বিজ্ঞান পত্রিকা

কোয়ান্টাম ফিজিক্স-৩: বিদ্যুৎ ও চুম্বকের ইতিবৃত্ত

[বইটির সূচীপত্র এবং সবখন্ডের লিংক একত্রে দেখুন এখানে]

মধ্য যুগের বিজ্ঞানীদের কাছে পদার্থবিজ্ঞানে  মহাকর্ষ বলের বাইরে আরো দুটো বিষয় পরিচিত ছিল। বিদ্যুৎ ও চুম্বক। এই দুটো বলও শূন্য মাধ্যমে অনুভব করা যায়। চুম্বক আবিষ্কারের নানা গালগল্প আছে।

৪ হাজার বছর আগের কথা। ম্যাগনেস নামে এক রাখাল ছিল দক্ষিণ গ্রিসে। মাঝে মাঝেই সে ভেড়া চরাতে যেত মাঠে। পাথুরে পাহাড়ি মাঠ। এখানে সেখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অজস্র পাথর। একদিন সে একটা ভেড়া হারিয়ে ফেলে। খুঁজে খুঁজে হয়রান। কোথাও পায় না। অবশেষে ভেড়ার খোঁজে পাহাড়ে ওঠে ম্যাগনেস। হঠ্যাৎ একটা কালো পাথরে তার পা আটকে যায়। অবাক হয় ম্যাগনেস। কীসে আটকালো ভেবে পায় না।
বোঝার চেষ্টা করে। এক সময় সে আবিষ্কার করে কালো পাথরের সাথেই তার জুতো আটকে গেছে। অদ্ভুত ব্যাপার! ম্যাগনেসের জুতোর নিচে পেরেক জাতীয় কিছু ছিল, যাতে পাহাড়ে উঠতে গিয়ে পিছলে না যায়। ম্যাগনেস বুঝতে পারে লোহার পেরেকেকে টেনে ধরেছে কালো পাথর। অপ্রাত্যাশিতভাবেই আবিষ্কার হয়ে যায় চুম্বক পাথরের। ম্যাগনেসের নাম থেকেই ওই পাথরের নামকরণ করা হয় ম্যাগনেট।

রাখাল ম্যাগনেস অপ্রত্যাশিতভাবে চুম্বক আবিষ্কার করে

চুম্বক আবিষ্কারের এই গল্পটা নিয়ে দু দলে ভাগ হয়ে গেছেন বৈজ্ঞানিকরা। কেউ কেউ মনে করেন এটা নিছকই বানানো একটা গল্প। অন্যদল মনে করেন গল্পটা আসলে সত্যি। সত্যিই যদি হয়, তাহলে বলতে হয় মানুষ অপ্রত্যাশিতভাবেই চুম্বক আবিস্কার করে। তবে বিদ্যুৎ ও চুম্বক নিয়ে সর্বপ্রথম গবেষণা করেন গ্রিক পন্ডিত থ্যালেস। ম্যাগনেশিয়া শহরে এজিন সাগরের বালুচরে এক ধরনের লোহা পাওয়া যেত।

আজকাল ধাতুর বিভিন্ন রূপকে আকরিক বলে। বালুচরের ওই লোহাও আসলে লোহার একপ্রকার আকরিক। সেই লোহা ছোট ছোট লোহার টুকরো ও লোহার গুঁড়োকে আকর্ষণ করত। থ্যালেস লোহার সেই আকরিকের নাম দিয়েছিলেন ম্যাগনেশিয়া পাথর। অর্থাৎ আকর্ষণকারী পাথর। সেখান থেকেই ম্যাগনেট বা চুম্বক শব্দটা এসেছে।

অ্যাম্বর পাথর নামে এক ধরনের বস্তুর প্রচলন ছিল সে সময়। পাইন গাছের আঠা বহু বছর পড়ে থাকলে অ্যাম্বরে পরিণত হত। একে রেজিনও বলে। একদিন থ্যালেস একটা অ্যাম্বর পাথর কুড়িয়ে এনেছিলেন কী একটা কাজে লাগাবার জন্য। কিন্তু পাথরটার গায়ে ময়লা ছিল। থ্যালেস সেটাকে পরিষ্কার করার জন্য রেশম জাতীয় কাপড় দিয়ে ঘষছিলেন। হঠাৎ তিনি লক্ষ করলেন, ঘষা পাথরটা ছোট ছোট হালকা বস্তুকে আকর্ষণ করছে। তা হলে অ্যাম্বরও কি চুম্বকের বৈশিষ্ট্য ধারণ করে?

থ্যালেস ভাবলেন, ম্যাগনেসিয়া পাথর শুধু শুধু লোহার গুঁড়ো আর লোহার টুকরোকে আকর্ষণ করে। কিন্তু ঘষা অ্যাম্বর যেকোনো হালকা বস্তুকে আকর্ষণ করতে পারে। তা হলে ম্যাগনেশিয়া ও ঘষা অ্যাম্বরের বৈশিষ্ট্য এক নয়। এই আকর্ষণ বলের অন্য নাম আছে। অ্যাম্বরের গ্রিক নাম ইলেক্ট্রন। পরবর্তীতে ইলেক্ট্রন থেকেই ইলেক্ট্রিসিটি অর্থাৎ বিদ্যুৎ শব্দটি এসেছে।

দ্বাদশ শতাব্দীতে চীনা বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করলেন চুম্বকের এক অসাধারণ গুণ। দন্ডাকৃতির চুম্বক ঝুলিয়ে রাখলে এরা সব সময় উত্তর-দক্ষিণ দিক মুখ করে থাকে। তারা এও আবিষ্কার করলেন, যে দিকটা উত্তর দিকে মুখ করে থাকে, তাকে ঘুরিয়ে দক্ষিণমূখি করে দিলেও সে আবার উত্তরমুখি হয়ে যায়। ঠিক তেমনি দক্ষিণের দিকে যে মুখটা থাকে শত চেষ্টা করলেও সে কখনও উত্তরমুখি করা যাবে না। অর্থাৎ পৃথিবীর দুই মেরুর মতো চুম্বকের দুটি মেরু থাকে। উত্তর আর দক্ষিণ মেরু।

ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ফরাসি দার্শনিক পেট্রাস পেরেগ্রিনাস আবিষ্কার করলেন চুম্বক মেরুদের বিষ্ময়কর গুণটি। তিনি দেখরেন, এক চুম্বকের উত্তর মেরু আরেক চুম্বকের দক্ষিণ মেরুকে আর্কষণ করে। আবার এক চুম্বকের উত্তর মেরু আরেক চুম্বকের উত্তর মেরুকে বিকর্ষণ করে। তেমনি এক চুম্বকের দক্ষিণ মেরু আরেক চুম্বকের দক্ষিণ মেরুকে বিকর্ষণ করে।

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগ পর্যন্ত চুম্বকত্বের বিষয়টি ছিল শুধুই পরীক্ষামূলক। গাণিতিক কোনো তত্ত্বের মাধ্যমে চুম্বকত্ব প্রকাশ করা হয়নি। ১৭৮৫ সাল। ফরাসি বিজ্ঞানী চার্লস অগাস্তিন দ্য কুলম্ব চুম্বকত্বকে গণিতিক ছাঁচে ফেললেন চুম্বকত্বকে। তিনি আসলে চেয়েছিলেন একটি চুম্বকের একটা মেরু আরেকটি চুম্বকের মেরুকে কী বলে আকর্ষণ বা বিকর্ষণ করে সেটা মাপতে। সম্ভবত নিউটনের মহাকর্ষ সূত্রকে মাথায় রেখেই তিনি গাণিতিক কাঠামোটা দাঁড় করাতে চেয়েছিল। সেই অনুযায়ী যে সূত্রটা দাঁড় করালেন, তা মহাকর্ষ অনেকটা সূত্রের মতোই। দুটি মেরুর মধ্যে ক্রিয়াশীল চুম্বক বল তাদের মধ্যবর্তী দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতে ক্রিয়া করে।

ফ্যারাডে বললেন, চৌম্বক বল আসলে স্থানের ভেতরে ছড়িয়ে থাকে। কুলম্বের সূত্রানুযায়ী সে বল দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতে সে ক্রিয়া করে। এর ফলে চুম্বকের চারপাশে শক্তিশালী এক বলক্ষেত্র তৈরি হয়। ফ্যারাডে বললেন আসলে চুম্বকের দুই মেরুকে মাথায় রেখে চুম্বকের চারপাশে ওই বলক্ষেত্রের ভেতর অসংখ্য রেখা আঁকা যায়। লোহার গুঁড়ো আসলে বলক্ষেত্রের সেই অদৃশ্য রেখাকেই দৃশ্যমান করেছে। এইসব অদৃশ্যরেখা বরাবরাই চুম্বকের দুই মেরুর ভেতর আকর্ষণ ক্ষেত্র সৃষ্টি করেছে। ফ্যাারাডে চৌম্বকক্ষেত্রগুলোকে ব্যখ্যার জন্য কয়েকটি সূত্রের অবতারণা করেছিলেন। সে বিষয়ে না হয় আরেকটু পরে আলোচনা করা যাবে।

এখান থেকে আরেকটি বিষয় বেরিয়ে আসে। সেটা হলো কেন দ- চুম্বককে ঝুলিয়ে রাখলে সে সব সময় উত্তর ও দক্ষিণ দিক নির্দেশ করে? আর কেনইবা কম্পাসের কাঁটা সবসময় উত্তর ও দক্ষিণ দিক নির্দেশ করে?

আসলে পৃথিবী নিজেই একটা চুম্বক। উত্তর ও দক্ষিণ মেরু বরাবর সে বলরেখা ছড়িয়ে রেখেছে। ঝুলন্ত চুম্বক ও কিংবা কম্পাসের স্বাধীন কাঁটার ওপর এই বলরেখাগুলো ক্রিয়া করে। চুম্বকের বলরেখা আর পৃথিবীর বলরেখাগুলো পরষ্পরের সাথে মিলে যায়। এই রেখাগুলোই ঝুলন্ত ও কিংবা স্বধীন চুম্বককে বাধ্য করে তাদের সাথে সামান্তারালে থাকতে।

বলরেখা ও বলক্ষেত্রের এই বৈশিষ্ট্য মহাকর্ষ ও বিদ্যুতক্ষেত্রের ভেতরেও দেখা যায়। সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব প্রকাশের আগে ফ্যারাডের এই ক্ষেত্রতত্ত্বই আইনস্টাইনের চিন্তার খোরাক যুগিয়েছিল। আইনস্টাইন মহাকর্ষের যুগান্তকারী ক্ষেত্রতত্ত্বের অবতরণা কলেছিলেন।

ওই দেখো, শুধু তো চুম্বক নিয়েই বক বক করছি! আসলে তো আমাদের আলোচনায় বিদ্যুৎও ছিল। মূল আলোচনা অবশ্য আলোকে নিয়ে। আপতত আলোর বিষয়টা দূরে সরিয়ে ফিরে যাই বিদ্যুতে। অবশ্য এজন্য আবার আমাদের পেছন ফিরে তাকাতে হবে।

অধ্যায়ের শুরুতেই আমরা থ্যালেসের বিদ্যুৎ আবিষ্কারের কথা বলেছিলাম। এবার আমাদের ফিরে যেতে ষোড়শ শতাব্দীতে। ব্রিটিশ বিজ্ঞানী উইলিয়াম গিলবার্ট প্রমাণ করেন অ্যাম্বর ছাড়াও আরও কিছু কিছু বস্তুকে ঘষলে বিদ্যুৎ তৈরি করতে পারে। এই ধরনের সকল পদার্থকে ‘ইলেক্ট্রিক’ নামকরণ করলেন গিলবার্ট।

১৭৩৩ সালে ফরাসি রসায়নবিদ চার্লস দুফ্যে আরেকটা নতুন পরীক্ষা করলেন। তিনি একটা কাচদ-েকে রেজিন দিয়ে ঘষলেন। দেখা গেল, উভয়ই ছোট ছোট শোলার টুকরোকে আকর্ষণ করতে পারতে পারে। তিনি আরও একটা পরীক্ষা করলেন। কাচদ-ের দ্বারা বিদ্যুতায়িত করলেন কিছু শোলার টুকরো। আর রেজিন দিয়ে বিদ্যুতায়িত করলেন আরো কিছু শোলার টুকরো। সম্ভবত কাচদ- ও রেজিন দিয়ে আলাদা আলাদাভাবে ঘষে বিদ্যুয়াতি করা হয়েছিল শোলার টুকরোগুলোকে। এবার কাচে ঘষা একটা শোলার টুকরো ছেড়ে দিলেন রেজিনে ঘষা শোলার একটা টুকরোর কাছে। দেখলেন, ওই টুকরো দুটো পরস্পরকে আর্কষণ করছে। আরেকটা পরীক্ষা করলেন তিনি। কাচে ঘষা একাধিক শোলার টুকরোকে কাছাকাছি রাখলেন। তারা পরস্পরকে বিকর্ষণ করল। তেমনি রেজিন দিয়ে ঘষা শোলার টুকরোগুলোও পরস্পরকে বিকর্ষণ করল।
এটা কেন হলো?

দ্যুফে নিশ্চিত হলেন বিদ্যুৎ শুধু আকর্ষণই করে না চুম্বকের মতো বিকর্ষণ ক্ষমতাও এর আছে।

তবে বিদ্যুৎ গবেষণায় প্রাণ সৃষ্টি করেছিলেন মার্কিন বিজ্ঞানী বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন। ফ্রাঙ্কলিন বললেন, প্রতিটা বস্তুর ভেতরেই বিদ্যুৎ সঞ্চিত থাকে। কিন্তু সেই বিদুুৎ এমনভাবে থাকে, তাকে সণাক্ত করা যায় না। একটা নির্দিষ্ট বস্তুকে আরেকটা নির্দিষ্ট বস্তুতে ঘষলে এদের বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায়। যেমনটি অ্যাম্বর ও রেশমের ঘর্ষণের ফলে হয়ে থাকে। ঘর্ষণের ফলে একটা বস্তু থেকে কিছু বিদ্যুৎ সরে যায়। সরে যাওয়া সেই বিদ্যুৎ যোগ হয় অন্য বস্তুটিতে। ফ্রাঙ্কলিন বললেন, যেসব বস্তুতে বিদ্যুৎ যুক্ত হয় সেসব বস্তুকে ধনাত্মক বিদ্যুৎতায়িত বস্তু বলা যেতে পারে। আর যেসব বস্তু থেকে বিদ্যুৎ সরে যাচ্ছে তাদের নাম দিলেন ঋণাত্মক বিদ্যুতায়িত বস্তু। তখন পর্যন্ত চার্জ বা অধান শব্দটার সাথে পরিচয় হয়নি। তাই ‘ধণাত্মক আধানযুক্ত’ বা ‘ঋণাত্মক আধানযুক্ত’ বস্তু এখনই লিখতে পারছি না।

ফ্রাঙ্কলিন আরো বললেন, ধনাত্মক বিদ্যুতায়িত বস্তু ঋণাত্মক বিদ্যুতায়িত বস্তুকে আকর্ষণ করে। কিন্তু একটি ধনাত্মক বিদ্যুতায়িত বস্তু আরেকটি ধনাত্মক বিদ্যুাতায়িত বস্তকে বিকর্ষণ করে। তেমনি একটি ঋণাত্মক বিদ্যুতায়িত বস্তু আরেকটি ঋণাত্মক বিদ্যুাতায়িত বস্তুকে বিকর্ষণ করে।

ফ্রাঙ্কলিনের কাছে একটি প্রশ্নের উত্তর ছিল না। ঘষা বস্তু দুটোর কোনটিতে বিদ্যুৎ যুক্ত হচ্ছে আর কোনটি থেকে বিদ্যুৎ সরে যাচ্ছে? অর্থাৎ কোনটা ধনাত্মক আর কোনটা ঋণাত্মক। আসলে বিদ্যুতের চার্জের বিষয়ে কোনও ধারণায় ছিল না তখনকার বিজ্ঞানীদের। ছিল না, ধনাত্মক ও ঋণাত্মক চার্জ সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণাও। শুধুমাত্র অনুমানের ওপর নির্ভর করেই ফ্রাঙ্কলিন সিদ্ধান্ত নিলেন, ঘষা কাচের বিদ্যুৎ ধনাত্মক আর রেজিনের বিদ্যুৎ ঋণাত্মক।

অনুমানের ওপর নির্ভর করে দেওয়া সিদ্ধান্ত ঠিক ও ভুল হওয়ার সম্ভাবনা ফিফটি-ফিফটি। দুর্ভ্যাগবশত পরবর্তীকালে ফ্রাঙ্কলিনের সিদ্ধান্ত ভুল বলে প্রমাণীত হয়। আসলে রেজিন ধনাত্মক চার্জে চার্জিত হয় আর ঘষা কাচ ঋণাত্মক চার্জযুক্ত।

বস্তুর বিদ্যুতায়িত হওয়ার বিষয়টাকে চার্জ বা আধান নাম করলেন সেই কুলম্ব। তিনি বললেন, বিদ্যুতায়িত বস্তুর ভেতর যে বিদ্যুৎ থাকে তাকে চার্জ বলা যেতে পারে। চার্জ অনেকটা বিন্দুর একেটা কণা বা বিন্দুর মতো। এদের একটির প্রকৃতি ধনাত্ম্ক আরেকটির প্রকৃতি ঋণাত্মক। সাধারণ বস্তুতে ধনাত্মক ও ঋণাত্মক চার্জের ভারসাম্য থাকে। তাই সাধারণ একটি বস্তু আকর্ষণ ও বিকর্ষণ কিছুই করে না। ঘষার পর একটি বস্তু থেকে ধনাত্মক চার্জ সরে গিয়ে অপর একটি বস্তুতে জমা হয়। ফলে আগের বস্তুতে চার্জের ঘাটতি পড়ে। সেখানে ঋণাত্মক চার্জের ধর্ম প্রকাশ পায়।
কিন্তু কেন? চার্জ সরে গেলেই সেখানে ঋণাত্মক চার্জের জন্ম হয় কীভাবে?

আসলে ঋলাত্মক চার্জের জন্ম হয় না। আগে থেকেই ওখানে ঋণাত্মক চার্জ ছিল। স্বাভাবিক আচরণ করা সব বস্তুতেই ধণাত্মক ও ঋণাত্মক চার্জ থাকে। একেবারে সমানে সমান। ধনাত্মক চার্জ ও ঋণাত্মক চার্জ পরস্পরকে আকর্ষণ করে। স্বাভাবিক বস্তুতে ধনাত্মক ও ঋণাত্মক চার্জ সমান থাকে। তাই ওদের পরস্পারিক আকর্ষণ বলের ভারসাম্য বজায় থাকে। অর্থাৎ বাড়তি কোনও চার্জ নেই যে অন্য বস্তুকে আকর্ষণ করবে। কিন্তু ঘষার পর একটা থেকে ধণাত্মক চার্জ সরে গিয়ে আরেকটায় জমা হয়। তখন প্রথম বস্তুটায় ধনাত্মক চার্জের তুলনায় ঋণাত্মক চার্জ বেশি হয়ে যায়। ফলে আকর্ষণ বলের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। বাড়তি ঋণাত্মক চার্জের প্রকৃতি তখন সেই বস্তুটার ওপর প্রভাব বিস্তর করে। বস্তুটা তখন ঋণাত্মক হয়ে ওঠে চার্জধর্মী । তখন সে আরেকটা ধনাত্মক চার্জে চার্জিত বস্তুকে আকর্ষণ করার ক্ষমতা লাভ করে।

অন্যদিকে ঘষার ফলে যে বস্তুটিতে ধনাত্মক চার্জ জমা হয়, সে বস্তুটিরও চার্জের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। ধনাত্মক চার্জ তাতে বেশি হয়ে যায়। অতিরিক্ত ধনাত্মক চার্জগুলো সে বস্তুর ওপর প্রভাব বিস্তার করে। তখন বস্তুটিও ধণাত্মক চার্জের মতো আচরণ করে। সে বস্তুটি তখন ঋণাত্মক চাজধর্মী বস্তুকে আকর্ষণ করার ক্ষমতা লাভ করে।

আগেই বলেছি কুলম্ব ১৭৮৫ সালে দুটি চুম্বক মেরুর আকর্ষণ বলের মান নির্ণয়ের জন্য একটি সমীকরণ আবিষ্কার করেছিলেন। কিছুটা মহাকর্ষ সূত্রের মতো সেই সমীকরণের চেহারা। এর ঠিক দুবছর পর কুলম্ব বিদ্যুতের জন্যেও এমন একটি সমীকরণ আবিষ্কার করলেন।
১৭৮৭ সাল। নিউটনের প্রিন্সিপিয়া অব ম্যাথমেটিকা আবিষ্কারের ঠিক একশো বছর পর। চার্লস অগাস্টিন ডি কুলম্ব আবিষ্কার করলেন বৈদ্যুতিক ক্রিয়ার অসামান্য সেই সূত্রটি আবিষ্কার করলেন। যেকোনো দুটি  চার্জিত বস্তুর ভেতর অবশ্যই বৈদ্যুতিক আকর্ষণ অথবা বিকর্ষণ বল ক্রিয়া করবে। দুটি সমধর্মী চার্জিত বস্তু পরস্পরকে বিকর্ষণ করবে তেমনি দুটি বিপরীতধর্মী চার্জিত বস্তু পরস্পরকে  বিকর্ষণ করবে। এই আকর্ষণ বলে মান নির্ভর করবে বস্তুদুটিতে ক্রিয়াশীল চার্জের পরিমাণের, মধ্যবর্তী দূরত্ব ও মধ্যবর্তী মাধ্যমের ওপর।
এই সমীকরণ বলে চার্জের পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে বস্তু দুটোর মধ্যে আকর্ষণ বা বিকর্ষণ বলের মান বৃদ্ধি পাবে। আর যদি চার্জের মধ্যবর্তী দূরত্ব বৃদ্ধি পায় তবে আকর্ষণ বা বিকর্ষণ বলের মান কমবে। এই কমার হারও হবে বর্গাকারে। অর্থাৎ দূরত্ব দ্বিগুণ হলে আকর্ষণ  বা বিকর্ষণ বলের মান কমে এক চতুর্থাংশে দাঁড়াবে।

নিউটনের মহাকর্ষ বলের মতো এখানে দূরক্রিয়ার উপস্থিতি! অর্থাৎ কোনো একটা চার্জের পরিবর্তন ঘটলে আকর্ষণ বা বিকর্ষণ বলের মান কমে যাবে তৎক্ষণাৎ। এটাই কুলম্বের সূত্রের বড় ত্রুটি। এই ত্রুটি ছিল তার চৌম্বক বলের সমীকরণেও।

বিদ্যুৎ আকর্ষণ নিয়ে গবেষণা চলল বহুদিন। সেই সঙ্গে গবেষণা চলল সাধারণ চুম্বক নিয়েও। কিন্তু কুলম্বের সূত্রকে ক্রটিমুক্ত করতে পারলেন না কেউ-ই।

[বইটির সূচীপত্র এবং সবখন্ডের লিংক একত্রে দেখুন এখানে]

-আব্দুল গাফফার রনি
বিজ্ঞান লেখক
[ফেসবুক প্রোফাইল]

বিজ্ঞান পত্রিকা প্রকাশিত ভিডিওগুলো দেখতে পাবেন ইউটিউবে। লিংক:
১. টেলিভিশনঃ তখন ও এখন
২. স্পেস এক্সের মঙ্গলে মানব বসতি স্থাপনের পরিকল্পনা

Exit mobile version