকাশ করা হবে।]
[বইয়ের সূচীপত্র তথা সবগুলো লেখা একত্রে পাবেন এখানে]

আরাফাত রহমান
প্রভাষক,  অণুজীববিজ্ঞান বিভাগ, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
[লেথকের ফেসবুক প্রোফাইল]

Exit mobile version