☞ দুটো ঘটনা দিয়ে শুরু করতে চাই। প্রথমটি পাশ্চাত্যের ধ্রুপদী সংগীতের বিখ্যাত নাম নিকোলা প্যাগানিনিকে নিয়ে। প্যাগানিনি বেহালা বাজানোর আধুনিক রীতি স্থাপন করে গেছেন। তাঁর বেহালা বাজানোর হাত তখনকার সমসাময়িক অন্যান্য প্রতিভাধর বেহালা বাদকদের ছাড়িয়ে এতটাই রোমাঞ্চে উঠে গেছিল যে শেষকালে তাকে শয়তানের উপাসক এর সম্বোধন পেতে হয়েছিল। হবেই না বা কেন? প্যাগানিনি তাঁর হাত এমন অদ্ভুদ ভাবে বাঁকিয়ে বেহালা বাজাতে পারতেন যা কিনা অন্য স্বাভাবিক মানুষদের জন্যে অসম্ভব ছিল। তাঁর হাতের আঙ্গুল গুলো ছিল অস্বাভাবিক রকম লম্বা। চাইলেই তিনি তাঁর হাত না নাড়িয়ে আঙ্গুল এর প্রথম সন্ধি সমকোণে বাঁকিয়ে বেহালা বাজাতে পারতেন। সমসাময়িক কুসংস্কারাচ্ছন্ন ইউরোপিয়ানরা তাঁকে শয়তানের উপাসক বলে আখ্যায়িত করা শুরু করেছিল। প্যাগানিনি নিজেও মানুষের এই ভীতিকে উপভোগ করার চেষ্টা করতেন। সেজন্যে তিনি কালো পোশাক পরিধান করতেন। কালো ঘোড়ায় চরতেন। সত্যিকার অর্থে পেগানিনি একটা জটিল বংশগত রোগ মারফান সিনড্রোম এ আক্রান্ত ছিলেন। দেহের সংযোজক কলার জিনে মিউটেশন ঘটার কারণে এই রোগ হয়। এতে করে সংযোজন কলায় পরিবর্তন আসে। ফলত পায়ের আঙ্গুল, হাতের আঙ্গুল অস্বাভাবিক রকমের লম্বা হয়ে যায়। অস্থি সন্ধি গুলো অধিক নমনীয় হয়ে পড়ে। বংশগত এই বিরল রোগটি প্যাগানিনির জীবনে বলা যায় আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়ায়।
দ্বিতীয় ঘটনাটি স্পেনের রাজা দ্বিতিয় চার্লসকে নিয়ে। ১ নভেম্বর, ১৭০০ সালে তিনি মারা যান। তাঁর মৃত্যুর সাথে সাথে স্পেনের পুরো হাবসবার্গ সাম্রাজ্যই বিলুপ্ত হয়ে যায়। তিনি সফল রাজা তো ছিলেনই না সেই সাথে তিনি ছিলেন নপুংসক। তিনি শারীরিক ভাবেও প্রতিবন্ধী ছিলেন। তাঁর জিব অস্বাভাবিক রকমের বড় ছিল, দেহ অস্বাভাবিক ছিল, মানসিক ভাবেও প্রতিবন্ধিও ছিলেন তিনি। স্পেন এর শেষ রাজার এই বেহাল দশাই রাজবংশটির বিলুপ্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু সত্যিকার অর্থে এর মূল কারণ ছিল সেই রাজবংশের বিবাহ পদ্ধতি। সতেরো প্রজন্ম ধরে এই রাজবংশে নিজেদের মধ্যেই বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়। এমনকি চার্লসের নিজের মা ছিলেন তাঁর পিতার ভাগ্নি এবং তাঁর দাদি সম্পর্কে তাঁর খালা ছিলেন! এভাবে দীর্ঘদিন ধরে নিজ বংশের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে বিয়ে হলে এর পরিণাম আসলে এমনই হবে। কেননা এই ক্ষেত্রে বংশের ত্রুটিযুক্ত জিন গুলোর বংশানুক্রমে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। এই দুটো ঘটনারই রহস্যের অন্তর্নিহিত উত্তর বংশগতির বিজ্ঞান তথা জেনেটিক্স দিয়েছে। এই রকম আরও নানা রকম বংশগতি বিষয়ক প্রশ্ন যেমন মা-বাবার বৈশিষ্ট্য কি সন্তান-সন্ততিতে বংশানুক্রমে যায়? গেলে সেটা কীভাবে? জিন বলতে কি সত্যি কিছু আছে? থাকলে সেটা আমাদের শরীরে কীভাবে কাজ করে? ভবিষ্যতে কি বংশগত রোগ সমূহ থেকে স্থায়ী ভাবে নিস্তার পাওয়া সম্ভব?- এতসব বিচিত্র্য প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে আপনাকে বংশগতির বিদ্যা তথা জেনেটিক্স সম্পর্কে জানতে হবে, বোঝতে হবে। সুতরাং নিজ মাতৃভাষায় তথা বাংলায় এই বিষয়ের একটা বই কি রকম দরকারি সেটা বলে শেষ করা যাবে না।
আর এই কাজটিই বেশ চমৎকার, সাবলীল আর যথার্থ ভাবে করছেন গবেষক, লেখক, আমার বিজ্ঞান লেখালেখির পথপ্রদর্শক আরাফাত রহমান ভাই। বলছি গত বইমেলাতে প্রকাশিত হওয়া তাঁর “জেনেটিক্সঃ বংশগতিবিদ্যার সহজ পাঠ” বইটির কথা। পেপারব্যাক করা চাররঙা এই বইটির প্রচ্ছদ, নকশা নিয়ে ইতোমধ্যেই অনেক প্রশংসার কথা এসেছে। আমি বরং সরাসরি বই এর বিষয়বস্তুতে যাই। প্রকৃতি আমাদের জীবনের মহাকাব্য লিখেছে নিউক্লিওটাইডস এর অনুক্রম দিয়ে। আমাদের গায়ের রং, উচ্চতা, বুদ্ধিমত্তা, চুলের রং, চোখের রং থেকে শুরু করে যাবতীয় বৈশিষ্ট্য কোষের ডিএনএ তে থাকা কিছু নিউক্লিওটাইডস এর অনুক্রম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। সেসব অনুক্রমকে বলে জিন। এই জিন বংশানুক্রমে পিতা-মাতার এসব বৈশিষ্ট্য নিয়ে যায়। বংশগতি নিয়ে মানুষের কৌতূহল ছিল সেই কৃষি বিপ্লব থেকেই। হিপক্রিটাস, অ্যারিস্টটল, ডারউইনসহ অনেকেই বংশগতিকে বোঝার চেষ্টা করে গেছেন। শেষে এই যুগান্তকারী কাজটা অনেকটাই করে ফেলেছিলেন অস্ট্রিয়ান ধর্মযাজক গ্রেগর জোহান মেণ্ডেল। মটরশুঁটি নিয়ে দীর্ঘ সাত বছর গবেষণা করে মেণ্ডেলই প্রথম বলেন কিছু ফ্যাক্টর এর মাধ্যমে বংশানুক্রমে পিতা-মাতার বৈশিষ্ট্য সন্তানের দেহে যায়। মেণ্ডেল এর এই থিওরি তখন মেনে নেন নি জীববিজ্ঞানের বেশিরভাগ বিজ্ঞানীই। তার অবশ্য কারণও আছে। তখনও বিজ্ঞানীদের এটা জানা ছিল না যে, ‘’ক্রোমোজোম এ থাকা ডিএনএ-ই বংশগতবস্তু। আর ক্রোমোজোম কোষ বিভাজনের মাধ্যমে ডিএনএ কে বংশানুক্রমে স্থানান্তরিত করে।’’
থমাস হান্ট মরগান, ফ্রেডরিখ মিশারসহ অনেক নামকরা জীববিজ্ঞানীও তখন বিশ্বাস করতেন ডিএনএ নয় প্রোটিন-ই বরং বংশগত বস্তু। তবে পরবর্তীতে মরগান-ই ফলের মাছি নিয়ে গবেষণা করে দেখান যে, মেণ্ডেল দেয়া থিওরিই সঠিক। তিনিই মেণ্ডেল এর ফ্যাক্টরকে জিন নামে অভিহিত করেন এবং বলেন জিন এর অবস্থান ক্রোমোজোম এ। বংশগতির এই ইতিহাস বেশ বিস্তারিত আর সুন্দরভাবে উঠে এসেছে জেনেটিক্স বইটায়। বইটার ইতিহাস বর্ণনা সন্দেহাতীত ভাবে পাঠকের মনে জায়গা করে নেবে। শুধু তাই-ই নয় মেণ্ডেল এর দেয়া সুত্রগুলোর সীমাবদ্ধতা কোন জায়গায়, বংশগতির নতুন শাখা এপিজেনেটিক্স, মিউটেশন কি- এই সব কিছুরই সহজ বাংলায় উপস্থাপন করা হয়েছে বইটিতে। ডিএনএ এর গঠন, ডিএনএ এর সংখ্যা বাড়ে কি করে, কি করে ডিএনএ তে থাকা জিন কাজ করে সেসব সম্বন্ধেও পাঠকের জ্ঞানতৃষ্ণা মিটবে আশা করি বইটি পাঠ করে। তাছাড়া ডিএনএ এর দ্বিসুত্রাকার গঠন আবিষ্কারের সেই বিতর্কিত প্রশ্ন, ফ্রান্সিক -ক্রিক কি রোজালিণ্ড ফ্রাঙ্কলিন এর ডিএনএ নিয়ে গবেষণার তথ্য চুরি করেছিল? তার উত্তরও মেলবে এই বইয়ে।
বইটির সপ্তম এবং অষ্টম অধ্যায় দুটি আমার কাছে বিশেষ প্রাধান্য পেয়েছে। এই অধ্যায় দুটি আলোচনা করেছে বর্তমান এর বেশ আলোচিত বিষয় জিনোম সিকোয়েন্স প্রযুক্তি এবং জিনোম সম্পাদনার প্রযুক্তি নিয়ে। সেই সাথে এই ক্ষেত্রে আমাদের ভবিষ্যৎ কি তাও বিশেষ গুরুত্বের সহকারে তুলে ধরা হয়েছে।
কোন জীবের ডিএনএ তে থাকা সকল জিন এর সমষ্টিকে একসাথে বলে জিনোম। কোন জীব এর জিনোম এর অনুক্রম বের করে ফেলতে পারলে ঐ জীব এর বংশগতির বলা যায় সবটাই জানা হয়ে যাবে। জিনোম সিকোয়েন্স প্রযুক্তি ইতোমধ্যেই মানুষকে সেই সুযোগ করে দিয়েছে। এখন মানুষ চাইলেই পর্যাপ্ত অর্থনৈতিক সামর্থ্য থাকলে তার জিনোম সিকোয়েন্স করে জেনে ফেলতে পারবে তার বংশগতিতে কোন ত্রুটি আছে কিনা। বর্তমানে মানুষ ধীরে ধীরে তার নিজের বংশগতিকে নিজেই সম্পাদনা করার ক্ষমতা অর্জন করছে। ক্রিসপার ক্যাস-৯ এর মতন প্রযুক্তি গুলো দিয়ে জীবের জিনোম এ একদম জিন লেভেল এ গিয়ে পরিবর্তন করা যায়। বংশগত রোগের চিকিৎসায় এই আবিষ্কার একটা বিপ্লব তো বটেই। কিন্তু এর অন্য খারাপ দিকও আছে। মানুষেরা তাদের জিনোম নিজের ইচ্ছে মতন সম্পাদনা করার সুযোগ পেয়ে গেলে কল্পকাহিনীর ফ্রাঙ্কেস্টাইন কে সৃষ্টি করার চেষ্টা করলে নিজেই নিজের ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের কিছু সংস্থা দাবী করে তারা দম্পতিদের উচ্চ গুন সম্পন্ন ভ্রুন নির্বাচন করে দিতে পারবে। এতে করে সমাজের প্রতাপশালী একটা অংশ নিজেদের ইচ্ছে মতন প্রজন্ম বাছাই এর সুযোগ পাবে। তাছাড়া জিনোম সম্পাদনা করে তারা ইচ্ছে মতন তাদের পরবর্তী প্রজন্মের জিনোম পরিবর্তন করে ফেলতে পারবে। এইসব কতটা মানবিক বা ন্যায় তা এখন বিতর্কের বিষয়। সবশেষে বংশগতিবিদ্যা নিয়ে যারা একেবারেই নতুন তাদের জন্যে বাংলা ভাষায় এই বইটা দিয়ে শুরু করা একটা উত্তম সিদ্ধান্ত হবে। সেই সাথে যাদের ইতোমধ্যেই বংশগতি নিয়ে পড়াশোনা আছে তারাও বইটির রস আস্বাদন করতে পারবেন বলে আমার ধারণা।
পর্যালোচনায়ঃ সুজয় কুমার দাস
শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়