আজ ১৮-ই আগস্ট। বিজ্ঞানের ইতিহাসে আজকের দিনে নিষ্ক্রিয় গ্যাস হিলিয়াম আবিষ্কৃত হয়। পর্যায় সারণীর অষ্টম গ্রুপ তথা নিষ্ক্রিয় গ্রুপের অন্যতম মৌল এটি। বায়ুমণ্ডলে নাইট্রোজেন, অক্সিজেন ও হাইড্রোজেনের পাশাপাশি অল্প বিস্তর হিলিয়ামেরও অস্তিত্ব রয়েছে।
1868 সালের এই দিনে পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ চলছিল। পিয়েরে জনসন (1824-1907) নামে ফ্রান্সের একজন জ্যোতির্বিদ গ্রহণের সময় সূর্যের বর্ণালী পর্যবেক্ষণ করছিলেন। সৌর বর্ণালী পর্যবেক্ষণের সময় তিনি বর্ণালীতে এমন কিছু দেখতে পান যা একদমই অপরিচিত। বর্ণালীরেখার একটি অংশ আগের পর্যবেক্ষিত কোনো মৌলের বর্ণালির সাথে মিলে না। এমন মৌলের প্রতিনিধিত্ব করছে যার কোনো অস্তিত্ব পৃথিবীতে নেই। অন্তত তখন পর্যন্ত এটি সম্পর্কে কেউ কিছু জানতো না। তার মানে অবশ্যই এটা নতুন কোনো মৌল। উল্লেখ্য বর্ণালী রেখা বিশ্লেষণ করলে কোনো নক্ষত্র কী দিয়ে গঠিত তা জানা যায়। এই পদ্ধতির মাধ্যমেই অনেক দূরের কোনো বহির্জাগতিক গ্রহ-নক্ষত্র কী কী উপাদান দিয়ে তৈরি তা জানা যায়।
পিয়েরে জনসনের পর্যবেক্ষণের কিছু দিন পর স্বতন্ত্র একটি মৌল হিসেবে চিহ্নিত হয়। তখন পর্যন্ত পৃথিবীতে এর উপস্থিতি সম্পর্কে কেউ না জানাতে একে বহির্জাগতিক মৌল (extraterrestrial element) বলে ডাকা হয়। অনেকটা এইচ. জি. ওয়েলসের সায়েন্স ফিকশনের মতো, মঙ্গল গ্রহ থেকে এমন কিছু প্রাণী এসে পৃথিবীকে আক্রমণ করে যাদের দেহ যে মৌল দিয়ে তৈরি তা পৃথিবীর পর্যায় সারণীর কোনো মৌলের সাথেই মিলে না।
ভারতে বসে পিয়েরে জনসন সূর্যগ্রহণের পর্যবেক্ষণটি করেন। বর্ণালীর হলুদ রঙের কাছে ৫৮৭.৪৯ ন্যানোমিটার অঞ্চলে ঐতিহাসিক এই ব্যতিক্রমটি দেখতে পান। প্রাথমিকভাবে একে সকলেই সোডিয়ামের বর্ণালী বলে ভুল করে বসবে। সোডিয়ামের বর্ণালী এই অঞ্চলেই থাকে এবং দেখতেও অনেকটা এরকমই। কিন্তু তিনি ব্যতিক্রমটি ধরতে পেরেছিলেন। আগ্রহ বলে কথা, বিশেষ সূর্যগ্রহণ পর্যবেক্ষণ করার জন্য ফ্রান্স থেকে এসে ভারতে ক্যাম্প করেছিলেন।
তার শনাক্ত করা বর্ণালীটি তখন পর্যন্ত ল্যাবরেটরিতে কৃত্রিমভাবে এই বর্ণালী তৈরি করা সম্ভব হয়নি। ব্রিটিশ জ্যোতির্বিদ স্যার নরম্যান লকইয়ার (1836-1920) ও রসায়নবিদ স্যার এডওয়ার্ড ফ্র্যাংকল্যান্ড পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হন এটি একটি স্বতন্ত্র মৌল। মৌল হলেও এর অস্তিত্ব পৃথিবীতে নেই। তাই নামকরণও সেভাবেই করা হয়। সূর্যে এই মৌলের অস্তিত্ব আছে বলে সূর্যের নামের সাথে মিলিয়ে এর নামকরণ করা হয়েছে হিলিয়াম। গ্রিক শব্দ হিলিয়াস (helios) থেকে হিলিয়াম (Helium) শব্দের উৎপত্তি। প্রাচীন গ্রিকরা সূর্যকে দেবতা বলে মনে করতো এবং সূর্যকে হিলিয়াস বলে ডাকতো।
আবিষ্কারের পর অনেক বছর ধরে মনে করা হতো পৃথিবীতে এর অস্তিত্ব নেই। তবে আর যাই হোক, বহির্জাগতিক একটি মৌল আছে এবং পৃথিবীতে এর অস্তিত্ব নেই, এরকম তথ্য বিজ্ঞানীদেরকে এমন ইঙ্গিত দেয় যে পৃথিবীতে আরো ভালো করে মৌল খুঁজে দেখা দরকার। ১৮৯৫ সালের দিকে রসায়নবিদ উইলিয়াম র্যামসে ক্লিভাইট খনিজ পর্যবেক্ষণ করার সময় ব্যতিক্রমী একধরনের মৌলের সন্ধান পান। তিনি এর নমুনা রসায়নবিদ উইলিয়াম ক্রুকস ও নরমান লকইয়ারের কাছে পাঠিয়ে দেন। এইদিকে লকইয়ার আগেই সূর্যের হিলিয়ামের পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন এবং নামকরণ করেন। তার কাছে হিলিয়াম অপরিচিত নয়। খনিজ থেকে পাওয়া নমুনাটি সূর্যে পাওয়া নমুনার সাথে মিলে যায়। এবং এর সাহায্যে বহির্জাগতিক মৌলটি পৃথিবীর স্বাভাবিক মৌলে পরিণত হয়।
– সিরাজাম মুনির শ্রাবণ