মৃতদেহে জন্মানো অদ্ভূত এক নীল খনিজ

0
713

আপনি যদি আল্পস পর্বতের চূড়ায় ৫ হাজার বছর আগে মৃত বরফ মানব Ötzi-র খুব কাছাকাছি যান এবং গভীর ভাবে লক্ষ্য করেন, তবে দেখতে পাবেন তার গায়ে ছোট ছোট নীল কণার সৃষ্টি হয়েছে।

প্রথম অবস্থায় দেখে মনে হবে তার মৃত্যুর পর বরফ আচ্ছাদিত থাকার কারণে কিংবা শারীরিক অসুস্থতার জন্যে চামড়ার মাঝে এই অদ্ভুত নীলাভ স্ফটিকের আবরণ সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু তা একদমই নয়। মূলতঃ এটি ভিভিয়ানাইট (vivianite) (বা ব্লু আয়রন স্টোন) নামক একটি খনিজ। কোন মৃতদেহ দীর্ঘদিন কোন লৌহ সমৃদ্ধ এলাকার মধ্যে অবস্থান করলে প্রায়ই এর দেখা মিলে।

Ötzi-কে যেখানে তাকে পাওয়া যায় সেখানে ভিভিয়ানাইট এর কিছু অংশ আসে পাথরের মাঝে লৌহ থাকার কারণে, তবে অন্যান্য ক্ষেত্রে বিষয়টি আরও জটিল।

Atlas Obscura তে ক্রিস রজ বলেন, জন হোয়াট নামের এক ব্যাক্তিকে ১৮৮১ সালে একটি ঢালাই লোহার কফিনে সমাহিত করা হয়। সে সময়ে পরিবারের শোকার্ত সদস্যদের জন্য কফিনের মাঝে একটি জানালার মতো যায়গা খোলা রাখা হতো। যদিও কফিনের ঢাকনা বন্ধ থাকতো।

তাকে কবর দেয়ার কিছুদিন পর জানালাটি ভেঙ্গে যায় এবং এর মাধ্যমেই ভূগর্ভস্থ পানি লোহার কফিনের ভেতর ঢুকে ও তার শরীরের সংস্পর্শে চলে আসে।

এক শতাব্দী পর ঐ এলাকার জমির উন্নয়ন কাজ পরিচালনাকালে হোয়াইটকে কবর খুঁড়ে বের করে আনা হয়। আর তখনি উপস্থিত সকলেই অবাক বিষ্ময়ে দেখেন, কফিনের ভেতরে তার সমস্ত শরীর নীলাভ ভিভিয়ানাইট স্ফটিকে আবৃত।

এক টুকরো হাড়ে ভিভিয়ানাইট –র উপস্থিতি দেখতে এমন হয়
এক টুকরো হাড়ে ভিভিয়ানাইট –র উপস্থিতি দেখতে এমন হয়

ভিয়েতনামে বিমান দূর্ঘটনায় নিহত এক আমেরিকান সৈন্যের মৃত দেহেও এই ভিভিয়ানাইট পাওয়া গিয়েছিলো। খনিজের উপস্থিতি দেখে গবেষকরা বলেছিলেন, সম্ভবত সৈন্যটি বিমানের এক টুকরো ভাঙ্গা অংশের পাশেই একটি ভেজা সমতল জায়গায় মাটিচাপা পরেছিলো যার জন্যই ভিভিয়ানাইট সৃষ্টি হতে পেরেছে।

অনেকগুলো ঘটনার মাঝে এসব কয়েকটা উদাহরণ মাত্র যেখানে প্রত্নতত্ত্ববিদগণ উদ্ধারকৃত মৃতদেহ থেকে অদ্ভুত খনিজ বেয়ে উঠা দেখেছেন।

তাহলে এখানে কি ঘটছে?

ফসফেট যখন আয়রন ও পানির মিথস্ক্রিয়ায় যে ঘটনা ঘটে এখানেও ঠিক একই ঘটনা ঘটেছে। যখন আমাদের দেহ বিভিন্ন অণু দ্বারা গঠিত তখন সেই অণুগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে ফসফেট যা ভিভিয়ানাইট এর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর সৌভাগ্যক্রমে এটা আমাদের দেহের সবখানে পাওয়া যায়।

রজ বর্ণনা করেন, “ফসফেট হাড় এবং দাঁতের মতো শক্ত অংশে উপস্থিত থাকে (হাইড্রোক্সিল্যাপেটাইট খনিজের অংশ হিসেবে) যা আরএনএ এবং ডিএনএ এর সাথে জুরে থাকতে সহায়তা করে। আবার কোষের সাহায্যে শক্তি সংরক্ষণ ও প্রবাহিত করতে ব্যবহৃত হয় সেই সাথে তাদের অনেক প্রোটিন ভিত্তিক কার্যক্রমও নিয়ন্ত্রিত করে।”

তাই যখন একজন ব্যাক্তি মারা যান এবং তার দেহ আলাদা হতে শুরু করে তখন ফসফেট মৃতদেহের চারপাশের পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে। যদি এই পরিবেশ হোয়াইটের কফিনের মতো কিংবা Ötzi-র বরফাচ্ছাদিত সমাধির মতো ভেজা হয়ে থাকে এবং লৌহ দ্বারা পূর্ণ থাকে তবে ফসফেটের সাথে অন্যান্য অণুর সাথে মিথস্ক্রিয়া ঘটিয়ে খনিজ গঠন করে।

প্রথম দিকে স্ফটিকের রং বর্ণহীন হয়ে থাকে তবে যদি এরা বাতাসের অক্সিজেনের সংস্পর্শে আসে তাহলে দ্রুত নীল রংযের হয়ে যায়। পরে যখন কেউ মৃতদেহ খুঁজে পাবে তাদের সামনে এই আদ্ভুত দৃশ্য আবির্ভূত হবে।

ঐ লাশগুলোর জন্য ভিভিয়ানাইট-র গঠন ভালো কি খারাপ হবে তা খুঁজে বের করতে গবেষকদের প্রচেষ্টা চলছে। উদাহরণ হিসেবে, এর গঠন মৃতদেহগুলো কিভাবে সমাহিত করা হয়েছিলো কিংবা কবরের চারপাশের মাটি কেমন ছিলো সে সম্পর্কে আরো বিস্তর ধারণা পাওয়া যাবে। এছাড়াও এটা দেহাবশেষের অবশিষ্টাংশ ক্ষয় হওয়া থেকে রক্ষা করতে পারে। অন্যদিকে যদি দলটি মৃতদেহটির ডিএনএ বিশ্লেষণ করতে যায় তবে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে। কারণ পলিমারেজ চেইন রিএকশন (PCR) নামক একটি পরীক্ষার মাঝে এটি বাধা সৃষ্টি করার মতো ক্ষমতা রাখে। পিসিআর ডিএনএকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করার এবং অনুলিপি করার কাজে যুক্ত থাকে। যেহেতু ফসফেটের সাথে যুক্ত, তাই এটি উক্ত প্রতিক্রিয়া ঘটানোতে বাধার সৃষ্টি করবে।

তাই পরবর্তীতে আপনি যদি কোন প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার সম্পর্কে পড়েন এবং সেখানে অবশিষ্ট দেহাবশেষে নীল কিছু দেখা যায় তবে এটি ভিভিয়ানাইট। আর আপনি যদি আপনার কবর পূর্বেই নির্বাচন করে রাখতে চান তবে অবশ্যই কোন ভিজে, লৌহ সমৃদ্ধ এলাকাই নির্বাচন করবেন।

-শফিকুল ইসলাম

মন্তব্য করুন