[বইটির সূচীপত্র এবং সব খন্ডের লিংক একত্রে দেখুন এখানে]
এক
বিজ্ঞানের সাথে বিপ্লব ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। সেটা আজ থেকে নয়, সেই গ্রিক সভ্যতার আমল থেকেই। অ্যারিস্টোটল বলেছেন সুর্য পৃথিবীর চারপাশে ঘুরছে। অ্যারিস্টার্কাস বললেন উল্টো কথা। সূর্য নয় পৃথিবীই সূর্যের চারপাশে ঘুরছে। অ্যারিস্টটোলের বাণী তখন ধর্মের মতো। তিনি যেটা বলতেন সেটাই ঠিক। তাঁর কথাটা যাচাই করে দেখার কথা কেউ ভাবেননি। অ্যারিস্টার্কাস ভেবেছিলেন। তবে দলে তিনি একা। তাঁর কথা কেউ বিশ্বাস করেনি। অ্যারিস্টোটলের ভুল মতকেই যুক্তির ছাঁচে ঢেলে সাজান টলেমি। খ্রিস্টের জন্মের প্রায় দুই শতাব্দী পর পৃথিবীকেন্দ্রিক মহাবিশ্বের একটা মডেল তৈরি করলেন তিনি। অ্যারিস্টোটল-টলেমির মতে প্রভাবিত হয় খ্রিস্টধর্মও। তাই তাঁদের বিরোধিতা করা মানে ধর্মের বিরোধিতা করা। এমনই চরমে পৌঁছালো অপবিজ্ঞানের গোঁড়ামি।
তারপরেও বিজ্ঞান থেমে থাকেনি। মধ্যযুগে কোপার্নিকাসের জন্ম হলো। অ্যারিস্টোটল-টলেমিদের অপবিজ্ঞানের ভিত তিনি নাড়িয়ে দিলেন। তিনি বললেন, সূর্য নয়, পৃথিবীই ঘুরছে সূর্যের চারপাশে। আর পৃথিবী সূর্য কেউই নয় মহাবিশ্বের কেন্দ্র। কেপলারের কথাও কেউ শুনতে চাইল না। কোপার্নিকাস নিজেও ধর্মনেতাদের রোষে পড়তে চাননি। তাই তাঁর সব তত্ত্ব প্রকাশ হলো তাঁর মৃত্যুর আগমুহূর্তে।
কোপার্নিকাসের বই কেউ কেউ হয়তো পড়ল, কিন্তু বুঝল কজন! তারচেয়ে বড় কথা বিশ্বাসই করল না কেউ। বোধহয় ভুল হলো কথাটা। একজন বুঝেছিলেন। তিনিও তরুণ এক পাদ্রি। জিয়োর্দানো ব্রুনো। কোপার্নিকাসের বই তাঁর জ্ঞানচক্ষু খুলে দিল। তিনি ভাবলেন গোটা মহাবিশ্বে আমাদের এই পৃথিবী নিতান্ত তুচ্ছ এক গ্রহ মাত্র। আপাত দৃষ্টিতে ভাবনা সরল মনে হতে পারে। কিন্তু এই ভাবনা প্রচার করতে গিয়ে ভিত নড়ে গেল অন্ধ পাদ্রি আর পোপদের ভুল ব্যাখ্যার। তারা ভীত হয়ে পড়ল। কে, এই ছেলে? এ তো পাদ্রী নয়, এর হতে খ্রিস্ট ধর্ম বিনাশ হবে। এখনই ওকে থামাতে না পারলে সরে যাবে ধর্মগুরুদের পায়ের নিচের মাটি। সুতারং ওকে থামাতে হবে। কিন্তু সে তরুণ দুর্বার, প্রাণনাশের হুমকি-ধামকিতে সে থামলো না। শেষ পর্যন্ত তাঁকে মৃত্যুদ-াদেশ দেওয়া হলো। সেই দন্ডের বোঝা মাথা নিয়েই সে ঘুরে বেড়ালো গোটা ইউরোপে। আলো ছড়াতে ছড়াতে। তখন ভীত ধর্মগুরুরা ছলনার আশ্রয় নিয়ে ধরে ফেলল ব্রুনোকে। রোমের রাজপথে হাজার হাজার লোকের সামনে তাঁকে জীবন্তু পুড়িয়ে মারা হলো। সেই হাজার নির্বোধ লোকেরা প্রতিবাদ করল না। বুঝল না জ্ঞানের মহিমা।
কিন্তু আরেকজন ঠিকই ঘরে বসে জ্ঞানের আলোটা গায়ে-গতরে বাড়িয়ে মশাল বানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তিনি গ্যালিলিও গ্যালিলি। তিনি শুধু প্রচারেই সীমাবদ্ধ থাকলেন না। পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে দেখালেন কোপার্নিকাস ব্রুনোর মত অভ্রান্ত। তিনি নিজেও তো কতকিছু জুড়লেন তাঁর সাথে। দাঁড়িয়ে গেল পদার্থবিজ্ঞানের সত্যিকারের ভিত। কিন্তু পোপের শ্যেণ দৃষ্টির আড়ালের থাকতে পারলেন না। নির্বোধ ধর্মগুরুরা তাঁকে দিয়ে ক্ষমা-ভিক্ষা চাইয়ে ছাড়ল। বলিয়ে নিল, তিনি যা বলেছেন সব ভুল! ভুল বললেই তো আর প্রকৃতির নিয়ম পাল্টে যাবে না। যাইওনি। গ্যালিলিও ওপরে ওপরে ভুল স্বীকার করলেন ঠিকই, তবে তলে তলে তাঁর গবেষণা চালিয়ে গেলেন।
ধর্মগুরুদের কাছে সে খবরও গোপন রইল না। তারা গালিলিওর বিচার করলেন, কারাদ- দিলেন। ছোট্ট, নিচু এক ঘরে, যে ঘরে সোজা হয়ে দাঁড়ানো যায়, সেই ঘরে বড় কষ্টে, খেয়ে না খেয়ে, অসুখে জর্জরিত হয়ে ৮ বছর নিঃসঙ্গ নিষ্কর্ম অবস্থায় কাটিয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন মহান বৈজ্ঞানিক। তবে যে বিপ্লবের সুচনা হয়েছিল কোপার্নিকাসের হাত ধরে, ব্রুনোর হাতে তা আলোর মিছিল হয়ে প্রজ্জ্বলিত হলো, তাঁর সফল ভিত্তিভূমি তৈরি হলো গ্যালিলিওর হাতে। ধর্মের খোলস ছেড়ে বিজ্ঞান পেল আলাদা স্বত্ত্বা। বিজ্ঞানের সেই ভিত্তিভূমিকে গণিতের ছাঁচে ফেলে, পরীক্ষা-নিরিক্ষা আর প্রমাণের সাহায্যে সত্যিকারের কাঠামোবদ্ধ করে গেলেন নিউটন। পরের দুশো বছর নিউটনের ওই কাঠামোর ভেতরে আবদ্ধ থেকেই এগিয়ে গেল বিজ্ঞান।
কিন্তু দু’শো বছর পর বিজ্ঞানে ঘটল আরেকটি বিপ্লব। সেটা স্কটিশ বিজ্ঞানী জেমস ক্ল্যার্ক ম্যাক্সওয়েলের হাত ধরে। তবে এবার আর ধর্মের সাথে বিদ্রোহ নয়। এাবারের লড়াইটা বিজ্ঞানের সাথে বিজ্ঞানের। বিজ্ঞানের সেই দ্বিতীয় বিপ্লবের কাহিনীতে যাবার আগে ম্যাক্সওয়েলকে একটু চিনে নেওয়া ভালো।
দুই
ম্যক্সওয়েলের জন্ম ১৮৩১ সালের ১৩ নভেম্বর। স্কটল্যান্ডের রাজধানী এডিনবরায়। বিখ্যাত এবং শিক্ষিত এক পরিবারে। বাবা জন ক্ল্যার্ক ম্যাক্সওয়েলই জেমসকে ছোটবেলা থেকে গড়েপিটে মানুষ করেন। তিনি পড়াশোনা করেছিলেন আইনে। কিন্তু কোনদিন কোর্টে যাননি কোনো কেসের সুরহা করতে। পারিবারিক সম্পত্তি ছিল বেশ। সেগুলো দেখাশোনা করতেন। তবে জেমসই তাঁর ধ্যান-জ্ঞান।
তিন বছর বয়সী জেমসের সব কিছুতেই আগ্রহ। বিশেষ করে যন্ত্রপাতি আর পোকামাকড়ের প্রতি। বিভিন্ন যন্ত্রের ক্রিয়াকৌশল সম্পর্কে প্রশ্ন করে বাবাকে ব্যতিব্যস্ত রাখত। বাবা জন ম্যাক্সওয়েল তাতে বিরক্ত বোধ করতেন না। ছেলেকে বরং বুঝিয়ে দিতেন সহজভাবে। শিশু ম্যাক্সওয়েল নানারকম পোকামাকড় ধরে নিয়ে আসত ঘরে। পোষার জন্য। কিন্তু বেচারা পোকামাকড়েদের তখন বেহাল দশা। খাওয়া-দাওয়া বন্ধ। পোকামাকড়দের কষ্ট দেখে সেগুলোকে আবার ছেড়ে দিতেন জেমস ম্যাক্সওয়েল।
নয় বছর বয়সে মাকে হারান ম্যাক্সওয়েল তখন বাবার সাথে ঘনিষ্ঠতা আরও বাড়ে। তাঁকে ভর্তি করানো হয় এডিনবরা অ্যাকাডেমিতে। কিন্তু অসুখ চিনে জোঁকের মত শেকড় গেঁড়ে বসে ম্যাক্সওয়েলের শরীরে। প্রায়ই অসুখে ভুগতেন। স্কুল কামাই হত। পরে অবশ্য ঠিক হয়ে যায়।
ছোটবেলা থেকেই জ্যামিতিতে খুব ভাল ছিলেন। জটিল সব জ্যামিতির ছবি শুধু ছবি দেখেই নিখুঁত মাপে আঁকতে পারতেন। জন ম্যাক্সওয়েল প্রায়ই জেমস ম্যাক্সওয়েলকে রয়্যাল সোসাইটিতে নিয়ে যেতেন। যাওয়া-আসার এক পর্যায়ে রয়্যাল সোসাইটির বিজ্ঞানীর সাথে পরিচয়। জেমস ম্যাক্সওয়েল তাদের সান্নিধ্যে এসে উদ্বুব্ধ হন। এরই মাঝে তিনি আবিষ্কার করে ফেলেন উপবৃত্ত নির্ণয়ের নতুন এক পদ্ধতি। কম্পাসের সাহায্য ছাড়াই। শুধু একটা আলপিন আর একটুকরো সুতোর সাহায্যে। বয়স তখন মাত্র চোদ্দ। সেই বয়সেই কাচের বক্রতলে আলোর প্রতিসরণ নিয়ে রীতিমতো গবেষণা শুরু করে দেন ম্যাক্সওয়েল। তাঁর প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে রয়্যাল সোসাইটির এক সভায় তাঁকে ডাকা হয়। সেখানে ম্যাক্সওয়েলে দেখান কীভাবে আলপিন আর সুতোর সাহায্যে উপবৃত্ত আঁকা যায়।
ষোলো বছর বয়সে ম্যাক্সওয়েল ভর্তি হন এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ততদিনে তার গণিত প্রতিভার সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে। ১৮৫০ সালে তিনি এডিনবরা ছাড়েন। ভর্তি হন ক্যাম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্রিনিটি কলেজে। সেই বিখ্যাত ট্রিনিটি কলেজ। এই কলেজেই পড়াশোনা করেছিলেন স্যার আইজ্যাক নিউটন।
ছাত্র হিসেবে খুব ভাল ছিলেন ম্যাক্সওয়েল। তবে শান্ত-শিষ্ট ছিলেন না। হই-হুল্লোড় করতেন। ঘুম নিয়ে করতেন পরীক্ষা-নিরীক্ষা। তাতে অন্যের ঘুমের বারোটা বেজে যেত।
ট্রিনিটি কলেজে খুভ ভাল করলেন। সেখানেই গবেষণা শুরু করেন। শুরু হলো আলোকবিদ্যার ওপর তাঁর কাজ। তিনিই প্রথম দেখালেন লাল সবুজ আর নীল রঙের মিশ্রণে অনেক রং পাওয়া যায়। এদের মিশ্রণের অনুপাতের ওপর নির্ভর করে মিশ্রণের পর কোন রংটি পাওয়া যাবে। তিনি আরেকটা ব্যাপারও দেখালেন। নীল আর হলুদ আলোর মিশ্রণ ঘটিয়ে গোলাপি আলো পাওয়া যায়। কিন্তু নীল আর গোলাপি রং মিশিয়ে কখনও হলুদ রং পাওয়া সম্ভব নয়। বর্ণান্ধতা নিযে তাঁর গবেষণা উল্লেখ করার মতো। এজন্য তিনি রয়্যাল সোসাইটি থেকে রামসর্ফোড পদক লাভ করেন।
১৮৫৬ সারে ক্যামব্রিজ ছাড়লেন ম্যাক্সওয়েল। সেখান থেকে চলে গেলেন অ্যাবারডিনে। মরিশ্চিল কলেজে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিলেন। ওই কলেজের প্রিন্সিপালের মেয়ে ছিলেন ক্যাথেরিন মেরি। তাঁকে বিয়ে করলেন ম্যাক্সওয়েল। ১৮৬০ সালে ম্যাক্সওয়েল ছাড়েন সেই কলেজ । চলে যান লন্ডনের বিশ্বখ্যাত কিংস কলেজে। গণিত, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন সব তাঁকে পড়াতে হত ছাত্রদের।
শনিগ্রহের বলয় নিয়ে কাজ করেছেন ম্যাক্সওয়েল। তবে ম্যাক্সওয়েল বলেছিলেন শনির উপগ্রহের ঘূর্ণণের কারণেই বলয় তৈরি হয়েছে। আগে মনে করা হত শনির বলয় বুঝি নিরেট। ম্যাক্সওয়েল বললেন সেটা নিরেট নয়। এখন আমরা জানি, ম্যাক্সওয়েলও ঠিক বলেননি। শনির বলয় আসরে পুঞ্জিভূত গ্যাসের বলয়। তবে নিরেট নয়, একথাটা ঠিক।
গ্যাসের গতিতত্ত্ব নিয়ে কাজ করেছেন জেমস ম্যাক্সওয়েল। একটা নির্দিষ্ট তাপে গ্যাসের অণুগুলি কী অনুপাতে থাকে তা হিসাব করে বের করেছিলেন তিনি। তবে ম্যাক্সওয়েলের বড় আবিষ্কার তাঁর তড়িচ্চুম্বকীয় সমীকরণগুলো। সেগুলো নিয়ে আলোচনা করব আমরা এই অধ্যায়ের শেষাংশে।
১৮৬৫ সালে ম্যাক্সওয়েলের বাবা মারা যান। এই বিষয়টাতেই অনেক কষ্ট পেলেন তিনি। কিংস কলেজ ছেড়ে ফের ফিরে গেলেন স্কটল্যান্ডের পৈত্রিক সম্পত্তি দেখাশোনার করতে। পাশাপাশি গবেষণাও চালিয়ে গেলেন। তাপগতিবিদ্যা, দৃষ্টিবিজ্ঞান ও সাধারণ পদার্থবিদ্যার ওপর বেশ কিছু পাঠ্যবই লিখলেন। মাঝে মাঝে অবশ্য ক্যামব্রিজে যেতেন। সে শুধু ছাত্রদের পরীক্ষা নিতে।
কবিতা ভালবাসতেন ম্যাক্সওয়েল। ছোট বেলা থেকেই কবিতা পড়তেন। লিখতেনও। পাড়ার ছোট ছোট শিশুদের সাথে তার ভারি ভাব ছিল। তাদের সাথে খেলতে ভালবাসতেন।
১৮৭১ সারে ক্যামব্রিজের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপকের পদটা খালি হয়। ডাক আসে ম্যাক্সওয়েলের। সেই ডাক ফিরিয়ে দেননি। ফিরে যান নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে। সেখানে একটা গবেষণাগার করতে চাইলেন ম্যাক্সওয়েল। বড় ও বিশ্বমানের গবেষণাগার। কিন্তু টাকা তো চাই। কে দেবে? এগিয়ে এলেন আরেক বিখ্যাত বিজ্ঞানী হেনরি ক্যাভেনডিশের পরিবার। সাথে আরেক ধর্ণাট্য ব্যক্তি ডেভনশায়ার ডিউক। তাদের আর্থিক সহায়তায় ক্যামব্রিজে তৈরি হলো বিখ্যাত ক্যাভেনডিশ ল্যাবরেটরি। পরিচালক হলেন ম্যাক্সওয়েল। এই গবেষণাগার পরবর্তীতে সারাবিশ্বের তরুণ বিজ্ঞানীদের স্বপ্নের ল্যাবরেটরিতে পরিণত হয়।
হেনরি ক্যাডেনভিশের অনেকগুলো গবেষণাপত্র ছিল বিদ্যুতের ওপর। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সেসব গবেষণাপত্র একাত্রিত করলেন ম্যাক্সওয়েল। খুব যত্ন সহকারে সম্পাদনা করে একটা সংকলন প্রকাশ করলেন সেগুলোর।
জীবনের শেষ সময়টা বড় কষ্টে কেটেছে ম্যাক্সওয়েলের। তাঁর স্ত্রী অসুস্থ। তাঁকে সেবা করতেই দিন কেটে যায়। ততদিনে তাঁর নিজের শরীরেও বাসা বেঁধেছে ঘাতক ব্যধি ক্যান্সার। কিন্তু নিজের অসুখ লুকিয়ে স্ত্রীর সেবা করে গেছেন। গবেষণাও চালিয়ে গেছেন। তবে সব কিছুরই তো শেষ আছে। ১৮৭৯ সালে ৫ নভেম্বর মাত্র ৪৮ বছর বয়সে পৃথিবী ছেড়ে চলে যান ঊনবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে প্রতিভাধর বিজ্ঞানী।
তিন
১৮৬৪ থেকে ১৯৮৪ সাল, এই দশ বছর ম্যাক্সওয়েল বিজ্ঞানের দ্বিতীয় বিপ্লবের কাজে নিয়োজিত ছিলেন। এই সময়েই তিনি ফ্যারাডের বিদ্যুৎ ও চুম্বক বররেখা ও ক্ষেত্রতত্ত্ব নিয়ে কাজ করেন। তিনি ফ্যারাডের চুম্বক ও তড়িৎক্ষেত্রের মধ্যে সম্পর্ক নির্ণয়ের জন্য চারটি সমীকরণ নির্ণয় করলেন। সেই সমীকরণ থেকই বেরিয়ে এলো তড়িচ্চুম্বকের ধারণা। ম্যাক্সওয়েল আরো দেখালেন, সাধারণ আলোও একপ্রকার তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ। সাধারণ আলোর বাইরেইও যেসব তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ রয়েছে সেগুলোও আলো বৈ কিছু নয়। নিউটন আলোক বর্ণালীর জনক। সেই বর্ণালীর সীমা বেনিআসহকলা-তে সীমাব্ধ। বেনিআসহকলা মানে বেগুনি, নীল, আসমানী, সবুজ, হলুদ, কমলা ও লাল সাতটি রংয়ের আদ্যক্ষর। সূর্যের সাদা আলেঅর ভেতর এই ক্রমেই লুকিয়ে থাকে সাতটি রং। রংধনুর সাতরংয়ের বিন্যাসও এই ক্রমে। এটাকে নিউটনের বর্ণালি বলে। এই বর্ণালির সর্বোচ্চ সীমা হচ্ছে লাল আলো। এর তরঙ্গদৈর্ঘ্য সবচেয়ে বেশি। আর সর্বনি¤œ তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেগুনি আলোর। কিন্তু ম্যাক্সওয়েল দেখালেন বর্ণালীর সীমা শুধু দৃশ্যমান আলোকেই সমীবদ্বধ নয়। ম্যাক্সওয়েলের বর্ণালীর সর্বোচ্চ সীমা বেতার তরঙ্গ। আার সবনি¤œ গামা রশ্মি। পরবর্তীকালে আবিষ্কার হওয়া সবরকম আলো বা তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গই ম্যাক্সওয়েলের বর্ণালীতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
বিদ্যুৎক্ষেত্র স্পন্দিত বা ত্বরিত হলে তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ বিকিরণ করে। একটা বিন্দু চার্জ যদি কোনো কক্ষপথকে কেন্দ্র করে ঘোরে তখনও উৎপন্ন হয় তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ।
ফারাডে বলেছিলেন চৌম্বক্ষেত্রের মানের পরিবর্তন বিদ্যুৎক্ষেত্রের জন্ম দিতে পারে। ম্যাক্সওয়েল বললেন বিদ্যুৎক্ষেত্রের পরিবর্তনের হারও জন্ম দিতে পারে চৌম্বকক্ষেত্রের। চৌম্বকক্ষেত্রে সৃষ্টি করা যায় তড়িৎ ক্ষেত্রের পরিবর্তন করে কিংবা কোনও বিদুৎ পরীবাহী মাধ্যমে বিদ্যুৎ প্রবাহ র্সষ্টি করে। এর ফলে জন্ম হয় সরণ কারেন্ট বা সরণ প্রবাহের। আর সরণ কারেণ কোনও মাধ্যম ছাড়াই শুন্যস্থানের মধ্য দিয়ে চলতে পারে। এই সিদ্ধান্তের ওপর ভিত্তি করে ম্যাক্সওয়েল চারটি সমীকরণের জন্ম দিলেন। সেই সমীকরণগুলো হলো:
প্রথমেই আসা যাক সময়ের কথায়। নিউটনের মহাকর্ষ সূত্রে কিন্তু সময় উল্লেখ ছিল না। তেমনি কুলম্বের সূত্রের সময় উল্লেখ নেই। ফ্যারাডে বা অন্য বিজ্ঞানীরাও বলতে পারেননি বিদ্যুৎ কিংবা চুম্বকক্ষেত্রের ওপর সময় কোনও প্রভাব ফেলে কিনা। ধরা যাক, একটা ধনাত্মক ও একটা ঋণাত্মক চার্জ রাখা আছে বেশ কিছুটা দূরে। ফলে একটা তড়িৎক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে এবং চার্জদুটি পরস্পরে প্রতি আকর্ষণ বল অনুভব করছে। হঠাৎ ধণাত্মক চার্জের পাশে আরেকটা ধণাত্মক চার্জ রাখা হলো। স্বভাবতই নতুন ধনাত্মক চার্জটির করণে বিদ্যুৎক্ষেত্রের মানের পরিবর্তন ঘটবে। এবং সেই পরিবর্তনের প্রভাব পড়বে ঋণাত্মক চার্জটির ওপরেও। কথা হচ্ছে বিদ্যুৎক্ষেত্রের পরিবর্তনের সাথে সাথে সাথে কি ঋণাত্মক চার্জ সেই খবর জেনে যাবে?
ম্যাক্সওয়েলের আগের বিজ্ঞানীরা মনে করতেন বিদ্যুৎ ও চৌম্বক ক্রিয়া তাৎক্ষণিক ঘটানা। এসব ঘটনার দূরে ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগে না। কিন্তু ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ দেখাল, ওটা ঠিক নয়। তড়িৎ কিংবা চুম্বকের প্রভাব ছড়িয়ে পড়তে কিছুটা হলেও সময় লাগে। অর্থাৎ তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গের গতি অসীম নয়। তড়িচ্চুম্বকীয় প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে আলোর গতিতে।
তাই যদি হয় সেখানেও তো সমস্যা। তখনকার বিজ্ঞানীরা জানতেন আলোর গতি নির্দিষ্ট নয়, প্রসঙ্গ কাঠামোর সাপেক্ষে তা পরিবর্তিত হয়। কিন্তু তড়িচ্চিুম্বকীয় প্রভাব কী প্রসঙ্গকাঠামো সাপেক্ষে ভিন্ন আচরণ করবে? ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণেই রয়েছে এই সমাধান। অবশ্য তার জন্য সমীকরণেগুলো প্রতিপাদন করতে হবে। আমরা সেদিকে যাব না। শুধু জেনে নেব ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণে এ বিষয়ে কী বলা হয়েছে।
ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ বলে তড়িচ্চুম্বকীয় প্রভাব সবসময় এই একই গতিতে ছড়ায়। তার মানে তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গের গতি ধ্রুবক। তা কখনও পরিবর্তন হবার নয়। সুতরাং আলোর গতিও নির্দিষ্ট। এটাই ছিল ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণের সবচেয়ে বড় সাফল্য। সবচেয়ে বড় বিপ্লবও। কারণ, আলোর গতি নির্দিষ্ট হলে গ্যালিলিওর রূপান্তর ভেঙ্গে পড়ে। নিউটনের বলবিদ্যাও কাজ করে না তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গের ক্ষেত্রে। এই কথাটা আগে কেউ ভাবার সাহসই পেত না। কিন্তু ম্যাক্সওয়েল ভাবলেন এবং দেখিয়ে দিলেন সবক্ষেত্রে নিউটনীয় গতিবিদ্যা চলে না।
তাহলে ম্যাক্সওয়েলের তড়িচ্চুম্বকীয় বিদ্যা কি আলদা গতিবিদ্যার জন্ম দিল?
ঠিক তাই। আগে চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞানে শুধুই নিউটনীয় গতিবিদ্যার প্রচলন ছিল। ম্যাক্সওয়েলের হাত ধরে জন্ম হলো নতুন গতিবিদ্যার। এর নাম তড়িৎগতিবিদ্যা।
এজন্যই ম্যাক্সওয়েলকে বলা হয় অন্যতম মৌলিক বিজ্ঞানী। নিউটন যেমন বলবদ্যিার সূচনা করেছিলেন। আইনস্টাইন বেরিয়ে আসেন সেই ধারা থেকে। কিন্তু নিউটনীয় পদার্থবিজ্ঞানের বাইরে নুতন এক পদার্থ বিজ্ঞানের জন্ম দেন আইনস্টাইন। অন্যদিকে ম্যাক্সপ্লাঙ্কের হাতে জন্ম নেয় কোয়ান্টাম মেকানিক্স। এই দুইয়েরই আঁতুড়ঘর কিন্তু ম্যাক্সওয়েলের তড়িচ্চুম্বকীয় সমীকরণ। পরবর্তী অধ্যায়ে আমরা এ বিষয়ে আরও জানব। তবে আইনস্টাইনের একটা মন্তব্য উল্লেখ করা জরুরি ম্যাক্সওয়েলের জীবনালেখ্য। ১৯৩১ সালে ম্যাক্সওয়েলের জন্ম শত বার্ষিকী পালিত হয়। সেখানে আইনস্টাইন বলেন, ‘নিউটনের পর পদার্থবিজ্ঞান যতগুলো বিজ্ঞানীর দেখা পেয়েছে তার মধ্যে ম্যাক্সওয়েলই সবচেযে সফল ও প্রভাবশালী।’
ম্যাক্সওয়েল তড়িচ্চুম্বকের যে সমীকরণ দেন, তার কোনোটাই নিউটনীয় বলবিদ্যা মেনে চলে না। অনেক বিজ্ঞানী-এর শুদ্ধতা নিযে প্রশ্ন তোলেন। কিন্তু প্রমাণগুলোও এত অকাট্য, না মেনে উপায়ও ছিল না। আসলে ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ পদার্থবিজ্ঞানে তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গের অবারিত দ্বার খুলে দেয়। বিজ্ঞানের জগতে ঘটে যায় বড়সড় বিপ্লব। ম্যাক্সওয়েল তখন একাই সেই বিপ্লবের কান্ডারী।
[বইটির সূচীপত্র এবং সব খন্ডের লিংক একত্রে দেখুন এখানে]
-আব্দুল গাফফার রনি
বিজ্ঞান লেখক
[ফেসবুক প্রোফাইল]