অধ্যায়-১: পরমাণু
অনুচ্ছেদ-৫: বিভিন্ন পরমাণুর মধ্যে পার্থক্য
[বইয়ের সূচীপত্র তথা প্রকাশিত সবগুলো আর্টিকেলের জন্য এখানে দেখুন]
পরমাণু যদি বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে তাহলে যৌক্তিকভাবেই ধরে নেওয়া যায় যে, তাদের মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণ পার্থক্য থাকবে, বিশেষ করে বিভিন্ন পরমাণুুর ধর্ম হবে বিভিন্ন ধরনের। যদি তা না-ই হয় অর্থাৎ সবধরনের পরমাণুর ধর্মই যদি একই রকম হয় তাহলে কেনইবা একগুচ্ছ পরমাণু একত্রিত হয়ে সোনা আর অপর একগুচ্ছ পরমাণু একত্রিত হয়ে সীসা তৈরি করবে?
প্রাচীন গ্রীক পন্ডিতরা সবচেয়ে বেশী প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছিলেন যে বিষয়টিতে তা হচ্ছে জ্যামিতি, কাজেই তাঁরা যেহেতু মৌলিক পদার্থ এবং পরমাণু নিয়ে চিন্তা করেছিলেন, তাঁদের পক্ষে পরমাণুর আকৃতি নিয়েও চিন্তা করাটাই স্বাভাবিক। তাঁদের কাছে পানি গঠনকারী পরমাণুগুলো ছিলো গোলকাকৃতির যেগুলো পানি ঢালার সময় পরস্পরের সাপেক্ষে সহজে গড়াগড়ি দিয়ে এগোতে পারে। মাটির গঠনকারী পরমাণুগুলো হতে পারে ঘনকাকৃতির এবং স্থিতিশীল যেন মাটি সহজে প্রবাহিত না হয়। আগুনের পরমাণু হতে পারে কন্টকিত এবং ধারালো যেই কারণে এগুলোর সংস্পর্শ যন্ত্রণাদায়ক এবং এভাবেই অন্যান্য পদার্থের জন্যও একই ভাবে আকৃতি কল্পনা করে নেওয়া হয়।
প্রাচীন গ্রীকদের মনে এই ধারণাও বদ্ধমূল ছিলো না যে এক বস্তুর পরমাণুকে অন্য বস্তুর পরমাণুতে রূপান্তর করা যায় না। এটা বিশেষভাবে সত্য সোনা এবং সীসার ক্ষেত্রে, যাদের পরমাণুগুলোকে মনে করা হতো মাটির পরমাণু গুলোরই বিশেষ ধরনের রূপভেদ। তারা ভেবেছিলো হয়তোবা মাটিকে সীসায় এবং সীসাকে সোনায় পরিণত করার জন্য মাটির পরমাণুকে সামান্য পুনর্বিন্যাস্ত করে সীসায় এবং সীসার পরমাণুগুলোকে সামান্য এদিক-সেদিক করে সোনায় পরিণত করা যাবে।
প্রায় দুই হাজার বছর ধরে বিপুলসংখ্যক মানুষ সীসাকে সোনায় পরিণত করার জন্য চেষ্টা চালিয়ে গেছে যাদের মধ্যে একটি শ্রেণী ছিলো প্রতারণাপ্রবণ এবং অজ্ঞ কিন্তু একটি বড় অংশই ছিলো বিজ্ঞানমনষ্ক এবং প্রবল ভাবে আগ্রহী। এই ধরনের রূপান্তরের ঘটনাকে বলা হয় “ট্রান্সমিউটেশন (Transmutation)” বা পারস্পরিক রূপান্তর (ল্যাটিন শব্দ হতে, যার মানে হচ্ছে পারস্পরিক পরিবর্তন)। এই ধরনের প্রচেষ্টা সর্বদাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে।
যদ্যাবধি আধুনিক পারমাণবিক তত্ত্ব উন্নতি লাভ করতে শুরু করেছে, এটি স্পষ্ট হয়ে এসেছে যে, পরমাণু শুধু পরস্পর হতে ভিন্ন ধরনেরই নয় বরং এক ধরনের পরমাণুকে আরেক ধরনের পরমাণুতে রূপান্তর সম্ভব নয়। প্রতিটি পরমাণুর ধর্ম স্থায়ী এবং সুনির্দিষ্টি কাজেই সীসার কোনো পরমাণুকে সোনায় পরিণত করা যাবে না (বিশেষ কিছু অবস্থায় এটি যে মোটেও সত্য নয় তা জানার সময় তখনো আসে নি)।
কিন্তু বিভিন্ন পরমাণু যদি পরস্পর হতে ভিন্ন ভিন্নই হবে তাহলে এই ভিন্নতা আসবে কোথা হতে? ডাল্টন নিচের মতো করে ভেবেছিলেন। যদি আট ভাগ অক্সিজেন এবং একভাগ হাইড্রোজেন মিলে পানি তৈরি হয় এবং পানির অণুতে যদি একটি অক্সিজেন পরমাণু এবং একটি হাইড্রোজেন পরমাণু থেকে থাকে তাহলে নিশ্চয়ই একটি অক্সিজেন পরমাণুর ওজন একটি হাইড্রোজেন পরমাণুর তুলনায় আটগুণ বেশী হবে। (আরো সুনির্দিষ্ট করতে চাইলে প্রত্যেকের বলা উচিৎ একটি অক্সিজেন পরমাণুর ‘ভর’ একটি হাউড্রোজেন পরমাণুর ভারের আট গুণ। ওজন হচ্ছে কোনো বস্তুকে যে বলে পৃথিবী আকর্ষণ করে, অন্যদিকে স্থুল ভাবে বললে ভর হচ্ছে, কোনো বস্তুতে অবস্থিত মোট পদার্থের পরিমাণ। এই দুই ধারণার মধ্যে ভর বেশী মৌলিক)।
এটি নিশ্চিত যে, ডাল্টনের পক্ষে অক্সিজেন বা হাইড্রোজেন কোন পরমাণুরই ভর জানার সুযোগ ছিলো না, কিন্তু তাদের ভর যা-ই হোক না কেন অক্সিজেন পরমাণুর ভর হাইড্রোজেন পরমাণুর ভরের আটগুণ বলে বোঝা গিয়েছিলো। আপনি চাইলে বলতে পারেন হাইড্রোজেন পরমাণুর ভর ১ (১ এর একক কী সেটি না উল্লেখ করে।) তাহলে আপনি এটিও এখন বলতে পারেন যে অক্সিজেন পরমাণুর ভর ৮। (প্রকৃতপক্ষে ডাল্টনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে আমরা এখন বলে থাকি হাউড্রোজেনের পরমাণু ১ ডাল্টন, কিন্তু এটিকে শুধু ১ হিসেবে চালিয়ে দেওয়াটাই প্রচলিত)।
ডাল্টন অন্যান্য পরমাণু দিয়ে গঠিত যৌগ নিয়েও কাজ করলেন এবং বিভিন্ন পরমাণুর তুলনামূলক ভরের একটি ব্যবস্থা চালু করলেন। তিনি এর নাম দিলেন পারমাণবিক ‘ওজন’। এই পরিভাষাটি অদ্যাবধি ব্যবহার করা হয় যদিও প্রকৃতপক্ষে এর নাম হওয়ার কথা পারমাণবিক ভর। (প্রায়শঃই এমন ঘটনা ঘটে যে বিজ্ঞানীর একটি নির্দিষ্ট পরিভাষা ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেন এবং পরবর্তীতে অন্য একটি পরিভাষা আরো উপযুক্ত বলে প্রতীয়মান হয়। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে যায়, কেননা আগেরটি হয়তোবা এতোই প্রচলিত হয়ে গেছে যে, মানুষ ইতিমধ্যে পুরোনো পরিভাষাটি ব্যবহারেই অভ্যস্ত। আমরা শীঘ্রই এই বইয়ের অন্যান্য ক্ষেত্রেও এই ব্যাপারটি ঘটতে দেখব।)
ডাল্টনের পারমাণবিক ওজন নির্ণয়ের পদ্ধতির সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিলো যে, পদ্ধতিটি ভুল হওয়ার সম্ভাবনা খুবই বেশী। কেননা তিনি ধরে নিয়েছিলেন পানির অণু একটি হাইড্রোজেন এবং একটি অক্সিজেন অণু দিয়ে গঠিত। এবং তাঁর এই তথ্যের কোনো পরীক্ষালব্ধ সাক্ষ্য-প্রমাণ ছিলো না।
এসব ক্ষেত্রে ভুল এড়ানোর জন্য আপনাকে অবশ্যই সাক্ষ্য-প্রমাণ ও আলামত খুঁজতে হবে। ১৮০০ সালে ব্রিটিশ রসায়নবিদ উইলিয়াম নিকলসন (William Nicholson, ১৭৫৩-১৮১৫) এসিড মিশ্রিত পানির মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ চালনা করে অক্সিজেন এবং হাইড্রোজেন গ্যাসের বুদ্বুদ তৈরি করলেন। গবেষণা চালিয়ে গিয়ে তিনি দেখলেন যে, উৎপন্ন হাইড্রোজেন গ্যাসের আয়তন অক্সিজেন গ্যাসের আয়তনের দ্বিগুণ, যদিও উৎপন্ন অক্সিজেনের ভর হাইড্রোজেন গ্যাসের আটগুণ।
কেন উৎপন্ন হাইড্রোজেনের ভর অক্সিজেনের আটগুণ পাওয়া গেলো? এটা কি এই কারণে হতে পারে যে, পানির অণু দু’টি হাইড্রোজেন আর একটি অক্সিজেন পরমাণু দিয়ে গঠিত? এমনকি হতে পারে অক্সিজেনের ভর হাইড্রোজেনের দু’টি পরমাণুর সম্মিলিত ভরের তুলনায় আটগুণ? কিংবা হাইড্রোজেনের একটি পরমাণুর তুলনায় তা ১৬ গুণ? অন্যভাবে বললে, যদি হাইড্রোজেনের পারমাণবিক ওজন হয় ১, তাহলে অক্সিজেনের পারমাণবিক ওজন আট না হয়ে ১৬ হতে পারে?
ডাল্টন এই ধারণা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানালেন। (এই ধরনের ঘটনা প্রায়শঃই ঘটে, যখন দেখা যায় একজন অতিবড় বিজ্ঞানী হয়তো বিজ্ঞানকে অনেক বড় একটি ধাপ সামনে এগিয়ে নিয়েছেন এবং আরেকধাপ এগিয়ে নিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন। দেখে মনে হয়, প্রথম বড় ধাপটি তাদের সামর্থের সবটুকু নিংড়ে নিয়েছে এবং সামনে এগিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব অন্যদের কাঁধে পড়ছে)।
এই যখন পরিস্থিতি, তখন বার্জেলিয়াস এগিয়ে এলেন এবং হাইড্রোজেনকে ১ ও অক্সিজেনকে ১৬ নম্বরে স্থান দিয়ে দিলেন। তিনি অন্য মৌলগুলো নিয়েও এই কাজ চালিয়ে গেলেন এবং ১৮২৮ সালে পারমাণবিক ওজনের একটি তালিকা প্রকাশ করলেন যা ডাল্টনের তালিকার চেয়ে অনেক উন্নত ছিলো। বার্জেলিয়াসের কাজ-কর্ম থেকে এটি স্পষ্ট হয়ে গেলো যে, প্রত্যেকটি মৌলের পারমাণবিক ওজন ভিন্ন ভিন্ন এবং একই মৌলের পরমাণুসমূহের ওজন অভিন্ন (এখানে আমি অবশ্যই আপনাদের আরেকবার স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, পরবর্তীতে প্রমাণিত হয়েছে এই উপসংহার পুরোপুরি শুদ্ধ নয়। তবে এটি পরবর্তী প্রায় এক শতাব্দীর রসায়নবিদদের গবেষণা চালিয়ে নেওয়ার মতো যথেষ্ট পরিমাণ শুদ্ধ ছিলো। কালক্রমে জ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে এই দৃষ্টিভঙ্গী কিছুটা পরিবর্তীত হয়েছিলো এবং পারমাণবিক তত্ত্ব এর সাথে সাথে অমূল্য অগ্রগতি অর্জন করেছিলো। বৈজ্ঞানিক তত্ত্বগুলো সময়ের সাথে সাথে উন্নত হয় এবং এটি বিজ্ঞানের গর্ব। বিজ্ঞানের তত্ত্বগুলো হুবহু অপরিবর্তীত থাকতে হবে এটা মনে করা মানে হচ্ছে পাঁচতলায় পৌঁছনোর জন্য সিঁড়িতে ছোট ছোট অনেকগুলো ধাপ না দিয়ে নিচ থেকে পাঁচতলা পর্যন্ত উঁচু একটি মাত্র ধাপ দেওয়াটাই যুক্তি-যুক্ত মনে করা)।
যা-হোক, যেমনটি দেখা গিয়েছিলো, পানিকে যখন তড়িৎ প্রবাহ দিয়ে ভেঙে ফেলা হয় তখন অক্সিজেনের চেয়ে দ্বিগুণ আয়তনের হাইড্রোজেন উৎপন্ন হয়। এই তথ্য থেকে আমরা কীভাবে জানতে পারি যে পানির অণুতে একটি অক্সিজেনের বিপরীতে দু’টি হাইড্রোজেন পরমাণু আছে? বার্জেলিয়াসের কাছে এমনটা মনে হয়েছে তবে তিনি নিশ্চিত ছিলেন না। এটিও ছিলো একটি অনুমান এমনকি ডাল্টনের ১ টি হাইড্রোজেনের বিপরীতে একটি অক্সিজেন ধরে নেওয়ার পেছনে যতটুকু তথ্যপ্রমাণ ছিলো এখানে সেটুকুও ছিলো না।
১৮১১ সালে ইতালিয় পদার্থবিদ এমেদিও এভোগেড্রো (Amedeo Avogadro, ১৭৭৬-১৮৫৬) আরেকটু বিস্তৃত ভাবে এই বিষয়টি নিয়ে অনুমান করেন। তিনি প্রস্তাব করেন, যে কোনো গ্যাসের ক্ষেত্রে সমান সংখ্যক অণু সমান আয়তন দখল করে। যদি একটি গ্যাসের আয়তন অন্য গ্যাসের দ্বিগুণ হয় তাহলে প্রথমোক্ত গ্যাসে দ্বিতীয় গ্যাসের দ্বিগুণ পরিমাণ অণু উপস্থিত আছে। একে এভোগেড্রোর প্রকল্প বলা হয়। (প্রকল্প হচ্ছে এক ধরনের অনুমান যা মাঝে মাঝে গ্রহণ করা হয় শুধু মাত্র ‘যদি এমন হয় তাহলে কেমন হবে’ কিংবা ‘যদি এমন হয় তাহলেতো তেমনটি হওয়ার কথা, দেখা যাক হয় কিনা’ এমনটি খতিয়ে দেখার জন্য। যদি কোনো একটি কিছু ধরে নিয়ে অসংলগ্ন ফল পাওয়া যায় তাহলে প্রকল্পটি বাতিল করে দেওয়া হয়)।
প্রকৃতিগতভাবে, যখন একজন প্রতিশ্রুতিশীল বিজ্ঞানী একটি প্রকল্প উত্থাপন করেন যে সেটি ‘সত্য হলেও হতে পারে’ তখন সেটি সত্য প্রমাণিত হওয়ার বেশ ভালো সম্ভাবনা থাকে। এভোগেড্রোর প্রকল্পটি পরীক্ষা করে দেখার একটি পদ্ধতি হতে পারে বিপুল সংখ্যক গ্যাস নিয়ে তাদের অণুগুলোর অন্তর্ভূক্ত পরমাণু নিয়ে পর্যবেক্ষণ করা।
যদি কেউ এই কাজটি শুরু করে এবং শেষ পর্যন্ত দেখতে পায় যে, তার ফলাফল ইতিপূর্বে নিশ্চিত হওয়া কোনো বিষয়ের সাথে পরষ্পরবিরোধী, যেমন: একটি ধারায় দেখা গেলো নির্দিষ্ট কোনো প্রকল্প অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট অণু একটি নির্দিষ্ট বিন্যাসের পরমাণু দিয়ে গঠিত এবং অপর ধারায় দেখা গেলো বিন্যাসটি ভিন্ন ধরনের তাহলে বোঝা যাবে যে, এভোগেড্রোর প্রকল্পটি ভুল।
বস্তুতপক্ষে, এভোগেড্রোর প্রকল্পকে কেউই একটি ক্ষেত্রেও বিভ্রান্তিকর হিসেবে পাননি এবং এটিকে আর প্রকল্প নয় বরং সত্য বলে বিবেচনা করা হয়েছিলো যদিও বিশেষ বিশেষ অবস্থায় এটিকে অবশ্যই কিছুটা পরিবর্তন করে নিতে হত। এটিকে এখনো এভোগেড্রোর প্রকল্পই বলা হয় কেননা রসায়নবিদরা এটিকে এই নামে ডেকে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন।
এখানে একটি সমস্যা হলো, এভোগেড্রোর প্রকল্পটি যখন আবির্ভুত হয়েছিলো তখন খুব অল্প পরিমাণ রসায়নবিদই এটির প্রতি মনোযোগ দিয়েছিলেন। তাঁরা এটির কথা হয় শোনেন নি অথবা উদ্ভট কিংবা গুরুত্বহীন মনে করে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। এমনকি বার্জেলিয়াসও তাঁর পারমাণবিক ওজনের তালিকা করার সময় এই প্রকল্প ব্যবহার করেন নি, সেই কারণে তাঁর তালিকাটির কিছু কিছু জায়গায় ভুল হয়ে গিয়েছিলো।
১৮৫৮ সালে ইতালীয় রসায়নবিদ স্ট্যানিসলাস ক্যানিজারোর (Stanislaus Canizaro, ১৮২৬ -১৯২০) দৃষ্টিগোচর হলো যে, এভোগেড্রোর প্রকল্পই হচ্ছে সেই জিনিস যা একটি অণু কয়টি পরমাণু দিয়ে গঠিত তা বের করার জন্য প্রয়োজন। ১৮৬০ সালে রসায়নের উপরে একটি বড়ো-সড়ো আন্তর্জাতিক সম্মেলন হয় যাতে সমগ্র ইউরোপ থেকে রসায়নবিদগণ অংশ নেন (এটিই ছিলো এই ধরনের প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলন)। এই সম্মেলনে ক্যানিজারো খুব সফলতার সাথে প্রকল্পটিকে ব্যাখ্যা করেন।
এই ঘটনা রাতারাতি পরমাণবিক ওজনের ধারণা পাল্টে দিল। ১৮৬৫ সালের মধ্যে বেলজিয়ামের রসায়নবিদ জাঁ-স্যারভা স্টাস (jean servais stas ১৮৩১-১৮৯৮) পারমাণবিক ওজনের একটি নতুন তালিকা প্রণয়ন করেন যা বার্জেলিয়াসেরটির চেয়ে উন্নতমানের ছিলো। প্রায় চল্লিশ বছর পরে, আমেরিকান রসায়নবিদ থিওডোর উইলিয়াম রিচার্ড (Theodore William Richards, ১৮৬৮-১৯২৮) আরো সূক্ষ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে আরো অনেক যথার্থভাবে এই মানগুলো নির্ণয় করেন যা ইতিপূর্বে সম্ভব ছিলো না কেননা কিছু নতুন আবিষ্কারের কারণে পারমাণবিক ওজনের বিষয়টিকেই পরিমার্জন করে ফেলতে হয়েছিলো (আমরা সামনে তা দেখব)। রিচার্ডের সময়কালে নোবেল পুরষ্কারের প্রচলন ঘটে এবং পারমাণবিক ওজন নিয়ে তাঁর কাজের জন্য ১৯১৪ সালে তাঁকে রসায়নে নোবেল পুরষ্কার দেওয়া হয়।
যেমনটি পাওয়া গেলো, সবচেয়ে ছোট পারমাণবিক ওজন বিশিষ্ট মৌলটি হচ্ছে হাইড্রোজেন। যদি এর পারমাণবিক ওজন ঐচ্ছিক ভাবে ১ এ রাখা হয় তাহলে অক্সিজেনের পারমাণবিক ওজন হবে ১৬ এর চেয়ে সামান্য কম। (এটি পুরোপুরি ১৬ নয়, যার কারণ আমরা পরবর্তীতে আলোচনা করব)। কিন্তু, অক্সিজেন খুব সহজেই বিশাল সংখ্যক অন্যান্য মৌলের সাথে যুক্ত হয়। তাই কিছু কিছু মৌল আছে যাদের পারমাণবিক ওজন হাইড্রোজেনের বদলে অক্সিজেনের সাথে তুলনা করে বের করা সহজ। তাই হাইড্রোজেনের সাপেক্ষে অক্সিজেনের পারমাণবিক ওজন ঠিক না করে অক্সিজেনের জন্যই একটি সুবিধাজনক পারমাণবিক ওজন ঠিক করাই শ্রেয়। এটাকে ১ ধরা ঠিক হবে না কেননা তাহলে এরচেয়ে ছোট ওজনের পরমাণুগুলোকে ১ এর চেয়ে ছোট মানে নির্ণয় করতে হবে যা রাসায়নিক গণনাসমূহকে জটিল করে তুলবে।
তাই অক্সিজেনের পারমাণবিক ওজনকে ১৬ তে স্থির রাখাই প্রথা হয়ে দাঁড়ায় যার সাপেক্ষে হাইড্রোজেনের পারমাণবিক ওজন পাওয়া যায় ১ এর চেয়ে কিছুটা বেশী। এর অর্থ দাঁড়ায় কোনো মৌলের পারমাণবিক ওজনই ১ এর চেয়ে ছোট হবে না। স্টাসের তালিকাটি এভাবেই তৈরি করা হয় এবং এটি একসময় প্রথা হয়ে যায়। (ইদানিংকালে পরিস্থিতি কিছুটা পরিবর্তীত হয়েছে যা পরবর্তীতে ব্যাখ্যা করা হবে।)
যদি মৌলসমূহকে তাদের পারমাণবিক ওজনের ক্রমানুসারে তালিকাভূক্ত করা হয় তাহলে তাদেরকে একটি অপেক্ষাকৃত জটিল ছকে সাজানো সম্ভব যা মৌলের কিছু বিশেষ ধর্মকেও প্রকাশ করে এবং মৌলসমূহের ধর্মে একটি পর্যায়ক্রমিক মিল পাওয়া যায়। যদি ছকটি সঠিকভাবে বিন্যাস্ত করা যায় তাহলে একই ধরনের ধর্ম বিশিষ্ট মৌলগুলো একই কলামে পড়ে। এই ছকটিকে বলা হয় পর্যায় সারণি (periodic table) এবং ১৮৬৯ সালে এর একটি কর্মক্ষম সংস্করণ প্রথম উপস্থাপন করেন রাশিয়ান রসায়নবিদ দিমিত্রি ইভানোভিচ মেন্ডেলিভ (Dmitri Ivanovich Mendeleev, ১৮৩৪-১৯০৭)।
প্রথম দিকে পর্যায় সারণি মোটেও সুস্পষ্ট ও সহজবোধ্য ছিলো না কেননা মেন্ডেলিভ সব মৌল সম্বন্ধে জানতেন না। অনেক মৌল তখনো আবিষ্কৃত হয় নি। মৌলসমূহকে তাদের ধর্ম অনুযায়ী ছকে স্থাপন করতে গিয়ে মেন্ডলিভকে অনেকগুলো ঘর ফাঁকা রাখতে হয়েছে। তিনি অনুভব করলেন, যে স্থানগুলো পর্যায় সারণিতে খালি আছে সেখানে একেকটি করে মৌল বসবে যা ভবিষ্যতে আবিষ্কৃত হবে। এরমধ্যে তিনটি খালি ঘর নিয়ে তিনি ১৮৭১ সালে ঘোষণা দিলেন যে, এই তিনটি ঘরে যেসব মৌল বসবে তাদের ধর্মসমূহ কেমন হবে। ১৮৮৫ সালের মধ্যে সেই তিনটি মৌল আবিষ্কৃত হলো এবং মেন্ডেলিভ তাদের ধর্ম সম্বন্ধে যে ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন তা হুবহু মিলে গেলো। এই ঘটনা থেকে এটা প্রতীয়মান হলো যে, পর্যায় সারণি শুধু মাত্র ইচ্ছামত সাজানো একটি সারণি নয় বরং পরমাণুর বৈশিষ্ট্য অনুযায়ীই এটি তৈরি হওয়া অবশ্যম্ভাবী যদিও তখনো কেউ ব্যাখ্যা করতে পারেন নি কেন পর্যায় সারণি এভাবে কাজ করে। (পরবর্তীতে আমরা এতে আবারও ফিরে আসব।)
[বইয়ের সূচীপত্র তথা প্রকাশিত সবগুলো আর্টিকেলের জন্য এখানে দেখুন। বিজ্ঞান পত্রিকায় সম্পূর্ণ বইটিই পড়া যাবে, তবে মুদ্রিত সংস্করণটি সংগ্রহ করতে চাইলে যোগাযোগ করুন: ছায়াবিথী প্রকাশনী, ফোন: ০১৭২৩৮০৭৫৩৯]
-ইমতিয়াজ আহমেদ
সম্পাদক, বিজ্ঞান পত্রিকা
[ফেসবুক প্রোফাইল]