বিজ্ঞান পত্রিকা

কোয়ান্টাম ফিজিক্স-৫: ইয়ংয়ের পরীক্ষা ও ইথারের হেঁয়ালি

[বইটির সূচীপত্র এবং সব খন্ডের লিংক একত্রে দেখুন এখানে]

দ্বিতীয় পর্বে আমরা দেখেছি হাইগেনস আলোর তরঙ্গ ধর্মের কথা বলেন। এর জন্য হাজির করেন ইথার তত্ত্ব। ইথার নিয়ে আলোচনা করা দরকার। তার আগে আরেকটা কাজ, তরঙ্গ তত্ত্বের প্রমাণ হাজির করতে হবে। না, নিউটন-হাইগেনসের কালে কোনো বিজ্ঞানী আলোর তরঙ্গ তত্ত্বের প্রমাণ হাজির করতে পারেনি। প্রমাণ হলো হাইগেনস-তত্ত্বের ১২৩ বছর পর। প্রমাণ করলেন ব্রিটিশ পদার্থবিদ থমাস ইয়াং।

আলো তরঙ্গ, একথা প্রমাণের জন্য একটা পরীক্ষা চালিয়েছিলেন ইয়াং। ‘ইয়াংস ডাবল স্লিট এক্সপেরিমেন্ট’ নামে সেটা দুনিয়া জুড়ে বিখ্যাত। বাংলাদেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা সেটাকে ‘ইয়াংয়ের দ্বিচির পরীক্ষা’ নামে জানে। চির-টির শব্দগুলো কেমন অদ্ভুত ঠেকে। তারচেয়ে ছিদ্র বললে  ক্ষতি কী? আমরা ওই নামেই ডাকি না কেন পরীক্ষাটাকে ‘ইয়াংয়ের দুই ছিদ্র পরীক্ষা’।

ইয়াংই কিন্তু এই পরীক্ষার জনক নন। পরীক্ষাটা প্রথম করেন এক ইতালিয়ান বিজ্ঞানী। ফ্রান্সিসকো মারিয়া গ্রিমাল্ডি। কিন্তু ইতিহাস বড় নির্মম। কখনো কখনো সফলদেরও আড়াল করে রাখে। নইলে গ্রিমাল্ডিয়ের নামটা পর্যন্ত আজ ইতিহাসের কানাগলিতে হারিয়ে গেছে। নিউটনীয় বিজ্ঞানের প্রভাবের কারণেই হয়তো আড়ালে পড়ে গেছিলেন গ্রিমাল্ডি। এজন্য তাঁর পরীক্ষা দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি বিজ্ঞানীদের।

ফ্রান্সিসকো মারিয়া গ্রিমাল্ডি

ইতিহাস ছেড়ে এবার ল্যাবরেটারিতে ঢুকে পড়া যাক। সেখানে থমাস ইয়াং তাঁর বিখ্যাত পরীক্ষার সব সরঞ্জাম  সাজিয়ে বসিয়ে আছেন। ইয়াংয়ের পরীক্ষাাটাকে আমরা আমাদের মতো করে সাজিয়ে নিতে পারি। একটা ঘর। পুরোপুরি অন্ধকার। ডার্ক রুম যাকে বলে আরকি।  সেই ঘরের ভেতর আরেকটা ঘর। এই ঘরটা ধরা যাক মসৃণ কাঠবোর্ড দিয়ে তৈরি। কাঠবোর্ডের দেয়ালে পাশাপাশি দুঠো ছিদ্র করলেন ইয়াং। মেঝে থেকে একটু উঁচুতে।

থমাস ইয়াং

তারপর দেয়ালের বাইরের দিকে একটা টেবিল রাখা হলো।  টেবিলের ওপর রাখা হলো একটা মোমবাতি। মোমবাতির শিখা আর ছিদ্র দুটো একই উচ্চতায় অবস্থান করবে। তবে কোনো একটা ছিদ্রের সোজাসুজি রাখলে চলবে না মোমবাতিকে। রাখতে হবে দুই ছিদ্রের মাঝামাঝি জায়গায়। এতে আলো দুই ছিদ্রের ওপর পড়বে সমানভাবে।

দুই ছিদ্র দিয়ে প্রবেশ করা আলোক রশ্মি গিয়ে পড়বে কাঠের ঘরটার ভেতরে। ঠিক বিপরীত দিকের দেয়ালে। এই দেয়ালটা সাদা রংয়ের হলে ভালো হয়। পর্দার মতো কাজ করে তাহলে। দুই ছিদ্র দিয়ে আলোক রশ্মি গিয়ে পড়বে সেই পর্দায়। পর্দায় পড়া আলোক রশ্মি দুটির চেহারা কেমন হবে?

এটাই মোক্ষম প্রশ্ন। এ প্রশ্নের যে জবাব পেলেন ইয়াং, তা আলোক বিজ্ঞানকে ওলট-পালট করে দিল। আলো যদি কণা হত তাহলে রশ্মি দুটো ছিদ্র দিয়ে চলে যেত সরলরেখায়। কোনো কোণে বেঁকে যেত না। সোজা গিয়ে পড়ত সামনের দেয়ালে বা পর্দায়। পর্দায় দুটো আলোক বিন্দু তৈরি করত। ছবিটা হতো নিচের মতো।

চিত্র : ৪.১

কিন্তু ইয়ং যে ফল পেলেন তা মোটেও এই ছবিটার মতো মতো নয়। দেখলেন ছিদ্র দিয়ে প্রবেশ করা আলোক রশ্মি পর্দার ওপরে শুধু দুটো উজ্বল বিন্দুই তৈরি করেনি। প্রতিটা উজ্জ্বল বিন্দুর পাশে একটা করে অন্ধকার বিন্দু তৈরি হয়ছে। আবার অন্ধকার বিন্দুর পাশে একটা করে উজ্জল বিন্দু তৈরি করেছে। নিচের ছবির মতো।

চিত্র : ৪.২

ছবিটা দেখে মনে হয়, আলোক রশ্মিগুলো ছিদ্র দিয়ে আসছে না। আসছে দুই ছিদ্রের ঠিক মধ্যবিন্দু দিয়ে। অথচর সেই মধ্যবিন্দুতে কোনও ছিদ্রই নেই। এভাবে পর্দার ওপর বেশ কিছু উজ্জ্বল ও অন্ধকার বিন্দুর পট্টি তৈরি হয়। সেই পর্দাটাকে ঘুরিয়ে সুবিধা মতো করে দেখা যাক।

চিত্র: ৪.৩

পর্দায় পাশাপাশি পাঁচটা উজ্বল আলোক বিন্দু দেখা যাচ্ছে। দুটো  উজ্জ্বল বিন্দুর মাঝখানের অংশে একটা করে অন্ধকার বিন্দু আছে। পুরো ঘরটাই অন্ধকার। অন্ধকার পর্দা বা দেয়ালটাও। তাই উজ্জ্বল বিন্দুগুলোর মাঝখানে অন্ধকার বিন্দুগুলো আলাদাভাবে দেখা যাবার কথা নয়।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে ইয়ং এই ফল কেন পেলেন। আলো যদি কণা হতো পর্দায় শুধু দুটো ছবি দেখো দিত। চিত্র : ৪.১-এর মতো। তার মানে আলো কণা নয়। আলোকে তরঙ্গ ধরলেই কেবল এ প্রশ্নের জবাব পাওয়া যেতে পারে। অর্থাৎ ইয়াং সিদ্ধান্তে এলেন, আলো আসলে তরঙ্গই।

দুই
ইয়াংয়ের পরীক্ষায় প্রমাণিত হলো আলো হচ্ছে তরঙ্গ। সেই সাথে আবার বেশ জোরালোভাবে ইথার ধারণা শিকড় গেঁড়ে বসল। কিন্তু ম্যাক্সওয়েল ইথার বিষয়ে সন্দেহ করেন। কারণ, তাঁর সমীকরণ থেকেই বেরিয়ে এসেছে আলোর বেগের নির্দিষ্ট মান। বিভিন্ন রংয়ের আলোর তঙ্গরদৈর্ঘ্য ভিন্ন হলেও তাদের রৈখিক গতি সব সময় স্থির। আর সেটা এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল। ম্যাক্সওয়েলের কাজ নিয়ে আমরা পরবর্তীতে বিস্তারিত আলোচনা করব।

ইথার থাকলে কী কী সমস্যা এসে হাজির হয়, সেগুলো দেখে নেওয়া যাক। ম্যাক্সওয়েল আলোর গতি যে ধ্রুব, সেটার একটা ভিত্তি দাঁড় করালেন। কিন্তু আলোর এই স্থির গতি কার সাপেক্ষে? যেমন একটা ট্রেনের গতি হিসেব করা হয় কোনো স্থির বস্তুর সাপেক্ষে। একজন্য সবচেয়ে উপযোগী বস্তু ট্রেন স্টেশন। আলোর ক্ষেত্রে কি এমন কোনো স্টেশন আছে। আলোর গতি যদি তাৎক্ষণিক ঘটনা না হয় তা হলে সে চলে কীভাবে? আলো গতি ধ্রুব হলে ইথারের আর দরকার হয় না।

ধরা যাক, আলোর গতির স্থির একটা সাপেক্ষ পাওয়া গেল। সেটা ইথার। অনেকটা ট্রেন স্টেশনের মতো। ধরা যাক, স্টেশন থেকে একটা ট্রেন পুব দিকে যাচ্ছে ঘণ্টায় ২০০ কিলোমিটার গতিতে। ট্রেন লাইনের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে একটা বাস রাস্তা। সেই রাস্তা ধরে একটা বাস পুব দিকে যাচ্ছে ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার গতিতে। তাহলে স্টেশনের সাপেক্ষে ট্রেনের গতি ২০০ কিলোমিটার এবং বাসের ১০০ কিলোমিটার। কিন্তু বাসের ভেতরের যাত্রীরা দেখবেন, ট্রেনটা ১০০ কিলোমিটার গতিতে তাদের পাশ কাটিয়ে চলে গেল। আর ট্রেনের যাত্রীরা দেখবেন বাসটা ১০০ কিলোমিটার বেগে পেছন দিকে সরে যাচ্ছে।

এবার ধরা যাক পুব দিক থেকে সেই বাস রাস্তা ধরে একটা ট্রাক ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার বেগে স্টেশনের দিকে ছুটে আসছে। তা হলে প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলো দেখবেন ট্রেনটা ২০০ কিলোমিটার বেগে পুব দিকে ছুটে যাচ্ছে। আর ট্রাকটা ১০০ কিলোমিটার বেগে ছুটে আসছে স্টেশনের। কিন্তু ট্রাকের ড্রাইভার অনুভব করবেন ৩০০ কিলোমিটার বেগে ট্রেনটা তাকে পাশ কাটিয়ে বিপরীত দিকে চলে যাচ্ছে।
ধরা যাক, ওই ট্রেন লাইনের পাশের আরেকটা ট্রেন লাইন আছে। পুব দিকে আরেকটা ট্রেন একই সময়ে ঘণ্টায় ২০০ কিলোমিটার বেগে যাত্রা শুরু করল। তবে স্টেশনের লোকজন দেখবে দুটো ট্রেনই ২০০ কিমি বেগে পুব দিকে ধেয়ে চলেছে। কিন্তু এক ট্রেনের যাত্রী আরেক ট্রেনের দিকে তাকালে দেখবেন ট্রেনটা নড়ছেই না। অর্থাৎ পরস্পরের সাপেক্ষে তারা স্থির।

এখন ইথারকে স্থির স্টেশন ধরে নেওয়া যাক। ধরা যাক, আলো নামের ট্রেনটি ইথার সাপেক্ষে ঘণ্টায় ১ লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল বেগে পূব দিকে ছুটে চলেছে। ধরা যাক, পাশের লাইন দিয়ে আরেকটা ট্রেন চলেছে সেকেন্ডে ১ লক্ষ মাইল বেগে। তা হলে দ্বিতীয় ট্রেনের যাত্রীরা দেখবেন প্রথম ট্রেন অর্থাৎ আলো মাত্র ছিয়াশি হাজার মাইল বেগে ছুটছে!

অর্থাৎ ইথারের কারণে ধরে নেওয়া হলো আলোর গতি বিভিন্ন বেগে চলমান বস্তুর সাপেক্ষে ভিন্ন ভিন্ন। মানে আর দশটা বেগের মতো আলোর বেগ প্রসঙ্গ কাঠামো সাপেক্ষে পরিবর্তনশীল। কিন্তু ম্যক্সওয়েলের তড়িচ্চুম্বকীয় সমীকরণ বলছে আলোর বেগ ধ্রুবক।

ইথার যদি সত্যিই থাকে তাহলে এক সাথে দুটো লাভ। আলো যদি তরঙ্গ হয় তা হলে শব্দ তরঙ্গের মতো জন্য তারও মাধ্যম দরকার হবে। অর্থাৎ ইথারের বুকে ঢেউ তুলে তরঙ্গাকারে চলে। দ্বিতীয় লাভটা হলো একটা স্থির বস্তু পাওয়া গেল। এর সাপেক্ষে এখন আলোর বেগ নির্ণয় করতে অসুবিধা নেই।

এমনিতে অসুবিধা নেই। কিন্তু ইথার বলে আদৌ যদি কিছু না থাকে অসুবিধা কিন্তু বিরাট। ইথার যদি থাকেই আলোর কী অবস্থা হয় দেখা যাক। বাতাসে শব্দ তরঙ্গকারে চলে। যতক্ষণ শব্দ তরঙ্গ নূন্যতম শক্তি ধরে রাখতে পারে ততক্ষণ চলে। আমরা দেখি শব্দ তরঙ্গ একটানা চলতে পারে না। একসময় তা বাতাসের বাধার কারণেই থেমে যেতে বাধ্য হয়। ইথার যদি আলোর এমন মাধ্যম হয় তাহলে সে একসময় আলোকেও থামিয়ে দিতে সক্ষম! প্রমাণ আছে আলো কখনও থামে না।

আরেকটা ব্যাপার খেয়াল করে দেখুন। আপনি যদি শব্দের উৎসের দিকে দৌড়ে যান। বাতাস যেদিক থেকে শব্দ বয়ে নিয়ে আসছে সেদিকে দৌড়ান, শব্দ আরও দ্রুত আপনার দিকে এগিয়ে আসবে। অনেকটা দুই গাড়ি মুখোমুখি এগিয়ে আসার মতো। আলোর ক্ষেত্রেও এমন ঘটা উচিৎ ছিল। ইথার আলোকে যেদিক থেকে বয়ে নিয়ে আসছে সেদিকে যদি আপনি দৌড়ে যান তাহলে আলো দ্রুত আপনার দিকে এগিয়ে আসার কথা। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটে না।

ম্যাক্সওয়েল বললেন, যদি ইথার বলে কিছু থাকে, তবে আলোর ক্ষেত্রেও এমন ঘটনা ঘটা উচিত। অর্থাৎ যখন ইথারের ভেতর দিয়ে আলোর দিকে ছোটা হবে তখন আরও দ্রুত আলোর কাছাকাছি চলে আসা উচিৎ। আলোর বেগ তখন বেশি হবে। আবার খুব দ্রুত গতিতে ইথারের ভেতর দিয়ে আলো যেদিকে যাচ্ছে সেদিকে ছুটলে আলোর গতি কম মনে হওয়ার পড়ার কথা। ম্যাক্সওয়েল ভাবলেন, ইথার যদি থেকেই থাকে তবে পৃথিবীও ইথারের মধ্যে নিমজ্জিত পৃথিবী সূর্যের চারপাশে বৃত্তাকারে (আসলে উপবৃত্তাকারে) ঘুরছে। তাই জানুয়ারি মাসে পৃথিবীর অভিমুখ যেদিকে জুলাই মাসে তার ঠিক উল্টো দিকে। তেমনি অক্টোবর মাসের পৃথিবীর অভিমুখ এপ্রিল মাসের অভিমুখের উল্টো দিকে হবে। নিচের চিত্রের মতো।

ছবিটি স্টিফেন হকিং ও লিওনার্ড ম্লডিনোর দ্য গ্যান্ড ডিজাইন বই থেকে নেওয়া হয়েছে।

ইথারের অস্তিত্ব থাকলে জানুয়ারি ও জুলাই মাসে পৃথিবীতে আলোর গতির ভেতর পার্থক্য দেখা যাবার কথা। ম্যাক্সওয়েল তাঁর ধারণার কথা রয়্যাল সোসাইটির জার্নাল ‘প্রসিডিং অব রয়্যাল সোসাইটি’র সম্পাদককে জানান। কিন্তু সম্পাদক ম্যাক্সওয়েলের ধারণাকে যুক্তিযুক্ত মনে করেননি। ১৮৭৯ সালে মাত্র ৪৮ বছর বয়সে ম্যাক্সওয়েল পাকস্থলির ক্যান্সারে মারা যান। তাই তাঁর যুক্তির পক্ষে প্রমাণ রেখে যেতে পারেননি। ম্যাক্সওয়েলের ধারণায় অনুপ্রাণিত হলেন  পোলিশ আমেরিকান পদার্থবিদ আলর্বাট মাইকেলসন।

প্রাচীনপন্থি বিজ্ঞানীরা ইথার তত্ত্ব আকড়ে বসে থাকলেন। ইথারকে বাঁচাতে তাঁরা নিত্যনতুন তত্ত্ব হাজির করেন। ইথারকে তারা একেবারে নিশ্চল বস্তু হিসেবে কল্পনা করেছিলেন। সমস্ত মহাবিশ্বকেই তাঁরা নিশ্চল ইথরের ভেতর নিমজ্জিত ভেবেছিলেন। ইথার যদি নিশ্চতভাবে থাকে তাহলে যেকোনও বস্তু গতিশীল বস্তু ইথারকেও গতিশীল করবে। ধরা যাক, শান্ত সমূদ্রে একটা স্পিড বোট চলেছে। স্পিডবোট চলঅর কারণে বোটের পেছন দিকে পানির একটা ¯্রােত তৈরি হবে। পানিরে সেই স্যোতের গতি হবে বোটের গতির বিপরীত দিকে।

আরেকটু পরিষ্কার ধারণা নেওয়া যাক। কোনো এক রাস্তা একটা বাস দাঁড়িয়ে আছে। ধরা যাক, সেখানকার বায়ুম-ল তখন একবারে থমথমে। মানে স্থির। এখন যদি বাসটা চলতে শুরু করে তবে সেখানে বায়ুপ্রবাহের সৃষ্টি করবে। রাস্তার সামনের বাতাসকে ঠেলে এগিয়ে যাবে বাস। ফলে বাসের পেছন দিকে বায়ুপ্রবাহ সৃষ্টি হবে। সেই বায়ু প্রবাহের গতির দিকে হবে বাসের বিপরীত দিকে। এই বায়ুপ্রবাহ দেখার অবিজ্ঞতা সবার আছে।

ইথার যদি থাকেই, সেই নিশ্চল ইথারের ভেতর দিয়ে ছুটে চলেছে পৃথিবী। পৃথিবীর বার্ষিক গতির কথা বলা হচ্ছে। সেই গতির কারণে পৃথিবী তার সামনের বায়ম-লকে ঠেলে সামনে এগিয়ে চলছে। তার ফলে পৃথিবীর গতির বিপরীত দিকে ইথারের প্রবাহ তৈরি হবার কথা।


এই বিষয়টিই পরীক্ষা করার কথা ভাবলেন আলবার্ট মাইকেলসন। কীভাবে? ধরা যাক একটা নদী। তার প্রস্থ ১ কিলেমিটার। এখন একটা নৌকা সেই নদীটা পার হবে। ধরা যাক, নৌকাটা ৩০ মিনিটে নদীর এপা থেকে ওপারে পৌঁছে যাবে। আবার যদি  নৌকাটা ওপার থেকে এপারে ফিরে আসে তাহলে আর আধঘণ্টা সময় লাগবে। তাহলে কোথাও না থামলে নৌকটা থেকে ওপারে গিয়ে আবার এপারে ফিরে আসতে সময় লাগবে মোট ৬০ মিনিট।  অর্থাৎ ২ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেবে ৬০ মিনিটে।

এখন ধরা যাক, নৌকাটি  স্রোতের অনুকুলে ১ কিলোমিটার চলছে। স্রোত নৌকাটির গতিবেগ বাড়িয়ে দেবে। ধরা যক, নৌকাটি ১ কিলোমিটার নদী পেরোতে সময় নেবে ২০ মিনিট। এবার নৌকাটা ফিরে আসবে আবা যেখান থেকে চলা শুরু করেছিল সেখানে। এবার কিন্তু নৌকা আর স্রোতের সাহয্য পাচ্ছে না। বরং স্রোত তার স্বাভাবিক গতিকে বাধাগ্রস্ত করবে। সেটা সাহায্য করার তুলনায় অনেক বেশি। স্রোতের অনুকুলে চলার সময় নৌকা স্রোতের কাছ থেকে যে সাহায্য পেয়েছিল, এবার বিপরীতে চলার সময় আরও বেশি বাধাগ্রস্ত হবে। ধরা যাক, এবার সেই একই পথ ফিরে আসতে নৌকার সময় লাগছে ৪৫ মিনিট। তাহলে এক কিলোমিটার পথ স্রোতের অভিমুখে চলে আবার বিপরীত ফিরে আসতে মোট সময় লাগছে ৬৫ মিনিটি। নদী আড়াআড়ি ভাবে এপার-ওপার করতে সময় লেগেছিল ৬০ মিনিট। দুই ক্ষেত্রেই কিন্তু স্রোতের বেগ সমান। তবু আড়াআড়িভাবে একই পথ একবার যেতে ও ফিরে আসতে নৌকার যে সময় লাগে, স্রোতের অভিমূখে একই পথ যেতে ও ফিরে আসতে সময় বেশি লাগে। এটা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত।

মাইকেলসন ভাবলেন, একই ঘটনা তাহলে ইথার আর আলোর ক্ষেত্রেও ঘটার কথা। পৃথিবীর বিপরীত দিকে ইথারের প্রবাহ চলছে। আলো যদি ইথারে ভর দিয়ে চলে তাহলে পৃথিবীর বিপরীত দিকে, ইথার প্রবাহ যেদিকে সেদিকে আর পৃথিবীর গতির লম্বদিকে আলোর একই পথ পাড়ি দিতে সময়  কম-বেশি লাগার কথা। পৃথিবীর গতির বিপরীত দিকে ১ মিটার পথ পাড়ি দিয়ে ফিরে আসতে যে সময় লাগবে, পৃথিবীর গতির লম্ব দিকে তারচেয়ে কম সময় লাগা উচিৎ। এটা পরীক্ষা করার জন্য, মাইকেলসন একটা ব্যতিচার মাপার যন্ত্র তৈরি করলেন। এটাই সেই মাইকেলসনের বিখ্যাত ইন্টারফেরোমিটার। একই নকশার ইন্টারফেরোমিটার ব্যবহার করা হয়েছে মহাকর্ষ তরঙ্গ শণাক্ত করতেও । সেই যন্ত্রটার নাম লাইগো।

যাইহোক, মাইকেলসন পরীক্ষা করে যে ফল পেলেন তা মোটেই ইথারের অস্তিত্ব প্রমাণ কররে না। কিন্তু সেকথা প্রকাশ করলে ইথারবাদী বিজ্ঞানীরা খেপে যেতে পারেন। তখন মাইকেলসন বিষয়টা জানিয়ে চিঠি লিখলেন আরেক বিখ্যাত বিজ্ঞানী লর্ড র‌্যালেকে। র‌্যালের পরামর্শেই মাইকেলসন তাঁর পরীক্ষাটি আরেকবার করলেন আরেক বিজ্ঞানী এডওয়ার্ড মর্লিকে সাথে নিয়ে। সেই পরীক্ষাটাই মাইকেলসন-মর্লির পরীক্ষা নামে বিজ্ঞানের ইতিহাসে অমর হয়ে আছে।

[বইটির সূচীপত্র এবং সব খন্ডের লিংক একত্রে দেখুন এখানে]

-আব্দুল গাফফার রনি
বিজ্ঞান লেখক
[ফেসবুক প্রোফাইল]

Exit mobile version