বিজ্ঞান পত্রিকা

জীবাণু দিয়ে তৈরি হবে আগামী দিনের ব্যাটারি!

সীমিত শক্তি,সম্পদ ও প্রাচুর্যের গ্রহ আমাদের এই পৃথিবী। শক্তির ব্যবহার দিন দিন যত বাড়ছে,শক্তি আহরণের উৎস দ্রুতহারে কমছে। আধুনিক বিশ্বের মানুষ দুই ধরনের শক্তি সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে, জ্বালানী ও বৈদ্যুতিক শক্তি। এই শক্তি দুইটির উৎসও তাই দিন দিন কমে যাচ্ছে যা আমাদের জীবনধারনের জন্য অশনিসংকেত বলা যেতে পারে। তাই বিজ্ঞানীরা প্রতিনিয়ত এই দুইটি শক্তির বিকল্প উৎস অনুসন্ধানের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা যে উৎস খুঁজে পেয়েছেন তা সত্যিই অবিশ্বাস্য। তাঁরা প্রথমবারের মত জীবাণু দিয়ে জ্বালানী কোষ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। Microbial fuel cell নামের এই কোষ বাইরের কোন শক্তি ছাড়াই স্বতস্ফূর্তভাবে তড়িৎ উৎপন্ন করতে পারে। তার মানে ব্যাকটেরিয়া বা জীবাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষম। তাই একে বৈদ্যুতিক শক্তির একটি বিকল্প উৎস হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।

ত্রিমাত্রিক এই জ্বালানী কোষটি কাগজ দিয়ে বানানো হয়েছে।এটি বর্তমানে গবেষকরা তাদের ধারণার একটি প্রমাণপত্র হিসেবে রেখে দিয়েছেন। তবে তাঁরা আশা প্রকাশ করেছেন,ভবিষ্যতে ব্যাটারীতে শক্তির উৎস হিসেবে দুর্লভ ধাতু লিথিয়ামের পরিবর্তে ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার করার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে।

জ্বালানী কোষটি মূলত ব্যাকটেরিয়ার কার্যকলাপের সুবিধা গ্রহণ করে। এটি ব্যাকটেরিয়ার রাসায়নিক শক্তিকে ভেঙ্গে ফেলে এবং সেখান থেকে ইলেকট্রন নিঃসরণ করে। এই নিঃসরিত ইলেকট্রন থেকেই বৈদ্যুতিক শক্তি আহরণ করা হয়, যা খুবই বিরল একটি পদ্ধতি।

কিন্তু এরও একটি সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কারণ ইলেকট্রন নিঃসরণের জন্য ব্যাকটেরিয়াতে অবশ্যই রাসায়নিক শক্তি সঞ্চিত থাকতে হবে। যদি এই শক্তি সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়.তবে ইলেকট্রন নিঃসরণও বন্ধ হয়ে যাবে। বিজ্ঞানীরা এর আগে যতবার জীবাণু দিয়ে জ্বালানী কোষ তৈরি করার চেষ্টা করেছেন, ততবারই এই সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন। এমনকি তাঁরা বাহ্যিক শক্তি প্রদান করে এই কোষগুলো চালানোর প্রচেষ্টাও চালান। কারণ তাঁদের কাছে বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদনই ছিল মূল বিষয়।

তবে কিছুদিন আগে লোয়া স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক এই সীমাবদ্ধতাকে জয় করার দাবি করেছেন। তাঁরা ত্রিমাত্রিক কাগজের তৈরি এক ধরনের জ্বালানী বৈদ্যুতিক কোষ তৈরির কথা ঘোষণা করেন। এই বিদ্যুত কোষে তাঁরা জীবাণুকে শক্তির উৎস হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তবে আশ্চর্যের বিষয় হল, এরা আপনাআপনি তাদের দেহে রাসায়নিক শক্তি উৎপন্ন করতে পারে। এই জীবাণুদের শরীরে পটাশিয়াম ফেরিসায়ানাইড নামক যৌগ স্বয়ংক্রিয়ভাবে তৈরি হয়, যার বিয়োজনে পরবর্তীতে ইলেকট্রন পাওয়া যায়। তাই এক্ষেত্রে তড়িৎ উৎপাদনে বাহ্যিক কোন শক্তির প্রয়োজন পড়ে না। তাঁরা গবেষণাগারে পরীক্ষার মাধ্যমে দেখেছেন, কোন বাইরের শক্তি অথবা মানুষের হস্তক্ষেপ ছাড়াই এই কোষ প্রায় ৫ দিন নিরবচ্ছিন্ন তড়িৎ সরবরাহ করতে সক্ষম।

প্রকল্পের প্রধান গবেষক নাসতারান হাশেমি বলেছেন, এই তড়িৎ কোষে যে শক্তি উৎপন্ন হয় তার পুরোটাই ব্যবহার্য।কারণ এক্ষেত্রে কোষের মধ্য দিয়ে তরল প্রবাহের জন্য কোন ইলেকট্রন লাগে না। তিনি এই উদ্ভাবনকে তড়িৎ প্রকৌশলবিজ্ঞানের অনেক বড় বিজয় বলে উল্লেখ করেছেন।

এই নতুন জ্বালানী কোষের কর্মপদ্ধতি জানতে হলে আমাদেরকে আগে একটি সাধারণ বৈদ্যুতিক কোষের ক্রিয়াকৌশল সম্পর্কে জানা প্রয়োজন। বিদ্যুৎ কোষ বলতে আমরা মূলত ব্যাটারীকেই চিনি।ব্যাটারীর প্রধানত তিনটি অংশ থাকে; অ্যানোড,ক্যাথোড ও তড়িৎ বিশ্লেষ্য পদার্থ। ইলেকট্রন ক্যাথোডে এসে জমা হয়। তখন তড়িৎ বিশ্লেষ্য পদার্থ(আয়নিত দ্রবণ)একে অ্যানোডের দিকে ধাবিত করে। এই ইলেকট্রন পুনরায় ক্যাথোডে ফিরে আসার আগে তার যাত্রাপথে কোন বৈদ্যুতিক বস্তুতে (লাইট,ফ্যান ইত্যাদি)শক্তি সরবরাহ করে। যতক্ষণ পর্যন্ত কোষে তড়িৎবিশ্লেষ্য পদার্থ বিদ্যমান থাকবে,ততক্ষণ পর্যন্ত ইলেকট্রনও গতিশীল থাকবে।

জীবাণু দিয়ে তৈরি এই বিদ্যুৎকোষে তড়িৎবিশ্লেষ্য পদার্থ  মূলত Shewanella oneidensis  MR-1 ব্যাকটেরিয়া ও এর খাদ্য বা রাসায়নিক শক্তি পটাশিয়াম ফেরিসায়ানাইড এর সমন্বয়ে গঠিত। তাদেরকে একে অপরের দিকে প্রবাহিত করতে বিজ্ঞানীরা কাগজের উপর কতগুলো ছোট ছোট গতিপথ তৈরি করেন যা এদেরকে নিয়ন্ত্রিতভাবে চলতে সহায়তা করে। কারণ সেগুলো খুবই পাতলা। ঠিক যেভাবে কৈশিক নালী আমাদের শরীরের রক্তকে দেহের বিভিন্ন অঙ্গের দিকে নিয়ে যায়। যখন তারা একে অপরের সাথে মিলিত হয়,ব্যাকটেরিয়াটি পটাশিয়াম ফেরিসায়ানাইড ভক্ষণ করে ও একে বিয়োজিত করে ইলেকট্রনে রূপান্তরিত করে।

নিচে চিত্রের সাহায্যে এই বিষয়টি দেখানো হল। এতে হলুদ রঙয়ের পেট্রিডেশে রয়েছে ব্যাকটেরিয়া আর সাদা পেট্রিডিশে রয়েছে পটাশিয়াম ফেরিসায়ানাইড। এদের মাঝে রয়েছে প্রোটন বিনিময়কারী সাদা পর্দা (PEM)। এই পর্দা ইলেকট্রনের প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করে।

পাঁচ দিন পরে গবেষকরা দেখেন,সাদা পর্দার চারপাশে রাখা কার্বনের কাপড়ে নতুন করে ব্যাকটেরিয়া জন্মেছে।এ থেকে তারা বুঝতে পারেন,এই পাঁচদিন ব্যাকটেরিয়াগুলো পটাশিয়াম ফেরিসায়ানাইডকে ইলেকট্রনে রূপান্তরিত করেছে ও তারা দ্রুতহারে বেড়েও উঠেছে।

মাঝখানের অংশে কি ঘটে তা নিচের ডায়াগ্রামে প্রকাশ করা করা হয়েছে।এখানে হলুদ রং দ্বারা ব্যাকটেরিয়ার প্রবাহ ও সবুজ রং দ্বারা খাদ্য বা পটাশিয়াম ফেরিসায়ানাইডের প্রবাহ দেখানো হয়েছে।

পাঁচদিনে এই বিদ্যুত কোষ ৫২.৫ মাইক্রোলিটারের দ্রবণ থেকে সর্বোচ্চ ৫২.২৫ মাইক্রোঅ্যাম্পিয়ার বিদ্যুৎ ও ১.৩ মাইক্রোওয়াট শক্তি উৎপন্ন করতে সক্ষম হয়। অন্যভাবে বলা যায়, এক ঘনমিটার ব্যাকটেরিয়া ও পটাশিয়াম ফেরিসায়ানাইড থেকে প্রায় ২৫ ওয়াট বৈদ্যুতিক শক্তি উৎপন্ন করা সম্ভব। এটা খুব বেশি কিছু নয়। আইফোন বা কম্পিউটার চালাতে এর চেয়ে অনেক বেশি শক্তির প্রয়োজন।

তাই বিজ্ঞানীরা তাঁদের এই বৈদ্যুতিক কোষটির উপর আরো গবেষণা করছেন। তাঁরা এই প্রক্রিয়াটিকে আরও গতিশীল করার চিন্তা করছেন। এছাড়াও তাদেরকে এই কোষের আকার ক্ষুদ্র করার দিকেও নজর দিতে হবে যাতে সেটি বিভিন্ন বৈদ্যুতিক উপকরণে (যেমন:ব্যাটারী) সহজে ব্যবহার করা যায়।

তবে চেষ্টা করলে এটি এখনই তৈরি করা সম্ভব। এক্ষেত্রে বিদ্যুত কোষে ইলেকট্রন তৈরিতে বর্জ্য বা নর্দমার পানি ব্যবহার করা যেতে পারে।নর্দমার পানি কোষের রাসায়নিক পদার্থ বা খাদ্য হিসেবে কাজ করবে।ব্যাকটেরিয়া এটি গ্রহণ করে বর্জ্য পদার্থকে আলাদা করে ফেলবে। ফলে পানি বিশুদ্ধ হয়ে যাবে ও সেই একই সময়ে তা তড়িৎ উৎপন্ন করবে।

জীবাণু দিয়ে তৈরি এই জ্বালানী কোষকে ব্যবহার উপযোগী করতে বিজ্ঞানীদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। তবে তাঁদের এই প্রচেষ্টা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবীদার।

নাসরুল্লাহ্ মাসুদ

Exit mobile version