প্রকৃতিতে প্রচুর পরিমাণে বিচিত্র ধরনের সৃষ্টির অস্তিত্ব আছে। তাদের খুব সামান্য একটি অংশ মাত্র মানুষ পোষ মানাতে পারে। অল্প পরিমাণ প্রাণীকে সরাসরি নিজেদের আদেশ-উপদেশ পালন করাতে পারে। যেসব প্রাণীদের পোষ মানাতে পারে তাদের দিয়ে আবার সব ধরনের কাজ মন মতো কাজ করিয়ে নেয়া যায় না। প্রয়োজনের তাগিদে মানুষের এমন কিছু দরকার যা দিয়ে নিজের চাহিদামতো কাজ আদায় করিয়ে নেয়া যাবে।
কেমন হতো যদি পিপড়াদের মতো ছোট প্রাণীদের পোষ মানানো যেতো? কেমন হতো যদি ফড়িংকে দিয়ে শত্রুপক্ষের অবস্থান ও গোপন সংবাদ হাসিল করানো যেতো? বাস্তবে হয়তো এসব প্রাণীদের দিয়ে এম কিছু করা যাবে না, কিন্তু তাই বলে বিজ্ঞানীরা বসে থাকেননি। তাঁরা ক্ষুদ্র পোকা-মাকড়ের মতো করে রোবট বানিয়ে যাচ্ছেন। আকারে বড় হবার কারণে মানুষ যেখানে যেতে পারে না, ছোট বা সংকুচিত স্থান হবার কারণে যাওয়া সম্ভবও নয়, সেখানে এদের দিয়ে কাজ করানো যাবে ইচ্ছে মতো। এমন ধরনের কয়েকটি পতঙ্গ রোবট নিয়ে আজকের আয়োজন।
১. রোবট মৌমাছি (Robobee)
হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির একদল গবেষক এই রোবট-মৌমাছি তৈরি করেন। এটি নিজে নিজেই উড়তে পারে। পাখার নিচে থাকে কন্ট্রোল প্যানেল। কন্ট্রোল প্যানেলের সাহায্যে একে নিয়ন্ত্রণ ও নির্দেশনা দেয়া হয়। এর পাখা প্রতি সেকেন্ডে ১২০ বার উঠানামা করাতে পারে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে সহজে উড়ে যাবার জন্য, আগুন লেগে তৈরি দুর্ঘটনায় (যেখানে মানুষ প্রবেশ করতে পারে না), এমনকি ফুলের কৃত্রিম পরাগায়নেও এদের কাজে লাগানো যাবে। আকৃতির দিক থেকে এগুলো কেমন ছোট তা একটি উদাহরণে বুঝা যাবে। এরকম এক হাজারটা মৌমাছি যদি একত্রে নেয়া হয় তবে তাদের ভর হবে আধা কেজির মতো!
২. রোবট পিপড়া
১৯৯০ সালেই পিপড়া রোবট বানানোর পরিকল্পনা শুরু হয়। এই ধরনের রোবটের ডিজাইন চিন্তা-ভাবনা করেন ম্যাসাচুসেট ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজির ছাত্র জেমস ম্যাকলারকিন। তার তৈরি করা রোবট পিঁপড়ার ভেতরে একটি ছোট কম্পিউটার, আলোক সংকেত শনাক্ত করার সেন্সর, দুটি মোটর ছিল। একটি মোটরের সাহায্যে চলাচল করতো এবং আরেকটি ব্যাবহার করত দাঁত (ম্যান্ডিবল) নাড়াচাড়া করার কাজে। লম্বায় মাত্র ১ ইঞ্চি। লুকিয়ে রাখা বা হারিয়ে যাওয়া কোনো বস্তু খুঁজে পেতে এই রোবট কাজে লাগবে। সরু সুরঙ্গের ভেতর থেকে কোনো তথ্য বা ভিডিও করে আনতে এগুলো উত্তমভাবে ব্যবহার করা যাবে। ধীরে ধীরে একে আধুনিক করা হচ্ছে। আধুনিক সংস্করণে সুবিধা থাকছে বেশি, দাম পড়ছে কম।
৩. ড্রাগন ফ্লাই
জর্জিয়া টেকের একদল গবেষক ড্রাগন-ফ্লাই নামক এই রোবটটি তৈরি করেন। এর চার কোনায় চারটি পাখা। আকারে তেমন বড় নয়, হাতের তালুতেই সহজে জায়গা করে নিতে পারবে। বিমান বা হেলিকপ্টারের মতো করে উড়তে পারে এই পতঙ্গ-রোবট। যেখানে মানুষ যেতে পারে না বা গেলে কৌশলগত কারণে কিছু সমস্যার দেখা দেয় এরকম নিষিদ্ধ বা গোপন জায়গা থেকে খুব সহজেই তথ্য পৌঁছে দিতে পারে। পাশাপাশি করতে পারে ভিডিও। এমনভাবে উড়ে যে, কেউ দেখলে সত্যিকারের পোকা বলেই মনে করে; বুঝতে পারে না এটা একটা যন্ত্র।
৪. রোবট তেলাপোকা
২০০৯ সালে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক এই রোবট-তেলাপোকাটি তৈরি করেন। তাঁরা ছয়-পাওয়ালা ক্ষুদ্র রোবট তৈরি করতে চাইছিলেন। ছয় পায়ের ধারণা থেকে ছয়-পাওয়ালা তেলাপোকা রোবট তৈরি করে ফেলেন। দৈর্ঘ্যে ১০ সেন্টিমিটার। এই ক্ষেত্রে ১০ সেন্টিমিটার মোটামুটি ভালোই বড়। তবে বড় হলেও এর চলাচলের গতিতে কোনো সমস্যা হয় না। প্রতি সেকেন্ডে প্রায় তিন মিটার যেতে পারে। এই দিক থেকে এটি বিশেষ ধরনের। এটি এমন দ্রুত গতির রোবট যা ১ সেকেন্ডে তার দেহের দৈর্ঘ্যের ২৬ গুণ দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে।
৫. হেক্টর
এটিও ছয় পা-ওয়ালা রোবট। তবে একে তেলাপোকা থেকেও একটু টেকসই করে গড়ে তোলা হয়েছে। কিন্তু এক দিক থেকে সুবিধা বেশি পেলে অন্য দিক দিয়ে কমে যায়। এরও হল তাই, টেকসই হলেও এটি তেলাপোকার মতো উন্নত নয়। তবে এটি বৈজ্ঞানিক গবেষণার কাজে ব্যবহারের জন্য বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছে। যে কাজগুলো দেখতে ছোটখাটো কিন্তু মানুষ সেগুলো করতে পারে না সেই কাজগুলো করবে হেক্টর নামের এই ক্ষুদ্র রোবট।
৬. চতুর্মুখী কপ্টার
হাঁটতে, দৌড়াতে ও উড়তে পারে বলেই এর এই নাম- ‘চতুর্মুখী কপ্টার’। কার্বন ফাইবারের ফ্রেমে তৈরি এই রোবটে ৬ টি ঘূর্ণায়মান অংশ (rotor) আছে। এগুলো ভারসাম্য রক্ষা করে এবং চলতে সাহায্য করে। এর উদ্ভাবক Mad Lab Industries-এর একজন সদস্য। নিছক মজা করার জন্য এই অদ্ভুত রোবট তৈরি করেছিল তারা। সংস্থার নামই তো ‘ম্যাড’! তবে মজা করে তৈরি করলেও এটি এমন পারফরমেন্স দেখিয়েছে যে একে দেখলে যে কেউই বলবে এটি ভবিষ্যতের রোবটের জন্য মডেল হতে যাচ্ছে।
৭. রোবট উইপোকা
আসবাবপত্র আর কাঠ কুড়কুড় করে খেয়ে ফেলা পোকাকে বেছে নেয়া হয়েছে রোবট বানানোর নমুনা হিসেবে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক এই কৃত্রিম রোবট-উইপোকা তৈরি করেন। এর পেছনে কাজ করেছেন কম্পিউটার বিজ্ঞানী রাধিকা নাগপাল, এবং তার সহকর্মীরা। রোবট-উইপোকারা ক্ষুদ্র স্থাপনা তৈরি করতে পারে। ক্ষুদ্র ইট সাজিয়ে সাজিয়ে এরা সিঁড়ি বানাতে পারে। চলার পথে উঁচু কোনো বাধা পড়লে নিজে নিজেই ইট বিছিয়ে বাধার সমান উঁচু হয়ে পার হয়ে যেতে পারে। ভবিষ্যতে নির্মাণ কাজে, নির্মাণ কাজে মানুষকে সাহায্য করতে তাদের ব্যাবহার করা যেতে পারে।
৮. ছোট তেলাপোকা
এরা দেখতে স্বাভাবিক জীবন্ত তেলাপোকার মতোই। তবে আকৃতিতে ছোট। আগে উল্লেখ করা তেলাপোকারা তাদের কাজে অনেক সচল। সেই তুলনায় এটা এতটা সচল নয়। তবে এদের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এরা কয়েকটি রোবট খুব সুন্দরভাবে একসাথে মিলতে পারে। অনেকটা ফুটবল খেলার টিমের মতো। তার ফলে মনে হয় এরা সত্যিকারের কোনো তেলাপোকা। এদেরকে আগে উল্লেখ করা তেলাপোকার সাথে ব্যাবহার করা যেতে পারে। ফলে সহজে মানুষের চোখকে ফাঁকি দেয়া যাবে।
৯. রোবট প্রজাপতি
জাপানি গবেষকদের দ্বারা তৈরি হয়েছে এই রোবট প্রজাপতি। এটি হয়তো প্রকৃতির প্রজাপতির মতো অনিন্দ্য সুন্দর নয়, কিন্তু তারপরেও খুব কাজের। আকার-আকৃতিতে আসল প্রজাপতির মতো। চালাতে বাইরে থেকে নজরদারি করা লাগে না। সামনে কোনো বাধা থাকলে এটি নিজে নিজেই তা অতিক্রম করে যেতে পারে।
১০. গোয়েন্দা প্রজাপতি রোবট
ইজরাইলের বিজ্ঞানীরা এমন এক প্রজাপতি রোবট তৈরি করেছেন যা পুরোদস্তর গোয়েন্দার কাজ করতে পারবে। ভরে মাত্র ২০ গ্রাম। ভবনের ভিতরে থাকা কোনো কিছুর তথ্য উদ্ঘাটন ও সংগ্রহের জন্য একে উপযুক্ত করে বানানো হয়েছে। এর সাথে খুবই ক্ষুদ্রাকৃতির ক্যামেরা ও মেমোরি কার্ডও জুড়ে দেয়া হয়েছে। রোবটটির সাথে একটি হেলমেটের সম্পর্ক আছে। যখন কেও এই হেলমেটটি মাথায় পরবে তখন এই রোবটটি যা দেখে অর্থাৎ ক্যামেরায় যা ধরা পড়ে অনেক অনেক মাইল দূরে থেকে হেলমেট পরিহিত লোকটিও তাই দেখতে পায়।
– সিরাজাম মুনির শ্রাবণ