[সব পর্বের তালিকা ও লিংক পাবেন এখানে]
নবম অধ্যায়ঃ কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি
নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্বের মতো বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের সাফল্যে অভিভূত হয়ে ঊনবিংশ শতকের শুরুতে মারকুই দ্যা ল্যাপ্লাস বলেছিলেন মহাবিশ্বের সব কিছুই পূর্বনির্ধারিত (deterministic)। তাঁর বিশ্বাস ছিল, এমন কিছু বৈজ্ঞানিক সূত্র থাকবে, যার মাধ্যমে আমরা মহাবিশ্বে যা কিছু ঘটবে তার সবকিছু অনুমান করতে পারব, অন্তত মূলনীতিগুলতো জানবই। কোনো এক সময় মহাবিশ্ব কী অবস্থায় আছে তা জানাই এর জন্যে যথেষ্ট হবে। একে বলা হয় প্রারম্ভিক (initial) বা প্রান্তীয় (boundary) শর্ত। (এই সীমানা স্থানেরও হতে পারে, আবার সময়েরও হতে পারে। স্থানের ক্ষেত্রে প্রান্তীয় শর্তের অর্থ হচ্ছে মহাবিশ্বের যদি কোনো বহিস্থ সীমান্ত বা প্রান্ত থেকে থাকে তবে সেই প্রান্তে এর অবস্থা।) ল্যাপ্লাসের বিশ্বাস ছিল, এক গুচ্ছ পূর্ণাঙ্গ সূত্র এবং উপযুক্ত প্রারম্ভিক ও প্রান্তীয় শর্তের মাধ্যমে আমরা মহাবিশ্বের অন্য যে কোনো সময়ের পূর্ণাঙ্গ চিত্র হাতে পাব।
প্রারম্ভিক শর্ত কেন প্রয়োজন তা খুব সহজেই বোঝা যাচ্ছে: বর্তমানের আলাদা আলাদা চিত্র ভবিষ্যতকেও আলাদা আলাদা রূপ দেবে। তবে স্থানের ক্ষেত্রে প্রান্তীয় শর্তের গুরুত্ব বুঝতে পারা একটু কঠিন। মূলনীতি অবশ্য একই। যে সমীকরণের উপর ভিত্তি করে তত্ত্ব তৈরি হবে, তার সমাধান অনেক রকম হতে পারে। অতএব আপনাকে প্রারম্ভিক বা প্রান্তীয় শর্তের সাহায্য নিয়ে ঠিক করতে হবে কোন সমাধানটি সঠিক হবে। এটা অনেকটা এ রকম যে আপনি বললেন, আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অনেক টাকা আসছে-যাচ্ছে। কিন্তু আপনি শেষ পর্যন্ত দেউলিয়া হয়ে যাবেন নাকি স্বচ্ছল থাকবেন তা শুধু কত টাকা আসছে- যাচ্ছে তার উপর নির্ভর করে না। আপনি কত টাকা নিয়ে অ্যাকাউন্ট শুরু করেছেন তার প্রারম্ভিক ও প্রান্তীয় শর্তের উপরও এটি নির্ভর করে। ল্যাপ্লাসের কথা যদি সঠিক হয় তাহলে মহাবিশ্বের বর্তমান অবস্থা জানার পর এই সূত্রগুলোর সাহায্যে এর অতীত ও ভবিষ্যৎ দুটো সম্পর্কেই অনুমান করা যেত। যেমন, সূর্য এবং গ্রহদের অবস্থান জানার মাধ্যমে আমরা নিউটনের সূত্র দিয়েই আগের বা পরের কোনো সময়ে সৌরজগতের অবস্থা বলতে পারি। গ্রহদের ক্ষেত্রে মনে হচ্ছে নিশ্চয়তাবাদ (Determinism) আসলেই সঠিক। জ্যোতির্বিদরা সূর্য বা চন্দ্রগ্রহণের মতো ঘটনার অনুমান করতে বেশ সিদ্ধহস্ত। কিন্তু ল্যাপ্লাস আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে অনুমান করলেন যে, অন্য সব কিছু, এমনকি মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রণের জন্যেও একই রকম সূত্র আছে।
আমরা ভবিষ্যতে কী করব তা কি বিজ্ঞানীরা সত্যিই বলতে পারবেন? এক গ্লাস পানিতে ১০২৪ (১ এর পরে ২৪টি শূন্য, বা এক হাজার কোটি কোটি কোটি) টির বেশি অণু থাকে। বাস্তবে আমরা কোনো দিনই এই প্রত্যেকটি অণুর অবস্থা জানার আশাই করতে পারি না, মহাবিশ্ব বা এমনকি আমাদের দেহের পূর্ণাঙ্গ অবস্থার কথা না হয় বাদই দিলাম। এর পরেও মহাবিশ্বকে পূর্বনির্ধারিত বলার অর্থ হচ্ছে আমাদের মস্তিষ্কের হিসাব করার ক্ষমতা থাক বা না থাক, ভবিষ্যৎ পূর্বনির্ধারিতই বটে।
বৈজ্ঞানিক নিশ্চয়তাবাদের এই ধারণা বহু মানুষের তীব্র বিরোধিতার মুখে পড়েছিল। বিরোধীরা ভেবেছিল, মহাবিশ্বকে ঈশ্বরের নিজের ইচ্ছা মতো নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে এটি বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তবু এই মতবাদ বিংশ শতকের গোড়ার দিক পর্যন্ত বিজ্ঞানের মৌলিক নীতি ছিল। আস্তে আস্তে এই বিশ্বাসের বিপরীত লক্ষণ দেখা দিতে শুরু করে। এর প্রথম দিককার কিছু প্রমাণ আসে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী লর্ড র্যালে ও স্যার জেমস জিন্স এর হিসাব থেকে। তাঁরা নক্ষত্রের মতো উত্তপ্ত বস্তুরা যে পরিমাণ কৃষ্ণবস্তু বিকিরণ অবশ্যই নির্গত করবে তার হিসাব বের করেন। (সপ্তম অধ্যায়ে আমরা দেখেছি, যে কোনো বস্তু উত্তপ্ত হলে তা থেকে কৃষ্ণবস্তু বিকিরণ নির্গত হবে)
সেই সময়ে আমরা যে সূত্র জানতাম তা অনুসারে, একটি উত্তপ্ত বস্তু যে-কোনো কম্পাঙ্কে [১] সমান হারে তড়িচ্চুম্বকীয় বিকিরণ নির্গত করবে। সেক্ষেত্রে দৃশ্যমান আলোর বর্ণালীর প্রত্যেক রং এর জন্যে সমান পরিমাণ শক্তি নির্গত হবে। শুধু তাই নয়, মাইক্রোওয়েভ, বেতার, এক্স-রে ইত্যাদি সব কম্পাঙ্কের জন্যেই সমান শক্তি নির্গত হবে। নিশ্চয়ই মনে আছে, প্রতি সেকেন্ডে একটি তরঙ্গ কতবার উপরে- নিচে উঠানামা করে তাই হচ্ছে তরঙ্গের কম্পাঙ্ক। গণিতের ভাষায় বললে, একটি উত্তপ্ত বস্তুর সব কম্পাঙ্কের তরঙ্গ সমান হারে নির্গত করার অর্থ হচ্ছে, বস্তুটি প্রতি সেকেন্ডে শূন্য এবং দশ লাখের মধ্যবর্তী কম্পাঙ্কের তরঙ্গ তৈরি করতে যে পরিমাণ শক্তি নির্গত করবে, এটি প্রতি সেকেন্ডে দশ থেকে বিশ লাখের মধ্যবর্তী কম্পাঙ্কের তরঙ্গ তৈরি করতেও সেই একই পরিমাণ শক্তি নির্গত করবে। একইভাবে প্রতি সেকেন্ডে আরও বেশি তরঙ্গ তৈরির ক্ষেত্রেও সমান শক্তি নির্গত হবে। মনে করুন যে প্রতি সেকেন্ডে শূন্য থেকে দশ লাখ বা দশ থেকে বিশ লাখ ইত্যাদি পরিমাণ তরঙ্গ সৃষ্টি হতে এক একক পরিমাণ শক্তি নির্গত হয়। তাহলে সব কম্পাঙ্কের মোট নির্গত শক্তির পরিমাণ হবে ১+ ১+ ১+ … অসীম পর্যন্ত। যেহেতু কোনো তরঙ্গে প্রতি সেকেন্ডে সৃষ্ট তরঙ্গের সংখ্যা অসীম, তাই শক্তির পরিমাণ যোগ করে কখনো শেষ করা যাবে না। অতএব, মোট নির্গত শক্তির পরিমাণও হবে অসীম।
১৯০০ সালে জার্মান বিজ্ঞানী ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক এই হাস্যকর ফলাফল এড়ানোর একটি উপায় বের করেন। তিনি বললেন যে এক্স-রেসহ অন্যান্য তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ শুধু নির্দিষ্ট বিচ্ছিন্ন গুচ্ছ আকারেই নির্গত হয় [২]। তিনি একে নাম দিলেন কোয়ান্টা (কোয়ান্টা হল কোয়ান্টাম শব্দটির বহুবচন)। অষ্টম অধ্যায়ে আমরা বলেছি, আজকে আমরা আলোর কোয়ান্টামইকে বলি ফোটন। আলোর কম্পাঙ্ক যত বেশি হবে এর শক্তির পরিমাণও হবে তত বেশি। অতএব, যে কোনো নির্দিষ্ট রং বা কম্পাঙ্কের সব ফোটন অবিকল একই রকম হলেও প্ল্যাঙ্কের তত্ত্ব অনুসারে ভিন্ন কম্পাঙ্কের ফোটনরা এই অর্থে আলাদা যে তাদের বহন করা শক্তির পরিমাণ ভিন্ন ভিন্ন। এর অর্থ হল কোয়ান্টাম তত্ত্ব অনুসারে, কোনো নির্দিষ্ট রং এর সবচেয়ে দুর্বল আলোর (একটিমাত্র ফোটন যে আলো বহন করে) শক্তির পরিমাণ তার রং এর উপর নির্ভর করে। যেমন, বেগুনি আলোর কম্পাঙ্ক লাল আলোর দ্বিগুণ হওয়ার কারণে এক কোয়ান্টাম বেগুনি আলোর শক্তি এক কোয়ান্টাম লাল আলোর শক্তির দ্বিগুণ। তাই, বেগুনি আলোর ক্ষুদ্রতম যে শক্তি থাকা সম্ভব তা লাল আলোর ক্ষুদ্রতম সম্ভাব্য শক্তির দ্বিগুণ।
এতে করে কৃষ্ণবস্তু সমস্যার সমাধান হয় কিভাবে? কোনো নির্দিষ্ট কম্পাঙ্কে একটি কৃষ্ণবস্তু যে ক্ষুদ্রতম পরিমাণ তড়িচ্চুম্বকীয় শক্তি নির্গত করতে পারে তা হল সেই কম্পাঙ্কের একটি ফোটনের বহন করা শক্তির সমান। বেশি কম্পাঙ্কের ফোটনের শক্তি বেশি। তাই বেশি কম্পাঙ্কের ক্ষেত্রে কৃষ্ণবস্তু কর্তৃক নির্গত ক্ষুদ্রতম শক্তির পরিমাণ বড় হয় (অর্থ্যাৎ, যার কম্পাঙ্ক যত কম তার ক্ষুদ্রতম শক্তি তত কমে যায়)। যথেষ্ট বড় কম্পাঙ্কের ক্ষেত্রে একটিমাত্র কোয়ান্টামের শক্তিই একটি বস্তুতে মোট যে শক্তি আছে তার চেয়েও বেশি হয়। অতএব এই ক্ষেত্রে কোনো আলোই নির্গত হবে না। এর ফলে উপর্যুক্ত যোগের সেই অসীম ধারার অবসান ঘটে। প্ল্যাঙ্কের তত্ত্ব অনুসারে তাই উচ্চ কম্পাঙ্কের ক্ষেত্রে বিকিরণের পরিমাণ কমে যাবে। ফলে, বস্তুটি সসীম হারে শক্তি হারাবে। এভাবেই কৃষ্ণবস্তু সমস্যার সমাধান হয়।

চিত্রঃ সম্ভাব্য সবচেয়ে দুর্বল আলো। [আলো দুর্বল হবার অর্থ হল ফোটনের সংখ্যা কম। যে কোনো রং এর সবচেয়ে দুর্বল আলো হচ্ছে একটিমাত্র ফোটন কর্তৃক বহন করা আলো।]
অনিশ্চয়তা নীতি বলছে, ল্যাপ্লাসের বিশ্বাস সঠিক নয়। বৈজ্ঞানিক সূত্র ব্যবহার করে ভবিষ্যৎ অনুমান করার পুরো স্বাধীনতা প্রকৃতি আমাদেরকে দেয় না। এর কারণ হল, ভবিষ্যতে কোনো কণার অবস্থান ও গতিবেগ কী হবে তা জানতে হলে এর প্রাথমিক অবস্থা জানতে হবে। অর্থ্যাৎ, এর বর্তমান অবস্থান ও বেগ সঠিকভাবে জানতে হবে। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে এটা করতে হলে কণার উপর আলো ফেলতে হবে। এখন, কণাটিতে ধাক্কা লেগে কিছু আলো এদিক- সেদিক সরে যাবে [৩]। আলোর এই ছড়িয়ে পড়া দেখে দর্শক কণার অবস্থান বের করতে পারবেন। কিন্তু, একটি নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোর সংবেদনশীলতা সীমিত। অন্য দিকে ঐ কণার অবস্থান নিক্ষিপ্ত আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের (তরঙ্গের পরপর দুটি চুড়ার মধ্যবর্তী দূরত্ব) চেয়ে বেশি সূক্ষ্ম করে বের করা যাবে না। অতএব, ঐ কণার অবস্থান সঠিকভাবে বের করতে হলে ছোট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো ব্যবহার করতে হবে (যাতে বেশি সূক্ষ্ম হিসাব পাওয়া যায়)। তরঙ্গদৈর্ঘ্য ছোট হওয়ার অর্থ কম্পাঙ্ক বেশি। প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম তত্ত্ব অনুসারে, আপনি চাইলেই ইচ্ছে মতো অল্প পরিমাণ আলো ব্যবহার করতে পারেন না। আপনাকে অন্তত এক কোয়ান্টা ব্যবহার করতেই হবে। এর শক্তি আবার কম্পাঙ্ক বাড়ার সাথে সাথে বাড়তে থাকবে। অতএব আপনি যত বেশি নির্ভুলভাবে একটি কণার অবস্থান বের করতে চাইবেন তত বেশি শক্তির আলোর কোয়ান্টা নিক্ষেপ করতে হবে।
কোয়ান্টাম তত্ত্ব অনুসারে, আলোর মাত্র একটি কোয়ান্টামও কণাটিকে উত্তেজিত করবে। এর ফলে এর বেগ এমনভাবে বদলে যাবে, যা পরিমাপ করা সম্ভব নয়। আর আপনি যত বেশি শক্তিশালী আলো ব্যবহার করবেন, এই উত্তেজনা তত বেড়ে যাবে। এর অর্থ হচ্ছে, অবস্থান ভালোভাবে বের করতে গিয়ে আপনি যখন বেশি শক্তির কোয়ান্টাম ব্যবহার করছেন, আপনি তখনি কণাটিকে খুব বেশি উত্তেজিত করছেন। ফলে, আপনি যত বেশি নির্ভুলভাবে কণাটির অবস্থান বের করবেন, এর বেগ সম্পর্কে ততই অনিশ্চিত তথ্য হাতে পাবেন। একইভাবে সত্য উল্টো প্রক্রিয়াও। হাইজেনবার্গ দেখান, অবস্থান ও বেগের অনিশ্চয়তার গুণফল কখনো একটি নির্দিষ্ট ধ্রুব সংখ্যার চেয়ে ছোট হয় না। এর অর্থ হল, আপনি যদি অবস্থানের অনিশ্চয়তা কমিয়ে অর্ধেক করেন, আপনাকে বেগের অনিশ্চয়তা বাড়িয়ে দ্বিগুণ করতে হবে। একইভাবে বেগের অনিশ্চয়তা কমাতে গেলেও বেড়ে যাবে অবস্থানের অনিশ্চয়তা। এই দেওয়া- নেওয়ার ঘটনায় প্রকৃতি কাজ করে আমাদের বিপক্ষে।
এখন প্রশ্ন হল, আমাদেরকে কতটুকু অনিশ্চয়তা মেনে নিতেই হবে? এটা নির্ভর করে আগে উল্লেখিত সেই নির্দিষ্ট ধ্রুব সংখ্যাটির মানের উপর। এই সংখ্যাটিকে বলা হয় প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবক। সংখ্যাটি খুবই ক্ষুদ্র। এই সংখ্যাটি ক্ষুদ্র হওয়ার কারণেই কোয়ান্টাম তত্ত্বের এই অনিশ্চয়তা আপেক্ষিক তত্ত্বের মতোই খুব সহজে আমাদের চোখে পড়ে না। (অবশ্য আমাদের জীবনযাত্রার উপর কোয়ান্টাম তত্ত্বের প্রভাব আছে। যেমন আধুনিক ইলেকট্রনিক্সের কথাই চিন্তা করুন।) যেমন ধরুন, আমরা যদি এক গ্রাম ভরের একটি পিং- পং বলের অবস্থান কোনো এক দিকে এক সেন্টিমিটারের মধ্যে নির্ণয় করি, তাহলে আমরা এর বেগও অনেক বেশি নির্ভুলভাবে (কোয়ান্টাম কণিকার তুলনায়) মাপতে পারব। কিন্তু আমরা যদি একটি ইলেকট্রনের অবস্থান একটি পরমাণুর ব্যাসের সমান সূক্ষ্ম করেও মাপতে চাই, তাহলে আমরা এর বেগ মাপতে গেলে তা প্রতি সেকেন্ডে প্রায় এক হাজার কিলোমিটার কম- বেশি হয়ে যাবে। একে কোনোভাবেই নিখুঁত মান বলা যায় না।
আপনি কী প্রক্রিয়ায় বা কোন ধরনের কণার বেগ বা অবস্থান বের করতে যাচ্ছেন তা নিয়ে অনিশ্চয়তা নীতি নাক গলায় না। হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতি প্রকৃতির একটি মৌলিক ও অনিবার্য বৈশিষ্ট্য। আমরা বিশ্বকে যেভাবে দেখি তার উপর এর বিশাল প্রভাব আছে। সত্তর বছরের বেশি সময় পার হলেও এই প্রভাবগুলো এখনও এখনো বহু দার্শনিকের মাথায় ঢোকেনি, যার ফলে এটা এখনো বিতর্কের ভালো একটি বিষয়। অনিশ্চয়তা নীতির মাধ্যমে ল্যাপ্লাসের স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যায়। শেষ হয়ে যায় বিজ্ঞানের সেই সূত্রের স্বপ্ন, যা মহাবিশ্বের সবকিছুই আগে থেকে বলে দিতে পারবে। আমরা যদি বর্তমানকেই ঠিক মতো পরিমাপ করতে না পারি, তবে ভবিষ্যতের ঘটনা অনুমান করারতো প্রশ্নই আসে না!
এর পরেও আমরা এমন কোনো অতিপ্রাকৃত সত্তার কথা কল্পনা করতে পারি যার হাত- পা আমাদের মতো বাঁধা নয়, যিনি মহাবিশ্বকে উত্তেজিত না করেই এর বর্তমান অবস্থা জেনে নিতে পারেন। তার জন্যে এমন এক গুচ্ছ সূত্র থাকবে, যা ভবিষ্যতে কী ঘটবে তা সঠিকভাবে বলে দিতে পারে। কিন্তু আমাদের মতো মরণশীল প্রাণীর কাছে মহাবিশ্বের সেই মডেলের তেমন কোনো গুরুত্ব নেই। এক্ষেত্রে আমাদের জন্যে মিতব্যয়ীতার নীতি অবলম্বন করাই সুবিধাজনক। অর্থ্যাৎ, তত্ত্বের যে অংশটুকু পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব নয়, তা বাদ দিতে হবে। দর্শনের জগতে এই নীতির নাম অকাম’স রেজর (Occam’s Razor)। এর উপর ভিত্তি করে ১৯২০ এর দশকে হাইজেনবার্গ, এরভিন স্রডিঞ্জার ও পল ডিরাক মিলে নিউটনীয় বলবিদ্যাকে নতুন করে ঢেলে সাজিয়ে নতুন তত্ত্ব কোয়ান্টাম মেকানিক্স [৪] প্রস্তুত করেন। এর অন্যতম প্রধান ভিত্তিই হল অনিশ্চয়তা নীতি। এই তত্ত্ব অনুসারে, পারমাণবিক কণিকাদের কোনো বিশেষ ও সুনির্দিষ্ট অবস্থান ও বেগ নেই। এরা বরং অনিশ্চয়তা নীতি দ্বারা বেঁধে দেওয়া বেগ ও অবস্থানের সমন্বয়ে একটি কোয়ান্টাম অবস্থার অধিকারী হয়।
কোয়ান্টাম মেকানিক্সের একটি বৈপ্লবিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এটি কোনো পর্যবেক্ষণের জন্যে একটিমাত্র ফলাফল অনুমান করে না, বরং অনেকগুলো আলাদা আলাদা সম্ভাব্য ফলাফল ঘোষণা করে। এর সাথে বলে দেয় প্রত্যেকটির সম্ভাবনা। অর্থ্যাৎ, আপনি যদি একই ধরনের এবং একই প্রক্রিয়ায় শুরু হওয়া অনেকগুলো সিস্টেম [৫] থেকে অনেক বেশি বার পরিমাপ নেন তাহলে দেখা যাবে কিছু ক্ষেত্রে পরিমাপের ফলাফল পাওয়া যাবে ‘ক’, অন্য কিছু ক্ষেত্রে পাওয়া যাবে ‘খ’ এবং এভাবেই চলতে থাকবে। ‘ক’ অথবা ‘খ’ কতবার ঘটবে আপনি তার একটি অনুমান তৈরি করতে পারবেন, কিন্তু কোনো পরিমাপেরই নির্দিষ্ট ফলাফল বলতে পারবেন না।
![চিত্রঃ অনিশ্চিত কোয়ান্টাম অবস্থান। [কোয়ান্টাম থিওরি অনুসারে, একটি বস্তুর অবস্থান ও বেগের পরিমাপের নির্ভুলতা অসীম হওয়া সম্ভব নয়। ভবিষ্যতে বস্তুটির কী ঘটবে তাও নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়।]](https://i1.wp.com/bigganpotrika.com/wp-content/uploads/2016/12/Picture10-2.jpg?resize=597%2C452)
চিত্রঃ অনিশ্চিত কোয়ান্টাম অবস্থান। [কোয়ান্টাম থিওরি অনুসারে, একটি বস্তুর অবস্থান ও বেগের পরিমাপের নির্ভুলতা অসীম হওয়া সম্ভব নয়। ভবিষ্যতে বস্তুটির কী ঘটবে তাও নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়।]
কোয়ান্টাম মেকানিক্স বিজ্ঞানের জগতে অনুমান করার অক্ষমতার বিষয়টিকে (unpredictability) প্রবেশ করিয়েছে, যাকে এড়াবার কোনো উপায় নেই । আইনস্টাইন এর বিরুদ্ধে তীব্র আপত্তি তোলেন, যদিও তিনি নিজেও এসব ধারণার ভিত্তি তৈরিতে অবদান রাখেন। সত্যি কথা হল, তাঁর নোবেলও পাওয়া হয়েছে সেই কোয়ান্টাম থিওরির কল্যাণেই। কিন্তু তবু তিনি কখনো মেনে নেননি যে মহাবিশ্ব সম্ভাবনা দিয়ে (অর্থ্যাৎ অনির্ধারিত উপায়ে) চলতে পারে। তাঁর বিখ্যাত বক্তব্য, ‘ঈশ্বর পাশা খেলেন না’ তাঁর এই মতেরই প্রতিফলন।
কোয়ান্টাম থিওরি আমাদের সামর্থ্যের লাগাম টেনে ধরে। এর অর্থ কি এই যে কোয়ান্টাম থিওরি বিজ্ঞানেরও লাগাম টেনে ধরে? বিজ্ঞানের অর্থ যদি হয় উন্নতি, তাহলে এই উন্নতি কীভাবে হবে তা ঠিক করবে প্রকৃতি। এক্ষেত্রে আমরা অনুমান বলতে কী বুঝব তার সংজ্ঞা নতুন করে ঠিক করতে হবে। আমরা হয়ত কোনো পরীক্ষার ফলাফল সঠিকভাবে অনুমান করতে পারব না, কিন্তু পরীক্ষাটি বারবার করে আমরা বলতে পারব যে কোয়ান্টাম তত্ত্ব অনুসারে এই এই ঘটনার সম্ভাবনা এই এই। তাই অনিশ্চয়তা নীতি থাকলেও প্রকৃতির পরিচালনায় কাজ করা সূত্রগুলোর উপর আস্থা হারানোর প্রয়োজন নেই। সত্যি বলতে শেষ পর্যন্ত অধিকাংশ বিজ্ঞানী কোয়ান্টাম মেকানিক্সকে মেনে নিয়েছেন এ জন্যেই যে পরীক্ষায় পাওয়া ফলাফল এর অনুমানের সাথে দারুণভাবে মিলে গেছে।
হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য হচ্ছে কণারা কিছু ক্ষেত্রে তরঙ্গের মতো আচরণ করে। আমরা আগেও দেখেছি, এদের নির্দিষ্ট কোনো অবস্থানে থাকে না, এরা বরং কিছু সম্ভাব্য অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। ওদিকে আলো কিন্তু তরঙ্গ দিয়ে তৈরি। কিন্তু প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম তত্ত্ব বলছে, কিছু ক্ষেত্রে আলোও কণার মতো আচরণ করবে। এটি শুধু গুচ্ছ বা কোয়ান্টা আকারে নির্গত বা শোষিত হতে পারে। সত্যি কথা হল, কোয়ান্টাম মেকানিক্সের পুরোটাই নতুন ধরনের গণিতের উপর নির্ভরশীল। এটি বাস্তব জগতকে কণা বা তরঙ্গ হিসেবে দেখে না। কিছু সময় কণাদেরকে তরঙ্গ হিসেবে মনে করতে হয়, আবার অন্য কাজের জন্যে তরঙ্গকে কণা ধরে নিলে সুবিধা হয়। কিন্তু এভাবে চিন্তা করা হয় শুধু কাজের সুবিধার জন্যেই। পদার্থবিদরা কোয়ান্টাম মেকানিক্সের কণা ও তরঙ্গের দ্বৈততা (wave- particle duality) বলতেই একেই বোঝেন।
কোয়ান্টাম মেকানিক্সে তরঙ্গের মতো আচরণের ফলে আমরা দুই ধারার কণার মধ্যে ব্যতিচার [৬] দেখতে পাই। সাধারণত ব্যতিচার হল তরঙ্গের একটি বৈশিষ্ট্য। তরঙ্গরা একে অপরের সাথে মিলিত হলে এক ধারার চূড়ার সাথে আরেক ধারার খাঁজের দেখা হতে পারে। এক্ষেত্রে এরা থাকে বিপরীত দশায় এবং একে অপরকে বাতিল করে দেয়। কেউ কেউ ভাবতে পারেন দুটো তরঙ্গ মিলিত হলেই এদের শক্তি বেড়ে যাবে। বাস্তবে কিন্তু সব সময় তা হয় না, যেমন এই ক্ষেত্রে হয়নি। আলোর ক্ষেত্রে ব্যতিচারের একটি পরিচিত উদাহরণ হল সাবানের বুদবুদে দেখা রং। পানির যে হালকা আবরণ দিয়ে বুদবুদ তৈরি হয়, তার দুই পাশের আলোর প্রতিফলনের ফলে এর সৃষ্টি। সাদা আলোতে প্রতিটি আলাদা তরঙ্গদৈর্ঘ্য বা রঙের আলোক তরঙ্গ থাকে। কিছু তরঙ্গদৈর্ঘ্যের ক্ষেত্রে সাবানের এক পাশের আবরণ থেকে প্রতিফলিত তরঙ্গ চূড়া আরেক পাশ থেকে প্রতিফলিত তরঙ্গের খাঁজের সাথে মিলিত হয়। এই তরঙ্গদৈর্ঘ্যের রংগুলো প্রতিফলিত আলোতে থাকে না, যার কারণে একে দেখতে রঙিন লাগে [৭]।
![চিত্রঃ সম ও বিপরীত দশা।[দুটো তরঙ্গের খাঁজ ও চূড়াগুলো যদি একই সাথে চলে তাহলে দুটোর মিলনে আরও শক্তিশালী তরঙ্গ উৎপন্ন হয় (চিত্রের ২য় অংশ)। কিন্তু যদি একটার খাঁজ মিশ্রিত হয় আরেকটার চূড়ার সাথে, তাহলে তরঙ্গদুটো একে অপরকে নাকচ করে দেয়৮।]](https://i2.wp.com/bigganpotrika.com/wp-content/uploads/2016/12/Picture9-1.jpg?resize=702%2C276)
চিত্রঃ সম ও বিপরীত দশা।[দুটো তরঙ্গের খাঁজ ও চূড়াগুলো যদি একই সাথে চলে তাহলে দুটোর মিলনে আরও শক্তিশালী তরঙ্গ উৎপন্ন হয় (চিত্রের ২য় অংশ)। কিন্তু যদি একটার খাঁজ মিশ্রিত হয় আরেকটার চূড়ার সাথে, তাহলে তরঙ্গদুটো একে অপরকে নাকচ করে দেয় [৮]।]
![চিত্রঃ পথের দূরত্ব ও ব্যতিচার। [দ্বি-চির পরীক্ষায় উপরের ও নিচের ছিদ্র দিয়ে পর্দার বিভিন্ন উচ্চতায় পৌঁছা তরঙ্গের দূরত্ব ভিন্ন হওয়ায় কোথাও তরঙ্গ একে অপরেকে শক্তিশালী করে, আবার কোথাও একে অপরকে নাকচ করে দেয়। এই ব্যতিচারের ফলে তৈরি হয় একটি নকশা।]](https://i0.wp.com/bigganpotrika.com/wp-content/uploads/2016/12/Picture8-2.jpg?resize=702%2C386)
চিত্রঃ পথের দূরত্ব ও ব্যতিচার। [দ্বি-চির পরীক্ষায় উপরের ও নিচের ছিদ্র দিয়ে পর্দার বিভিন্ন উচ্চতায় পৌঁছা তরঙ্গের দূরত্ব ভিন্ন হওয়ায় কোথাও তরঙ্গ একে অপরেকে শক্তিশালী করে, আবার কোথাও একে অপরকে নাকচ করে দেয়। এই ব্যতিচারের ফলে তৈরি হয় একটি নকশা।]
![চিত্রঃ ইলেকট্রনের ব্যতিচার। [দুটি চির দিয়ে ইলেকট্রনের ধারা নিক্ষেপ করা ও প্রত্যেকটি দিয়ে আলাদাভাবে ইলেকট্রন প্রবাহিত করার ফলাফল একই হয় না। এর কারণ এখানেও ব্যতিচার হচ্ছে।]](https://i0.wp.com/bigganpotrika.com/wp-content/uploads/2016/12/Picture7-2.jpg?resize=321%2C584)
চিত্রঃ ইলেকট্রনের ব্যতিচার।
[দুটি চির দিয়ে ইলেকট্রনের ধারা নিক্ষেপ করা ও প্রত্যেকটি দিয়ে আলাদাভাবে ইলেকট্রন প্রবাহিত করার ফলাফল একই হয় না। এর কারণ এখানেও ব্যতিচার হচ্ছে।]
এবার কল্পনা করুন, চির দুটি দিয়ে একটি করে ইলেকট্রন প্রবাহিত করা হল। এবারেও কি ব্যতিচার ঘটবে? মনে হতে পারে যে প্রতিটি ইলেকট্রন দুটি চিরের যে কোনো একটি দিয়ে পার হবে। ফলে ব্যতিচার ঘটার কথা নয়। কিন্তু বাস্তবে একটি করে ইলেকট্রন পাঠানো হলেও ব্যতিচারের নকশা দেখা যায়। তার মানে প্রতিটি ইলেকট্রন একই সাথে দুটো চির দিয়েই যাচ্ছে! ব্যতিচার ঘটাচ্ছে নিজের সাথেই!
কণার এই ব্যতিচার আমাদের পরমাণুর গঠন বুঝতে গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। এই পরমাণুই আমরাসহ আমাদের চারপাশের সবকিছুর মূল গাঠনিক উপাদান। বিংশ শতকের শুরুতে মনে করা হত, পরমাণুতে ঋণাত্মক চার্জধারী কণা ইলেকট্রন এর ধনাত্মক চার্জধারী নিউক্লিয়াসের চারপাশে ঘোরে, ঠিক যেমনিভাবে গ্রহরা সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘোরে। মনে করা হত, ধনাত্মক ও ঋণাত্মক চার্জের আকর্ষণ ইলেকট্রনকে কক্ষপথে ধরে রাখে, যেমন করে সূর্য ও গ্রহদের মধ্যে মহাকর্ষীয় টান গ্রহদের কক্ষপথে ধরে রাখে। কিন্তু এই ধারণায় কিছু সমস্যা ছিল। বলবিদ্যা ও তড়িৎ বিজ্ঞানের চিরায়ত সূত্র কোয়ান্টাম মেকানিক্স আসার আগেই বলে দিয়েছিল যে এই প্রক্রিয়ায় ঘুরতে থাকা ইলেকট্রন বিকিরণ নির্গত করবে। এর ফলে এরা শক্তি হারাতে থাকবে এবং এক সময় পেঁচিয়ে এসে নিউক্লিয়াসে ধাক্কা খাবে। এর ফল দাঁড়াবে, পরমাণু এবং আসলে সকল বস্তুই এক সময় গুটিয়ে গিয়ে খুব অল্প জায়গায় অবস্থান নিবে। বাস্তবে কিন্তু এটা ঘটে না।
ড্যানিশ বিজ্ঞানী নিলস বোর ১৯১৩ সালে এর এই সমস্যার কিছু অংশের সমাধান বের করেন। তিনি বললেন যে হতে পারে ইলেকট্রনরা নিউক্লিয়াস থেকে যে কোনো দূরত্বে ঘুরতে পারে না, ঘুরতে হয় নির্দিষ্ট কিছু বিশেষ দূরত্বে। যদি ধরে নেওয়া হয় যে এই নির্দিষ্ট দূরত্বে শুধু একটি বা দুটি ইলেকট্রনই থাকতে পারে, তাহলে গুটিয়ে যাওয়ার সমস্যার সমাধান হয়, কেননা ভেতরের দিকের সীমিত কিছু কক্ষপথ পূর্ণ হয়ে গেলে ইলেকট্রনরা আর পেঁচিয়ে ঘুরতে পারবে না। এই মডেলের সাহায্যে সবচেয়ে সরল পরমাণু হাইড্রোজেনের ব্যাখ্যা খুব দারুণভাবে পাওয়া গেল, কারণ এতে নিউক্লিয়াসের চারদিকে একটিমাত্র ইলেকট্রন ঘুরছে। কিন্তু এই মডেল দিয়ে কীভাবে আরও জটিল পরমাণুর ব্যাখ্যা দেওয়া যাবে তা বোঝা যাচ্ছিল না। এছাড়াও সীমিত কিছু অনুমোদিত কক্ষপথের ধারণাকেও যথেষ্ট মনে হচ্ছিল না। এই কৌশল গাণিতিক দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করলে বেশ মূল্যবান জিনিস, কিন্তু প্রকৃতি কেন এভাবে কাজ করবে তা কারো মাথায় ঢুকছিল না। এর গভীরে আর কী সূত্র থাকতে পারে তাও স্পষ্ট ছিল না।
নতুন কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সূত্রের মাধ্যমে সমাধান হাতে এল। বোঝা গেল, নিউক্লিয়াসের চারদিকে ঘুরতে থাকা ইলেকট্রনকে তরঙ্গ ভাবা যেতে পারে। এর তরঙ্গদৈর্ঘ্য নির্ভর করে বেগের উপর। এবার মনে করুন বোরের মত অনুসারে নিউক্লিয়াসের চারদিকে নির্দিষ্ট দূরত্বে তরঙ্গ ঘুরছে। কিছু কক্ষপথের পরিধির মান হবে ইলেকট্রনের তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের পূর্ণ সংখ্যার (ভগ্নাংশ নয়) মানের সমান। এই কক্ষপথগুলোর ক্ষেত্রে তরঙ্গের চূড়া প্রত্যেকবার পাক খেয়ে আগের অবস্থানে আসবে। এর ফলে এই তরঙ্গগুলো শক্তিশালী হবে। এই কক্ষপথগুলোই বোরের অনুমিত অনুমোদিত কক্ষপথ। কিন্তু যেসব কক্ষপথের পরিধি তরঙ্গদৈর্ঘ্যের পূর্ণ সংখ্যা হবে না, তাতে ইলেকট্রন একবার পাক খেয়ে এসে তরঙ্গের চূড়া ও খাঁজকে মিলিয়ে দিয়ে তরঙ্গকে নাকচ করে দেবে। এই কক্ষপথগুলো অনুমোদিত হবে না। বোরের সূত্রের অনুমোদিত ও নিষিদ্ধ কক্ষপথের ব্যাখ্যা এবার পাওয়া গেল।
![চিত্রঃ পরমাণুর কক্ষপথের তরঙ্গ। [নিলস বোর কল্পনা করেছিলেন, পরমাণুর নিউক্লিয়াসের চারপাশে ইলেকট্রনের তরঙ্গ অবিরত ঘুরছে। এই চিত্র অনুসারে, যেসব কক্ষপথের পরিধি ইলেকট্রনের তরঙ্গদৈর্ঘ্যের পূর্ণ সংখ্যার সমান হবে শুধু সেই সেই কক্ষপথগুলোই টিকে থাকবে।]](https://i1.wp.com/bigganpotrika.com/wp-content/uploads/2016/12/Picture6-2.jpg?resize=702%2C337)
চিত্রঃ পরমাণুর কক্ষপথের তরঙ্গ। [নিলস বোর কল্পনা করেছিলেন, পরমাণুর নিউক্লিয়াসের চারপাশে ইলেকট্রনের তরঙ্গ অবিরত ঘুরছে। এই চিত্র অনুসারে, যেসব কক্ষপথের পরিধি ইলেকট্রনের তরঙ্গদৈর্ঘ্যের পূর্ণ সংখ্যার সমান হবে শুধু সেই সেই কক্ষপথগুলোই টিকে থাকবে।]
![চিত্রঃ ইলেকট্রনের বহু পথ। [চিত্রে যেমন দেখানো হয়েছে, কোয়ান্টাম থিওরির ব্যাখ্যায় রিচার্ড ফাইনম্যানের মত হল, কোনো কণা উৎস থেকে পর্দায় যেতে সম্ভাব্য প্রতিটি পথ অতিক্রম করে।]](https://i2.wp.com/bigganpotrika.com/wp-content/uploads/2016/12/Picture5-2.jpg?resize=702%2C417)
চিত্রঃ ইলেকট্রনের বহু পথ। [চিত্রে যেমন দেখানো হয়েছে, কোয়ান্টাম থিওরির ব্যাখ্যায় রিচার্ড ফাইনম্যানের মত হল, কোনো কণা উৎস থেকে পর্দায় যেতে সম্ভাব্য প্রতিটি পথ অতিক্রম করে।]
কোয়ান্টাম মেকানিক্স দারুণ সফল এক তত্ত্ব। আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রায় সব আবিষ্কারের কৃতিত্ব এর। টেলিভিশন ও কম্পিউটারসহ সব ইলেকট্রনিক যন্ত্রের প্রয়োজনীয় উপাদান হল ট্রাঞ্জিস্টর ও আইসি বা সমন্বিত বর্তনী (integrated circuit)। এই দুটোই মেনে চলে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সূত্র। রসায়ন ও জীববিজ্ঞানেরও ভিত্তি এই কোয়ান্টাম মেকানিক্স। ভৌত বিজ্ঞানের (physical science) যে অংশে এখনো কোয়ান্টাম মেকানিক্সের হাত পড়েনি তা হল মহাকর্ষ এবং মহাবিশ্বের বড় মাপের (লার্জ স্কেল) কাঠামো। আগে উল্লিখিত আইনস্টাইনের সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অনিশ্চয়তা নীতি মেনে চলে না। কিন্তু এটিকে অন্যান্য তত্ত্বের সাথে সন্ধি করতে হলে সেটা হওয়া খুব দরকার।
আগের অধ্যায়ে আমরা দেখেছি, আমরা এখনই জানি যে সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্বকে সংশোধন করতে হবে। অসীম ঘনত্বের অনুমান করতে গিয়ে চিরায়ত (অর্থ্যাৎ নন-কোয়ান্টাম) সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব নিজেই নিজের দুর্বলতা স্বীকার করছে। ঠিক এভাবেই কৃষ্ণবস্তু অসীম পরিমাণ শক্তি বিকিরণ করবে বা পরমাণু গুটিয়ে অসীম ঘনত্ব লাভ করবে বলার মাধ্যমে চিরায়ত বলবিদ্যা নিজের দুর্বলতা স্বীকার করেছিল। এই অগ্রহণযোগ্য সিঙ্গুলারিটি (অসীম ঘনত্বের বিন্দু) এড়াতে চিরায়ত সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্বকে কোয়ান্টাম থিওরির রূপ দিতে হবে। নতুন থিওরির নাম হবে কোয়ান্টাম থিওরি অব গ্র্যাভিটি বা কোয়ান্টাম মহাকর্ষ তত্ত্ব [৯]।
কিন্তু সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব যদি ভুলই হয়, তবে বিভিন্ন পরীক্ষায় এর সত্যতা দেখা যাচ্ছে কেন? আমরা এখনো এই তত্ত্বে কোনো ত্রুটি খুঁজে না পাওয়ার কারণ হল, আমরা সাধারণত যেসব মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের দেখা পাই তারা খুব দুর্বল। কিন্তু আমরা আগেই দেখেছি, মহাবিশ্বের সকল পদার্থ ও শক্তি আদি অবস্থায় যখন ক্ষুদ্র একটি জায়গায় গুটিয়ে ছিল, তখন এতে মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রও ছিল অনেক বেশি শক্তিশালী। এই শক্তিশালী ক্ষেত্রে কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি থিওরির প্রভাব হবে খুব গুরুত্বপূর্ণ।
আমরা এখনো কোয়ান্টাম মহাকর্ষ তত্ত্ব হাতে পাইনি। কিন্তু আমাদের মতে এর যে যে বৈশিষ্ট্য থাকা উচিৎ তার অনেকগুলোই আমাদের জানা হয়ে গেছে। এর একটি হল, কোয়ান্টাম থিওরিকে সামষ্টিক ইতিহাসের মাধ্যমে প্রকাশ করতে হলে ফাইনম্যানের প্রস্তাবনা মেনে চলতে হবে। আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এমন, যা যে কোনো চূড়ান্ত তত্ত্বে থাকতে হবে বলে আমাদের বিশ্বাস। এটি হচ্ছে মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রকে বক্র স্থান- কালের মাধ্যমে প্রকাশ করা। বক্র স্থানের কোনো কণা নিকটস্থ বিন্দুতে যেতে চায় সরল পথে। কিন্তু মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের প্রভাবে স্থান- কাল সমতল না হবার কারণে এই পথকে বাঁকা মনে হয়। ফাইনম্যানের সামষ্টিক ইতিহাসকে আমরা আইনস্টাইনীয় মহাকর্ষের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করলে কণার ইতিহাসের উদাহরণ এখন পূর্ণাঙ্গ বক্র স্থান- কালের মতো হচ্ছে, যা বলছে পুরো মহাবিশ্বের ইতিহাস।
মহাকর্ষের পুরাতন তত্ত্ব অনুসারে মহাবিশ্বের আচরণ মাত্র দুরকম হতে পারে। এক, এটি অনাদি কাল ধরে উপস্থিত ছিল। দুই, একটি সিঙ্গুলারিটি থেকে অতীতের কোনো একটি নির্দিষ্ট সময়ে এর যাত্রা শুরু। আমরা আগেই আলোচনা করেছি যে মহাবিশ্ব সব সময় উপস্থিত ছিল বলে বিশ্বাস না করার মতো কারণ আমাদের হাতে আছে। কিন্তু তবু এর যদি শুরু থাকেও তবে প্রচলিত সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব দিয়ে যদি আমরা জানতে চাই যে সমীকরণের কোন সমাধান আমাদের মহাবিশ্বের ক্ষেত্রে খাটবে, তাহলে আমাদেরকে এর আদি অবস্থা জানতে হবে। অর্থ্যাৎ, মহাবিশ্বের শুরু ঠিক কীভাবে হয়েছিল তা জানা দরকার। ঈশ্বর হয়ত শুরুতে প্রকৃতির নিয়মগুলো জারি করেছেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে এরপর তিনি একে সেই নিয়মের মাধ্যমে বিবর্তিত হতে দিয়েছেন, পরে আর নাক গলাননি। মহাবিশ্বের আদি অবস্থাকে তিনি কোন প্রক্রিয়ায় বাছাই করেছিলেন? সময়ের শুরুতে প্রান্তীয় শর্তগুলো কেমন ছিল? প্রচলিত সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্বে এটা একটা সমস্যা, কারণ মহাবিশ্বের আদিতে গিয়ে সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব আত্মসমর্পণ করে।
কোয়ান্টাম মহাকর্ষ তত্ত্বে কিন্তু আরেকটি সম্ভাবনা আছে। এটা যদি সত্য হয়, তবে এই সমস্যার সমাধান হবে। কোয়ান্টাম থিওরিতে স্থান- কালের সীমানা বা প্রান্ত তৈরি করার মতো কোনো সিঙ্গুলারিটি না থাকলেও তা পরিমাণে নির্দিষ্ট বা সসীম হতে পারে। স্থান- কাল হবে পৃথিবীর পৃষ্ঠের মতো। তবে মাত্রা থাকবে দুটো বেশি। আগেই আমরা বলেছি, আপনি পৃথিবীর পৃষ্ঠ থেকে যে কোনো এক দিকে যেতে থাকলে সামনে অভেদ্য কোনো বাধা পাবেন না বা প্রান্তে [১০] গিয়ে পড়েও যাবেন না, শেষ পর্যন্ত যেখান থেকে যাত্রা শুরু করেছিলেন সেখানেই ফিরে আসবেন। কোনো সিঙ্গুলারিটিতে গিয়ে পড়তে হবে না। যদি বাস্তবে মহাবিশ্বের ক্ষেত্রেও এটাই হয়ে থাকে তবে কোয়ান্টাম মহাকর্ষ তত্ত্ব নতুন একটি সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে। এতে এমন কোনো সিঙ্গুলারিটি থাকবে না, যেখানে গিয়ে বিজ্ঞানের সূত্রগুলো আত্মসমর্পণ করবে।
যদি স্থান- কালের প্রান্ত বা সীমানাই না থাকে, তাহলে সেই সীমানায় কী হবে তা নিয়েও মাথা ঘামানোর দরকার নেই। মহাবিশ্বের আদি অবস্থা জানারও কোনো দরকার নেই। স্থান- কালের এমন কোনো প্রান্ত থাকবে না যেখানে ঈশ্বর বা নতুন কোনো সূত্রকে স্থান- কালের প্রান্তীয় শর্ত তৈরি করে দিতে হবে। আমরা বলতে পারি, মহাবিশ্বের প্রান্তীয় শর্ত হচ্ছে, ‘এর কোনো প্রান্তই নেই’। মহাবিশ্ব নিজেই নিজেকে ধারণ করবে। বাইরের কোনো কিছু একে প্রভাবিত করবে না। এর সৃষ্টি বা ধ্বংস বলতে কিছু থাকবে না। এর শুধু অস্তিত্বই থাকবে। মহাবিশ্বের শুরু আছে বিশ্বাস করলে স্রষ্টার ভূমিকা পরিষ্কার। কিন্তু মহাবিশ্বের যদি কোনো প্রান্ত বা সীমানা না থাকে, এটি নিজেই নিজেকে ধারণ করে, এর শুরু বা শেষ না থাকে তাহলে ঈশ্বরের ভূমিকা কী হবে তা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।
[অনুবাদকের নোটঃ
১। একটি তরঙ্গ প্রতি সেকেন্ডে যতগুলো কম্পন বা পূর্ণ তরঙ্গ উৎপন্ন করে তাকে কম্পাঙ্ক বলে।
২। অর্থ্যাৎ একের পর এক অবিচ্ছিন্নভাবে বা অবিরত সব কম্পাঙ্কের জন্যে নির্গত হয় না।
৩। আলোর এই ছড়িয়ে পড়াকে আলোর বিক্ষেপণ (scattering) বলে। সূর্যের আলো আমাদের বায়ুমণ্ডলের ধূলিকণায় ধাক্কা খেয়ে ছড়িয়ে পড়ে বলেই আমরা আকাশ নীল দেখি।
৪। তত্ত্বটি আরও নাম হল কোয়ান্টাম থিওরি বা কোয়ান্টাম ফিজিক্স। বাংলায় এক কোয়ান্টাম বলবিদ্যা, কোয়ান্টাম তত্ত্ব বা কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যা বা কণাবাদী বলবিদ্যা ইত্যাদি অনেক কিছু বলা হয়।
৫। যেখানে পরীক্ষা চালানো হয় তাকে সিস্টেম বলা হয়। একই ধরনের সিস্টেম বলতে বোঝায় সিস্টেমের সব শর্ত একই থাকবে।
৬। দুটি তরঙ্গ একটির উপর দিয়ে আরেকটি যেতে চেষ্টা করলে সেখানে তরঙ্গের উপরিপাতন হয়। ব্যতিচার হল উপরিপাতন সংক্রান্ত ঘটনা। দুটি তরঙ্গের মধ্যে উপরিপাতনের ফলে একটি বিন্দুতে যদি সমদশা উৎপন্ন হয় তখন সেখানে উজ্জ্বল বিন্দু এবং বিপরীত দশার উপরিপাতন হলে অন্ধকার বিন্দু দেখা যায়। এটিই হল ব্যতিচার।
৭। যেহেতু সাদা আলো হচ্ছে সব আলোর সমষ্টি, তাই এখান থেকে কয়েকটি রঙের আলো বাদ পড়লে তাকে রঙিন দেখাব।
৮। ফলে আর তরঙ্গের কোনো চিহ্নই থাকে না। যেমন চিত্রের প্রথম অংশের রেখা থেকে বোঝা যাচ্ছে, এখানে কোনো তরঙ্গ নেই।
৯। কারণ, সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্বের কাজ মহাকর্ষ নিয়ে।
১০। পৃথিবীতে এমন কিছু জায়গা আছে যেগুলোকে বলা হয় পৃথিবীর প্রান্ত। বাস্তবে এরা পৃথিবীর প্রান্ত নয়। প্রান্ত বলা যেত এমন কোনো বিন্দুকে যেখানে গেলে আমরা পৃথিবী থেকে নিচে পড়ে যেতাম, আর উঠে আসতে পারতাম না। কিন্তু পৃথিবী গোল হওয়ায় এমন কোন জায়গা বাস্তবে নেই। ঐ জায়গাগুলোর নাম তাই শুধুই প্রতীকী।]
[সব পর্বের তালিকা ও লিংক পাবেন এখানে]
মূলঃ Stephen Hawking এবং Leonard Mlodinow
অনুবাদঃ আব্দুল্যাহ আদিল মাহমুদ
শিক্ষার্থী, পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
[লেখকের ফেসবুক প্রোফাইল]