বিজ্ঞান পত্রিকা

সৌরমডেলের ক্রম পরিবর্তন

বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো কিছুর অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হতে বা কোনো কিছুর অস্তিত্ব প্রমাণ করতে আমাদের ইন্দ্রিয়ের সাহায্য নিতে হয়। পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে কোনোকিছুর অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হলে আমরা তাকে বলি ‘বাস্তব’। কোনো কিছু প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অস্তিত্ব সম্পন্ন হলে তাকে সত্যিকার জিনিস বা সত্যিকার ঘটনা বা বাস্তবতা বলে ধরে নেয়া হয়। যেমন শব্দ বাস্তব, কারণ তা শুনতে পাই। তেঁতুল টক, কারণ তার স্বাদ নিতে পারি। পাতার রঙ সবুজ, কারণ তা দেখতে পাই।

তবে সবসময় সবকিছু ইন্দ্রিয়ে ধরা দেয় না। ধরা না দিলেও সেসব বাস্তব বা সত্য হবার দাবী রাখে। যে সকল ক্ষেত্রে কোনোকিছুর অস্তিত্ব সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে নিশ্চিত হতে পারে না সেসকল ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা মডেলের সাহায্য নেন।

আশেপাশের বাস্তব জগতের কোনো একটা ক্ষেত্রে কী ঘটে চলছে তার একটা সুচিন্তিত মতামতই হচ্ছে মডেল। আমরা হয়তো ভাবি আমাদের আশেপাশের এইখানটাতে কী হচ্ছে ঐখানটাতে কী ঘটে চলছে। চুলগুলো কীভাবে লম্বা হচ্ছে, নখগুলো কীভাবে বড় হচ্ছে। মনে মনে কিছু একটা ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করি। এই ব্যাখ্যাটাই হচ্ছে মডেল। এই মডেল সঠিকও হতে পারে আবার ভুলও হতে পারে। একজনের দেয়া মডেল পরবর্তীতে অন্যজন ভুল প্রমাণ করতে পারে। আজকে যে মডেল সঠিক বলে ধরে নেয়া হয়েছে আগামীতে সেটা বাদ যেতে পারে।

পঞ্চ ইন্দ্রিয় ব্যবহার করে বাস্তবতা সম্বন্ধে জানা যায়।

মডেলের এরকম নাটকীয় গ্রহণ-বর্জন-পরিবর্তন ঘটেছে সৌরজগতের ক্ষেত্রে। প্রাচীন কাল থেকেই অনেক বিজ্ঞানী অনেকভাবে সৌরজগৎকে ব্যাখ্যা করার জন্য অনেক রকমের মডেল প্রদান করেছেন। তাদের কারো কারোটা ছিল যৌক্তিক, কারো কারো ছিল আংশিক যৌক্তিক আবার কারো কারো দেয়া মডেল ছিল একদমই অযৌক্তিক। এই লেখায় সৌরজগতের মডেলের ক্রমান্বয়িক পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা করা হবে।

সুদূর প্রাচীনকালে মননশীল সত্ত্বার বিকাশের সময় থেকেই মানুষ আকাশের দিকে তাকিয়েছে, তারাখচিত রাতের আকাশ পর্যবেক্ষণ করেছে এবং আকাশজগতকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছে। আকাশকে ব্যাখ্যা করার প্রচেষ্টা হিসেবে সৌরজগৎ তথা বিশ্বজগতের গঠন বর্ণনা করতে বিভিন্ন রকমের মতবাদ বা মডেল প্রদান করেছে সময়ে সময়ে। সেসব মডেলই যুগ যুগ ধরে ক্রমান্বয়ে পরিবর্তিত হতে হতে বর্তমান উন্নত অবস্থানে এসেছে। সেই এরিস্টার্কাস-টলেমীর যুগ থেকে শুরু করে বর্তমানে এডুইন হাবল-এলান গুথ পর্যন্ত। যেন ছলনাময়ীর মতো বিশ্বজগতের মডেল কিছুদিন পরপরই তার রূপ পাল্টায়।

প্রাচীন যুগ

প্রাচীন মানুষের বিশ্বাস ছিল তাদের বসবাসের পৃথিবী হচ্ছে সমগ্র বিশ্বজগতের কেন্দ্র। সূর্য সহ অন্যান্য গ্রহ-নক্ষত্রগুলো পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। নিজেদের বসবাসের স্থলকে কেন্দ্রে রাখার পেছনে কাজ করেছে মানুষের স্বভাবজাত সেরা হবার প্রবণতা। তখনকার মানুষের একটা অলিখিত নিয়ম ছিল বৃত্তাকার যেকোনো জিনিসই সুন্দর এবং বৃত্তের মাঝে সেরা অংশটি হচ্ছে তার কেন্দ্র। কেন্দ্রই মুখ্য আর কেন্দ্রের বাইরের সমস্ত এলাকা গৌণ।

তার উপর মানুষ নিজেকে প্রাণিজগতের সেরা সৃষ্টি বা দেবতাদের সেরা কৃপা বলে মনে করতো। জাগতিক সবকিছুই সেরা জিনিসকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হবে এটা সাধারণ যুক্তির কথা। এখনো মানুষ নিজেকে সৃষ্টির সেরা হিসেবে ভাবে। আশরাফুল মাখলুকাত নামে চমৎকার একটি টার্মও আছে মানুষকে ঘিরে। যদিও বিজ্ঞানের দিক থেকে মানুষ সব দিক থেকে সেরা নয়। মানুষের কিছু কিছু দিক আছে উন্নত আবার কিছু কিছু দিক আছে অনুন্নত। কোনো ঘটনা, সময় বা অবস্থানের প্রেক্ষিতে মানুষ সেরা আবার কোনো ঘটনা, সময় বা অবস্থানের প্রেক্ষিতে মানুষের শারীরিক গঠন ও মনন নিম্ন পর্যায়ের। যাহোক এটা আমাদের আলোচনার বিষয় নয়। তবে এটা সত্য যে মানুষ সবসময়ই নিজেকে সেরা হিসেবে ভেবে এসেছে এবং নিজেকে সেরা ভাবতে স্বছন্দ বোধ করে।

নিজেকে সেরা মনে করার প্রভাব থেকে মানুষ নিজেই নিজেদের বসিয়ে দিয়েছে বিশ্বজগতের কেন্দ্রে। কারণ নিজেরা কেন্দ্রে না থাকলে কিংবা অন্য কোনো কিছুকে কেন্দ্রে রেখে নিজেরা বাইরে থেকে ঘুরলে সেটা একদমই মর্যাদাহানিকর ব্যাপার। মহাজাগতিক মান সম্মান বলে কথা!

এরিস্টার্কাস থেকে টলেমী

এতসব প্রভাবের মাঝে থেকেও তখনকার কিছু পর্যবেক্ষণ-দৃষ্টি সম্পন্ন মানুষের নাম শোনা যায়। তাদের একজন এরিস্টার্কাস (খ্রি. পূ. ৩১০-২১০)। এই আয়োনিয়ান (গ্রীক) বিজ্ঞানী খ্রিষ্টের জন্মের অনেক আগেই বলেছিলেন পৃথিবী বিশ্বজগতের কেন্দ্রে অবস্থিত নয়। ঐতিহাসিক বিবেচনায় ধারণাটি অত্যন্ত চমকপ্রদ। এর জন্য তিনি একটি চন্দ্রগ্রহণকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। চন্দ্রগ্রহণের সময় চাঁদের উপর পৃথিবীর ছায়ার আকার নির্ণয় করে প্রাপ্ত তথ্য উপাত্তের সাহায্যে সিদ্ধান্তে আসেন, সূর্য পৃথিবীর চেয়ে অনেক বড়। ছোট জিনিস সবসময়ই বড় জিনিসকে কেন্দ্র করে ঘুরে। যেহেতু সূর্য বড় এবং পৃথিবী ছোট তাই পৃথিবী বিশ্বজগতের কেন্দ্র হতে পারে না।

শুধু তাই নয়, তিনি এও ধারণা করেছিলেন, রাতের আকাশে আমরা যে তারাগুলো দেখি সেগুলো দূরবর্তী সূর্য ছাড়া আর কিছুই নয়। আমাদের সূর্য পৃথিবী থেকে অনেক বড়, কিন্তু দূরে অবস্থান করার কারণে ছোট থালার সমান বলে মনে হয়। তেমনই তারাগুলোও হয়তো এতটাই বেশি দূরে অবস্থান করছ যে অনেক বড় হওয়া স্বত্বেও ক্ষুদ্র বিন্দু বলে মনে হয়। এরিস্টার্কাসের অনুমান আজকের আধুনিক মহাকাশবিদ্যার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। এতো প্রাচীনকালে কোনো যন্ত্রপাতি ছাড়া এমন সিদ্ধান্তে আসা সত্যিই একটি অবিশ্বাস্য ব্যাপার।

এরপর উল্লেখ করা যায় গণিতবিদ টলেমীর (আনুমানিক ৮৫-১৬৫) কথা। প্রাচীন মিশরের জ্ঞানের রাজধানী ছিল আলেক্সান্দ্রিয়া। আলেক্সান্দ্রিয়ার গণিতবিদ ছিলেন টলেমী। টলেমী বিশ্বজগৎ সম্বন্ধে তার করা পর্যবেক্ষণ ও গাণিতিক হিসাব নিকাশ থেকে বলেন, বিশ্বজগতের কেন্দ্র হলো আমাদের পৃথিবী। পৃথিবীর চারপাশেই ঘুরছে বিশ্বজগতের সবকিছু। ভুল হোক বা সঠিক হোক তিনি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণে চমৎকার একটি কাজ করেছিলেন। বিশ্বজগৎ নিয়ে তিনিই প্রথম একটি মডেল তৈরি করেন। যদিও তার মডেলে পৃথিবী ছিল কেন্দ্রে কিন্তু তারপরেও এটি মডেল এবং বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষায় মডেল গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। পরে হয়তো কোনো মডেল ভুল প্রমাণিত হতে পারে কিন্তু তার মতবাদের সাথে গাণিতিক যুক্তি কিংবা সৌরজগতের অনুমান নির্ভর একটি রেপ্লিকা (প্রতিলিপি) তৈরি করেছিলেন। তার এই মডেলটি পৃথিবীকেন্দ্রিক মডেল বা geocentric model নামে পরিচিত।

টলেমী ও টলেমীর মডেলের রেপ্লিকা। ছবিঃ westsea.com

উল্লেখ্য, টলেমীর এই মডেলটি ছিল অনেক ঝামেলাপূর্ণ ও ত্রুটিপূর্ণ। জটিল গাণিতিক হিসাব নিকাশে ভরা। এই মডেল দূরবর্তী তারকাগুলো আসলে কী তার সামান্য ধারণাও দিতে পারে না। এই মডেলে তিনি সকল তারাগুলোকে একত্রে একটি স্তর কল্পনা করেছিলেন এবং সেটিই ছিল বিশ্বজগতের সর্বশেষ স্তর। তারাগুলো ঐ স্তরে থেকেই নিজেরা নিজেদের মাঝে অবস্থান পরিবর্তন করতে পারে। তবে কখনোই অন্য স্তরে যেতে পারে না। আর তারকা স্তরের সকলটা ছিল ফাকা স্থান।

উল্লেখ্য, টলেমীর এই মডেল চার্চ মেনে নিয়েছিল এবং ধর্মীয় সমর্থন পেয়েছিল। মেনে নেবার কারণ এই মডেল বিশ্বজগৎ সম্বন্ধে বাইবেলের দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন দেয়।  তারার সর্বশেষ স্তরের বাইরে স্বর্গ ও নরকের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ জায়গা পাওয়া যায়, যা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে খুব দরকারি। ধর্মের প্রতি মানুষের স্বভাবজাত শ্রদ্ধা থাকাতে এবং এই মডেল ধর্মের সমর্থন পাওয়াতে এটি পরবর্তীতে অনেক বছর পর্যন্ত টিকে রয়েছিল।

চিত্রঃ টলেমীর দৃষ্টিতে বিশ্বজগৎ। এই মডেলে তারার স্তর ছিল বিশ্বজগতের সর্বশেষ সীমা। ছবিঃ Cosmos: A Spacetime Odyssey (2014)

কোপার্নিকান যুগ

নাম করা যায় একজন বিজ্ঞানীর যিনি অনুমান এবং কল্পনাকে পাশ কাটিয়ে পর্যবেক্ষণের আলোকে বলেছিলেন পৃথিবী সৌরজগতের কেন্দ্র নয়। সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘুরে না বরং পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরে। ষোড়শ শতাব্দীর এই বিজ্ঞানীর নাম নিকোলাস কোপার্নিকাস। তার দেয়া মতবাদ প্রথম থেকেই বাধার সম্মুখীন হয়। তাদের বক্তব্য ছিল নিজের চোখে এবং খোলা চোখেই তো দেখা যাচ্ছে সূর্য পৃথিবীর চারপাশে ঘুরছে। তাহলে কেন বলবো সূর্যই সৌরজগতের কেন্দ্র?

আর যদি পৃথিবীই ঘুরবে তবে তো ঘূর্ণনের ফলে তার বায়ুমণ্ডল মহাশূন্যে হারিয়ে যাবার কথা। তার উপর যদি পৃথিবীই ঘুরে থাকে তবে তো পাখিরা বাসা ছেড়ে উড়ে যাবার পর বাসায় আর ফিরে আসতে পারতো না। হারিয়ে যেতো। পৃথিবী যদি ঘুরে তবে তার সাথে সাথে গাছপালাও ঘুরবে। গাছপালার সাথে সাথে পাখির বাসাও ঘুরবে। তবে কীভাবে পাখিরা তাদের বাসায় ফিরে যায়? শুধুমাত্র পৃথিবী স্থির থাকলেই এরকমটা সম্ভব।

তখন পর্যন্ত এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়নি যে, বায়ুমণ্ডল পৃথিবীর অভিকর্ষে বাধা এবং পৃথিবীর ঘূর্ণনের সাথে সাথে বায়ুমণ্ডলও ঘুরছে। বায়ুর স্তরের পরে আছে শূন্যস্থান। শূন্যস্থানে কোনো কিছুর সংঘর্ষ হবার প্রশ্নই আসে না সেটা বায়ু হোক আর যাই হোক। সংঘর্ষ না হলে বায়ুর মহাশূন্যে হারিয়ে যাওয়াটাও অযৌক্তিক। বায়ুমণ্ডল পৃথিবীর সাথে সাথেই ঘুরছে। এর সাথে ঘুরছে পাখিরাও। তবে তাদের হারিয়ে যাবার প্রশ্ন কেন?

তাদের বিপক্ষে কোপার্নিকাসের যুক্তি কী ছিল? তিনি আঙুল তুলেছিলেন, যদি পৃথিবী সৌরজগতের কেন্দ্র হয় তবে কেন বছরের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ঋতু দেখা যায়? এবং কেন ঠিক এক বছর পর পর একই ঋতু ফিরে আসে? সূর্য যদি পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরতো তাহলে এরকমটা পাওয়া যাবার কথা নয়। এরকমটা ব্যাখ্যা করা যায় সূর্যের চারপাশে পৃথিবীর বার্ষিক গতির মাধ্যমে। অর্থাৎ এই সমস্যার সহজ সমাধান পাওয়া যায় যদি ধরে নেয়া হয় পৃথিবী সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে।

কোপার্নিকাসের সময়কালে চার্চের বিরুদ্ধে যায় এমন কথা উচ্চারণ করা ছিল মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার সমতুল্য। তাই কোপার্নিকাস তার সৌর-মডেল বিষয়ক বইটি প্রকাশ করেছিলেন কথোপকথন আকারে। চার্চের রোষের মুখে যেন না পড়েন সেজন্য বইটি উৎসর্গ করে দেন চার্চের একজন পাদ্রিকে। বইয়ের কথোপকথনে সূর্যকেন্দ্রিক সৌরজগতে বিশ্বাসী ব্যক্তির তুখোড় যুক্তিতে পৃথিবীকেন্দ্রিক সৌরজগতে বিশ্বাসী ব্যক্তি ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায়। বইটি প্রকাশ করেছিলেন তার জীবনের একদম শেষ পর্যায়ে। যখন বইটি মুদ্রিত হয়ে তার হাতে এসেছিল তখন তিনি বার্ধক্যের শয্যায়।  বইটি কয়েকবার নাড়াচাড়া করে দেখতে পেরেছিলেন মাত্র। এর পরপরই তিনি পরলোকগত হন।

কোপার্নিকাস

চার্চের প্রবল প্রতাপের সময় বইটি যিনি প্রকাশ করেছিলেন তার সাহস আছে বলা যায়। তবে এখানে প্রকাশক একটা কৌশল ব্যবহার করেছিলেন। কথিত আছে, প্রকাশক বইয়ের শুরুতেই বলে দিয়েছিলেন, বইয়ে ব্যবহৃত তত্ত্বগুলো সত্য নয়! এই তত্ত্বগুলোর মাধ্যমে সৌরজগতকে সহজে ব্যাখ্যা করা যায়। জটিলতার পরিমাণ কমে যায়। অপেক্ষাকৃত সহজে ব্যাখ্যা করা যায় বলে এটি প্রকাশ করা হলো। বাস্তবের সাথে এর কোনো মিল নেই।

টলেমীর মডেল প্রায় ১২০০ বছর পর্যন্ত টিকে ছিল। কোপার্নিকাসই প্রথম এর বাইরে গিয়ে মতবাদ প্রদান করেন। ষোড়শ শতাব্দীতে সৌরজগতের গঠন ব্যাখ্যায় গাণিতিক মডেলসহ তার তত্ত্ব উপস্থাপন করেন। টলেমীর মডেল যেখানে অনেক জটিলতায় পূর্ণ ছিল সেখানে কোপার্নিকাসের মডেল ছিল অপেক্ষাকৃত সরল। তার দেয়া তত্ত্বটি Heliocentrism নামে পরিচিত। হিলিয়াস অর্থ সূর্য (গ্রিকদের দেবতা), আর সেন্টার অর্থ কেন্দ্র। দুটি মিলে হেলিওসেন্ট্রিজম শব্দের অর্থ হয় সূর্যকেন্দ্রিক।

যাহোক, কোপার্নিকাস মরে গিয়ে বেঁচে গিয়েছিলেন। তিনি যদি জীবিত থাকতেন বা তার জীবনের মাঝামাঝিতে বইটি প্রকাশ করতেন তাহলে গ্যালিলিওর মতো তাঁকেও অপমানের শিকার হতে হতো। নিজের দাবীগুলোকে ভুল বলে স্বীকার না করলে বা ক্ষমা না চাইলে হয়তোবা জিওর্দানো ব্রুনোর মতো তাঁকেও পুড়িয়ে মেরে ফেলা হতো।

উল্লেখ্য, কোপার্নিকাসের মডেলেও ত্রুটি ছিল। তার মডেল অনুসারে পৃথিবী সহ সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহগুলো বৃত্তাকার কক্ষপথে ঘুরছে। কিন্তু আদতে গ্রহগুলো বৃত্তাকারে নয়, উপবৃত্তাকারে ঘুরছে। সত্যি কথা বলতে কি, তখনকার সময়ে উপবৃত্তের ধারণা এখনকার মতো এতটা প্রতিষ্ঠিত ছিল না। ঐ সময়ে বৃত্তাকার যেকোনো জিনিসকেই সুন্দর বলে মনে করা হতো। কোনো কিছু বৃত্তাকার, তার মানে হলো এটি সুন্দর ও সুস্থিত। পৃথিবীর গতিপথ উপবৃত্তাকার হতে পারে এই ভাবনাটাই আসেনি তখন। কোপার্নিকাস প্রথা বা প্রভাবের বাইরে গিয়ে বিপ্লবী একটা কাজ করে ফেলেছিলেন, কিন্তু এই তিনিই বৃত্তাকারের প্রভাবের বলয় থেকে বের হতে পারেননি।

কোপার্নিকান বৃত্তাকার মডেল। ছবিঃ chronozoom.com

টাইকো ব্রাহে ও কেপলারের যুগ
পরবর্তীতে সৌরমডেলে সর্বপ্রথম উপবৃত্তের ধারণা নিয়ে আসেন ডাচ বিজ্ঞানী জোহানেস কেপলার (১৫৭১-১৬৩০)। কেপলার ছিলেন জ্যোতির্বিদ টাইকো ব্রাহের শিষ্য। টাইকো ব্রাহে ছিলেন খুব গোছালো মানুষ। তিনি তাঁর জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত সকল পর্যবেক্ষণ লিপিবদ্ধ করে রাখতেন। তাঁর ব্যক্তিগত একটি মানমন্দির ছিল। বুঝাই যায় পর্যবেক্ষণের জন্য তিনি তখনকার সময়ে কী পরিমাণ সুবিধা পেয়েছিলেন। একটু সন্দেহবাতিকও ছিলেন, তাঁর করা পর্যবেক্ষণগুলো কেপলারকে দিতে চাইতেন না, লুকিয়ে রাখতেন। আবার অন্যদিকে কেপলারকে ছাত্র হিসেবে পেতেও চাইতেন, কারণ কেপলার মেধাবী।

১৬০১ সালে হঠাৎ করে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে টাইকো ব্রাহের মৃত্যু হয়। এর ফলে লিপিবদ্ধ পর্যবেক্ষণগুলো কেপলারের হাতে আসে। কেপলার দেখতে পান মঙ্গল গ্রহের কক্ষপথের যেসব পর্যবেক্ষণ আছে তা কিছুতেই বৃত্তাকার কক্ষপথের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যায় না। তারপর আরো পর্যবেক্ষণের পর সিদ্ধান্ত নিলেন করলেন পৃথিবী ও সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহগুলো উপবৃত্তাকার কক্ষপথে সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরে। গ্রহদের এই ঘূর্ণন সংক্রান্ত ৩ টি সূত্রও প্রদান করেন। একদম পাক্কা আধুনিক বিজ্ঞানীর মতো কাজ। কোনো ঘটনা গাণিতিকভাবে প্রমাণ হয়ে গেলে তাকে আর সহজে বর্জন করা যায় না।

এখানেও উল্লেখ্য যে, কেপলার বিশ্বাস করতেন গ্রহগুলোর অনুভূতি ও চেতনা আছে। অর্থাৎ এদের প্রাণ আছে। এরা কোনো এক সত্তার আদেশে নিয়মতান্ত্রিকভাবে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে। গ্রহগুলো কেন ঘুরছে এবং কোন শক্তির প্রভাবে ঘুরছে সে ব্যাখ্যা কেপলার দিতে পারেনি।

নিউটন-আইনস্টাইনের যুগ
পরবর্তীতে পদার্থবিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটন তার মহাকর্ষ সূত্রে এর কারণ ব্যাখ্যা করেছিলেন। নিউটন তাঁর মহাকর্ষ সূত্রের মাধ্যমে কেন এবং কীভাবে গ্রহগুলো সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ ব্যাখ্যা প্রদান করেন। পরবর্তীতে দেখা গেল তাঁর দেয়া মহাকর্ষের সূত্র সৌরজগতের বাইরে অন্যান্য গ্রহের কক্ষপথের বেলায়ও সঠিক। এই সূত্রের সাহায্যে জোয়ার-ভাটার কারণ পর্যন্ত ব্যাখ্যা করা যায়। এমনকি এর সাহায্যে পৃথিবীতে বসেই চাঁদের ঘূর্ণন বেগ বের করেছিলেন নিউটন।

চাঁদ কেন ঝুলে আছে? চাঁদ কেন পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করছে? বস্তুগুলো যদি পারস্পরিকভাবে একে অপরকে আকর্ষণ করে তাহলে চাঁদ কেন পৃথিবীর আকর্ষণে পড়ে যাচ্ছে না? তিনি হিসাবের মাধ্যমে দেখালেন চাঁদ আসলে পৃথিবীতে পড়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর আকর্ষণের কারণে সর্বদাই পড়ে পড়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই বল ও বেগের পাশাপাশি চাঁদে আরো একটি বেগ কার্যকর। চাঁদ পৃথিবী থেকে বহির্মুখী একটা বলে সর্বদা পৃথিবী থেকে বাইরের দিকে ছুটছে। সূর্যকে কেন্দ্র করে গ্রহ যখন তৈরি হয় কিংবা মহাজাগতিক সংঘর্ষে পৃথিবীর পাশে চাঁদ যখন তৈরি হয় তখন থেকেই বাইরের দিকে এই বেগ কার্যকর ছিল। চাঁদের উপর পৃথিবীর আকর্ষণ বল এবং বাইরের দিকে বহির্মুখী বল পরস্পর কাটাকাটি যাচ্ছে। কাটাকাটি যাবার ফলে এটি একূল ওকূল না গিয়ে চারপাশে ঘুরছে। [এই প্রক্রিয়ার পেছনের পদার্থবিজ্ঞান কী তার সম্বন্ধে বিস্তারিত জানতে চাইলে দেখুন বিজ্ঞান ব্লগের ‘নিউটনের কামানে চড়ে কক্ষপথে’ লেখাটি।]

চাঁদের ঘূর্ণন বেগ কত হলে তা পৃথিবীর আকর্ষণ দ্বারা নাকচ হতে পারে তা অংকের মাধ্যমে হিসাব করে বের করলেন নিউটন। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো পরবর্তীতে জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের পরিমাপকৃত বেগের সাথে তাঁর নির্ণয় করা বেগ একদম মিলে যায়। একেই বলে গণিতের শক্তি। বেশিরভাগ সময়েই গণিত অকাট্য হয়।

নিউটনের তত্ত্ব এখনো নির্ভুলভাবে আছে। এখনো পড়ানো হয় দেশে দেশে বিজ্ঞানের সিলেবাসে। তবে বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে হলেও সার্বিক বিবেচনায় নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্ব তার নির্ভুলতা হারায়। মহাকর্ষকে নির্ভুলভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য পরবর্তীতে অ্যালবার্ট আইনস্টাইন তার সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব (General Theory of Relativity) প্রদান করেন। আইনস্টাইনের তত্ত্বটি জটিল হলেও এখন পর্যন্ত এটিই সবচেয়ে নির্ভুল তত্ত্ব। এই তত্ত্ব প্রদান করার পর অনেকবার এর সত্যতা যাচাই করে দেখা হয়েছিল। সকল ক্ষেত্রেই এর নির্ভুলতা প্রমাণিত হয়েছে।

আধুনিক যুগ
এরপর চলে আসে মহাবিশ্বের উৎপত্তি প্রসঙ্গ। ইতিহাসের সমস্ত সময় জুড়েই ছিল ঐশ্বরিক ধারণার প্রভাব। দেব-দেবতারা মানুষের জন্য জগৎ সৃষ্টি করে দিয়েছে এবং মানুষ এতে বসবাস করছে এর বাইরে যাওয়া বলতে গেলে অসম্ভবই ছিল। এর মানে হচ্ছে আজকে আমরা মহাবিশ্বকে যেমন দেখছি একশো বছর এক হাজার বছর এক লক্ষ বছর আগেও এরকমই ছিল। আজ থেকে শত হাজার লক্ষ বছর পরেও এরকমই থাকবে। মহাবিশ্বের এরকম ধারণার নাম স্টিডি স্টেট মহাবিশ্ব। এর বাইরে চিন্তাভাবনা করা উচ্চ ও আধুনিক দার্শনিকতার দাবী রাখে বলে ইতিহাসের প্রায় পুরোটা সময় জুড়েই স্থিতিশীল মহাবিশ্ব জায়গা করে নিয়েছিল। কারণ এর বাইরে চিন্তা করতে গেলে পর্যবেক্ষণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা তথ্য উপাত্ত লাগবে। আধুনিক টেলিস্কোপ ছাড়া এরকম ভাবনা নিয়ে খেলা করা তো প্রায় অসম্ভবই বলা যায়।

পরবর্তীকালে বিগ ব্যাং তত্ত্বের মাধ্যমে এর গণ্ডি ভাঙে। প্রায় একশত বছরের অনেক আগে থেকেই বিগ ব্যাং তত্ত্ব প্রচলিত ছিল, কিন্তু কারো নজর তেমন কাড়েনি। পরবর্তীতে এডুইন হাবল তাঁর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এর সত্যতা খুঁজে পান। এরপর রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যায় এই তত্ত্বটি।

বিগ ব্যাং থিওরি বা বৃহৎ বিস্ফোরণ তত্ত্ব মতে মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়েছিল ক্ষুদ্র বিন্দুবৎ অবস্থা থেকে। বিস্ফোরণের ফলে ধীরে ধীরে এটি প্রসারিত হয়। প্রসারিত হতে হতে অনেক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে আজকের এই অবস্থানে এসে পৌঁছেছে। ভবিষ্যতে আবার এই অবস্থার পরিবর্তন হয়ে যাবে।

বর্তমান কালের জনপ্রিয় বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং তাঁর ‘কালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস (A Brief History Of Time)’ বইতে বিগ ব্যাং থিওরির উপর যুক্তি দিয়েছেন। সাম্প্রতিক কালে NASA কর্তৃক উৎক্ষেপিত হাবল টেলিস্কোপের পাঠানো বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত ও ছবি বিগ ব্যাং থিওরির সত্যতা প্রমাণ করে যাচ্ছে। বিগ ব্যাং থিওরিই সর্বপ্রথম প্রসারমাণ মহাবিশ্ব সম্বন্ধে ধারণা প্রদান করে আমাদের।

তবে এর কিছু সীমাবদ্ধতাও আছে। বিগ ব্যাং তত্ত্ব প্রদান করার পর থেকে মহাবিশ্বকে ভালোভাবেই ব্যাখ্যা করতে পারছিল। এবং এর সত্যতার পেছনে সমর্থন দেবার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ তথ্য-প্রমাণও আছে। তবে প্রচুর তথ্য-প্রমাণ ও সমর্থন থাকলেও তা সকল প্রশ্ন বা সমস্যার সমাধান দিতে পারে না। যেমন মহাবিশ্বের একদম প্রাথমিক পর্যায়ে অতি-ছোট বিন্দুবৎ অবস্থায় থাকার সময়ের ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না বিগ ব্যাং তত্ত্বের মাধ্যমে।

যখন থেকে বিগ ব্যাং তত্ত্বের এই সীমাবদ্ধতা ধরা দেয় তখন থেকেই এর বিকল্প তত্ত্ব অনুসন্ধান শুরু হয়। সময়ে সময়ে মহাবিশ্বকে পরিপূর্ণভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য বেশ কয়েকটি জটিল তত্ত্ব প্রস্তাবও করা হয়। এর মাঝে একটি হচ্ছে বিগ বাউন্স তত্ত্ব। এই তত্ত্ব আজ থেকে অনেক আগেই প্রস্তাবিত হয়েছিল। তবে প্রস্তাবিত হলেও যথেষ্ট গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। তবে সাম্প্রতিক কিছু গবেষক এটি নিয়ে কাজ করে একে অধিকতর উপযুক্ত হিসেবে উপস্থাপন করেছেন এবং বলছেন মহাবিশ্বকে ব্যাখ্যা করার জন্য এটি বিগ ব্যাং এর চেয়েও বেশি কার্যকর।

এই তত্ত্ব অনুসারে মহাবিশ্ব কোনো একটি বিন্দুবৎ অবস্থা থেকে বিস্ফোরণের মাধ্যমে তৈরি হয়নি। মহাবিশ্ব চিরকালই অস্তিত্ববান ছিল। এই তত্ত্ব শুনতে অনেকটা স্থির মহাবিশ্ব তত্ত্বের মতো হলেও এটি স্থির মহাবিশ্বকে বাতিল করে দেয়।

এই তত্ত্ব অনুসারে মহাবিশ্ব সংকোচন ও প্রসারণের চক্রের মাধ্যমে চলছে। অনেকটা বেলুনের মতো, খুব স্থিতিস্থাপক কোনো বেলুনকে ফোলালে ফুলতে ফুলতে একসময় তা ক্রান্তি অবস্থানে এসে পৌঁছাবে। তারপর অল্প অল্প করে বাতাস চলে যেতে দিলে তা ধীরে ধীরে সংকুচিত হবে। সর্বনিম্ন পরিমাণ সংকোচনের পর তা আবার প্রসারিত হওয়া শুরু করবে। বিগ বাউন্স অনুসারে মহাবিশ্ব অনেকটা এরকমই। চক্রাকারে সংকুচিত হচ্ছে এবং প্রসারিত হচ্ছে। যখন সংকোচনের ক্রান্তি পর্যায়ে চলে আসে তখন কোয়ান্টাম মেকানিক্সের কিছু নিয়মের প্রভাবে আরো সংকোচিত হয়ে ক্ষুদ্র বিন্দু বা সিঙ্গুলারিটি তৈরি করতে পারে না। ঐ অবস্থান থেকে আবার প্রসারণ শুরু হয়ে যায়।

পরিশিষ্ট
এখানে আরো একজন মহান বিজ্ঞানীর কথা উল্লেখ না করলেই নয়। তিনি হলেন গালিলিও গ্যালিলি। তিনিই নভো দূরবীক্ষণ যন্ত্র বা টেলিস্কোপ নির্মাণ করেছিলেন, আজ থেকে ৪০০ বছর আগে ১৬০৯ সালে। নতুন তৈরি করা টেলিস্কোপ চোখে লাগিয়ে দেখতে লাগলেন চাঁদ, সূর্য ও অন্যান্য গ্রহ নক্ষত্র। এর সাহায্যে চাঁদের বুকে পাহাড়-পর্বত ও নানা রকম খানাখন্দ দেখতে পেলেন। সূর্যের গায়ে খুঁজে পেলেন কালো কালো দাগ। ১৬১০ সালে বৃহস্পতি গ্রহ পর্যবেক্ষণের সময় দেখতে পেলেন চারটি বস্তু। এগুলো বৃহস্পতির চাঁদ (উপগ্রহ) এবং এরা বৃহস্পতির চারপাশে ঘুরছে।

তখনো পৃথিবীকেন্দ্রিক সৌরজগতের ধারণাই প্রবল ছিল। কিন্তু তিনি তো নিজের চোখে দেখলেন সবকিছু পৃথিবীর চারপাশে ঘুরছে না। বৃহস্পতি এর জ্বলন্ত প্রমাণ। তাই তার পর্যবেক্ষণের কথা জানালেন সবাইকে। আর সবাই কেন তার কথা মেনে নিবে? ফলে সকলে বলতে লাগলো, গ্যালিলিও নামের এই লোকটা মাথায় ছিট আছে। হয়তো মানসিক সমস্যায় পড়ে এসব উল্টাপাল্টা জিনিস দেখছে।

তাদেরকে ডেকে এনে টেলিস্কোপে চোখ লাগিয়ে দেখালে তারা বলে হয়তো যন্ত্রের মাঝে সমস্যা আছে। চাঁদের মতো সুন্দর জিনিসে খানাখন্দ খালবিল পাহাড় পর্বত কীভাবে থাকবে? সূর্যে কালো দাগ থাকা মানে তো কলঙ্ক হয়ে যাওয়া।

তার এই মতবাদে রোমান ক্যাথলিক চার্চ খুবই নাখোশ হয়। চার্চ তার এই মতবাদ তো গ্রহণ করেইনি উপরন্তু বৃদ্ধ বয়সে গ্যালিলিওকে অমানুষিক শাস্তি দিয়েছিল। জোর করে তাকে বলিয়েছিল এর সব মিথ্যা। নিজ মতামতকে মিথ্যা বলতে এবং বাইবেলের সাথে সামঞ্জস্য নয় এমন কথা বলাতে ক্ষমা প্রার্থনার জন্য তাকে বাধ্য করা হয়েছিল। বাধ্য না হলে হয়তো তার গর্দান চলে যেত কিংবা তাকে পুড়িয়ে মারা হতো।

কথিত আছে প্রহসন মূলক ক্ষমা প্রার্থনার নাটক ও শাস্তির পর অসুস্থ গ্যালিলিও বিড়বিড় করে বলেছিলেন ‘Eppur si muove’। এর বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘কিন্তু এটি (পৃথিবী) এখনো ঘুরছে।’। অর্থাৎ আমি নিজেও যদি মুখে হাজার বার বলি ‘পৃথিবী স্থির’ তারপরও এটি ঘুরেই চলবে।

কালের প্রবাহে কালের মঞ্চে অনেক নাটকই প্রদর্শিত হয়। কালের শত শত বছরের অতিক্রমের পর দেখা যায় প্রায় ২৮০ বছর পর ১৯৯২ সালে ক্যাথলিক চার্চ স্বীকার করেছে, গ্যালিলিও নির্দোষ ছিলেন। গ্যালিলিওকে দোষী সাব্যস্ত করাটা ভুল ছিল। চার্চ যে এর জন্য তাদের ভুল স্বীকার করেছে এটাই তো অনেক কিছু। এরকম প্রতিষ্ঠান থেকে এরকম কিছু আশা করা যায় না সচরাচর।

প্রসঙ্গক্রমে একটা কথা বলা দরকার। আগে ল্যাটিন ছিল আভিজাত্যের ভাষা। ল্যাটিন ছাড়া অন্য ভাষায় কেউ লিখলে তাকে ভালো লেখক বলে গণ্য করা হতো না।  গ্যালিলিওই প্রথম পণ্ডিতদের ভাষা ল্যাটিনকে বর্জন করে মাতৃভাষায় বিজ্ঞান বিষয়ক রচনা লিখেছিলেন। আমাদের বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে এটা গুরুত্বপূর্ণ একটা বার্তা। বাংলাভাষায় বিজ্ঞানচর্চা অন্য ভাষার মতো বেশি একটা হয় না। ছাত্ররা বাংলায় লেখা বিজ্ঞান বইয়ের অভাব অনুভব করে। এর জন্য বাংলা ভাষায় প্রচুর বিজ্ঞান চর্চা দরকার।

তবে আশার কথা বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা দিন দিন বেড়ে চলছে। এই ধারায় চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে সত্যিই সমৃদ্ধ হয়ে যাবে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা। অন্তত গাণিতিক বাস্তবতা তা-ই বলে।

তথ্যসূত্র

  1. মহিমান্বিত নকশা (The Grand Design), স্টিফেন হকিং ও লিওনার্ড ম্লোডিনো, (অনুবাদ আশরাফ মাহমুদ), দিনরাত্রি প্রকাশনী।
  2. আবিষ্কারের নেশায়, আব্দুল্লাহ আল-মুতী, অনুপম প্রকাশনী।
  3. ইউডক্সাসের গোলক ও অন্যান্য প্রসঙ্গ, ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী, শুদ্ধস্বর, ২০১৩
  4. মহাকাশে কী ঘটছে, আব্দুল্লাহ আল-মুতী, অনুপম প্রকাশনী।
  5. বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ১০০ মনীষীর জীবনী (The 100), মাইকেল এইচ. হার্ট।
  6. বিগ ব্যাং নাকি বিগ বাউন্স, বিজ্ঞান পত্রিকা।
  7. http://sciencelearn.org.nz/Contexts/Satellites/Looking-Closer/Our-solar-system-revolutionary-ideas
  8. http://www.tiki-toki.com/timeline/entry/76343/Astronomy-Model-Timeline/
  9. https://en.wikipedia.org/wiki/Copernican_Revolution

-সিরাজাম মুনির শ্রাবণ
সহ-সম্পাদক, বিজ্ঞান ব্লগ
[লেখকের ফেসবুক প্রোফাইল]

Exit mobile version